বাচাল ছেলে: ৭ম বা শেষ পর্ব
বেলা একটা বাজে। বাসায় নিজ রুমে শুয়ে আছি। এ সময় মা রুমে এলেন। এসে বিছানায় বসলেন। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
কিরে তোর কি শরীর খারাপ?
না মা।
তাহলে কী হয়েছে? গত দুই দিন বাসা থেকে বের হোসনি। যে তুই বকবক করে আমার কান ঝালাপালা করে দিস, সেই তুই চুপচাপ। ঘটনা কী?
মা আমি কথা বললেও দোষ না বললেও দোষ। তুমি কী চাও বলো তো?
মা–বাবা যে কী চায়, সেটা মা–বাবা না হলে বুঝবি না।
বাবা হওয়া তো পরের কথা। আমি ঠিক করেছি, আমি এই জীবনে বিয়েই করব না।
তোর কি আবার নোভার সঙ্গে ঝগড়া লাগছে?
মা আমি কি কখনো তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, বাবার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হইছে কি না?
না, করিস না।
তাহলে তুমি আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করতেছো?
হি হি হি.... বুঝতে পারছি, বড় ঝগড়া হইছে।
মা শোনো, এর আগেরবার মজা করে বললেও, এবার আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমি মহেশখালী চলে যাব। আমি তোমাদের এই শহরে আর থাকব না।
মা মুচকি হেসে বললেন,
গিয়ে কি পানের বরজেই চাকরি নিবি?
শোনো মা, এটাকে ফান ভেব না। এবার আমি সত্যি সত্যি যাব। তবে পানের বরজে চাকরি করব না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মৎস্য ধরব।
তুই তো সাঁতারই জানিস না। তুই সমুদ্রে যাবি মাছ ধরতে!
মা শোনো, সন্তানকে যদি কোনো কাজে উৎসাহ দিতে না পারো, তবে চুপ থাকবা। এভাবে নেগেটিভ কথা বলে সন্তানের মনোবল ভেঙে দিবা না, প্লিজ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি,আমি বিসিএস চাকরিতে যোগদান করছি না।
তুই কি সিরিয়াস?
এক শ ভাগ সিরিয়াস।
আচ্ছা যা, তোর চাকরি করার কোনো দরকার নাই। তুই মৎস্য ধর। কিন্তু নোভার সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা আমাকে খুলে বল।
আমি মাকে সব খুলে বললাম। উনি সব শুনে বললেন,
তোর কাছে কি নোভার মায়ের ফোন নম্বর আছে?
শত্রুর ফোন নম্বর থাকবে না, এটা কেমন কথা বললা?
শোন, মা বয়সী একজন মানুষ সম্পর্কে কথা বলতে ভেবে কথা বলবি। এখন ফোন নম্বর দে।
মা আমার কাছ থেকে নোভার মায়ের ফোন নম্বর নিয়ে চলে গেলেন।
বিকেলের দিকে স্নেহা ফোন করল।
স্যার কেমন আছেন?
জানি না।
মানে কী?
কেমন আছি জানতে হলে আমার নিজেকে নিজেই প্রশ্নটা করতে হবে। কিন্তু আজকে এখন পর্যন্ত নিজেকে কেমন আছি জিজ্ঞাসা করিনি।
সমস্যা নাই, এখন জিজ্ঞাসা করেন?
না, এখন করতে ইচ্ছা হচ্ছে না।
থাক, তাহলে জিজ্ঞাসা করার দরকার নাই। আচ্ছা, আপনি কি আজ আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবেন?
তুমি এখন আমার ছাত্রী নও। আমি কেন তোমার সঙ্গে দেখা করব? শোনো তোমারে পড়ানোর সময় তুমি আমারে অনেক জ্বালাইছো। এখন আর এসব কইরো না।
নোভা আপার কাছে শুনলাম, আপনাদের নাকি বিয়ে ভেঙে গেছে?
হুঁ। এখন বুঝতে পারলাম, তুমি কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছো। আচ্ছা তুমি কি আমাকে এখন বিয়ে করার প্ল্যান করতেছো? ও রকম প্ল্যান থাকলে বলতে পারো। তবে একটা কথা মনে রাখবা, আমাকে বিয়ে করলে তোমার জীবন তেনা তেনা হয়ে যাবে। প্রথমত, আমাকে বিয়ে করলে তোমাকে ঢাকা ত্যাগ করে মহেশখালী যেতে হবে। কারণ, আমি মহেশখালী চলে যাচ্ছি।
ওখানে গিয়ে আপনি কী করবেন?
ওখানে ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মৎস্য ধরব। মৎস্য ধরে ট্রলারভর্তি করে নিয়ে আসব। তুমি যদি আমাকে বিয়ে করো, তখন তোমাকে সেই মৎস্য রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করতে হবে। আমার যতটুকু মনে পড়ে তুমি একদিন বলেছিলে, শুঁটকির গন্ধ তোমার সহ্য হয় না। এখন আমি জানি না, তুমি কীভাবে শুঁটকির গন্ধ সহ্য করে আমার সংসার করবে। আর একটা সমস্যা আছে। আমাকে বিয়ে করলে তুমি অল্পদিনেই বিধবা হবে বলে আমার ধারণা।
সেটা কেন?
কারণ, আমি সাঁতার জানি না। কোনো কারণে ট্রলার ডুবে গেলে, আমার ডুবে মরার সম্ভাবনা শতভাগ। তার মানে তুমি নিশ্চিত বিধবা।
সে ক্ষেত্রে আপনি আগে সাঁতার শিখবেন। পরে মাছ ধরতে যাবেন।
সাঁতার শিখলেও লাভ নাই। কারণ, আমি অলস টাইপের মানুষ, যার কারণে কষ্ট করে গভীর সমুদ্র থেকে সাঁতার কেটে আমি পাড়ে আসব না। এর চেয়ে চোখ বন্ধ করে আরামে টুপ করে ডুবে যাব। তারপর সমুদ্রের তলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। কারণ, ঘুম খুবই জরুরি জিনিস। আমি কি তোমাকে বোঝাতে পারলাম আমাকে বিয়ে করলে তোমার কী কী সমস্যা হবে? এত সুন্দর করে বোঝানোর পরেও যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, তাহলে আমার আর বলার কিছু নাই। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবা।
কিন্তু আপনি মহেশখালী যাবেনই–বা কেন? নোভা আপা বলল, আপনার নাকি বিসিএস হয়ে গেছে?
বিসিএস হয়েছে, কিন্তু আমি ওই চাকরিতে জয়েন্ট করছি না।
কেন!
কারণ, ওই চাকরি করলে আমাকে কোট, প্যান্ট, শার্ট, টাই পরতে হবে। অথচ এসব পরতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু আমি যদি মাছ ধরি, তাহলে আমি আমার প্রিয় পোশাক লুঙ্গি পরার সুযোগ পাব। আহ্, লুঙ্গিতে সেই শান্তি। তুমি না পরলে সেটা বুঝতে পারবা না। এক কাজ করো, তুমি এখন থেকে লুঙ্গি পরা শুরু করে দাও, শান্তি পাবা।
আমার কী মাথায় সমস্যা আছে যে আমি লুঙ্গি পরব? আপনি আর উল্টাপাল্টা কথা ছাড়তে পারলেন না, না?
না পরলে না পরবা, আমার কী? শান্তি হাতছাড়া করলা। আচ্ছা নোভা কি তোমাকে অনুরোধ করেছে, আমাকে বিয়ে করার জন্য? শোনো, তোমাকে আমি একটা গোপন কথা বলি, নোভার বুদ্ধি শুনবা না। আমার মাথায় একটু সমস্যা আছে, সেটাও জানে। যে কারণে নিজে আমাকে বিয়ে না করে তোমার গলায় ঝুলাতে চাচ্ছে। সে খুবই ডেঞ্জারাস মেয়ে। বি কেয়ারফুল।
পরের দিন দুপুরে স্নেহা আমাদের বাসায় এসে উপস্থিত হলো। আমাকে এক প্রকার জোর করে ও বাহিরে নিয়ে গেল। ও গাড়ি নিয়ে এসেছে। বাহিরে যাওয়ার পর স্নেহা আমাকে গাড়ির পেছনের আসনে বসতে বলে নিজে গিয়ে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল। আমি ভেতরে ঢুকেই দেখলাম নোভা বসে আছে। আমি বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। কী ঘটতে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি নোভাকে বললাম,
ঘটনা কী? আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
আমি জানি না। স্নেহা আমাকেও কিছু না বলে বাসা থেকে উঠিয়ে এনেছে।
আমি স্নেহার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললাম,
কী ব্যাপার স্নেহা, তুমি আমাদের দুজনকে এভাবে তুলে আনলা কেন? বিষয়টি তো খুবই সন্দেহজনক। আচ্ছা তুমি কি নোভার গলায় ছুরি ধরে আমাকে জোর করে বিয়ে করতে চাচ্ছো? শোনো, এসব করে লাভ হবে না।
স্যার আপনি কি সহজ স্বাভাবিক কোনো চিন্তা করতে পারেন না? আপনি সারাক্ষণ শুধু উল্টাপাল্টা ভাবেন আর উল্টাপাল্টা বলেন কেন? শুনেন আমার মনে হয়েছে আপনাদের দুজনের মধ্যে একান্তে আলাপ–আলোচনা হওয়া দরকার। যাতে আপনাদের বর্তমান সমস্যার একটা সুন্দর সমাধান হয়। তাই আপনাদের দুজনকে নিয়ে বের হয়েছি।
বাহ্ তোমার তো দেখি অনেক বুদ্ধি। ইস্, এই বুদ্ধি যদি একটু লেখাপড়ায় ব্যবহার করতে পারতা, তাহলে দেশ ও জাতির অনেক উপকার হতো।
স্নেহা মুচকি হাসি দিয়ে সামনের দিকে ঘুরে তাকাল। আমি নোভার দিকে তাকালাম। দেখলাম, দুই দিনেই ওর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আমি আদুরে গলায় বললাম,
কিরে তুই মনে হচ্ছে রাতে ঘুমাসনি। চোখ তো বসে গেছে।
আর তোর চোখ মুখ ফুলে যেভাবে টসটস করছে, মনে হচ্ছে এই কয়দিন সারা দিনরাত নিশ্চিন্তে ঘুমাইছিস।
হরে। সেই ঘুম দিছি। তবে শুধু ঘুমাইছি, সেটাও বলা ঠিক হবে না। মাঝেমধ্যে কিছু সময়ের জন্য জেগেও ছিলাম। কারণ, ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করতে হয়েছে।
কী পরিকল্পনা? লুঙ্গি পরে সমুদ্রে মাছ ধরার পরিকল্পনা?
হুঁ, কিন্তু তুই জানলি কীভাবে? বুঝেছি, স্নেহা বলেছে। এই মেয়েটা তো দেখি পুরাই পেটপাতলা।
তা কবে যাচ্ছিস?
কয়েক দিনের মধ্যে যাওয়ার চিন্তা করছি। কারণ, মৎস্য ধরব এই আনন্দে তর সইছে না। ভাবছি মাছ ধরব আর গলা ছেড়ে গান গাইব। গানও ঠিক করে ফেলেছি। বর্তমানের হিট গান।
সামনে থেকে স্নেহা ঘাড় ঘুরিয়ে উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
স্যার কী গান? একটু শোনান তো।
আমি গলা পরিষ্কার করে গান শুরু করলাম।
‘দুষ্টু কোকিল ডাকেরে কুককুককুককু,
মনে বাঁশি বাজেরে কুককুককুককু....
এই দুই লাইন গেয়ে প্রশ্ন করলাম, কেমন হয়েছে? স্নেহা হাতে তালি দিয়ে বলল,
স্যার জোস। আমি আপনাকে আরও কয়েকটা গানের প্ল্যান দেব। আপনি মাছ ধরবেন আর ওই সব গান গাইবেন।
আমি নোভার দিকে তাকিয়ে বললাম,
গান পছন্দ হয়েছে?
পাগলের গুষ্টি।
গালি দিস ক্যান? শিল্পীকে সম্মান দিতে শিখ। দেখ স্নেহা, কী সুন্দর মন্তব্য করেছে।
নোভা আমার কথা না শোনার ভান করে স্নেহাকে বলল,
তোমার কাছে ওর এই বেসুরা গলার গান ভালো লাগছে?
জি লাগছে। স্যারের সব কিছুই আমার ভালো লাগে।
একটা মানুষ এতো সুন্দর চাকরি ছেড়ে যাওয়ার মতো উদ্ভট প্ল্যান করছে, দেখলাম তুমি সেটাও পছন্দ করছো।
সমস্যা কী? আইডিয়াটা কিন্তু কিউট আছে।
এ কথা বলেই স্নেহা সামনের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
স্যার শোনেন, আপনি লুঙ্গি পরে মাছ ধরতে যান, তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু যাওয়ার আগে আপনাকে বিয়ে করে যেতে হবে। আপনার সামনে দুটো পথ খোলা। হয় আমারে বিয়ে করবেন অথবা নোভা আপাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু বিয়ে আপনাকে করতেই হবে।
স্নেহা শোনো, তুমি সুন্দরী, রূপবতী সবই ঠিক আছে। কিন্তু তুমি আমার ছাত্রী। আমি জীবনেও তোমাকে বিয়ে করব না।
আমি তো এখন আর আপনার ছাত্রী নই।
শোনো যে একবার ছাত্রী সে সারা জীবনের জন্য ছাত্রী। অবশ্য তুমি আমার ছাত্রী না হলেও তোমারে আমি বিয়ে করতাম না।
কেন স্যার?
দাঁড়াও কারণটা তোমারে শাহরুখ খানের সিনেমার একটা ফাটাফাটি ডায়ালগ দিয়া বুঝায় দিই। আমার হিন্দি খুবই খারাপ। তাই বাংলা হিন্দি মিলায়ে বলি। কী বলো?
আচ্ছা বলেন।
আমি শাহরুখ খানের মতো গলা কাঁপায়ে বললাম,
‘হাম একবার বাঁচি, একবার মরি, শাদি ভি একবার হোতি হ্যায়... ওর পেয়ার একবার হি হোতা হ্যায়...’
আমার কথা শেষ হতেই স্নেহা বাচ্চাদের মতো হাতে তালি দিয়ে বলল,
সো কিউট। নোভা আপা দেখছেন, আপনি কতটা ভাগ্যবতী? স্যার আপনাকে একেবারে পাগলের মতো ভালোবাসে।
নোভা হাসতে হাসতে বলল,
হি হি হি....যার মাথায় সমস্যা। সে তো পাগলের মতো ভালোবাসবে, তা–ই না?
নোভা হাসলেও ওর চোখে খুশির অশ্রু, গর্বের অশ্রু। কারণ, এমন পাগলের মতো বিশ্বস্ত ভালোবাসা যেসব মেয়েরই কাম্য।
স্নেহা নোভার দিকে তাকিয়ে বলল,
তাহলে আপনারা বিয়ে করছো না কেন? স্যার আপনি আপনার ইগো ফেলে ঘরজামাই হলেই তো পারেন। ঘরজামাই তো খারাপ কিছু না।
আমি উত্তর দেওয়ার আগে নোভাই বলল,
না স্নেহা ঘরজামাই খারাপ কিছু নয়। কিন্তু আমি চাই না, রাসেল ঘরজামাই হোক। আমি ওর এই ইগো নিয়ে গর্ব বোধ করি।
তাহলে আপনি বিয়ে করে স্যারের বাসায় উঠে যান।
নোভা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আমি বললাম,
সেটাও সম্ভব নয়। ও ওর মাকে একা ছেড়ে দিতে পারে না। নোভাকে উনার প্রয়োজন।
তাহলে উপায় কী?
আমি আর নোভা প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম,
জানি না।
আজ শুক্রবার। সকাল থেকে আমি আমার ব্যাগে প্রয়োজনীয় কাপড় এবং জিনিসপত্র ঢুকাচ্ছি। আজ রাতে নাইট কোচে মহেশখালীর উদ্দেশে আমি ঢাকা ত্যাগ করব। সকালে মাকে এ কথা বলার পর থেকেই মা অস্থির। বাবাও দেখলাম গম্ভীর হয়ে আছেন। আমার ছোট বোনসহ মা–বাবা সকাল থেকে বেডরুমে কী জানি পরামর্শ করছেন। আমি সামনে গেলেই তাঁরা চুপ হয় যাচ্ছেন।
দুপুরে বাবার সঙ্গে নামাজ পড়তে মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষে বের হতেই ছোট বোন ফোন করে জানাল সে অ্যাম্বুলেন্স কল করে মাকে নিয়ে ক্লিনিকে এসেছেন। মা নাকি অজ্ঞান হয়ে বাথরুমে পড়ে গেছেন। আমি আর বাবা মসজিদ থেকে বের হয়ে সরাসরি ক্লিনিকে ছুটলাম।
মাকে এখন কেবিনে রাখা হয়েছে। মাকে দেখতে নোভা এবং নোভার মা একটু আগে ক্লিনিকে এসেছেন। স্নেহাও ওর মাকে নিয়ে এসেছে। সবাই এখন কেবিনের ভেতর মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন। কেবিনের ভেতর আমার বাবা, ছোট বোন, আমার বড় মামা-মামি, তাঁদের দুই ছেলে, নোভা, নোভার মা, স্নেহা এবং স্নেহার মা অবস্থান করছেন। আমি কেবিনের বাহিরে রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। একটু পর নোভা বের হয়ে এল। এসে আমার পাশে দাঁড়াল। তারপর বলল,
আকাশে কী দেখছিস?
আমি আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বললাম,
আকাশ, মেঘ, গ্রহ, নক্ষত্র দেখে আবহাওয়া, পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। কারণ, সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে এ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে।
তুই কি সত্যি আজ চলে যাবি? খালাম্মার এই অবস্থায়?
শোন, তুই আমার মাকে চিনিস না। উনি একজন প্রথম শ্রেণির অভিনেত্রী। উনার কিছুই হয়নি। আমার যাওয়া আটকানোর জন্য উনি এই নাটক করছেন। একটা মানুষ বাথরুমে মাথা ঘুরে ফ্লোরের ওপর পড়ে গেল। অথচ তাঁর কোথাও কাটল না, ফাটল না, ছিলল না, এটা কেমন কথা? দেখেছিস উনার পরনে নতুন শাড়ি। আমার তো উনাকে দেখে মনে হলো, উনি প্রথমে আলমারি থেকে ভালো একটা শাড়ি বের করে পরেছেন। তারপর বাথরুমে গিয়ে বাথরুমের ফ্লোর মুছে পরিষ্কার করেছেন। এরপর আরাম করে বাথরুমে শুয়েছেন। তারপর সময় নিয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। হায়রে অভিনেত্রী।
তুই কি মানুষ? মাকে কেউ অভিনেত্রী বলে? আচ্ছা তোর কথা যদি মেনেও নেই, তাহলে ডাক্তার কেন বলল, মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। উনি কি ডাক্তারও হাত করে ফেলেছেন?
হুঁ। তুই জানিস ওই ডাক্তার কে? ওই ডাক্তারের সঙ্গে আমার ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমার বিয়ে হলেই ওদের বিয়ে হবে। শোন তোকে আরেকটা তথ্য দিই। মা যে অসুস্থ এবং এই ক্লিনিকে আছে, সেটা কি আমি তোকে ফোন করে জানাইছি?
না। তোর ছোটবোন মাকে ফোন করেছিল?
শোন, ওর কাছে তোর মায়ের নাম্বার নাই। এই নাম্বার সেদিন মা আমার কাছ থেকে নিয়েছেন। একটা জিনিস ভাবো তো, আমার বোন তোকে ফোন না করে তোর মাকে কেন ফোন করল?
কেন ফোন করল?
কারণ, ওদের উদ্দেশ্য হচ্ছে তোর মাকে ক্লিনিকে এনে তাঁর আবেগে ধাক্কা দেওয়া। আর এটা আমার মা-বাবা–বোনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা। সকাল থেকেই দেখছিলাম ওরা তিনজন কী নিয়ে জানি ফিসফিস করছিল। আমি সামনে গেলেই তাঁরা চুপ হয়ে যাচ্ছিলেন।
আমাদের কথার এই পর্যায়ে ছোট বোন এসে আমাকে আর নোভাকে কেবিনের ভেতর ডেকে নিল। আমরা ভেতরে যেতেই মা রোগীদের মতো কথা বলতে শুরু করলেন। ভাবে মনে হলো তার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।
রাসেল বাবা শোন, আমি মনে হয় আর বাঁচব না।
মা তুমি এখন কোনো কথা বলো না। তোমার কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে।
আমার বাক্যটি শেষ হতেই মা তার স্বাভাবিক বাচন ভঙ্গিতে বললেন,
আমার কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে না। শোন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ এখানেই তোর বিয়ে দেব।
কার সঙ্গে?
স্নেহার সঙ্গে।
অসম্ভব। এই পিচ্চিকে আমি বিয়ে করব না।
স্নেহা কপট রাগের ভঙ্গিতে বলল,
স্যার বিয়ে করবেন না ঠিক আছে। কিন্তু পিচ্চি বলবেন না। আমি এখন কলেজে পড়ি।
এবার মা বললেন।
ওকে। স্নেহাকে বিয়ে করতে হবে না। তোর বিয়ে নোভার সঙ্গে হবে।
মা আমি ঘরজামাই থাকব না।
তোর ঘরজামাই থাকতে হবে না। নোভার মায়ের সঙ্গে এই মাত্র আমার কথা হয়েছে। উনি তোদের বিয়েতে রাজি হয়েছেন। আমরা সবাই মিলে তোর সমস্যার একটা দারুণ সমাধান পেয়েছি।
কী সেটা?
শোন, আমাদের এই পরিকল্পনায় তোকেও ঘরজামাই থাকতে হবে না। আবার নোভার মাকেও মেয়ের সংসারে থাকতে হবে না।
খুলে বলো।
আমরা এখন তোদের ঘরোয়াভাবে বিয়ে দেব। বিয়ের পর যে যার বাসায় চলে যাবি। তারপর আমরা সবাই মিলে একটা সুন্দর বাসা খুঁজে বের করব। ওই বাসাটি তোরা ভাড়া নিবি। ওই বাসার ভাড়া অর্ধেক নোভার মা দেবে। আর বাকি অর্ধেক তুই দিবি। নোভার মা উনার বর্তমান বাসাটি ভাড়া দিয়ে এই নতুন বাসায় উঠবেন। এই বাসার যাবতীয় খরচ মানে খাওয়াদাওয়া কারেন্ট বিলসহ সব খরচের অর্ধেক তুই দিবি। বাকি অর্ধেক উনি দেবেন। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? এই বাসা তোরও না আবার উনারও না। তোদের দুজনের। কী বুদ্ধিটা কেমন? জটিল না?
হুঁ। এই বুদ্ধি কার মাথা থেকে এসেছে?
বুদ্ধিটা স্নেহার। গতকাল রাতেই ও আমাকে ফোন করে বুদ্ধিটি দিয়েছে।
আমি স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললাম,
মেয়ে, এই মেধা যদি লেখাপড়ায় প্রয়োগ করতা, তাহলে আর টেনে টুনে তোমাকে পাস করতে হতো না।
স্যার শোনেন, আমি টেনেটুনে পাস করিনি।
মা বললেন,
তাহলে কি এখন আমরা বিয়ের কাজ শুরু করতে পারি?
মা, আমরা এটা পরেও করতে পারব। এটা একটা ক্লিনিক। এখানে চিকিৎসা হয়, বিয়ে না। আর তা ছাড়া এখন হুট করে কাজি পাবে কোথায়?
এ কথা বলতেই ডাক্তার সাহেব মানে আমার হবু বোনজামাই কাজিকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলেন। আমি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললাম,
তার মানে সব রেডি করে রাখছো?
জি ভাইয়া। উনাকে আগেই এনে আমার অফিসে বসিয়ে রেখেছি। এতক্ষণ উনাকে নিয়ে আমি দরজার বাহিরে অপেক্ষা করছিলাম।
এখন রাত দেড়টা। আমরা রাত ১০টার দিকে মাকে নিয়ে ক্লিনিক থেকে বাসায় চলে এসেছি। অন্যরা সবাই যার যার মতো নিজ নিজ বাসায় চলে গেছে। আমি এখন আমাদের বিল্ডিংয়ের ছাদের ওপর চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছি। একটু পর নোভা ফোন দিল। হ্যালো বলতেই প্রশ্ন করল,
কিরে কী করিস?
ছাদে চিত হয়ে শুয়ে আছি।
মানে কী!
মানে হচ্ছে মন খারাপ। তাই ছাদে চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছি।
মন খারাপ কেন? তোর তো খুশি হওয়ার কথা। একটু আগে বিয়ে করলি।
তা ঠিক। কিন্তু তোদের কারণে আমার মৎস্য ধরার সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। সেটা ভেবে মন খারাপ।
কুত্তা। মানুষে বিয়ে করে কত খুশি হয়, আর সে আছে মাছ ধরা নিয়ে।
মানুষের বিয়ে আর আমার বিয়ে কী এক হইল?
মানে কী?
মানে এটা কেমন বিয়ে? আজ আমার বাসর রাত। অথচ আমি বেকুবের মতো ছাদে একাকী চিত হয়ে শুয়ে আছি। তাহলে বিয়ে করে কি লাভ হইলো? হে মাবুদ, এমন ফালতু বাসর রাত যেন কারও কপালে না থাকে।
হি হি হি...জানিস, আমাদের বিল্ডিংয়ের ছাদে না দরজা আছে।
তো।
দরজার দুই পাশ থেকেই ছিটকানিও লাগানো যায়।
বুঝলাম। কিন্তু তাতে কী?
বাসর রাত করতে চাইলে চলে আয়। আজ আমরা আমাদের ছাদে বাসর রাত করব। ভোরে সবাই ঘুম থেকে উঠার আগে তুই চলে যাবি। কেউ জানবে না। মাও জানবে না।
ইয়াহু। তুই কি সিরিয়াস? দাঁড়া আমি এখনি আসছি।
কুত্তা, থাপ্পড় খাবি। শখ কতো?
মানে কী?
আগে একটা বাসা ভাড়া কর। এরপর অনুষ্ঠান করে আমারে বাসায় উঠায় নে। তারপর এসব ঢঙের কথা বলিস।
তাহলে এখন কী করব?
যা করছিলি তা–ই কর। আকাশ দেখ। আর আমাকে একটা রোমান্টিক গান শোনা। যেন পুরোটা রাত রোমান্টিক হয়ে যায়।
তুই গান শুনবি? এক সেকেন্ড।
এ কথা বলেই আমি গলা ছেড়ে গান ধরলাম,
‘আমি ডানা কাটা পরি
আমি ডানা কাটা পরি...
ওই কুত্তা তুই ফোন রাখ।
কেন কী হয়েছে?
ফালতু কোথাকার।
বলেই নোভা ফোন কেটে দিল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার আকাশ দেখা শুরু করলাম। শেষ...
* লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]