ছলনাময়ী-শেষ পর্ব

ঝিলমিল চিন্তা করছে মনিরকে নিয়ে। আমাকে আটকিয়ে রেখেছে। কোথাও যেতে দিচ্ছে না। বারবার বলছে, আমাকে দিয়ে  কোনো কাজ হবে না। দুই দিন পেরিয়ে গেল। এখনো মনিরের খোঁজ পাওয়া গেল না। এখন সে আমাকে নিয়ে থানায় যাবে। আমিও রেডি।

ঝিলমিল একটু সেজে নিচ্ছে। আমি বলে উঠি, ‘থানায় যাবে মনিরের খোঁজে বুঝলাম, তা এত সাজ কিসের?’

ঝিলমিল একটু রেগে বলে, ‘তুমি কোনো কথা বলবে না। কোথায় সাজছি, একটু প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
‘ও আচ্ছা।’
‘ওসি সাহেবের নাম্বার আছে?’
‘না নেই।’
‘তা থাকবে কেন?’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘তবে আমার নাম্বার আছে ওসির কাছে।’
‘তুমি কে যে তোমার নাম্বার ওসি সাহেব রাখবে?’

‘আমি কে সেটা বড় বিষয় নয়। তবে পুলিশ তো জনগণের সেবক, তাই আমাদের সেবার জন্য আমার নাম্বারটা তিনি রাখতেই পারেন, তাই নয় কী?’
ঝিলমিল রেডি। এখনোই বের হবে। এমন সময় মোবাইলে কল আসে। পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে (রিংটোন)। ঝিলমিল বলল, ‘কি হলো মোবাইল রিসিভ কর।’
অপরিচিত নাম্বার। মনে হয় রং নাম্বার।
রিসিভ কর।

ফোনটা কেটে গেল। ঝিলমিল বকাঝকা করছে। আমি ঝিলমিলের পেছন পেছন হাঁটছি। আবার কল আসে পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে। একই নাম্বার থেকে কল এল। কে হতে পারে। অমনি ঝিলমিল হাত থেকে মোবাইল নিয়ে রিসিভ করে। ‘হ্যালো?’ বলতেই ওপাশ থেকে বলল, ‘আমি ওসি জাফর বলছিলাম।’
ঝিলমিল বলল, ‘জি বলুন।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘মুরাদ সাহেব আছেন?’
‘জি আছে। কেন ফোন করেছেন জানতে পারি?’
‘জি আপনি মুরাদ সাহেবের কি হোন জানতে পারি? নাকি মিসেস মুরাদ বলছিলেন।’
ঝিলমিল চট করে বলে উঠল, ‘জি আমি মিসেস মুরাদ বলছি, এবার বলুন কী ঘটনা।’
‘আসলে হয়েছে কী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোহরাব খান ফোন করেছিলেন। বলছিলেন মুরাদ সাহেবের নাম্বার নাকি উনার কাছে নাই। আমার কাছে আছে। আমি নাম্বারটা দিয়েছি। সেটা বলার জন্য কল করেছি।’

কল কেটে ঝিলমিল আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাহ, বাহ, একেবারে মন্ত্রীর সঙ্গে চলাফেরা। বিষয়টা কী খুলে বলো তো।
‘শালা মীরজাফর, মন্ত্রীরে নাম্বার দিয়ে দিল।’

ঝিলমিলের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে জাফরকে কল করে বলি, ‘জাফর সাহেব মনিরের কোনো খবর পেয়েছেন।’
ওপাশ থেকে জাফর বলে, ‘আরে মুরাদ সাহেব যে আজকে মনির নামে তিনটা ছেলেকে ধরা হয়েছে। আপনি এসে দেখতে পারেন।’
‘ওকে আমি আসছি।’

আরও পড়ুন
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঝিলমিলকে নিয়ে থানায় গেলাম। ওসি জাফর মনির নামের তিনজনকে সামনে হাজির করে। ঝিলমিল মনিরকে পেয়ে যায়। সে মনিরকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। একজন আধুনিক যুগের আমেরিকার বাসিন্দা এমন একটা মেয়ে এভাবে কান্না করছে, সেটা ভেবে অবাক হতেই হয়। সত্যি ঝিলমিলের তুলনা হয় না।

ওসি জাফর বলল, ‘আরে উনি কাঁদছে কেন?’
আমি বললাম, ‘কাঁদুক, কাঁদলে মন হালকা হয়।’
ওসিকে চুপ করিয়ে বাকি দুজন মনিরের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম। ‘কী খবর ভাইসাবেরা?’

এক মনির বলে উঠল, ‘আমি শরবত বিক্রি করি। একজনকে শরবত দিতে গেছি, এমন সময় পুলিশ বলে, “তোর নাম কী?” আমি বললাম, মনির। অমনি আমাকে ধরে নিয়ে আসে। আমার শরবতের গাড়ি পড়ে আছে। না জানি কী অবস্থা!’
আহারে বেচারা। পরের জনকে বললাম, ‘তোমাকে কেমনে ধরল?’
‘ভাইজান, আমি আমার বোনকে আনতে গেছিলাম। রাস্তা থেকে একজন আমাকে মনির বলে ডাক দিল, এটা শোনে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে আসে।’

আরও পড়ুন
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘এখন আপনার বোনের কী অবস্থা?’
‘আল্লাহ জানে। আমার বোনের এক চোখ কানা। চোখে দেখে না। গোলাপ শাহ মাজারে পাশে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে।’
অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। ওসি জাফরকে বললাম, ‘এভাবে সবাইকে ধরে আনা ঠিক হয়নি।’

আমার কথা শোনে জাফরের ভুরু কুঁচকে যায়। সে বলে উঠে, ‘যাক বাবা যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর!’
‘আমি তো আপনাকে চুরি করতে বলেনি। আমি শুধু বলেছি, মনিরকে খোঁজে বের করতে।’

‘তা কীভাবে বের করব। আপনি মনিরের কোনো ছবি কী আমাকে দেখাইছেন?’
ঝিলমিল বলে, থাক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এখন চলো বাসায়।
‘না অত সহজে যাওয়া যাবে না। এই দুইজন মনিরকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। ইনাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জাফর সাহেব আপনি উনাদের স্বসম্মানে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।’

আরও পড়ুন

‘কইলেই অইল। আমি পারব না।’
‘তাহলে আপনার শ্যালিকার সঙ্গে প্রেমের খবরটা আপনার বউয়ের কাছে পৌঁছে যাবে।’
‘দেখুন মুরাদ সাহেব, আজেবাজে কথা বলে আমাকে ভয় দেখাবেন না।’
‘ওকে ঠিক আছে। তাহলে বান্দরবান যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন।’
ওসি জাফর এবার রাজি হলো। আমি বললাম, ‘শরবত মনিরকে হাজার দুই হাজার টাকা দিয়ে দিবেন জাফর সাহেব।

আর এই কানা মনিরের বোনকে খুঁজে বের করে দিবেন।’
‘মানে কী? আমি টাকা দেব কোত্থেকে!’
কথা বেড়েই চলেছে। ঝিলমিল আর সহ্য করতে পারছে না। সে বলে, ‘মুরাদ ভাই, তুমি

কী শুরু করেছো বল তো।’
‘আমি ঠিকই বলছি।’
অবশেষে ঝিলমিল টাকা দিয়ে দিল। আর কানা মনির আর শরবত মনিরকে গাড়িতে তুলে নিল। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। রাত ৯টা বাজে। ঝিলামিল ড্রাইভ করছে। গাড়িতে বসে আছি আমরা পাঁচজন। কানা মনির, শরবত মনির, মজনু মনির, ঝিলমিল ও আমি মুরাদ।

আরও পড়ুন

আমি বললাম, ‘কানা মনির তোমার বোনের খোঁজ আগে করব। ভালো হবে না।’
‘জি ভাই। ভাইজান, আমি তো কানা না। আমার বোন কানা।’
‘ওই হলো, যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। তোমার বোন কানা বুঝলাম। তুমি তো তোমার বোনের টাকায় খাচ্ছো। তাই না?’

কানা মনিরের জবান বন্ধ। শরবত মনিরকে বললাম, ‘শরবত মনির তোমার কী অবস্থা?’
‘ভাইজান আমার আপনার দেওয়া নামটা বেশ ভালো লাগছে। আমি সাত বছর ধরে ঢাকার শহরে শরবত বিক্রি করছি। আমার নামটা তো শরবত মনির ওই হওয়া উচিৎ, তাই না। এখন টেনশনে আছি শরবতে গাড়িটা পাব কিনা।’
‘তারপর মজনু মনিরের কী খবর?’

মনির চুপ। কোনো কথা বলছে না। আমি সামনে সিটে বসা ছিলাম। পেছনে ফিরে মনিরের দিকে তাকালাম। একি মনির কাঁদছে। বুঝতে পারলাম, কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। ও কি ময়নার দেখা পেয়েছিল। থাক এখন গাড়িতে আর কথা না বলাই ভালো।
ঝিলমিল গোলাপ শাহ মাজারে কাছে এসে রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামল। কানা মনিরকে বললাম, ‘তোমার বোন কোথায়?’

মনির কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। আমিও নামলাম।

সঙ্গে শরবত মনিরকে বললাম একটু খুঁজে দেখো তো। বেশি সময় লাগেনি কানা মনিরের বোনকে পাওয়া গেছে। কিন্তু একটু অন্য রকম। কানা মনির চিৎকার দিল। আশেপাশে কয়েকজন ছুটে এল। মেয়েটির বয়স বেশি হবে না। তেরো কি চৌদ্দ হবে। গায়ের জামা ছেঁড়া। কী হতে পারে! রাতও তো বেশি না। ১০টা পেরিয়ে। আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, কেউ একজন তার কাছ থেকে কাড়াকাড়ি করে টাকাগুলো নিয়ে গেছে। আর কিছু না। ঝিলমিল কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে মেয়েটিকে দিলাম।

চলে এলাম শরবত মনিরের গাড়ির কাছে। ওর গাড়ি আছে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ওকে টাকা দিতে হলো না। তারপর সোজা বাসায় চলে এলাম। ঝিলমিলকে অনেক ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কিছু বললাম না। জানি ঝিলমিল অনেক ক্লান্ত। মনিরকে বললাম, ‘তুই গোসল শেষ করে খেয়ে একটা ঘুম দে। সকালে কথা হবে।’
ঝিলমিল চুপচাপ আছে।

তাই তাকে আর কিছু বললাম না। সোজা নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। ঘুম চলে আসছে। কোনো কিছু ভালো লাগছে না। ঘুমই যেন রাজ্যের সেরা শান্তি। বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছি। এমন সময় কেউ একজন, মুরাদ ভাই, মুরাদ ভাই, বলে ডাকছে। মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। ডাকটা আর থামছে না। চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। হঠাৎ কানে স্পষ্ট শব্দ ঝিলমিল আমাকে ডাকছে। আমি উঠে বসলাম। আজকে আর ঝিলমিলের অবাধ্য হওয়া যাবে না।

চলে এলাম ঝিলমিলের সামনে। সেকি, ঝিলমিল এ কী পরেছে। একটা পাতলা টি-শার্ট আর সালোয়ার। ঝিলমিল বলল, ‘খেতে এসো।’

‘মনির খাবে না।’
‘মনির খাবে। সে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে।’
ডাইনিং টেবিলে বসে আছি। ঝিলমিল নিজের হাতে আমাকে খাবার দিচ্ছে। রাত বাজে ১২টা। কাজের মেয়েটাও বাসায় নেই।  ঝিলমিলকে দেখতে ইচ্ছে হলেও, আমি দেখছি না। কারণ, ওর মধ্যে এখন যে সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে, সেটা নেশাযুক্ত সৌন্দর্য। যে নেশা থেকে বেড়িয়ে আসা অতটা সহজ নয়।

‘তারপর মনির সাহেবের কী অবস্থা?’
ঝিলমিলের কথার কোনো জবাব মনির দিচ্ছে না। শুধু খেয়েই যাচ্ছে। মনিরের খাবার দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে খুব ক্ষুধার্ত। পৃথিবীতে সব জ্বালা সহ্য করা গেলেও ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করা অনেক কঠিন । আমি ঝিলমিলকে হাতে ইশারা দিয়ে বলি,
‘চুপ থাক। ওকে কিছু বলার দরকার নেই।’

ঝিলমিল তার চোখটা বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল। তারপর একটা মুচকি হাসি দিল। যা দেখে আমার ভেতরে মুচড়ে যায়। বাসাতে আমি ঝিলমিল মনির ছাড়া আর কেউ নেই। নিচ তলাতে দারোয়ান চাচা আছে। মাঝরাতে এক যুবতী এক প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করবে, মুচকি হাসবে এটা ৯ নম্বার বিপদ সংকেত থেকেও বড় কিছু।

আমি একটু তাড়াহুড়া করে খাবার সেরে বাইরে বেরিয়ে পড়ি।  ঝিলমিল অবশ্যই বলছিল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘এইতো আসছি।’ বলে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ি। পৃথিবীতে প্রকৃতি এত মায়া কেন দিল। সেটা বোঝা দায়। মাঝরাতে পৃথিবীর সবকিছু একটু অন্যরকম সুন্দর লাগে। তেমনি মানুষের ভেতর মানুষটাও জাগ্রত হয়। আমি হাঁটছি রাস্তার পাশ দিয়ে। বাসায় আজ ফেরা যাবে না।

নিজেকে কারও কাছে সঁপে দেওয়ার লোক আমি না।
আলোকে মনে পড়ে গেলো। আচ্ছা, আলো এখন কী করছে? মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই ঝিলমিলের কল। এখন রিসিভ করা যাবে না। আরেকবার কল। নো রিসিভ। অ্যাগেইন কল। ডোন্ট রিসিভ। নাউ মেসেজ কামিং। আই ইনবক্স ওপেন...
‘মুরাদ তুমি যদি এখন না আস, তাহলে একটা অঘটন হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।’
‘বাসায় গেলেও অঘটন হবে, না গেলেও হবে। সেটা আমি জানি।’

আমি ঝিলমিলের মেসেজের উত্তরও দিলাম না। সে আবার ইনবক্স করল। সেটা সিন করলাম না। এবার সে একটা ছবি পাঠাল। আমি ছবিটা দেখেই আকস্মিক মোবাইলটা সুইচ স্টপ করে ফেলি। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। পকেটে টাকা নেই। থাকলে একটা সিগারেট খেতে পারলে ভালো লাগত।

গভীর রাত। রাস্তায় দ্বৈত পায়ের সংখ্যা অনেক কম। কারও কাছ থেকে একটা সিগারেট পাওয়া যাবে কি না। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল এক মধ্যবয়সী পুরুষকে। তার সামনে দুই জন নারীও আছেন। বিষয়টা বুঝতে পারছি বোধ হয়। এমন সময় একজন মেয়ে আমাকে বলে, ‘কী ভাইজান, যাবেন নাকি।’ ভেতরে আরেকটা মুচড় দেয়। আমি মেয়েটির দিকে একবার ভালো করে তাকাই। দেখতে বেশ ভালো। তবে ঠোঁটের লিপস্টিকটা ঠিক নেই। কত আর ঠিক রাখবে। কত জনের সঙ্গে সময় কাটায়। কতবার লাগাবে আর কতবার মুছবে। আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করি। ঝিলমিলের ছবিটা দেখব বলে।

ঝিলমিল আমাকে যে ছবিটা দিছে, সেটা দেখার মতো ছবি না। খুবই কামনাময়ী একটা ছবি। টি-শার্ট খোলা ছিল। শুধু বুকের অর্ধেক ঢাকা ছিল। ও যে এমন করবে, সেটা আমি পূর্বেই ধারণা করেছিলাম। যাই হোক, মোবাইল চালু করতেই দেখি, মেসেজে লেখা ‘আমার লাশটা সকালে একবার দেখে যেয়ো।’

আমি অবাক! ঝিলমিলের মোবাইলে কল করি। ফোন বন্ধ। সত্যিই কি ঝিলমিল আত্মহত্যা করবে। আমি যতটুকু জানি, মেয়েরা জ্বালা মেটাতে চাইলে একজন পুরুষের কাছে যাবে। কিন্তু আত্মহত্যা তো করার কথা না। না না এটা মেনে নেওয়া যায় না। আর আমার জানা মতে ঝিলমিল এতটা বোকা মেয়েও না।

এখন আমি কী করব, বুঝতে পারছি না। হাঁটার গতি থামাতে ইচ্ছে না হলেও থেমে গেলাম। এমন সময় পুলিশের গাড়ি আসে। একজন পুলিশ আমাকে বলছে, ‘এই মিয়া এত রাতে এখানে কী করেন?’

আমি চুপ। কিছু বলছি না। আরেকজন বলেন, ‘এ তো মাগির দালাল।’
আমার কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু ঝিলমিলের বিষয়টা মাথায়।

‘ওই বেটা, কথা কস না কেন?’
‘ভাই, একটা সিগারেট হবে?’
সিগারেট চাইতেই ওরা আমাকে ধরে গাড়িতে তোলে। রাত দুইটা বাজে থানায় গিয়ে দেখি একটা মেয়েকে পুলিশ জিজ্ঞেসাবাদ করছে। ওসি জাফর মেয়েটিকে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। আমি মেয়েটির দিকে না তাকিয়ে জাফরের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ‘মানুষের কত রকমের নেশা থাকে। এই যেমন ওসি জাফরের নারীর প্রতি লালসা। পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে একজন ঝিলমিল কত করে আমাকে পাশে চাইল, সেটা আগে থেকেই বুঝতে পেরে বেড়িয়ে পড়ি। ফলে এখন আমি থানাতে।
জাফর সাহেব আমাকে দেখেই অবাক হয়ে বলে, ‘আরে মুরাদ সাহেব আপনি! এখানে কীভাবে?’

‘একটা সিগারেট খাওয়াতে পারবেন।’
‘কী? আপনি সিগারেট খেতে এত রাতে আমার কাছে এসেছেন। কী অবাক কাণ্ড! এ নিন সিগারেট খান।
আমি সিগারেট নিয়ে থানার রুম থেকে বাইরে চলে যাই। আর নিশ্চয়ই অন্য পুলিশেরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সিগারেট ধরায়। থানার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখলাম, তাকে বোধ হয় আমি চিনতে পেরেছি। কিন্তু সে পুলিশের কাছে ধরা পড়ার মেয়ে না। সিগারেট শেষ করে ওসি জাফরের সামনে চেয়ারে বসি। জাফর সাহেব আবার বলে, ‘এত রাতে সিগারেট খেতে এসেছেন।’

‘বোকা সেজে কথা বলবেন না জাফর সাহেব। আমি বোকা লোক পছন্দ করি না।’
জাফরের ভুরু কুঁচকে যায়। এবং গলার স্বর নামিয়ে বলে, ‘আমি বোকা।’
‘বোকা নয়তো কী! এত রাতে সিগারেটের জন্য আমি আসব আপনার কাছে। আমাকে আপনার পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে।’
‘ও সরি, ভাই মুরাদ। আমি এখন বুঝতে পেরেছি। তা কেন ধরে আনল?’
‘আমি জানি না। আপনি জিজ্ঞেস করেন।’
‘এই কেটা উনারা ধইরা আনছিস, ক বলছি ক।’
‘আচ্ছা বাদ দেন। এখন বলেন এই মেয়েটি থানায় কেন?’
‘মুরাদ সাহেব আপনি কি চেনেন ওকে?’

আলোকে বলি তুমি এখানে বস। আলো এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল। লজ্জায় লাল হয়ে আছে। আমার সামনে লজ্জার কিছু নেই। এটা বলতে গিয়েও বললাম না। ওসি জাফর আমার ও আলোর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। কী বলবে বুঝতে পারছেন না। আমি আলোকে বলি, ‘তুমি তো থানায় থাকার কথা না। আর কাউকে না ফোন দিলেও আমাকে তো ফোন দিতে পারতে।’

‘আসলে আমার ফোনটা ওসি সাহেবের কাছে।’
এই কথা শুনে আমি ওসির দিকে তাকাতেই ওসি ফোন দিয়ে দিল। আমি ওসিকে বলি, ‘আরে বোকা জাফর সাহেব, মানুষ চেনেন না। এবার বোধহয় আপনার চাকরি গন।’
‘কী যে কন না মুরাদ আপনি। আমার কী হবে? যা তেলেসমাতি আপনারাই দেখান।’
ওসি জাফরের সঙ্গে কথা শেষ করে আমি আলোকে নিয়ে থানা থেকে বেড়িয়ে পড়ি। রজনীর অন্তে দুজন আজ খুব কাছাকাছি। আলো বলে, ‘তোমার সঙ্গে এভাবে দেখা হবে, এমনটা আমি কখনো ভাবিনি।’

‘কিন্তু আমি ভাবি। কারণ, আমার সঙ্গে এমনটা হয় বলে। আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। আলো আমি আজ তোমাকে মন ভরে দেখতে চাই। তুমি কি তোমাকে দেখতে দেবে?’
আলো অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, যে মানুষটা কখনো আমাকে কাছে চায়নি, আজ সে কী বলছে। আলো বলল, ‘মুরাদ তোমার কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘তুমি কি ঠিক আছো?’
‘জানি না।’

‘এ আবার কেমন কথা মুরাদ।’
‘এত কথা বলছো কেন? আমি তোমাকে দেখতে চাই? তুমি রাজি কিনা সেটা বল?’
‘আমি তো তোমার সামনেই আছি, দেখ।’
‘এভাবে না।’
‘কীভাবে দেখবে মুরাদ? আমার কাপড় খুলে দেখবে?’
‘হুম....!’
‘আমাকে হাসালে মুরাদ। আমি তোমাকে চিনি না! তোমার তো আমার আঁচল ধরার ইচ্ছাটুকুও নেই। আর তুমি খোলবে আমার কাপড়। হা হা হা...।’
‘আলো তুমি হাসছ।’
‘তা হাসবো না কাঁদব।’
‘ঠিক আছে থাক তুমি, আমি চলে যাচ্ছি।’

‘আমি জানি, এইটুকু শক্তিই তোমার আছে। আর কিছু পার আর না পার, চলে যেতে পার।’
আলোর চোখে পানি। আমি দাঁড়ালাম। আলোর দুটো হাত দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরল। আস্তে করে আমার খুব কাছে আসতে লাগল। শেষ রাত্রির আলো আর শহরে নিয়ন আলোতে আলোকে এত সুন্দর লাগছে যে ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর কাছে নিজেকে সঁপে দেই। আমি অবাক। আলো আমার এতো কাছে চলে এল। আমি তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

যেই আমার বুকে নরম মাংসের ছোঁয়া স্পর্শ করল, পিঠের মধ্যে নরম দুটি হাতে যখন শক্ত করে চেপে ধরল, তখন আমি বুঝতে পারলাম, পৃথিবীর সকল শক্তিকে হার মানানোর ক্ষমতা রাখে এই নারীশক্তি। নিশিতে নির্জনে আলো আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমিও একটু সুযোগ দিলাম আলোকে। বেচারি বড্ড বেশি ভালোবাসে আমাকে। ভালোবাসার মানুষকে সবাই কাছে পেতে চায়। কিছুক্ষণ পর আমি বুঝতে পারছি আলো খুব বেশি কান্না করছে। আমি বললাম, ‘এবার ছেড়ে দাও।’

‘না আমি ছাড়ব না।’
‘প্লিজ আলো এমন করে না।’
‘আমি জানি মুরাদ, তোমার সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। আমি আর তোমাকে পাব না। তোমাকে জড়িয়ে ধরে যে আনন্দ পাচ্ছি, এইটুকু আনন্দ সারা জীবনেও পাইনি।’
‘কেন, যখন অন্য পুরুষের সাথে রাত কাটাও তখনো পাওনি?’
এ কথা শুনে আলো আমাকে ছেড়ে দিল। আমি আর দাঁড়ালাম না। এভাবে কথা বলাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি।

সকাল হয়ে এল ঝিলমিল বাড়ির সামনে আছি। আমি জানি ঝিলমিল আত্মহত্যা করেনি। আমাকে সে ভয় দেখিয়েছে। বাসার ভেতর প্রবেশ করতেই দেখি কাচের জিনিসপত্র ভাঙা। রাতে রাগে ঝিলমিল এসব ভাঙচুর করেছে। কিন্তু এখন সে কোথায় আছে? ঝিলমিলের রুমের দরজায় নক করতেই দরজা খুলে গেল। কই, ভেতরে কেউ নেই। বাসায় মনির আছে। মনিরের রুমের দরজা আটকানো। জানালা দিয়ে উঁকি দিতে চোখে পড়ে, ঝিলমিল–মনির দুজনে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। বুঝতে আর বাকি রইল না, ঝড় তাহলে মনিরের ওপর দিয়ে গেছে।

এ জগতে সবাই ছলনাময়ী। কই ঝিলমিল তো বলছিল, আমাকে সে ভালোবাসে। আমাকে যদি ভালোই বাসে, তাহলে এসব কী? কেন জানি মনে হচ্ছে, আলোই আমাকে প্রকৃতভাবে ভালোবাসে। আমি আবার বেরিয়ে পড়ি। নিরার কথা মনে পড়ে গেল। সোজা নিরাদের বাসাতে চলে গেলাম। দারোয়ান বলল, কালাম ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল ভর্তি আছেন। নিরা আপাও কালাম ভাইয়ের কাছে আছে।
আমি আর কিছু না বলে সোজা ঢাকা মেডিকেল চলে গেলাম।

এত বড় মেডিকেল, তারপরও মানুষের গিজগিজ করে। ফ্লোরেও অনেক মানুষের চিকিৎসা চলছে। আমি কালাম ভাইকে খুঁজছি। একপর্যায়ে খুঁজে পেলাম। নিরা কালাম ভাইয়ের পায়ের দিক দিয়ে বেডের অল্প একটু জায়গাতে ডিম আকৃতিতে ঘুমাচ্ছেন। কালাম ভাই সজাগ আছেন। আমাকে দেখে কালাম ভাই ইশারা করলেন কোনো কথা না বলার জন্য। তাহলে নিরা উঠে যাবে।

মেয়েটা সারারাত ঘুমায়নি। আমি কালাম ভাইয়ের মাথায় হাত দিলাম। সাথে সাথে কালাম ভাই কেঁদে ফেললেন। অমনি নিরার ঘুম ভেঙে গেল। নিরা আমাকে দেখে অবাক হলেও, নিজেকে স্বাভাবিক করে রাখল। আমি বললাম, ‘কালাম ভাই আমি কোনো কিছু জানি না। আজকে আপনার বাসাতে গিয়েছিলাম। পরে জানতে পারি আপনি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন।’

নিরা বলল, ‘মুরাদ ভাই কিছু মনে করবেন না, ভাইয়ার সাথে কথা বলা নিষেধ আছে।’
‘ঠিক আছে, নিরা তুমি একটু বাইরে আসো তো।’
আমি নিরা দুজনে কালাম ভাইকে রেখে একটু দূরে এলাম। নিরাকে বললাম, ‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো নিরা।’
‘হ্যাঁ সবই ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এভাবে বলছেন কেন?’
‘তুমি কিছু মনে করো না। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের টাকাপয়সার সমস্যা আছে।’

‘টাকাপয়সার সমস্যা থাকলে আপনি কী করবেন?’
নিরার চোখে পানি চলে এসেছে। আমি বললাম, ‘শোনো নিরা, এখন কান্নার সময় না। কঠিন সময়গুলোতে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। আচ্ছা তুমি আমাকে একটু খুলে বলো তো?’

অনেক পীড়াপীড়ির পর নিরা বলল, ‘আসলে ভাইয়ার অ্যাক্সিডেন্টের পরে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। তাছাড়া, আমাদের বাড়িটাও বন্ধক রাখা অনেক আগে ব্যাংকের কাছে। এখন হাতে তেমন কোনো টাকা নেই।’
‘আচ্ছা এ সময়ে এসে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা। যাই হোক, তুমি শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান একটা মেয়ে। আমি চাইব, খারাপ লাগলেও তুমি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে।’
‘জি বলেন?’

‘রোমানকে তোমার কেমন লাগে?’
নিরা চুপ, কথা বলছে না। আমি বললাম, ‘চুপ থাকার কিছু নাই। উত্তর দাও।’
‘মুরাদ সাহেব আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?’
‘আমি যেটা বলতে চাই, সেটা তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। কিন্তু আমাকে বলতে পারছ না। যাই হোক আমি টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আসো কামাল ভাইয়ের কাছে যাই।’
‘আপনি এত কিছু বুঝতে পারেন। আরও কিছু আছে সেগুলো বুঝতে পারেন না।’
আমি চুপ। কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমি চাই না সে বলুক আমাকে ভালোবাসে। আমি চাই সে বলুক রোমানকে ভালোবাসে। নিরাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে এলাম কালাম ভাইয়ের কাছে।

কালাম ভাই বলল, ‘মুরাদ ভাই আমার, আমি মরে গেলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার চিন্তা শুধু আমার ছোট বোনটাকে নিয়ে।’
‘নিরাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন।’
কালাম ভাই। যার নাম শুনলেই অলিগলির সবাই ভয় পেত। আজ সে অসহায়ের মতো মেডিকেলে পড়ে আছে। চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রুপাত হচ্ছে। প্রকৃতি কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায়, এটা কেউ বলতে পারে না। নিরা যথেষ্ট সুন্দরী ও রূপসী মেয়ে। ওকে যেকোনো ছেলে বিয়ে করতে রাজি হবে। আমি রোমানের সাথে কথা বলে সব ঠিক করি। রোমান আসে, নিরার সাথে দেখা করে।

এদিকে খবর আসে আলো আত্মহত্যা করেছে। মানুষ পৃথিবীতে আসবে, আবার চলে যাবে—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আলোর মৃত্যু আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। আলোকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। ছুটে গেলাম। নিথর দেহটা পড়ে আছে। বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত আমার কাছ থেকে এসে সে ফাঁস নেয়। ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী তাহলে আমি।

আলোর লাশটাকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করলেও জড়িয়ে ধরলাম না। শেষ রাতে আলো আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, ‘তোমার সাথে আর আমার দেখা হবে না। এটাই আমাদের শেষ দেখা। তার মানে আলো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আত্মহত্যা করবে। ওসি জাফর কী আলোর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছে! নাকি সেও আলোকে জোর করে.....। থাক এখন আর এসব ভেবে কী হবে। আলো তো নেই। চোখের কোণে মনে হয় খানিকটা জল জমা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো কান্না করার লোক না। তবে কী আমি আলোর ভালোবাসার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি। এখন দুর্বল হলে কী হবে। সে তো আর এই পৃথিবীতে নেই।’

নিরার বিয়ে হয়ে গেলো রোমানের সাথে। ঝিলমিল মনিরের সাথে সুখের সংসার করছে। শুনেছি ডায়না নামের মেয়েটাও নিখোঁজ। আর আলো তো চলেই গেলো। সবাই যার যারটা বুঝে পেল। কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে আমি কী পেলাম? সবাই শুধু হাতটাই বাড়াল। কেউ আর হাতটা ধরে কাছে টেনে নিল না। যদিও একজন আমাকে খুব কাছে টেনে নিয়েছিল। সেও আমার সাথে ছলনা করল। চলে গেল অনেক দূরে। যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরে না। যাবেই তো, ছলনাময়ীরা কারও সাথে থাকে না। (শেষ...)