বাচাল ছেলে: ২য় পর্ব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক ঘণ্টার মধ্যে স্নেহাকে পড়ানোর কাজ শেষ করলাম। ওদের বাসা থেকে বের হয়ে নোভার কথামতো নোভাকে ফোন দিলাম।

‘বল কী বলবি?’

‘কাল মা-বাবার বিবাহবার্ষিকী। সন্ধ্যায় বাসায় একটা ঘরোয়া পার্টি হবে। এই পার্টিতে শুধু আমাদের কয়েকজন নিকট আত্মীয় আসবেন। বাইরের মানুষদের মধ্যে একমাত্র তোকেই দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে।’

‘এত সম্মান দিস না আমাকে। আমি সইতে পারব না। একটা গান আছে না, “না পারি সহিতে না পারি কইতে তুমি কি কুয়াশার…।”’

‘ওই চুপ কর। শোন, ভাব ধরিস না। মা কিন্তু তোকে দাওয়াত দিতে চায়নি।’

‘এত অপমান করিস না। আমি সইতে পারব না। একটা গান আছে না…’

‘ওই তুই চুপ করবি?’

‘আরে বাবা তোর মা আমাকে অপমান করছে আমি একটু গান গেয়ে কাঁদতেও পারব না?’

‘কাঁদতে হবে না। মা মানা করলেও বাবা তোকে আসতে বলেছে।’

‘তোর মা মানা করেছে, আর তোর বাবা যেতে বলেছে। এটা কোন ধরনের দাওয়াত বুঝলাম না। খুলে বল তো কাহিনি কী?’

‘কাহিনি খুবই জটিল। শোন বাসায় আমার বিয়ের জন্য আলোচনা চলছে। আমি মাকে তোর কথা বলেছি। তুই আমার ক্লাসমেট শুনেই মা আপত্তি জানাল। তারপর যখন বললাম তুই এখনো বেকার, সঙ্গে সঙ্গে মা তোকে রিজেক্ট করে দিলেন। আমি মাকে বোঝানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। বলেছি মা, রাসেল অনেক ভালো ছেলে, মজার ছেলে। আশপাশের মানুষকে সারাক্ষণ আনন্দে রাখে। মা বললেন, “কয়েকটা উদাহরণ দাও।” তখন তোর কয়েকটা ক্যাম্পাসের মজার কাহিনি মাকে বললাম।’

‘তা শুনে উনি কী বললেন?’

‘বললেন, তোর নাকি মাথায় সমস্যা আছে। তোর জরুরি চিকিৎসা দরকার।’

আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লাম। আমার দীর্ঘনিশ্বাস সম্ভবত নোভা শুনতে পেয়েছে। তাই সে সান্ত্বনার সুরে বলল,

‘মন খারাপ করিস না প্লিজ।’

‘তুই কি আমাকে নাচতে বলতেছিস?’

‘সেটা করতে পারিস। তবে একটা কথা কী জানিস? মা কিন্তু মিথ্যা বলেনি। হি হি হি...তোর মাথায় তো একটু সমস্যা আছেই। হি হি হি...।’

‘হাসতে থাক। মন উজাড় করে হাস। হেসে হেসে অপমান কর।’

‘সরি। শোন মা যখন কোনোভাবেই তোর ব্যাপারে রাজি না। তখন আমি বাবাকে গিয়ে ধরলাম।’

‘উনি কী বললেন?’

‘বাবাকে অনুরোধ করায় বাবা মাকে বললেন, ‘আচ্ছা ছেলেটা আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে আসুক। ওকে দেখি, কথা বলি, ফিউচার পরিকল্পনা শুনি। তারপর ডিসিশন নিই।’ তাই তোকে দাওয়াত দেওয়া।

‘তার মানে তোর বাবা আমাকে দাওয়াত দিচ্ছে। তোর মা না।’

‘হুঁ। বাবা এত করে বোঝানোর পরও মা এখনো তোকে বাসায় নেওয়ার পক্ষে না। এনিওয়ে কাল বাসায় চলে আয়, তারপর দেখা যাবে।’

‘মাফ চাই। আমি তোর মায়ের এত আপত্তি মাথায় নিয়ে তোদের বাসায় যাব না।’

‘আসবি না বললেই হলো? ফ্রি ফ্রি প্রেম করবা, বিয়া করবা না, তাই না? এসব ধান্দা মাথা থেকে সরায়ে ফেলো চান্দু।’

‘কই আর প্রেম করলাম? হাতটাও ধরতে দিস না। হাগ, চুমু তো পরের কথা। মানুষ প্রেম করে কত কিছু করে। লিটনের ফ্ল্যাটে যায়। আর আমরা টিএসসিতে বসে চা আর ঝালমুড়ি খাই। শোন বসে বসে চা আর ঝালমুড়ি খাওয়াকে প্রেম বলে না।’

‘ছি ছি ছি...তোর মনে এসব কুচিন্তা ঘোরে? তুই আমাকে রুমে নিতে চাস? ছি ছি ছি...তোর চরিত্র তো দেখি পুরাই খারাপ। তোরে তো আমি আরও ভালো মনে করেছিলাম। ছি ছি ছি...।’

‘ভাইরে তোর আল্লাহর দোহাই লাগে এভাবে বারবার ছি ছি করিস না। তোর ছি ছি করার ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে আমি একজন নিশ্চিত নারী পাচারকারী। শুধু তা–ই নয়, আমার বাপ–দাদারাও এ কাজে যুক্ত।’

‘আমি তোরে এমন কিছু বলিনি। নিজে নিজে কথা বানাইছ না। আমি বুঝি না, একটা মানুষ এত ফালতু কথা বলে কেমনে! তোর মুখ ব্যথা করে না?’

‘কেন করবে না? আমি কি মানুষ না? মাঝে মাঝে আমার চোয়াল ব্যথা করে। তখন আমি নিজেই নিজের চোয়াল ম্যাসাজ করি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ের পর বউরে দিয়া সকাল–বিকেল গাল ম্যাসাজ করাব।’

‘কী বললি!’

‘আচ্ছা যা করতে হবে না। এখন বল কখন যেতে হবে। আর কাল তাঁরা আমার সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে কী কী কথা বলতে পারেন, তার একটা ধারণা দে। আমার কিন্তু একটু একটু ভয় করছে।’

‘তুই যে ভয় পাওয়ার মানুষ না, সেটা আমি ভালো করেই জানি। এনিওয়ে তোকে বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। তাঁরা জাস্ট তোর সঙ্গে পরিচিত হবে। আর শোন তাঁরা তোকে মেয়ের হবু জামাই হিসেবে না, মেয়ের বন্ধু হিসেবেই কথা বলবে। অতএব নো টেনশন।’

‘গুড। তা কী নিয়ে যাব, আর কি পোশাক পরে যাব, একটা পরামর্শ দে।’

‘সেটা দেওয়া যাবে না। তুই তোর বুদ্ধিমতো কাল পরিস্থিতি সামাল দিবি।’

‘কেন, বুদ্ধি দিলে কী সমস্যা? সব কাজে তো দিস।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘মা আমাকে শর্ত দিয়েছে তোকে কোনো কিছু শিখিয়ে না দিতে। কাল অনুষ্ঠানে কীভাবে আসবি, কী পরে আসবি, আর কী নিয়ে আসবি, এটা নাকি তোর একটা পরীক্ষা। তোর ব্যক্তিত্ব, রুচি, মানসিক পরিপক্বতা ইত্যাদি তারা তোর আচার–আচরণ দিয়ে কাল পরীক্ষা করবেন।’

‘এটা কোনো কথা? তুই তো আমারে বিপদে ফেলায় দিলি?’

‘শোন মা মানা করার পরও তোকে কিছু পরামর্শ দিই। কারণ, তোকে তো আমি চিনি তুই কেমন চিজ। কাল কোনো রকম পাগলামি করবি না। অযথা ফান করবি না। মানুষকে বিব্রত করবি না। মেপে মেপে কথা বলবি। কোনো কারণ ছাড়া বেশি কথা বলবি না। মনে রাখবি এটা ক্যাম্পাসের বন্ধুদের কোনো পার্টি বা আড্ডা না।’

‘আর কিছু?’

‘খামাকা দার্শনিকতা ফলাবি না। মনে রাখবি তুই দার্শনিক না।’

‘হুঁ।’

‘বাই। কাল সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে চলে আসবি।’

এ কথা বলে নোভা ফোন রেখে দিল।

নোভার মা আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছেন, সে কারণে আমার একটুও খারাপ লাগছে না। কারণ, কোনো বাবা-মা তার মেয়েকে বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তবে তিনি আমার মাথায় সমস্যা আছে বলাতে ওনার ওপর আমার মেজাজটা একটু গরম হয়েছে। ঠিক করলাম কাল তাঁকে মাথায় সমস্যা কাকে বলে সেটা বুঝিয়ে দেব। সব সময় নাটক–সিরিয়ালে দেখেছি বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ হয়। এবার আমি করব হবু জামাই-হবু শাশুড়ির যুদ্ধ। মনে মনে বললাম, আম্মাজান ওয়েট করেন। আমি আসছি। পাগল কত প্রকার ও কী কী সব বুঝে যাবেন।

নোভার পরিবার খুবই রুচিশীল মধ্যবিত্ত একটি পরিবার। নোভার সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় দুই বছরের মতো হলেও এই প্রথম ওদের বাসায় এলাম। কারণ, ওর মা বাসায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসাটা একদম পছন্দ করেন না।

ঠিকানামতো ঠিকঠাক নোভাদের বাসায় চলে এলাম। ওদের বাসা ছয়তলায়। ছয়তলায় উঠে দেখলাম পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট। একটি 6A অন্যটি 6B। নোভা যদিও বলেছিল ওদের ফ্ল্যাট কোনটি। কিন্তু আমি এখন মনে করতে পারছি না সেটি কোনটি, 6A না 6B? ছয়তলায় দাঁড়িয়ে নোভাকে ফোন দিলাম। কিন্তু সে ফোন ধরছে না, বারবার কেটে দিচ্ছে। সম্ভবত সে রাগ করেছে। অবশ্য রাগ করাটাই স্বাভাবিক। অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। আর এখন বাজে রাত সাড়ে ১২টা। চিন্তা করে ঠিক করলাম যা হওয়ার হবে 6A–তে বেল বাজাব। নিশ্চয় ভাবছেন কেন আমি 6A ঠিক করলাম। আসলে খেয়াল করলাম, নোভা নামের বানানে A আছে, কিন্তু একটাও B নাই। তাই 6B–এর পরিবর্তে 6A। হা হা হা...কী ভাবছেন? ভুয়া যুক্তি? আপনার ধারণা সত্য। এসব ভুয়া যুক্তির কারণেই আমার আশপাশের মানুষেরা আমার ওপর বিরক্ত।

আরও পড়ুন

সাহস করে 6A–তে বেল বাজালাম। ভেবেছিলাম নোভা এসে দরজা খুলবে। কিন্তু তিনবার বেল বাজার পর ১৯ কি ২০ বছর বয়সের একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর দরজা একটু ফাঁক করে সেখান দিয়ে মুখ বের করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখলাম মেয়েটির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। সম্ভবত আমি ভুল বাসায় নক করেছি। বুঝলাম নামের বানানের সঙ্গে ফ্ল্যাট নম্বর মিল থাকবে এটা আসলেই একটা ভুয়া যুক্তি।

আমি মেয়েটিকে সুন্দরভাবে সুর করে সালাম দিলাম,

‘আসসালামুলাইকুম ইয়া রাহমতুল্লাহি ওয়া বারকাতু।’

মেয়েটি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল,

‘ওয়ালাইকুম।’

‘এভাবে সালাম নিলে তো হবে না আপা। সালাম নিতে হবে সুন্দর করে। বলতে হবে, ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমতুল্লাহি ওয়া বারকাতু।’

মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

আমি মেয়েটিকে বললাম, ‘তা পরি, আপনি কেমন আছেন?’

‘আমার নাম তো পরি না। আমার নাম জয়নব।’

মেয়েটি তার নাম জয়নব বলাতে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ, তার মানে আমি সঠিক বাসাতেই নক করেছি। নোভার কাছে জয়নবের অনেক গল্প শুনেছি। সে এ বাসায় কয়েক বছর ধরে সাহায্যকারী হিসেবে আছে।

‘আপনার নাম জয়নব, সেটা ঠিক আছে। তবে আপনি দেখতে পরির মতো সুন্দর। তাই আপনাকে পরি বললাম। আপনি কখনো কি পরি দেখেছেন?’

‘না দেহি নাই।’

‘দেখলে বুঝতেন, ওরা আপনার মতোই সুন্দর।’

‘আমনে পরি দেখছেন?’

‘দেখেছি। আপনাকে দেখার আগে আরও দুইটা পরি দেখেছি। একজন অল্প বয়সের। আরেকজন একটু বেশি বয়সের। এই দুই পরি দেখতে সুন্দর হলেও এদের কিছু সমস্যা আছে। যিনি বেশি বয়সের, ওনার সমস্যা হচ্ছে সারাক্ষণ পান খায়। পান খেয়ে খেয়ে দাঁত–জিহ্বা সব লাল করে ফেলছেন। সে কারণে তাকে আমি লাল পরি বলে ডাকি। এই লাল পরির সঙ্গেই আমি থাকি। তিনি আমার বাবাকে বিবাহ করেছেন এবং তিনি আমাকে দুনিয়ায় এনেছেন। আর যে পরিটি অল্প বয়সের, তার সমস্যা হচ্ছে সে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে রাগারাগি করে, আর আমাকে বকা দেয়। তবে সে আবার আমাকে অনেক ভালোও বাসে। তাকে নীল রঙের পোশাকে খুবই সুন্দর লাগে। তাই তাকে আমি নীল পরি বলে ডাকি। আমার এই নীল পরিটি আবার আপনাদের এ বাসায় থাকেন। আল্লাহ চাহে তো তাকে আমি বিবাহ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তা জয়নব পরি, আপনি কেমন আছেন?’

‘আমি ভালা আছি ভাইজান। আমনে আমারে পরি কইছেন, হুইনা মনটা ফুরফুরা হইছে। আপনি অন্নেক ভালা মানুষ।’

‘ধন্যবাদ জয়নব পরি। তা আপনি কি কষ্ট করে আমার নীল পরিকে একটু ডেকে দেবেন? আজকে ওনার বাবা–মায়ের বিবাহবার্ষিকী তে সে আমাকে দাওয়াত দিয়েছে।’

‘কিন্তু পার্টি তো শেষ। খাওনদাওন করে সবাই বাসায় চইলাও গেছে।’

‘আপনাদের বাসার নীরবতা দেখেই বুঝতে পারছি অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে এবং সব মেহমান নিজ নিজ বাসায় চলে গেছেন। আচ্ছা খাবারের মেন্যু কী কী ছিল? রান্না কে করছে আপনি, নীল পরি, নাকি নীল পরির মা?’

‘হি হি হি...আম্মায় রান্না করছে। খুউব মজা হইছে।’

‘তা সব খাবার কি শেষ? পাতিলে কি একটুও নাই? থাকলে কাঁচায়–কুঁচায় খাইতাম। খুবই খিদা লাগছে। অবশ্য না থাকলেও সমস্যা নাই। বাসায় কি তিন মিনিটের লুডলস প্যাকেট আছে?’

‘জি আছে।’

‘আপনি তিন মিনিটের একটা নুডলস রান্না করে দেবেন। খেয়াল রাখবেন ঝাল যেন বেশি হয়। বাসায় কি কাঁচা মরিচ আছে? থাকলে নুডলসের মধ্যে ছয়টি কাঁচা মরিচ কুঁচি কুঁচি করে কেটে দেবেন।’

‘বাসায় কাঁচা মরিচ নাই। যা ছিল তা আজকের রান্নায় শেষ হইয়া গ্যাছে।’

‘না থাকলে নাই। তাহলে আজ ঝাল নুডলস খাব না। আপনি নুডলসের মধ্যে একটু চিনি আর একটু দুধ ঢেলে দেবেন। আমি মিষ্টি নুডলস খাব।’

‘হি হি হি…আচ্ছা আপনার নাম তো রাসেল ভাইয়া তাই না?’

‘জি।’

‘আফাতো ঠিকই কইছে, আমনে খামাকা বেশি কথা কন। তয় এইটা মিললেও আফা যেমন কইছে হের লগে তো আমনের চেহারা মিলতাছে না।’

‘আসলে আমি মাঝে মাঝে দাড়ি–চুল লম্বা করি। আবার মাঝে মাঝে কেটে ফেলি। সে জন্য অনেকেই আমার চেহারা মেলাতে পারে না। এ যেমন আজ সকালে খুব গরম লাগছিল, তাই আজ শেভ করার সময় মাথাও বেল করে ফেলেছি। হয়তো সে জন্য আমার চেহারা আপনার আপার বলার সঙ্গে মিলতেছে না।’

এ কথা বলেই মাথা থেকে ক্যাপটা খুলে জয়নবকে আমার বেল মাথাটা দেখালাম।

জয়নব মুখ চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

‘ভাইজান আমনের মাথা তো দেহি চকচক করতাছে। হি হি হি...। আমনেরে দেখতে আমাগো গ্রামের কালু পাগলার মতো লাগতাছে। কালু, পাগলা হইলেও সে দেখতে খুউব সুন্দর।’

আমি আবার ক্যাপটা মাথায় দিয়ে বললাম,

‘তার মানে আমাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। তাই তো?’

‘জি ভাইজান। আমনে মাশা আল্লাহ বহুত সুন্দর। পুরাই সিনেমার হিরোদোর মতন। কিন্তু বুঝলাম না, আফায় আমনের চেহারা নিয়া এইটা কইল ক্যান?’

‘কী বলেছে আপনার আপা?’

‘একটু আগে আমনে যখন বেল বাজাইলেন। তখন আফা আমারে কইল, যা রাসেল আইসে। দরজা খুলে বলবি, ‘অনুষ্ঠান শেষ। আপনি বাসায় চলে যান।’ আমি আফারে কইলাম দরজা খুইলা আমি কি দেইখা বুঝুম হে রাসেল? অন্য কোনো ব্যাডাও তো হইতে পারে? আফা কইল তুই মুখের দিকে তাকাইলেই বুঝবি। ওর চেহারার মধ্যে একটা চুর চুর ভাব আছে। হি হি হি...’

‘চুর চুর বলে নাই, সম্ভবত চোর চোর বলছে, তাই না? হা হা হা হা...’

আমার অট্টহাসি হাসি শুনে নোভা দৌড়ে এল। এসেই ঝাড়ি দিয়ে বলল,

‘ওই তুই হাসি থামা। এত রাতে ডাকাতের মতো হাসবি না। আর তুই এত রাতে এখানে কী করস?’

‘মানে কি তুই তো আজ আমারে দাওয়াত দিলি। আজ না তোর বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী?’

‘ওটা গতকাল ছিল। আজ নতুন দিন। এখন রাত বাজে সাড়ে ১২টা। এটা তোর আসার সময় হলো?’

‘আসলে হবু শাশুড়ির জন্য আনকমন গিফট কিনতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল। এই আনকমন গিফটের জন্য যে কত কষ্ট করছি, সেটা যদি জানতি।’

‘তোরে কি আমি আনকমন গিফট আনতে বলছি?’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘তা বলিসনি। আমি নিজের বুদ্ধিতেই এনেছি। আসলে উনি তো আমাকে অপমানজনকভাবে রিজেক্ট করে দিয়েছেন। তাই তাঁকে ইম্প্রেস করতে অনেক চিন্তাভাবনা করে মাথা খাটিয়ে, এই গিফটটি এনেছি। এটি একটি দরকারি এবং উপকারী গিফট। আমি শিওর বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে এমন গিফট কেউ দেয়নি, আর কেউ পায়নি।’

নোভা আমার হাতে ধরা বিশাল প্যাকেট দেখে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,

‘আল্লাহ জানে এটার মধ্যে কী আছে? তুই সত্যি করে বল তো এটার মধ্যে উল্টাপাল্টা কী আনছিস?’

‘বললে তো আর সারপ্রাইজ থাকল না। আর তা ছাড়া গিফটি তোর জন্য নয়। তাই তোর জানার দরকারও নাই।’

‘তোর গিফট আমার বাবা-মায়ের লাগবে না। তোর গিফট তোর কাছে থাক। তুই এখন বাসায় যা।’

‘বলিস কী! এই গিফট আনার জন্য সারা দিন কত কষ্ট করলাম। এক কাজ কর তোর বাবা-মাকে ডাক। গিফটটা দিয়ে যাই।’

‘বাবা-মা সম্ভবত ঘুমায়ে পড়েছে। তাদের এখন ডাকা যাবে না।’

‘আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী। তারা কি এত আগে ঘুমাবে? ঘুমাবে না। আমি শিওর তারা এখন একটু প্রেম–ভালোবাসা করবে।’

‘ছি ছি ছি। হারামজাদা তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না! তুই যা তো এখান থেকে।’

‘শোন অ্যাটলিস্ট কিছু খেতে দে। তোদের বাসায় ভালো-মন্দ খাব বলে সারা দিন কিছু খাইনি। দেখ মুখটা শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে।’

‘তুই সারা দিন কিছু খাসনি!’

‘না। সময় তো পাইনি।’

আমার কথা শেষ না হতেই দেখলাম নোভার চোখ দুটো ছলছল করছে। এই মেয়েটা দুনিয়ার রাগী একটা মেয়ে। সারাক্ষণ আমাকে বকার মধ্যে রাখে। অথচ আমার প্রতি তার মায়া অবিশ্বাস্য। আমি না খেয়ে আছি শুনেই তার চোখ ভিজে গেছে।

নোভা ধরা কণ্ঠে বলল,

‘আয় ভেতরে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি। কুত্তা তোর জন্য আমিও না খেয়ে আছি। আর আমি খাইনি বলে, মা–বাবাও না খেয়ে আছে।’

আমি গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলাম। সোফায় বসতেই নোভা বলল,

‘তুই বোস। আমি মা–বাবাকে ডেকে আনছি।’

বলেই নোভা ভেতরে চলে গেল। আমি আমার গিফটের প্যাকেটটা সামনের টি–টেবিলের ওপর রাখলাম। একটু পর জয়নব এসে আমাকে একটা তোয়ালে দিয়ে বলল,

‘ভাইজান আফা কইছে আমনেরে বাথরুমে যাইয়া হাত-মুখ ধুইয়া আইতে। আফা কইল আমনেরে দেখতে নাকি খুব ক্লান্ত লাগতাছে।’

আমি তোয়ালে হাতে নিয়ে বললাম,

‘জানেন জয়নব, এই জোয়ান আর বয়স্ক পরি দুইটা আমারে এত ভালোবাসে যে ভাবলেই আমার কান্না পায়। কিন্তু আমি কাঁদি না।’

‘কেন কান্দেন না।’

আমি জয়নবের কথা বলার মতো করে বললাম,

‘ব্যাডা মাইনষে কান্না দেখতে ফানি লাগে তাই।’

বলেই আমি শব্দ না করোই পুরো শরীর কাঁপিয়ে হো হো হো করে হাসতে লাগলাম।

‘ভাইজান এটা কেমুন হাসি? আওয়াজ নাই ক্যান?’

‘আওয়াজ করে হাসলে আপনার আফা আমারে বকা দেবে তাই। জানেন আমি না আওয়াজ না করে কথাও বলতে পারি। দেখবেন?’

এ কথা বলেই আমি আওয়াজ না করে কথা বললাম। জয়নব কিছু না বুঝেই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম,

‘কী বলছি বুঝতে পেরেছেন?’

‘না।’

‘আমি বলেছি, জয়নব বেগম আপনি কি সিনেমায় অভিনয় করবেন? আমি একদিন সিনেমা বানাব। আপনি হবেন সিনেমার নায়িকা।’

বলেই আমি অবাক জয়নবকে পেছনে রেখে আওয়াজ ছাড়া শরীর কাঁপিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। আমি শিওর সে এখন ভাবছে আফা এই পাগলের কি দেইখ্যা ভালোবাসছে। চলবে...

* লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র [email protected]

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]