বাচাল ছেলে: ৪র্থ পর্ব
আমি নোভার মা–বাবার সঙ্গে ফুডকোর্টে বসে আছি। আমি টেবিলের এক পাশে, আর ওনারা টেবিলের অপর পাশে। নোভার বাবা বললেন,
‘তা ইয়াং ম্যান, কী খাবে বলো?’
‘একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছি। নাশতা খাওয়া হয়নি। আর এখন বাজে বেলা তিনটা। ভাবছি, একসঙ্গে নাশতা ও দুপুরের খাবার দুটিই খাব।’
‘সেটা কেমন?’
‘প্রথমে কলিজা ভুনা দিয়ে পরোটা খাব। তারপর কাচ্চি খাব।’
‘চলো, আমরা খাবারের অর্ডার দিয়ে আসি।’
আমি আর নোভার বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে দোকানের দিকে গোলাম। দোকানের সামনে গিয়ে উনি ফিসফিস করে বললেন,
‘বাচ্চা, কিছু মনে করো না। তোমাকে এখন নোভার মা অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলবেন। যা তোমার মন খারাপ করে দেবে। সরি, বাচ্চা।’
আমরা খাবারের অর্ডার দিয়ে এসে নিজ নিজ জায়গায় বসলাম। তিনজনই চুপচাপ বসে আছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। একটু পর নোভার মা বললেন,
‘তোমাকে আমি সরাসরি কিছু কথা বলতে চাই। আমি জানি কথাগুলো তোমার পছন্দ হবে না। তবুও আমাকে বলতে হবে।’
‘ম্যাডাম আপনার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনি আমাকে অপমানসূচক কিছু কথা বলবেন। একটু আগে আঙ্কেল অনেকগুলো খাবার অর্ডার দিয়েছেন। আপনি যদি এখন অপমানসূচক কথা বলেন, তাহলে হয়তোবা আর খাবার রুচি থাকবে না। তাই বলছিলাম আগে খেয়ে নিই। তারপর আপনার যা ইচ্ছা বলবেন, আমি শুনব।’
আমার কথা শুনে উনি আর কিছু বললেন না। একটু পর খাবার এল। আমি আরাম করে সময় নিয়ে খাবারগুলো খেলাম। নোভার বাবা একটা কোল্ড ড্রিংকস নিলেন। তবে নোভার মা কিছুই খেলেন না। খাবার শেষ হওয়ার পর নোভার মা বললেন,
‘আমি কি এখন কথা শুরু করতে পারি?’
‘জি।’
‘তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?’
‘কোনো পরিকল্পনা নেই।’
‘চাকরির চেষ্টা করছ?’
‘না। চাকরি আমার ভালো লাগে না। কেমন একটা পরাধীন জীবন।’
‘তাহলে তোমার ভবিষ্যৎ চলবে কীভাবে?’
‘তা এখনো জানি না। তবে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। ভাবছি, ভাতের দোকান দেব। নোভা রান্না করবে। আমি বিক্রি করব। এ ব্যবসায় লাভ অনেক।’
‘আমি জানি, তুমি রসিকতা করছ। কিন্তু তোমার রসিকতা থেকেই বোঝা যাচ্ছে জীবন নিয়ে তোমার কোনো উচ্চাশা নেই। রসিকতায় তোমার ক্লাস তুমি চিনিয়ে দিয়েছ।’
‘তাই নাকি!’
‘তুমি কি পাতাবাহারগাছ চেনো?’
‘জি, না। আমি উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্র নই।’
‘পাতাবাহারগাছ চেনার জন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্র হতে হবে না। এই গাছ সবাই চেনে। এই গাছের পাতাগুলো দেখতে ফুলের মতো সুন্দর। কিন্তু যখন তুমি ওই গাছের কাছে যাবে। দেখবে আসলে এগুলো ফুল না পাতা। এর কোনো গন্ধ নেই। বিষময় একটি গাছ। ফুলের সঙ্গে যদি তুলনা করো, তাহলে পাতাবাহারগাছের পাতা একটা মূল্যহীন জিনিস।’
‘আপনি আমাকে পাতাবাহারগাছ চেনাচ্ছেন কেন?’
‘কারণ, আমার মেয়ে তোমাকে ফুল ভাবলেও তুমি যে একটা পাতাবাহার, সেটা বোঝানোর জন্য। তুমি হচ্ছো পাতাবাহারগাছের পাতা। অথচ নোভা আবেগে তোমাকে ফুল ভেবে স্বপ্ন দেখছে। একসময় এই আবেগ থাকবে না। তখন সে বুঝবে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। শোনো, তোমাকে একটা কথা সরাসরি বলি, তোমাকে আমার পছন্দ না।’
‘তা, আমাকে এখন কী করতে হবে?’
‘তুমি নোভার জীবন থেকে সরে যাবে।’
‘নোভাকে সরতে না বলে আপনি আমাকে সরতে বলছেন কেন?’
‘কারণ, সে তোমার জন্য অন্ধ। আমার ধারণা, তুমি ওকে তাবিজ করেছ। আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করছি। প্লিজ, তুমি আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যাও।’
‘ধরুন, আমি আপনার কথামতো সরে গেলাম। আপনার কি ধারণা, আমি সরলেই নোভা সরে যাবে?’
‘জানি, যাবে না। তাই তুমি এমন কিছু করবে, যাতে নোভা তোমাকে ঘৃণা করে সরে যায়?’
‘আপনি মনে হয় প্রচুর সিরিয়াল দেখেন, তাই না? না হলে এমন সিনেম্যাটিক কথা বলতে পারতেন না। আচ্ছা আপনি কী চান, আমি ওকে গিয়ে বলব যে আমার ক্যানসার হয়েছে? আমি আর কয়েক মাস বাঁচব? নাকি বলব, আমার অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে পরকীয়া চলছে? নাকি আমি মদের বোতল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে মাতলামি করব। তারপর সেই মাতলামির ভিডিও তৈরি করে ওকে দেব?’
‘না। ওসব করতে হবে না। আমার একটা প্ল্যান আছে? ওটাতে তোমারও উপকার হবে। নোভাও সরে যাবে?’
‘কী সেটা?’
‘দেখো, আমরা খুব বড়লোক নই। তারপরও আমি তোমাকে কিছু টাকা দেব। তা দিয়ে তুমি ব্যবসা শুরু করে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারবে। আমি নোভাকে বলব, তুমি তার জীবন থেকে সরে যাওয়ার বিনিময়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছ। আমি আমার মেয়েকে চিনি। এ কথা শুনলেই তোমার কাছ থেকে সে সরে যাবে। এখন বলো, তুমি রাজি?’
আমি নোভার বাবার দিকে তাকালাম। দেখলাম, উনি মাথা নিচু করে বসে আছেন। আমি নোভার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ভাবছি, বাংলা সিনেমার মতো বলব, না না চৌধুরী সাহেব, আপনি টাকা দিয়ে আমার ভালোবাসা কিনতে পারবেন না। হা হা হা...’
‘তুমি ফান করছ। তবে আমি ফান করছি না। প্লিজ বাবা, নোভা আমার একমাত্র সন্তান। আমি ওর জীবনটা সুন্দর ও গোছালো দেখতে চাই। আমি ওকে সুখী দেখতে চাই।’
‘আপনার কেন মনে হলো আমার সঙ্গে ও সুখে থাকবে না।’
‘আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। তোমাকে মা হিসেবে অনুরোধ করছি। প্লিজ।’
নোভার মা দুই হাত একত্র করে করজোড় মিনতি করল। দেখে খারাপ লাগল। মা তো মা–ই। সব মা–ই সম্মানের।’
‘যান, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। সত্যি টাকা দেবেন তো?’
‘অবশ্যই। কত টাকা চাই তোমার?’
‘১ হাজার ৫০০ টাকা দিন।’
‘তুমি কি ফান করছো?’
‘জি, না। শোনেন, আপনাকে একটা পরামর্শ দিই। নোভা জানে টাকাপয়সার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। আমি আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, এ কথা আপনি কসম কেটে বললেও ও বিশ্বাস করবে না। যেটা করলে বিশ্বাস করবে, তার একটা বুদ্ধি দিচ্ছি। আচ্ছা, নোভা কি জানে আপনারা আজ আমার সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসছেন?’
‘না।’
‘গুড। এখন আমি আমার ছাত্রীকে ফোন করব। দেখি ও ফ্রি আছে কি না। মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে। এটা নোভা জানে। মেয়েটি যদি ফ্রি থাকে ওকে বলব, এখন চলে আসতে। ওকে নিয়ে পরের শোতে সিনেমা দেখব। টিকিট খরচ আর পপকর্নসহ ১ হাজার ৫০০ টাকা লাগবে। তাই আপনার কাছে ১ হাজার ৫০০ টাকা চেয়েছি। মেয়েটি আসার পর আমি ওকে নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকব। আপনি সেটা ভিডিও করবেন। তারপর বাসায় গিয়ে নোভাকে ভিডিওটা দেখাবেন। ব্যস, আর কিছু করতে হবে না বা বলতে হবে না। আপনার যে মেয়ে, এই ভিডিও দেখার পর ওর সামনে গেলে আমাকে খুনই করে ফেলবে।’
‘খুবই ভালো আইডিয়া। তুমি ফোন দাও।’
স্নেহাকে ফোন দিলাম। এক রিং হতেই ফোন রিসিভ করল।
‘স্যার প্লিজ, বইলেন না যে আজ আসবেন না।’
‘কথা কম বলো। মন দিয়ে শোনো, আমি কি বলি।’
‘বলেন স্যার। আমি আপনার সব কথাই মন দিয়ে শুনি।’
‘ছবি দেখতে বসুন্ধরায় এসেছি। কিন্তু একা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তুমি একদিন বলেছিলে আমাকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখতে চাও। আমি রাজি হইনি। যদি এক ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারো, তাহলে আসো। না হলে জীবনেও আর এই সুযোগ তুমি পাবে না।’
‘স্যার, আমি এক ঘণ্টার মধ্যেই আসছি।’
ফোন রাখতেই নোভার মা বললেন,
‘কী বলল? আসছে?’
‘জি। কিন্তু জানেন, লজ্জা লাগছে। পিচ্চি একটা মেয়ে। একদম শিশু। মেয়েটাকে আমি আপনার কারণে এভাবে গিনিপিগ বানাচ্ছি।’
স্নেহা শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি পরায় ওকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। আমি ইচ্ছা করে স্নেহার পাশে একদম গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। স্নেহা লাজুক স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল,
‘স্যার, আমাকে কেমন লাগছে?’
‘তোমাকে এই প্রথম শাড়ি পরা দেখলাম। তুমি শাড়ি পরতে পারো আমি জানতাম না।’
‘আমি শাড়ি পরতে পারি না। মা পরিয়ে দিয়েছে।’
আমি খেয়াল করলাম, নোভার মা আমাদের ভিডিও করছেন। আমি শিওর এই ভিডিও দেখার পর নোভা আমাকে খুন করার জন্য পথে পথে ঘুরবে। ওর সামনে কোনোভাবেই পড়া যাবে না। আমি জানি, এক শ বছর পরও যদি ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখনো ও আমাকে বঁটি নিয়ে দৌড়ানি দেবে।’
‘তোমার মা জানে, তুমি এখানে এসেছ?’
‘জানবে না কেন? মাকে বললাম, মা আমাকে তাড়াতাড়ি একটা নীল শাড়ি পরিয়ে দাও। নীল রং স্যারের পছন্দ। স্যার বলেছেন, আমাকে সিনেমা দেখাবেন। এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে প্রোগ্রাম ক্যানসেল। এটা শুনে মা নিজেই ড্রাইভ করে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল।’
হঠাৎ খেয়াল করলাম, নোভার মা–বাবা চলে গেছেন। তার মানে, নোভার মা তার প্রয়োজনীয় ফুটেজ পেয়ে গেছেন। এতক্ষণ আমি স্নেহার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালেও এখন একটু সরে দাঁড়ালাম। তারপর বললাম,
‘আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমি কখনো তোমাকে বলিনি যে আমার নীল রং পছন্দ। তাহলে তুমি কী করে জানলে এটা?’
‘সবকিছু বলতে হবে কেন? মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। হি হি হি…’
‘পাকনামো করবা না। এ রকম যদি পড়ালেখাটা বুঝতে, তাহলে তোমাকে নিয়ে তোমার মা–বাবাকে এত টেনশন করতে হতো না। তোমাকে যে আমি গতকাল জার্নি বাই ট্রেন কম্পোজিশন মুখস্থ করতে দিয়েছিলাম, সেটা করছ?’
স্নেহা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল।
‘ঠিক আছে, শুরু করো। একটুও থামবা না আর অ্যা উ করবা না।’
‘স্যার, আমরা সিনেমা দেখতে এসেছি।’
‘তো?’
‘আমি শাড়ি পরে এত কষ্ট করে সেজে এসেছি জার্নি বাই ট্রেন মুখস্থ বলার জন্য? আপনি সিনেমা হলে এসে পড়া ধরবেন?’
‘শোনো, লেখাপড়ার কোনো সময়, স্থান, কাল ও পাত্র থাকে না। আমি ছোটবেলায় যখন টয়লেট করতাম, আমার ছোট মামা তখন দরজার বাইরে থেকে চিৎকার করে আমাকে গরুর রচনা ধরত। আমি চিৎকার করে গরুর রচনা বলতাম। গরুর চারটি পা, দুটি শিং ও একটি লম্বা লেজ আছে। লেজের মাথায় এক মুঠো চুল আছে। ওই চুল দিয়ে গরু মশা ও মাছি তাড়ায়।’
‘স্যার, প্লিজ। চলেন, সিনেমা শুরু হয়ে যাবে?’
‘তুমি যদি জার্নি বাই ট্রেন মুখস্থ বলতে পারো, তবেই আমরা সিনেমা দেখব। না হলে বাসায় যাও।’
স্নেহা কিছুক্ষণ আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
‘আপনি কি এটলিস্ট আমাকে একটু বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবেন? আমি একা একা কোথাও যাই না।’
‘তার মানে, তুমি মুখস্থ করোনি। তুমি এত ফাঁকিবাজ কেন?’
স্নেহা আর আমি রিকশায় করে ধানমন্ডি যাচ্ছি। ওকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসব। আমি ভেবেছিলাম, সিনেমা না দেখার জন্য হয়তো মুখ ভার করে থাকবে। কিন্তু ওর চেহারার মধ্যে কষ্টের লেশমাত্র নেই। তার পরিবর্তে সেখানে খুশি ও আনন্দ ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে ও এখন প্রচণ্ড সুখী একটা মেয়ে। আসলে আমি এখন পর্যন্ত মেয়েদের চিনতে পারলাম না। এরা কিসে কষ্ট পাবে, কিসে আনন্দ পাবে, সেটা বুঝতে গেলে আমাকে মনে হয় আরও কয়েকবার জন্ম নিতে হবে।’
দুজনে চুপচাপ বসে আছি। মনে হলো, স্নেহা আমার শরীরের দিকে একটু ঘেঁষে বসেছে। আমার অস্বস্তি লাগছে। আমি রিকশার একেবারে প্রান্তে গিয়ে বসলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম,
‘আচ্ছা, আমি একটা জিনিস বুঝলাম না, তুমি তোমার মাকে বললে স্যার সিনেমা দেখাবে। আর তোমার মা কিছু না বলে তোমাকে সাজিয়ে গুজিয়ে দিয়ে গেল? কারণটা কী?’
‘বলব না। বললে রাগ করবেন।’
‘না বললেও রাগ করব। তার চেয়ে বলে ফেলো।’
‘মাকে বললাম, “মা জানো, স্যারের এক ছোট্ট খালাতো বোন ছিল। নাম তমা। স্যার তমাকে খুব আদর করত। মেয়েটি করোনায় মারা গেছে। আজ তমার জন্মদিন। একটু আগে স্যার বলল, এক ঘণ্টার মধ্যে যদি আসতে পারিস, তা হলে তুই আজ আমার বোন তমা হয়ে আমার সঙ্গে সিনেমা দেখার সুযোগ পাবি।’ গৃহশিক্ষক যদি ছাত্রীকে বোন মনে করে, তাহলে সব মায়েরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। মেয়েকে নিয়ে আর টেনশন করতে হয় না। হি হি হি... বুঝতে পারছেন?’
‘মাই গড। তোমারে তো আমি বলদ ভাবতাম। তুমি তো দেখি পুরা কিসিঞ্জার।’
‘স্যার, উনি কে?’
‘তুমি ওনাকে চিনো না!’
‘জি, না? উনি কি হলিউডের সিনেমার কেউ?’
‘তোমার মতো ছাত্রীর শিক্ষক আমি, ভাবতেই লজ্জা লাগছে।’
‘স্যার, বলেন না উনি কে?’
‘উনি আমার খালাতো ভাই।’
খেয়াল করলাম, স্নেহা আবার আমার গা চেপে বসেছে। শরীর কিছুটা আমার দিকে ঝুঁকিয়ে রেখেছে।
‘তুমি তো মনে হচ্ছে আমাকে রিকশা থেকে ফেলে দেবে। সরে বসো।’
স্নেহা একটু মুচকি হাসল। কিন্তু সরে বসল না। আমি ওকে বললাম,
‘একটা জিনিস বুঝলাম না। আমি তোমাকে সিনেমা দেখানোর কথা বলে নিয়ে গেলাম। কিন্তু সিনেমা না দেখিয়ে ফেরত নিয়ে যাচ্ছি। বিষয়টা তোমার কাছে কষ্টদায়ক হওয়ার কথা। কিন্তু তোমার চেহারার ভেতর আমি কোনো কষ্টের ছাপ দেখতে পাচ্ছি না। কারণটা কী? অবশ্য কারণটা যাহোক না কেন? তুমি পোলাপাইনের মতো গাল ফোলাওনি, সে জন্য আমি খুব খুশি। ধন্যবাদ।’
‘হি হি হি...’
‘হাসছ কেন?
‘আমি আপনার পাশে বসে সিনেমা দেখতে না পেলেও আপনার শরীর ছুঁয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো রিকশায় বসেছি। তা–ও আবার আপনার বাঁ পাশে। এটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। এর মূল্য আপনি বুঝবেন না।’
আমি কিছুক্ষণ ঘাড় ঘুরিয়ে স্নেহার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেও সরাসরি গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
‘স্যার শুনুন, আমি এখন আপনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কিন্তু আমার মুখ হাঁ করে নেই। তাই এখন বলতে পারবেন না যে আমার আলজিব দেখা যাচ্ছে।’
আমি রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম,
‘মামা বাঁয়ে সাইড করেন।’
রিকশা থামার পর আমি রিকশা থেকে নামলাম। সামনে দাঁড়ানো আরেকটি খালি রিকশা ডেকে উঠে পড়লাম। তারপর স্নেহাকে বহনকারী রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম,
‘মামা, আপনি রিকশা টান দেন। আমি আপনার পেছন পেছন আসছি।’
আমি আমার রিকশা করে স্নেহাকে বহনকারী রিকশার পিছু পিছু চললাম। একটু পর স্নেহা একবার সামনের রিকশা থেকে পেছন ফিরে আমাকে বহনকারী রিকশার দিকে তাকাল। খেয়াল করলাম, মেয়েটির চোখ দুটি ভেজা। চলবে...
*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]