ছলনাময়ী-৭

ফাইল ছবি

গেটের ভেতরে প্রবেশ করতেই নিরাপত্তাকর্মী রহিম মিয়াকে দেখি বসে আছে। বুকের বাঁ পাশে নেম প্লেটে রহিম মিয়া নামটা লেখা আছে। রহিম মিয়া আমাকে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম সাহেব।’
‘আপনি আমাকে সাহেব বললেন! আমাকে সাহেব বলবেন না। আমি সাহেব না। আমি অতি সাধারণ মানুষ।’
‘আপনি সালামের উত্তর দিলেন না কেন?’
‘দিয়েছি তো!’
‘কই আমি তো শুনতে পেলাম না।’
‘আপনাকে শুনিয়ে উত্তর দিতে হবে, এমন তো কোনো নিয়ম নেই। আমি উত্তর দিয়েছি মনে মনে।’

‘কেন? মনে মনে উত্তর দিবেন কেন? আমি একজন বয়স্ক মানুষ। কষ্ট করে আপনাকে সালাম দিয়েছি। আর আপনি হের উত্তর দিবেন মনে মনে, তা তো হতে পারে না!’
বুঝতে পারছি, রহিম মিয়ার বয়স বেশি হলে কী হবে, সে একজন ঘাড়ত্যাড়া মানুষ।

আমি কোনো ঝামেলা না করে, প্রকাশ্যে সুন্দর করে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে চাচা, আমি উত্তর দিচ্ছি, আপনার ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক।’
‘এটা কী বললা? না এটা তো হবে না।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম...এর অর্থ তো, আপনার ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক।’
‘না আমি এত কিছু বুঝি না, আরবিতে উত্তর দাও?’
‘আজান পড়েছে অনেক আগেই। নামাজ আদায় করেছেন তো?’
‘আমি নামাজ পড়ি বা না পড়ি, তাতে তোমার কী?’
‘আপনার বয়স হয়েছে, কদিন পর মাটির নিচে চলে যাবেন। তখন আল্লাহকে কী বলবেন?’
‘তুমি দাঁড়াও, কোথাও যাবে না। আমি তোমাকে ছাড়ছি না।’

আমি আর কিছু না বলে ভেতরে নিচতলায় চলে এলাম। সেখানেও আছে সিকিউরিটি। তবে এর সামনে টেবিল আছে। একটা অফিসার অফিসার ভাব আছে। তারপর বয়সও কম। চল্লিশ প্লাস হবে বোধ হয়। নাম মোখলেস মিয়া। পেছনে পেছনে রহিম মিয়া চলে এসেছে। আমি কিছু বলার আগে রহিম মিয়া বলে ওঠে, ‘এই শোন ওরে ভেতরে ডুকতে দিবে না।’
আমি বললাম, ‘উনি কেন না করছে জানেন?’
মুখলেস মিয়া বলে, ‘না, আপনি বলুন কেন না করছে?’ ‘কেমনে যে বলি গোপন কথা।’
মোখলেস মিয়া বলল, ‘তারপরও বলেন, না বললে আপনারে ভেতরে ডুকতে দেব না।’
‘আচ্ছা আপনি যেহেতু বলছেন, তাই বলি, রহিম মিয়া আমার কাছ থেকে দুই শ টাকা ঘুষ চাইছিল। আমি দিইনা বলে সে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।’

রহিম মিয়া আমার কথা শোনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। আর বলে, ‘কত বড় মিথ্যা কথা!’
মোখলেস মিয়া বলে, ‘কী চাচা মিয়া, এই হলো আপনার আসল রূপ! আজকে ধরা পড়ল।’

আমি মাঝ থেকে বলি, ‘রহিম মিয়া এইও বলছে, দুই শর এক শ নাকি আপনারা দেবে। এখন আপনি বলেন। আমি কি টাকা দেব?’
মোখলেস মিয়া বলে, ‘না, দেবেন না। তলে তলে আমার নাম ভাঙিয়ে ঘুষ খাওয়া।’
রহিম মিয়া মুখটা মলিন করে বলে, ‘সব মিথ্যা কথা। এই বেটা কইত্তে আয়ছে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে বলে, এসেই আমার নামে মিথ্যা...।’

মুখলেস মিয়া বলে, ‘চুপ করেন মিয়া, আপনারে আমি চিনি, আপনি কতটা ভালো মানুষ, তা–ও আমার জানা আছে।’

আমি বলি, ‘মুখলেস সাহেব আপনাকে দেখেই বোঝা যায় আপনি খুব ভালো মানুষ। তা আমার খুব তাড়া ছিল, মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করার।’
মুখলেস মিয়া টেবিলের ওপর রেজিস্টার খাতায় আমার নাম–ঠিকানা লিখতে বলে। আমি লিখে ওপরে চলে আসি। পাঁচতলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অফিস। নিচে অবশ্যই দুই সিকিউরিটির ঝগড়া চলমান আছে। চলুক তর্ক। মন্ত্রীর অফিসের সিকিউরিটি। সারা দিন বসে থাকার কাজ। মাঝে মাঝে কোনো একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে কথা বলবে, ঝগড়া করবে, এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। পাঁচতলাতে চলে এলাম। এখানেও একজন সিকিউরিটি বসে আছে। আমাকে দেখে বললেন, ‘কে আপনি?’
১, ২ এখন আবার ৩ নম্বর। এই সিকিউরিটির ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। আর তাই আমি বলে উঠি, ‘আমি মন্ত্রী সোহরাব খানের ভাইগ্না। আচ্ছা আপনারা কী করুন বলুন তো। নিচে দুই সিকিউরিটি ঝগড়া করছে। যান গিয়ে ওদের থামান।’
এই সিকিউরিটির পোশাকে নাম লেখা নেই। তাই তার নাম জানা হলো না। সিকিউরিটি বিস্মিত হয়ে বলে, ‘কী বলছেন?’
‘যা বলছি সত্যি বলছি, যান নিচে গিয়ে দেখুন। তা না হলে কিন্তু আমি মামাকে বলে সকলের চাকরি নট করে দেব।’

সিকিউরিটি নিচে চলে গেল। মন্ত্রীর অফিসের সামনে চলে আসি। কতটা গেট পার হয়ে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হয়। তা সাধারণ মানুষের অজানা। অথচ এই সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পেয়ে হয় একজন মন্ত্রী হয়। আর মন্ত্রী হওয়ার পর সাধারণ মানুষকে ভুলে যায় এই ওপরের লোকগুলো। এই হচ্ছে আমাদের দেশের পরিস্থিতি।
দরজার সামনে দুপাশে দুটি ফুলের টব আছে। পাতাগুলো কত পরিষ্কার। সবুজ আর সবুজ। সবুজের মাঝে আছে ফুটন্ত রঙ্গন ফুল। দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। সুন্দর হবে না, মন্ত্রীর অফিস বলে কথা। দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল মাঝ বয়সী এক সুন্দরী নারী। কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে আছে। ব্লাউজটাও হালকা সবুজ। কিন্তু লিপস্টিক পরেছে খয়েরি। লিপস্টিকের কালার কি সবুজ কিংবা কলাপাতার রঙের নেই নাকি। ইচ্ছা করছে এখনই বলে ফেলি, যে লিপস্টিকের কালার কি গ্রিন পাওয়া গেল না। না সেটা বলা ঠিক হবে না। তবে নারী পেটের অংশ বেশ দেখা যাচ্ছে। থাক আর সামনে না আগানোটায় ভালো। আমি বললাম, ‘মন্ত্রী মহোদয় কোথায়?’
নারীর হাতে কিছু কাগজপত্র ছিল। আমার দিকে তাকাতে, তার হাত থেকে একটা ফাইল নিচে পড়ে গেল। কেন ফাইলটা পড়ে গেল সেটা বুঝতে পারছি না। হয়তো সে অন্য মনস্ক ছিল। তিনি নিচে থেকে ফাইল তুলতে গেলে, তার বুকের ওপর থেকে আঁচলটা সরে যায়। তারপরের দৃশ্য সেটা ব্যাখ্যা না করলেও চলবে। তবে বাংলা সিনেমাতে এমন দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বাজে নারী কণ্ঠে এক কামনাময়ী সুর।

হাইও মাইও লালা হো হো শব্দ হয়। ভিলেন কিংবা সাইড ভিলেন হলে, চোখ বড় বড় করে তাকায়, দাঁতে ঠোঁট কাটে। সেই দৃশ্যটুকু ক্লোজে দেখানো হয়। অভিনেত্রী স্লো-মোশনে আঁচলটা তোলে বুকের ওপর দিয়ে কাঁধে রাখে। সেই সঙ্গে চুলগুলো বাতাসের সঙ্গে খানিকটা উড়ে বেড়ায়। ভদ্রমহিলা নিজের কাপড় ঠিক করে আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম, ‘কেমন আছেন?’
অতি সহজ সরল উক্তি। যেন ইনাকে আমি চিনি। আগেও কথা হয়েছে। ভদ্রমহিলা বলল, ‘কে আপনি?’
‘আমি মুরাদ। আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে এসেছি।’
‘উনি তো এখন ব্যস্ত।’

‘উনি ব্যস্ত তাতে আমার কিছু আসে যায় না। ওনাকে বলুন আমি একটা ফাইল ওনার কাছে দিয়ে চলে যাব। তা ছাড়া আমিও কম ব্যস্ত নই।’
আমার কথা শোনে ভদ্রমহিলা বলে, ‘ফাইলটা আমার কাছে দেন।’

‘না আপনাকে দেওয়া যাবে না। আমি নিজে দেব।’
‘ওকে, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন আমি আসছি।’
মহিলা যাওয়ার আগে সোহরাব খান চলে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি, রুমেলের বন্ধু না?’
‘জি, আমার নাম মুরাদ।’

‘মুরাদ, হুম...। আগেও একবার তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে। এসো ভেতরে এসো।’
সোহরাব খানের মনটা আজ ফুরফুরে আছে। মুখে হাসি লেগেই আছে। আমি মন থেকে সোহরাব খানকে খুব একটা পছন্দ করি না। তবে আজকে তার হাসি মুখটা দেখে কেন জানি আমার খুব ভালো লাগছে। আমি বসে আছি সোহরাব খানের সামনে। সোহরাব খানের একটা ফোন এসেছে। সে ফোনে কথা বলছে। আমি অফিসকক্ষটা চোখ ঘুরিয়ে দেখছি। কত সুন্দর রুম। মাথার ওপর দেয়ালে সাঁটানো আছে জাতীয় নেতার ছবি। তার পাশে প্রধানমন্ত্রীর ছবি। একপাশে আলমারিতে অনেকগুলো ফাইলের স্তূপ। তার পাশে আছে ছোট্ট একটা চারাগাছ। পাতাগুলো কত সতেজ।

আরও পড়ুন

টেবিলের একপাশে একটা ফটো অ্যালবাম ফ্রেম আছে। তিনটা ছবি দেখা যাচ্ছে। সোহরাব খান, একটা ইয়াং বয় ও একটা কিশোরীর ছবি। ফোনে কথা শেষ করে সোহরাব খান বলে ওঠে, ‘তারপর বল, তুমি কেমন আছ?’
সোহরাব খান আমাকে একটু বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। সেটা বুঝতে পারছি। তবে এর একটা কারণ তো নিশ্চয় আছে। যাহোক, আমি ফাইলটা সোহরাব খানের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘আমি ভালো আছি।’
‘শোন, আমি তোমার সম্পর্কে জানি। রুমেলের কাছ থেকে তোমার অনেক কথা শুনেছি। আর এটাও জানি তুমি খুব একটা সহজ মানুষ নও।’
‘এই পৃথিবীতে মানুষ সহজ আবার মানুষই কঠিন। সেটা প্রমাণ হয় স্থানকালের ওপর নির্ভর করে।’

মন্ত্রী সাহেবের মুখে আর হাসি নেই। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার কথা অল্প হলেও বুঝতে পারছি। তবে তুমি বোধ হয় নিজেকে খুব বেশি চালাক মনে করো। কিন্তু তুমি বোধ হয় জান না, যারা নিজেকে খুব বেশি চালাক মনে করে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করে!’
‘আমি নিজেকে চালাক মনে করি বা বোকা মনে করি, সেটা ভাবার বিষয় আপনার না।’
‘তুমি কি রেগে যাচ্ছ?’
‘না।’
‘কেন, তোমার মধ্যে কি রাগ নেই?’
‘থাকবে না কেন, অবশ্যই রাগ আছে।’
‘কথায় আছে, রেগে গেলে তো হেরে গেলে।’

বুঝতে পারছি, সোহরাব খান আমার সঙ্গে মজা নিচ্ছে। তাই আমি বলে উঠি, ‘আপনার সঙ্গে আমি বেশি কথা বলতে চাই না।’
‘আচ্ছা বাদ দাও, আমি তোমার সঙ্গে তর্কে যেতে চাই না।’

আমি চুপ করে বসে আছি। কিছু বলছি না। সোহরাব খান আরও কিছু কথা বলবে, সেটা বুঝতে পারছি। সোহরাব খান আবার বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
‘জি বলুন, মিস্টার সোহরাব...
কথাটা শেষ করার আগে তিনি বলে উঠলেন, ‘বেয়াদবি করবে না। তুমি রুমেলের বন্ধু। রুমেল আমার ভাগনে হয়, তার মানে তুমিও আমার ভাগনে। তুমি আমাকে মামা বলে সম্বোধন করবে।’
‘জি মামা।’
‘এবার বল কী বলবে?’
‘আচ্ছা মামা আপনার রুমে কী, সিসি ক্যামেরা আছে?’
‘না, রুমে নেই। বাইরে আছে। কেন বল তো?’
‘থাকার দরকার কী, সিসি ক্যামেরা থাকলে তো আর সুন্দরী সেক্রেটারির খোলামেলা দেহটা দেখা যাবে না!’
মামা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি বলছ কী, এই কথার মানে কী?’
আমি একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলি, ‘না বোঝার ভান করবেন না মন্ত্রী সাহেব।

আপনাদের আমার চেনা আছে। প্রতিনিয়ত সকাল দুপুর বিকেলে সুন্দরীর সেক্রেটারির আঁচল সরিয়ে বুক দেখবেন। আর রাতে..। থাক সেদিকে আর গেলাম না।’
সোহরাব খানের মুখটা লাল হয়ে যায়। রেগে গিয়ে বলে, ‘ছিঃ মুরাদ ছিঃ... তুমি তো আস্ত একটা স্টুপিড।’

প্রতীকী ছবি

‘এই মিয়া রাখেন আপনার ডায়ালগ! আপনি যে কাজটা প্রতিদিন করেন, প্রতিদিন দেখেন, আর আমি সেটা একবার বলেছি বলে আমি স্টুপিড!’
‘বেয়াদবি করবে না বলে দিচ্ছি। আমি কিন্তু এখন...
‘কী করবেন? পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবেন। ডাকুন পুলিশ! তারাও জানুক মন্ত্রী সাহেবের আসল চেহারা।’
অল্প সময়ের ব্যবধানে সোহরাব খানের মুখটা মলিন হয়ে যায়।

কপাল দিয়ে গাম ঝরছে। পানি খেতে গিয়ে হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে যায়। ফ্লোরের ওপর পড়তেই গ্লাসটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। গ্লাসের শব্দ শোনে এক দৌড়ে সেক্রেটারি (মহিলা) চলে আসে। আমি বসে আছি। বলছে, ‘স্যার কী হয়েছে?’
অমনি সোহরাব খান বলে, ‘কিছু হয়নি, শিখা রানী তুমি এখন যাও, পরে এসো।’
আমি বললাম, ‘যাবে কেন? তিনিও থাকুক। যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সে থাকলে ভালো হয় না! কী বলেন?’
শিখা বলল, ‘আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে মানে, কী কথা?’
আমি বললাম, ‘তার আগে বলুন, আপনি মিস না মিসেস?’
‘সরি!’
‘এত দুঃখিত হওয়ার কিছু নাই। আমি যা বলছি তার উত্তর দেন।’
‘আমি শিখা রানী দাস।’

‘ও আচ্ছা, কলাগাছের মালিকও আছে দেখছি! তাহলে তো বাদুড়ের চিন্তা নেই! ওকে চালিয়ে যান। মামা আমি কী চলে যাব নাকি থাকব?’
সোহরাব খান আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোকে আমি এমন সায়েস্তা করব, হাড়ে হাড়ে টের পাবি।’

‘অত ভাব লয়েন না, এই দেখুন ওপরে, রুমের কোনায় সিসি ক্যামেরা ফিট আছে। এটাতে সবকিছু রেকর্ড আছে।’

সোহরাব খান অবাক হয়ে তাকায় সিসি ক্যামেরার দিকে। আর ভাবছেন আসলেই তো। তারপর মাথাটা টেবিলের ওপর নিচু করে।

শিখা রানী একটু নিচু হয়ে সোহরাব খানের মাথা ধরে বলে, ‘স্যার আপনি ঠিক আছেন তো?’
অমনি শিখা রানীর শাড়ির আঁচলটা পড়ে যায়। সোহরাব খান শিখা রানীর দিকে না তাকিয়ে, তাকায় আমার দিকে। আমি হেসে বলি, ‘শিখা রানী মেডাম, আপনি আপনার স্যারকে কলাপাতা সরিয়ে কলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। দেখবেন সবঠিক হয়ে গেছে!’
শিখা রানী সুন্দর মুখটা কালো হয়ে যায়। লাল চোখে আমাকে গিলে খাবে এমন অবস্থা। তিনি আঁচল ঠিক করবেন, নাকি আমাকে দমক দেবেন সেটা ভেবে পাচ্ছে না। আমি আবার বলি, ‘সুন্দরী শিখা রানী ম্যাডাম, এভাবে কোনো নারীরা শাড়ি পরেন না। এখন থেকে সেফটিপিন ব্যবহার করবেন। আপনাদের সম্পর্ক আছে, থাকুক এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তাই অফিসে এসব নয়।’

হাইপ্রেশারের মানুষ সোহরাব খান। শারীরিক অবস্থাটা ঠিক এই মুহূর্তে ভালো ঠেকছে না। তাকে আর ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। আমি আর কথা বাড়ালাম না। সোহরাব খানের উদ্দেশে বললাম, ‘মামা এবার বুঝতে পেরেছেন কে চালাক আর কে বোকা। শুনেন সিসি ক্যামেরা আছে ঠিকই। কিন্তু ভালো করে চেয়ে দেখুন সিসি ক্যামেরার কেব্‌ল কাটা আছে।’

মন্ত্রীর রুম থেকে বাইরে চলে এলাম। পেছনে দেখি শিখা রানীও এসেছে। আমি তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না। আমি শুধু বললাম, ‘জীবন কখনো আগুন, জীবন কখনো ফাগুন। এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা।’
নিচ দিয়ে হেঁটে প্রথম গেটের সামনে এসে দেখি রহিম মিয়া বসে ঝিমাচ্ছে। আমি ডাক দিলাম। রহিম মিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি কে? আপনারা তো চিনলাম না।’

‘একটু আগে না আপনারে দুই শ টাকা ঘুষ দিছিলাম, মনে নেই বুঝি।’
রহিম মিয়া চোখ বড় করে বলে, ‘আপনি যে কত বড় টাউটার সেটা আমি বুঝতে পারছি।’

আমি চোখ বড় করে কড়া করে দমক দিয়ে বলি, ‘এই মিয়া টাকা দুই শ দিবা কি না সেটা বলো, তোমার মন্ত্রী বাবারে কিন্তু খবর কইরা দিছি।’
এক দমকে কাঁদো কাঁদো গলায় রহিম মিয়া বলে, ‘আমার কাছে এত টাকা নাই।’
‘কত আছে?’
রহিম পকেটে হাত দিয়ে দেখে চারটা দশ টাকার নোট আছে। আমি তিনটা নোট নিয়ে চলে আসি।

রহিম মিয়া গেটের ভেতর থেকে বাইরে বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হাঁটছি। রহিম মিয়া ভাবছে, মানুষ কত খারাপ হয়। দুনিয়ার যত খারাপ মন্তব্য আছে, সে আমাকে নিয়ে ভাববে। তার দৃষ্টিতে খারাপ মানুষের তালিকায় আমি হব এক নম্বর। মোবাইলে অনেকগুলো মিসডকল দেখা যাচ্ছে। রুমেল কল করেছিল। আলোও কল করেছিল। আলোর একটা বার্তা আছে। বাহ অনেক সুন্দর লেখা। লেখাটা অনেকটা বড়সড়। একটা রিলাক্সের জায়গায় বসে লেখাটা পড়লে মন্দ হয় না। পকেটে টাকা আছে ত্রিশটা। পেটে খিদে আছে। খিদে নিয়ে হাঁটার তেমন মজা নেই। আশপাশে কোনো হোটেল দেখছি না। একটু হাঁটি। এর মধ্যে হোটেল পেয়ে যাব। সময় তো কম হয়নি। চারটা বাজে প্রায়। সেই সকালে একটি চা সঙ্গে দুটো লবণাক্ত বিস্কুট খেয়েছি। পাকস্থলী জানান দিচ্ছে, আমাকে আহার দাও। ঝিলমিলের ফোন এল। রিসিভ করব কি না? না এখন করা যাবে না। আগে আলোর লেখাটা পড়ে নিতে হবে। কত দিন মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয় না। আলোর জন্য মনটা কেন জানি ব্যাকুল হয়ে আছে। তাকে দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু সে তো ছলনাময়ী। দেখতে চাইলে দেখা দেয় না। এ যে কতটা যাতনাদায়ক। তা বোঝানো দায়। সামনে একটা ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে। ডাক দিলাম। ঝালমুড়ি বিক্রেতা একগাল হেসে বলে, ‘মামা শেষ।’

প্রতীকী ছবি
ছবি: সুমন ইউসুফ

‘মানে কী?’
ঝালমুড়ি বিক্রেতা আবারও হেসে বলে, ‘মামা ঝালমুড়ি নাই।’
দমক দিয়ে বললাম, ‘নাই তাহলে দাঁত খিলিয়ে হাসছিস কেন?’
যুবক বয়সী ঝালমুড়ি বিক্রেতার মুখটা মলিন হয়ে যায়। আসলে আমি বোধ হয় দমক দিয়ে কথা বলাটা ঠিক করিনি। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো মানুষের মুখের হাসি। আর সেই হাসিমাখা মুখটা কিনা মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল। আমি তাকে বলি, ‘কিছুই নাই?’
‘ছোলা বুট মসলা শেষ। শুধু মুড়ি আছে।’

‘দে মুড়িই দে। পেটে অনেক খিদে আছে।’
‘ভাইজান অল্প একটু চানাচুর আছে দেব কি?’
‘দে।’
আমি বললাম, ‘কত টাকা দেব?’
‘পাঁচ টাকা দিলেই হবে। এই নেন কাঁচা মরিচ দিয়ে খান ভালো লাগব।’
‘এই তো দেখি সবই আছে। আর তুই কি-না বললে, কিছুই নাই।’
‘কী যে কন ভাই, ছোলা বুট মসলা তেল ছাড়া কি ঝালমুড়ি হয়।’
‘ঘুগনি দিস না।’

‘মাঝে মাঝে ঘুগনি দিয়ে বানায়। ঘুগনির মজা সবাই বুঝে না। তয় পুরান টাউনে ঘুগনি ছাড়া চলে না।’

আমি চানাচুরমিশ্রিত মুড়ি কাঁচা মরিচ দিয়ে খাচ্ছি আর ছেলেটাকে বলছি, ‘একদিন ঘুগনি দিয়ে ঝালমুড়ি বানিয়ে দিস তো। তোর হাতের ঝালমুড়ি একদিন খাব।’
ছেলেটা হাসিমুখে বলে, ‘আচ্ছা ভাইজান। কিন্তু আমি আপনারে পাব কই?’
‘চিন্তা করিস না। আমিও পুরান টাউনে থাকি। তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে।’
‘আচ্ছা ভাইজান।’

‘আজকের দিনে তোর কত টাকা ইনকাম হয়ছে?’
‘এই চার–পাঁচ শ তো হবেই।’
‘ভালোই তো পুঁজি কম, আয় বেশি। পরিবারে কে কে আছে?’
‘কেউ নেই ভাই।’
‘বিয়ে করবি না?’
‘করব।’
‘তা পছন্দ আছে নাকি?’
ছেলেটার মুখে একটা অনুরাগের হাসি ফুটে উঠেছে। তার মানে সে একজনকে ভালোবাসে। তাকে কাছে পেতে চায়। এটাই তো স্বাভাবিক, যাকে ভালোবাসে, তাকে কাছে পেতে কে না চায়। আমি হাসি মুখে ছেলেটার কাছ থেকে চলে এলাম। হাঁটছি আর মুড়ি খাচ্ছি। ভালোই লাগছে।

আলো লিখেছে,
মুরাদ আমি জানি তুমি ভালো আছ। মাঝে মাঝে যখন তোমার কথা ভাবি, তখন তোমাকে না, বড্ড বেশি আপন আপন লাগে। ইচ্ছা করে পাখির মতো উড়ে তোমার কাছে চলে আসি। বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে তোমাকে দেখতে খুব বেশি ইচ্ছা হচ্ছে। জানি তোমার কাছে আমি একজন ছলনাময়ী। আর এইও জানি অল্প অল্প করে হলেও তুমি আমাকে ভালোবাস। আজকে একটা অনুরোধ করব, জানি আমার অনুরোধ তোমার কাছে তেমন কিছু না। তারপর আজকের শেষ বিকেলটা আমি টিএসসিতে তোমার অপেক্ষাতে থাকব। ইচ্ছা হলে তুমি এসো। আমি শাড়ি পরেছি। কেন জানি পরতে ইচ্ছা হলো। কেন জানি মনে হলো, শাড়ি তোমার খুব পছন্দ। তুমি আসবে তো?
ইতি
তোমার ছলনাময়ী (আলো)
পৃথিবীর মানুষগুলোর সব অনুরোধ রাখতে নেই। আবার কিছু কিছু অনুরোধ রাখতেও হয়। আলোর অনুরোধটুকু না রাখলে প্রকৃতি অখুশি হবে। আমারও তো দেখতে বেশ ইচ্ছা হচ্ছে আলোকে। আমিও তো প্রকৃতিরই একটা অংশ। আলোর নিমন্ত্রণে আলোকে না দেখে যেন শত দেখার আনন্দ আমার মাঝে ভর করছে।

প্রথম যেদিন আলোকে দেখি, সেদিনের কথা মনে হলে বিস্মিত হতে হয়। অথচ সেদিনই একজন ছলনাময়ীর সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ বিকেলে শেষ প্রান্তে এসে বাংলা একাডেমির ভেতরে বসে আছি।

পাশে ছিল কালো ড্রেস, কালো চশমা পরা ডায়না নামে পরিচয় দেওয়া এই আলো। সেদিন আমার সামনে আসার কথা ছিল শাড়ি পরে। অথচ সে এসেছিল ছলনাময়ী হয়ে। প্রথম দেখাতে তাকে চিনতে পেরেছিলাম বটে। সে বলেছিল, আজ আলো আসবে না। অথচ কিছুটা সময় পরে সেই আমার পছন্দের শাড়ি পরে এসেছিল। আমি তার রূপ দেখে যতটা না অবাক হয়েছি, তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম অন্য কিছু ভেবে। যে আলোকে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, সে আমার বিশ্বাসের আলো নয়। আমি একজন ছলনাময়ীকে দেখছিলাম। যার দেহে লেগে আছে অন্য পুরুষের স্পর্শ। বুকের ওপরের একটা পাশে খানিকটা লাল রক্তের জমাট দেখা যাচ্ছে।
আজ সেই ছলনাময়ীকে দেখতে মনটা বেশ আনচান করছে। আমিও শহীদ মিনারে কাছাকাছি আছি। টিএসসিতে হেঁটে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তাই হাঁটছি আর ভাবছি, আজ কোনো ছলনাময়ী নয়, আজ একটা চাঁদনী রাতে ঝলমলে আলোকে দেখতে পাব। যে আলোর স্পর্শে আলোকিত হবে আমার এই মন। আমি হব এই পৃথিবীর বুকে সেরা সুখী মানুষ। আলোর মায়াবী চোখে চোখ রেখে গেয়ে উঠব কবি নজরুলের সেই সংগীত,
‘মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর
নয়নের সেই সাধ।
তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
সেকি মোর অপরাধ?’

লেখক: এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর