ছলনাময়ী-৯

ট্রেনে বসে আছি। পাশে আছে ঝিলমিল। অনেক দিন পার গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। মা অসুস্থ। খবরটা ঝিলমিল দিয়েছে। জানালার পাশের সিটে ঝিলমিল বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। ঝিলমিল বলে উঠল, ‘দ্যাখো দ্যাখো কত সুন্দর দৃশ্য।’

আমার দেখার ইচ্ছে হচ্ছে না। ঝিলমিলের কথা শুনে মাথার ভেতর কেমন জানি লাগছে। নিজের মধ্যে খানিকটা অপরাধ বোধ করছি। মায়ের সঙ্গে আমি কোনো কথা বলিনি। কেন জানি এটাও মনে হচ্ছে, মা কি সত্যিই অসুস্থ? যা-ই হোক, মায়ের কথা হয়েছে ঝিলমিলের সঙ্গে। ঝিলমিল তার ভাইয়ের মেয়ে। কথা হতেই পারে। ভাইজি বলে কথা। কিন্তু আমার কিছুই ভালো লাগছে না। এদিকে ঝিলমিল শুরুতে অল্প অল্প করে কথা বলত। এখন মুখে মুড়ি ভাজা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

‘কত দিন পর গাঁয়ে যাচ্ছি। কত দিন পর ফুফি-ফুফাকে দেখব। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। আচ্ছা মুরাদ ভাই, তোমাদের বাড়ির পেছনে পুকুরটা কী এখনো আছে? নাকি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের অনেক নিউজ দেখা হয়। এর মধ্যে যখন দেখি বাংলাদেশের নদী ভরাট হচ্ছে, পুকুর ভরাট হচ্ছে, যা দেখে মনটা বেজার হয়ে যায়। আগের মতো কী বর্ষাকালে তোমাদের বাড়ির পেছনে পানি আসে? বর্ষার নতুন পানির আগমনে মনটা কত খুশি খুশি লাগত।’
পৃথিবীতে একটা বস্তু দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে না। সেটা হলো মিথ্যে কথা। ঝিলমিল আমার সঙ্গে মিথ্যে বলেছে। আসলে আমার মায়ের কোনো অসুখ হয়নি। ঝিলমিলের হাসিমুখ সেটা প্রমাণ করে। জানালার ওপরে ইমার্জেন্সি ট্রেন থামানোর চেইনটার দিকে তাকিয়ে আছি। ইচ্ছে করলে ঠিক এই মুহূর্তে চেইন টান দিয়ে ট্রেন দাঁড় করাতে পারি। নেমেও যেতে পারি। কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। কিছু না বলে ঝিলমিলের ওপর নির্ভর করে আছি, দেখি কী হয়। কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠেছি সকাল ৯টায়। নরসিংদী পেরিয়ে ভৈরবের কাছাকাছি চলে এসেছি। কুলিয়ারচর রেলস্টেশনে নেমে যাব। সেটা ভেবে ভালোই লাগছে। ঝিলমিল আর কোনো কথা বলছে না। একেবারে চুপ। মনে হয় ঘুম আসছে। আসবেই তো। বেশি কথা বললে শরীরে ক্লান্তি আসে। ক্লান্তি এলে শরীর বিশ্রাম চায়। ঝিলমিল ঝিমাচ্ছে। আমি চোখ বুজে মাকে কল্পনা করছি। কত দিন দেখি না মায়ের মুখ। এ শিরোনামে একটা গান আছে। গেয়েছেন খালিদ হাসান মিলু। এ মুহূর্তে গানটা শুনতে পারলে খুব বেশি ভালো লাগত। মনে মনেও গান শোনা যায়। চেষ্টা করছি, গানের লাইনগুলো মাথাতে আনতে। কিন্তু আসতে চাইছে না। মায়ের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বাড়ির পাশে আমের ডালে কালো কোকিলের কুহু ডাক কানে আসছে। বাহ্‌, এখন তো দেখছি গানের লাইনটাও মাথায় চলে এসেছে।
কত দিন দেহি না মায়ের মুখ,
হুনি না সেই কোকিল নামের কালা পাহির গান,
হায় রে পরান, হায় রে পরান।
হায় রে আমার গাঁয়ের বাড়ি, সারি সারি গরুর গাড়ি,
মরা নদীর চর।
দিঘির জলে হাঁসের খেলা, ঘরের চালে দুপুরবেলা,
রঙ্গিলা কইতর।
উঠানে চড়াই না সোনার ধান,
হায়..হায় রে পরান, হায় রে পরান....
কী চমৎকার গান। একেবারে গ্রামবাংলার প্রতিচ্ছবি ফোটে উঠেছে। গানটি শেষ করার আগেই ঝিলমিল বলে ওঠে, ‘মুরাদ ভাই, তুমি কী ঘুমাচ্ছ?’
আমি তাকালাম। ঝিলমিলের হাসিমুখ। সামনে একটা কিশোর বয়সের ছেলে শসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিলমিল শসা খাবে। আমি ছেলেটাকে বললাম, ‘কি ব্যাপার, শসা বিক্রির নামে সুন্দরী মেয়ে দেখা হচ্ছে বুঝি।’
অমনি আস্তে একটা থাপ্পড় মারল ঝিলমিল। বলল, ‘ফাইজলামি করবে না বলে দিচ্ছি। আমি শসা খাব।’
‘তা খাও না। এই ব্যাটা একটা শসা দে তো?’
‘একটা কেন? তুমি খাবে না?’
‘না আমি খাব না।’
‘তাহলে আমিও খাব না।’
‘ও আচ্ছা, সে কথা। আচ্ছা, ওই ব্যাটা চারটা শসা দে।’
ছোট ছোট চারটা শসা পিছ পিছ করে কেটে একটা কাগজের মধ্যে দিল। ঝিলমিল বলে, ‘প্রথমে খাবে না, এখন চারটা শসা!’
‘শসা আমার পছন্দের খাবার তালিকায় অন্যতম। তাই চারটে নিলাম। তুমি দুটো আমি দুটো।’

ঝিলমিল আর আমি শসা খেতে খেতে কুলিয়ারচর রেলস্টেশনে চলে এলাম। এখনই ট্রেন থামল বলে। ট্রেন থেকে নেমে একটা রিকশা নিলাম। সোজা চলে এলাম আমাদের বাড়ির সামনে।
দুপুর হয়ে এল। ঝিলমিল বুদ্ধি আঁটে। ও আগে আমার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। দেখবে মা ঝিলমিলকে চেনে কি না। আমি বলতে চেয়েছিলাম, অসুস্থ মানুষের সঙ্গে এমন করাটা কী ঠিক হবে? পেটে এলেও মুখে এল না। থাক ও ওর মতো করে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াক। এটা ওর ব্যাপার। আমি একটু দূরেই আছি। ঝিলমিল বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। মা ঝিলমিলকে দেখে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। ঝিলমিলের হাসিমুখ। বাট ঝিলমিল কিছু বলছে না। আমি একটু আড়াল থেকে দেখছি। মা বলছে, ‘তুমি কে মা?’
ঝিলমিল হাসতে হাসতে বলে, ‘তুমি গেস করো তো আমি কে?’
মা আর কিছু বলছে না। শুধু ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আর দেরি না করে মায়ের সামনে চলে এলাম। মা আমাকে দেখে বলে, ‘মুরাদ..! বাবা তুই এসেছিস।’
বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। মায়েদের চোখের পানি এমনই। আমি বললাম, ‘কান্নার কী আছে! আমি তো ভালো আছি।’
‘তোর কী হয়েছে বাবা? তুই শুকিয়ে গেছিস।’
এ পৃথিবীতে একটা মাত্র জায়গা আছে, যেখানে আশার চেয়ে ভরসা বেশি। সেই জায়গাটা হলো জননীর বুক। আমি কাঁদতে চাই না। তারপরও জননীর স্পর্শ, স্নেহময় আদরে সিক্ত হয়ে চোখে অশ্রু টলমল করছে। বুঝি চোখের পাতা ফেললেই গড়িয়ে পানি পড়বে। আমি নিজেকে শক্ত রেখে মাকে বললাম, ‘এত কেঁদো না তো, তোমার কান্না দেখতে কী আমরা আসছি?’
মা আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে। ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে উচ্চ কণ্ঠে ডাক দেয়, ‘এ মরিয়ম, লিজা তোরা কোথায়? তাড়াতাড়ি আয়। এই মুরাদ তুই ওরে নিয়ে ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোথাও যাবে না, ঠিক আছে?’
আমি মাকে কিছু বলতে চাইলে মা না শোনে চলে যায়। মাকে আটকাতে চাইলে ঝিলমিল আমাকে ধরে ফেলে। ইশারায় না-বোধক ইঙ্গিত দেয়। আমি বললাম, ‘তুমি আমাকে আটকাচ্ছ কেন?’
ঝিলমিল হাসিমুখে আস্তে করে বলে, ‘দেখি না ফুফি কী করে?’
এরই মধ্যে মরিয়ম, লিজা ও মা কোলার মধ্যে ধান-দূর্বাঘাস নিয়ে হাজির। আমি অবাক হয়ে মাকে বললাম, ‘এই কী করছ মা?’
মা বলে, ‘নতুন বউকে বরণ করছি। এত সুন্দর একটা বউ তোর জন্য খোঁজছিলাম।’
‘মা তুমি ভুল করছ। ও তোমার ছেলের বউ না। ও তোমার ভাইজি। শফিক মামার মেয়ে ঝিলমিল।’

মায়ের ভুরু কুঁচকে যায়। বরণডালা মরিয়মের হাতে দিয়ে ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে আসে। ঝিলমিলের মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘তুই আমার শফিকের মেয়ে। আমার কলিজার টুকরো। আয় মা, আমার বুকে আয়।’
মা ঝিলমিলকে জড়িয়ে ধরে আবার শুরু করল কান্না। এ কান্না থামার কান্না নয়। অঝোরে ঝরছে পানি। এই পৃথিবীতে যত নদী, সাগর, সমুদ্রর পানি আছে, সেই পানি শেষ হতে পারে, কিন্তু মায়ের চোখের পানি কখনো শেষ হবে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ঝিলমিলের চোখ দিয়েও অশ্রু ঝরছে। ঝরবেই তো। এ তো রক্তের সম্পর্ক। আপন ছোট ভাইয়ের মেয়ে বলে কথা। মা মরিয়মের হাত থেকে বরণডালা নিয়ে ঝিলমিলের মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে বরণ করে। মরিয়ম আমার ছোট বোন আর লিজা খালাত বোন। মরিয়মের উচ্চমাধ্যমিক শেষ। লিজার মাধ্যমিক শেষ। দুজনে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। ঝিলমিল এদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটাতে পারবে। সেটা ভেবে ভালো লাগছে। বাবা বাড়িতে নেই। বাবাকে দেখতে মন চাইছে। মা বলল, বাজারে গেছে। আসতে দেরি হবে। আমি ভাবলাম, ছয়সূতী এলাকাটা একটু ঘুরে দেখি।
আমি ছোট সময় থেকে কেমন জানি। খুব বেশি বন্ধুবান্ধব নেই আমার। তবে সবুজ আর কালাম নামে দুজনের সঙ্গে অল্প অল্প কথা হতো। দেখি, তাদের সঙ্গে দেখা হয় কি না। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দেখতে বেশ ভালো লাগছে। এমন একটা মেঠো পথ দেখে হয়তো কবিগুরু লিপিবদ্ধ করেছিলেন সেই মন ভুলানো সংগীত।
‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে।
ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে যায় ধুলায় রে।
আমার মন ভুলায় রে...’
পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিলাম। গ্রামের কিছু চিত্র ধারণ করব বলে। এখন দুপুরবেলা। এই সময় খরতাপের তীব্রতা প্রখর থাকে। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে থাকে। গ্রামের বিকেল বা সন্ধ্যাটা দারুণ লাগে। ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। দেখতে খুব ভালো লাগে। মোবাইলে ছবি তোলা হলো না। দুপুরবেলা প্রকৃতি তার রূপ প্রকাশ করে না। বিকেলে প্রকৃতি নিজেকে সতেজ করে তোলে নব উদ্যমে। কাউকে দেখছি না। আমি বরং বাড়ির দিকে যাই। একটু বিশ্রাম নিলে ভালো লাগবে।
শুয়ে আছি। রাত বাজে ৯টা। মরিয়ম ডাকছে। রাতের খাবার খেতে হবে। আমি খেতে চলে এলাম। ঘরের মেঝেতে পাটি বিছানো হয়েছে। পাটিতে বসে আছে লিজা, ঝিলমিল ও মরিয়ম। ঝিলমিলের পাশে জায়গা খালি আছে। আমাকে বসতে হবে ঝিলমিলের পাশে। মা খাবার রেডি করছে। মনে হচ্ছে হরেক রকমের আইটেম আছে। আমি মাকে বলেছিলাম আমাদের সঙ্গে বসার জন্য। মা না-বোধক মাথা নাড়াল। বুঝতে পারলাম, খাবার পরিবেশনের দায়িত্বটা পালন করতে হবে। মা প্লেটগুলো দিচ্ছে আর বলছে, ‘মুরাদ তুই জানিস, আজ যে আমার কত আনন্দ লাগছে?’
‘না বললে জানব কী করে, আগে বলো?’
মরিয়ম হেসে বলে ওঠে, ‘ভাইয়া কথা পেঁচাবে না বলে দিচ্ছি। ঝিলমিল এসেছে, তুইও কত দিন পরে এলি, বাবা আজ বাজার থেকে বড় ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে। ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ। সঙ্গে ছোট মাছও এনেছে। আরও কত কী এনেছে। আর সেসব মা আজ নিজের হাতে রান্না করেছে। মায়ের মনে যে কত আনন্দ হচ্ছে, সেটা আমি বুঝি, তুইও বুঝিস।’
‘আমি বুঝতে পারছি, বোন আমার অনেক কিছু বোঝে। আচ্ছা, আর কী কী বুঝিস একটু বল আমায়।’
মরিয়ম হেসে ওঠে। সেই সঙ্গে লিজাও হাসছে। শুধু ঝিলমিল তাকিয়ে আছে। লিজা বলে, ‘মুরাদ ভাই তুমি না একটা...’
‘ব্যাস, এইটুকু বলেই আটকে গেলি। শোন, আমার সঙ্গে চালাকি করবি না। তোদের মতো মেয়েদের আমার চেনা আছে।’
লিজা ভুরু কুঁচকে বলে, ‘ও আচ্ছা, ইদানীং তাহলে মেয়েমানুষ চেনা হচ্ছে খুব। তলে তলে টেম্পো চালানো হচ্ছে বুঝি।’

‘আমি কোনো কিছুই তলে তলে চালাই না। আমি যাহাই চালাই, প্রকাশ্যে চালাই।’
মরিয়ম বলে উঠল, ‘ভাইয়া তোর ছলনাময়ীর কী খবর?’
এখন আমার ভুরু কুঁচকে গেল। বলে কী মরিয়ম। ছলনাময়ী মানে? এই কথা তো আমি ছাড়া আর কেউ জানার কথা না। ঝিলমিল বলে ওঠে, ‘ছলনাময়ী! Who is she?’
সবার সামনে ভাতের প্লেট চলে এসেছে। মা নিজের হাতে সবাইকে তরকারি দিচ্ছে। ‘কথা বলা একদম নিষেধ। যা কথা হবে, খাবারের পর হবে। এখন চুপচাপ খেয়ে নাও।’ মায়ের কথা শোনে আমরা সবাই চুপ। বাবাকে ডাকা হলো। বাবাও আমাদের সঙ্গে খেতে বসেছে। বাবা বলল, ‘তা ঢাকাতে কী করছিস মুরাদ?’
‘মা বলছে খাওয়ার সময় কথা না বলার জন্য।’
অমনি মা বলে উঠল, ‘ঠিক বলেছি। খাওয়ার সময় কোনো কথা হবে না। আগে খাবার, তারপর কথা বলো।’
পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছে। মা টাকি মাছের ভর্তা করেছে। আমি আবার টাকি মাছের ভর্তা খুব ভালো পাই। চিংড়ি দিয়ে লাউ তরকারি, ইলিশের ডিমভাজা, ইলিশ ভুনা, পোলাও, সাদা ভাত আরও কত কী! এক এক করে সব কটি টেস্ট করা হলো। অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্না খেলাম। কত যে ভালো লাগছে।
এমনিতে গরমে অতিষ্ঠ মন। এদিকে লোডশেডিং। গ্রামের এই হলো এক সমস্যা। উঠানে বসেছে এক আড্ডা। পাশের বাড়ির থেকেও কয়েকজন আড্ডাতে অ্যাড হয়েছে। বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে রাত ১০টায় উঠানে বসে আড্ডা দিচ্ছে, বিষয়টাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। চলছে অক্ষর দিয়ে গানের খেলা। একটা অক্ষর দিয়ে একজন গান শুরু করবে। তারপর সেই যেখানে গিয়ে শেষ করবে, ঠিক শেষ অক্ষর দিয়ে আরেকজন আরেকটি গান গাইতে হবে। খেলাতে দুটি দল থাকবে। লিজার দলে চারজন ও মরিয়মের দলে চারজন। এর মধ্যে আমি আছি লিজার দলে। আর ঝিলমিল আছে মরিয়মের দলে। যে দল সঠিক অক্ষর দিয়ে গান গাইতে পারবে, সেই দলের জন্য ১০ নম্বর থাকবে। আর যে দল পারবে না, সেই দলের জন্য মাইনাস ১০ নম্বর। এই নিয়মে খেলা শুরু হলো।
শুরুতে লিজা গাইল, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...।’
মরিয়মের দলের ঝিলমিল গেয়ে ওঠে, ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে।/ তোমরা যে বলো দিবস-রজনী “ভালোবাসা” “ভালোবাসা”—/সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়...’
‘য়’ প্রথমে রেখে কোনো শব্দই হয় না। এই নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে। আমি বলে উঠি, ‘য়’ মানে ‘অ’ দিয়ে গাইলেও চলবে। এটাও একদল মানছে না।
ঝিলমিল বলে ওঠে, ‘ওকে ডান। সবকিছু ডিসমিস। গানের খেলা আবার শুরু হবে। এবার প্রথমে গান গাইবে মুরাদ ভাই।’
ঝিলমিলের কথার সঙ্গে দুই পক্ষই তাল মেলাল। আমি নিরুপায়। তবে আমার এই গানটি মনে মনে ডেডিকেট করেছি মরিয়মকে। গাইতে শুরু করি, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ...’

একজন গেয়ে উঠল, ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি সেই আগের মতোই আছ, নাকি অনেকখানি বদলে গেছ...’
উঠানে গানের আড্ডা চলছে। বেশ ভালোই লাগছে। আমি উঠে এলাম। গানের আসর থেকে অনেকটা দূরে আছি। কিন্তু কানে মিউজিকবিহীন খোলা কণ্ঠের আওয়াজ বাতাসে ভেসে আসছে। উঠে আসার একটা কারণ অবশ্যই আছে। আলোর মেসেজ এসেছে। মোবাইলের লাইট জ্বলতে পাশে আরেকজনকে দেখতে পেলাম। কে সে? ঝিলমিল দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বললাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ঝিলমিল বলল, ‘কী ব্যাপার চলে এলে যে।’
‘না এমনিতেই এসেছি। তুমি?’
‘আমি তোমার পেছন পেছন এসেছি। দেখতে এলাম তুমি কী করো।’
‘ও আচ্ছা।’
‘তা এসে ডিস্টার্ব করলাম না তো।’
ডিস্টার্ব করে বলে, ডিস্টার্ব করলাম না তো। আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আঁটে। আমি বলি, ‘ডিস্টার্ব না, তবে...’
‘তবে কী?’
‘আমার চেইন খোলতে হবে।’
ঝিলমিল ভুরু কুঁচকে বলে, ‘মানে কী? কিসের চেইন খোলবা?’
‘পুরুষের আবার চেইন কয়টা থাকে!’
‘ঠিক বুঝলাম না।’
অন্ধকারে ঝিলমিলের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আমি ওর খুব নিকটে চলে আসি। এবং ওর ডান হাতের বাহুতে শক্ত করে ধরে বলি, ‘এই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই!’
‘মুরাদ ভাই তোমার মতলব তো ভালো ঠেকছে না। ছাড়ো বলছি।’
‘না, আমি আর তোমাকে ছাড়ব না।’
বলে একটা হাসি দিলাম হা হা হা...! সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে আঙিনায় গানের আসরে চলে এল ঝিলমিল।
সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠতে হলো। মনির এসেছে। সে আমার চাচাতো ভাই। মনিরের একটা গুণ আছে। সেটা হলো সে খুব সুন্দর করে বাঁশী বাজাতে পারে। লেখাপড়া খুব একটা করেনি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় দুষ্টুমির জন্য হেডমাস্টার মেরেছিল। পরে বেতের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মাস্টারের বেত দিয়ে মাস্টারকে উল্টো আঘাত করে। শেষে দৌড়ে স্কুল ত্যাগ করে। পরে আর স্কুলে পা রাখেনি মনির। সেই থেকে চাচা মনিরকে গরু রাখতে মাঠে পাঠায়। মনির গরু রাখে আর মনের সুখে বাঁশী বাজাতে থাকে। মনির বলল, ‘মুরাদ ভাই, তুমি কেমন আছ?’
‘ভালো আছি। তারপর তুই কেমন আছিস?’
‘ভালা না।’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘আমি ঢাকা যামু।’
‘তুই ঢাকায় গিয়ে করবিটা কী?’
‘তুমি যে কাম দাও, আমি হেইডাই করমু।’
‘আমি তোকে কাজ দেব। বোকা নাকি! আরে আমারই তো বেইল নাই।’
‘আমি অত কথা বুঝি না। তুমি অনেক চালাক মানুষ। তুমি ইচ্ছে করলেই আমার একটা কামের ব্যবস্থা করে দিতে পারো।’
‘কী ব্যাপার মনির হঠাৎ ঢাকায় যেতে উতলা হয়েছিস।’
‘কিছু না, তবে আমি ঢাকা যামু।’
‘আচ্ছা, আমি পরে তোর সঙ্গে কথা বলতেছি। আগে বল বাঁশী বাজানো কেমন চলছে?’
‘আমি এহন আর বাঁশী বাজাই না।’
‘কেন? হঠাৎ বাঁশী বাজানো বন্ধ কারণ কী?’
‘আমার ভালো লাগে না।’
‘আচ্ছা, শুনছিলাম ময়না নামের একটা মেয়েকে তুই পছন্দ করতি।’

মনির আর কথা বলছে না। বুঝতে সক্ষম হলাম মনিরের সমস্যাটা। ছেলেটার ময়নাকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো।
বিকেলবেলা। ঝিলমিল, মরিয়ম ও লিজা মিলে বেশ আছে। আমি খুব একটা ভালো নেই। গ্রাম ভালো লাগছে, বাট সময় কাটানোর মতো কোনো সঙ্গী নেই। কুলিয়ারচর কালী নদীর তীরে এসে লঞ্চে ছাদে বসে আছি। এক পাশে পানির খেলা, অন্য পাশে মানুষের মেলা। কত কত মানুষের ঢল। এরই মধ্যে দৃষ্টি এসে আটকে যায় বেশ কয়েকটি কাকের দিকে তাকিয়ে। নদীর পানিতে তারা গোসল করছে। একটি কাক হুট করে পানির নিচে যায় আবার উঠে আসে। অন্য কাকটি একইভাবে গোসল করছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত একটা কথা আছে। কাক গোসল। মানে কেউ যদি তড়িঘড়ি করে গোসল সেরে ফেলে। তাকে বলে কাক গোসল। আজ অবশ্য সরাসরি বিষয়টা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি। বেশ ভালো লাগছে। প্রকৃতি আমাদের কত রকম করে সৃষ্টি করেছে। মানুষকে মানুষের মতো করে সৃষ্টি করেছে। পশুকে পশু। পাখিকে পাখি। আবার ভিন্ন ভিন্ন ধরন দিয়েছে। কেউ উড়ে বেড়ায়। কেউ হেঁটে বেড়ায়। আবার কেউ দৌড়ে বেড়ায়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কাকের গোসল দৃশ্যটুকু বন্দী করি।
গ্রামে কয়েক দিন কাটানো হলো। ঝিলমিল বলছে, সে ঢাকায় চলে যাবে। আমিও ঝিলমিলের সঙ্গে কথা বলে মনিরকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। মনিরকে ঝিলমিলের বাড়ির কাজে লাগিয়ে দিই। মনির কিন্তু দেখতে বেশ সুন্দর একটা ছেলে। তবে ওর মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট আছে। সেই বিষয় পরে জানা যাবে। আগে শহরে বুকে একটু হেঁটে নিই। চার-পাঁচ দিন শহর থেকে দূরে ছিলাম। কেন জানি শহরের জন্য মন পুড়ে। এখন আলাদা একটা প্রশান্তি অনুভব করছি। একটু টিএসসির এদিকে গেলে মন্দ হয় না। হাঁটছি। হঠাৎ সামনে পড়ল নিরা নামের সেই মেয়েটি। কত দিন পর দেখা। কিন্তু নিরা আমাকে দেখেনি। সে হাঁটছে। আমিও হাঁটছি। নিরা আসছে, আমি যাচ্ছি। দুজনে কাছাকাছি। হঠাৎ নিরা আমার দিকে তাকাল। আমি দেখেও চলে যাচ্ছি। নিরা বলল, ‘শোনোন?’
আমি হাঁটছি। দাঁড়াচ্ছি না। নিরা বলল, ‘মুরাদ সাহেব আপনি যাবেন না।’
এবারও দাঁড়ালাম না। অমনি নিরা আমার কাছে চলে আসে। আর বলে, ‘আমি যে ১০০ টাকা পাই, সেটা দেবেন না?’
আমি দাঁড়িয়ে বলি, ‘না দেব না!’
‘কেন দেবেন না?’
‘কারণ, আপনি বলেছেন আপনার টাকা লাগবে না।’
‘আচ্ছা বাদ দেন, টাকা দিতে হবে না। একবার বাসায় আসুন না। ভাই প্রতিদিনই আপনার কথা বলে। আর আমাকে বকাঝকা করে।’
‘না আমি যাব না।’
‘কেন যাবেন না?’
‘আপনি না করেছেন যাওয়ার জন্য।’
‘এখন তো আমি বলছি।’
‘তারপরও যাওয়া যাবে না।’
‘এখনো যাওয়া যাবে না, বুঝলাম না।’
‘আপনি বলছিলেন আপনি বললেও যেন আপনার বাসাতে না যাই।’
‘ও আচ্ছা, সরি, এই আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি, আমাকে ক্ষমা করুন।’
‘সুন্দরী মেয়েরা এভাবে হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়া ঠিক না। এতে প্রকৃতি কষ্ট পায়। আপনি চলে যান। আমি পরে আপনার ভাইকে ফোন করে নেব।’
‘আপনার কাছে নম্বর আছে?’
‘নেই, তবে সংগ্রহ করে নেব নে। আপনি চলে যান।’
‘আমি বলছি, মোবাইলে টিপুন।’
‘মোবাইল সঙ্গে নেই। বাসাতে রেখে এসেছি।’
যথেষ্ট বিস্মিত হয় নিরা আমার সঙ্গে কথা বলে। শেষে একটা কাগজে নম্বর লিখে আমাকে দিয়ে চলে যায়। নিরা হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আর হাঁটছি না। নিরার দিকে তাকিয়ে আছি। আসলে নিরার সঙ্গে আরেকটু সহজ করে কথা বলা উচিত ছিল। মেয়েটি মনে মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। দেরি না করে আজই একবার কালাম ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে হবে। সামনে একটা টপআপের দোকান আছে। সেখান থেকে নিরার দেওয়া নম্বরে কল করলাম। কালাম ভাই রিসিভ করল। কালাম ভাই বলল, ‘কে?’
আমি চুপ করে শুনছি কালাম ভাইয়ের কণ্ঠস্বর। কালাম ভাই বলল, ‘এই কে?’
‘আমি মুরাদ, ভাই। আপনি কেমন আছেন?’
‘মুরাদ! ভাই আমার।’
‘জি বলুন।’
‘তুমি একবার বাসায় আসো না ভাই।’
‘আচ্ছা, কালই আসব। এখন রাখি।’
‘আচ্ছা, আসো।’

ফোন রেখে দিলাম। হাঁটতে শুরু করলাম। হাতে মোবাইল নেই। মোবাইলটা কোথায় রাখা হলো, মনে পড়ছে না। রুমে রেখেছি, নাকি গাড়িতে রেখে চলে এসেছি, কিছু মনে আসছে না। সত্যি বর্তমান সময়ে মোবাইল ছাড়া চলা অতি কষ্টকর। আচ্ছা, যদি ফোনে কল আসে। যদি আলো কল করে। আলো, মানে হলো ছলনাময়ী। আলো কি ফোন দেবে? কে জানে? আচ্ছা, কাল একবার কালাম ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে। না কাল না, আজই যাব। রাতে ডিনারটা নিরার হাতে রান্না করা খাবার খেয়ে সেরে নেব। নিরার হাসিমুখটা দেখব। আচ্ছা, নিরা এত সুন্দর কেন? নিরার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো লাগতে। আচ্ছা, প্রকৃতি তো আমার জন্য নিরার মনে আলাদা একটা মায়া তৈরি করতে পারে, যা থেকে নিরা কালাম ভাইয়ের ফোনটা হাতে নেবে আর আমি কল করব। অমনি নিরা বলবে, হ্যালো কে বলছেন? আচ্ছা, একটা ফোন করে দেখি। আবার মোবাইলের দোকানে গেলাম। দিলাম ফোন। সে কি! এ তো মেঘ না চাইতে জল। নিরার কণ্ঠ। আমি চুপ করে শুধু শুনতে চাই। কিছু বলব, সেটা আর হচ্ছে না। নিরা বলল, ‘কে বলছিলেন?;
আমি চুপ। আবার নিরা বলল, ‘সরি, কে বলছিলেন?’
আমি চুপ। আবার নিরার সেই মিষ্টি কণ্ঠ, ‘আচ্ছা, শোনোন, ভাই ওয়াশরুমে আছে। একটু পরে কল করুন, ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।’
আমি ফোন কেটে দিলাম। মেয়েটা শুধু সুন্দরী না। কথাও খুব সুন্দর করে বলে। না জানি হাসিটাও কত সুন্দর। আমি যাব, অন্তত নিরাকে দেখতে হলেও আমি যাব।