ছলনাময়ী-৫

জানালার পর্দাটা সরাতেই বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির পানি এসে খানিকটা ভিজিয়ে দিল। বৃষ্টিকে খুব বেশি ভালোবাসি বলে বৃষ্টি আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমি রীতিমতো বিস্মিত। অঝোর ধারা বৃষ্টি হচ্ছে শহরের বুকে। রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। দোতলার ওপরে জানালার গ্রিলে হেলান দিয়ে বৃষ্টি দেখছি। মাঝেমধ্যে হাত দিয়ে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিচ্ছি। আহা! কী ভালো লাগা! ইচ্ছা হচ্ছে এখনই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ভিজতে। মোবাইলে কল আসে। রিসিভ করার ইচ্ছা নেই। এত সুন্দর বৃষ্টি আর ফাঁকা রাস্তা দেখতে বেশ লাগছে। ঢাকা শহরে ফাঁকা রাস্তা দেখা মধ্যরজনীতেও অসম্ভব। বৃষ্টির গতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যতই বৃষ্টি হোক, এই শহরে রাস্তায় জনমানবের চলাচলের কমতি থাকে না। কিন্তু আজকের বিষয়টি ভিন্ন। বৃষ্টি হচ্ছে বলে রাস্তায় কোনো যানবাহন ও মানুষ কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বৃষ্টির গতি কিছুটা কমেছে। ছাতা মাথায় একজন তরুণী হেঁটে যাচ্ছে। বাতাসের গতি বোধ হয় বেশি ছিল। হঠাৎ ছাতাটা উল্টে যায়। উল্টো ছাতা দেখতে অন্য রকম লাগছে। মেয়েটি ভিজে একাকার। কী করবে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মেয়েটিকে দেখছি খুব আগ্রহের সঙ্গে। আমি নিচে যাব কি না, সেটাই ভাবছি। না, থাক, দেখার দৃশ্যটা কিন্তু কম সুন্দর নয়। আচ্ছা, মেয়েটি যদি তার হাতের ছাতাটা ফেলে দেয়, ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকটি তরুণ ছাতা নিয়ে এসে মেয়েটির মাথার ওপর ধরে, তখন দৃশ্যটা কেমন হবে? অবশ্যই রোমাঞ্চকর একটা দৃশ্য হবে। মেয়েটি হাতের ছাতা ফেলে দিয়েছে। একজন চলেও এসেছে ছাতা নিয়ে। কিন্তু সে কোনো তরুণ নয়। সে তরুণী।
বেশ কদিন ধরে মামার বাসায় আছি। মামা ও তার একমাত্র মেয়ে ঝিলমিল আমেরিকায় থাকে। পুরোনো টাউনে পাঁচতলাবিশিষ্ট এই বাড়িটি তাদেরই। যে বাড়িতে চিন্তামুক্ত মনে রাত্রি যাপন করি আমি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে ঝিলমিল। বাংলাদেশে আসছে। মামা বোধ হয় এই জন্যই ফোন করেছিল। ঝিলমিলকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে হবে। সেই ছোট্ট ঝিলমিলকে দেখেছিলাম বছর দশেক আগে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছবি দেখেছি। ঝিলমিল সিনেমার নায়িকাদের মতো হয়েছে। নায়িকাদের মতো পোজে ছবি তোলে। আরও কত কী! আমি যে মুঠোফোনটা ব্যবহার করি, সেটা খুব একটা ভালো নয়। দিনে দুবার চার্জ দিতে হয়। তা না হলে সুইচ স্টপ। সত্য বলতে আমার মুঠোফোনটা বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। আমি অবশ্যই মুঠোফোন নিয়ে খুব একটা ভাবি না। আমার নতুন কিছু করতে ভালো লাগে। নতুন কিছু ভাবতে ভালো লাগে। আজ আর ভাবনা নয়। আজ যা কিছু হবে, পথে পথে হবে। পথটা আমার প্রাণ। পথ নিয়ে কিছু ভাবা যাক। সেটাও হাঁটতে হাঁটতে ভাবলে মন্দ হয় না।

আছি পুরোনো টাউন সদরঘাট বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে। ইতিহাস বলে এটি একটি ঐতিহাসিক পার্ক। উনিশ শতকের আগে এখানে একটি বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল, যার নাম ছিল আন্টাঘর। রানি ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষে শাসনভার গ্রহণ করার পর এই পার্কের নাম হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসকেরা প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সেপাইকে। জানা যায়, মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য সেপাইদের লাশ এনে ঝুলিয়ে রাখা হতো এই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে। সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে সিপাহি বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর নাম অনুসারে নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’। এই ঐতিহাসিক পার্কের প্রবেশপথের একটা পাশে কিছু আবর্জনা পড়ে আছে, যা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ দেখতে হলো। এই পৃথিবীর বুকে অনেক কিছুই দেখতে চায় না মানুষ, অথচ দেখতে হয়।
অনেকটা পথ হেঁটেছি। কোথাও একটু বসতে পারলে ভালো হতো। বাহাদুর শাহ পার্কের ভেতরে প্রবেশ করলাম। একটা বেঞ্চিতে বসলাম। বেশ ভালো লাগছে। খানিকটা খিদে অনুভব করছি। কিছু খেতে পারলে ভালো হতো। খেতে হলে এখন আবার পার্কের বাইরে যেতে হবে। তার চেয়ে বরং বেঞ্চিতে একটু হেলান দিই। আহ, কী প্রশান্তি! ওপরে আকাশ, তার নিচে বৃক্ষ দেবীর ডালপালা, তার সঙ্গে জুড়ে আছে পাতাবাহার, তারই নিচে বেঞ্চিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছি আমি। শরীর থেকে ক্লান্তি ক্রমেই বিদায় নিচ্ছে। চোখটা বুজে গেছে। পৃথিবীর আলো-বাতাস চোখ বুজে অনুভব করছি। আমি বুঝতে পারছি, আগামী দু-তিন ঘণ্টা আমাকে এখানেই থাকতে হবে। চারপাশ শ শ শব্দ ক্রমে কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঝালমুড়ি ঝালমুড়ি শব্দটা কানে বাজল। পেট বাবাজিও বলছে তার আহার লাগবে। কিন্তু আমার যে একেবারে উঠতে মন চাইছে না। তবে এই মুহূর্ত কেউ একজন আমার পাশে আছে, সেটা বুঝতে পারছি। কে সে? আমার যে একেবারে তাকাতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তাকালে আমি আমার নীরব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হব। সেটা আমি কখনো হতে দেব না। একটা মমতার বাতাস অনুভব করছি। আদর অনুভব করছি। ভালোবাসা অনুভব করছি। একটা মায়াবী মুখ দেখতে পাব চোখ মেলে, এমনটা মনে হচ্ছে। আসলে কী দেখতে পাব! নাকি একবার তাকিয়ে মনের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসব। এখন মনে হচ্ছে আমি আমার জন্মস্থান কুলিয়ারচরে আছি। প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে আমার কক্ষে ফ্লোরে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছি। সেখানে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডাকছে এই পৃথিবীর বুকে নাম্বার ওয়ান সেরা মানুষটি। একজন নারী। তার আদরি হাতটি আমাকে স্পর্শ করতে চায়। আমার ঘুম ভাঙাতে চায়। আবার ঘুম যেন না ভাঙে, সেটাও চায়। তাই হাতটি আমার অতি কাছে এনে পুনরায় ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু আমি চাচ্ছি হাতটি আমাকে স্পর্শ করুক। আমাকে সজাগ করুক। আমি দেখতে চাই তাকে। কত দিন দেখি না তাকে। মনে হচ্ছে কেউ নেই আমার পাশে। আমিও নেই। নিদ্রায় নিজেকে সঁপে দিলাম।
মুয়াজ্জিনের আজানের শব্দ কানে বাজছে। এটা কোন ওয়াক্তের আজান। মে বি আসর হবে। আরও একটু ঘুমালে মন্দ হতো না। চোখ খুলতে একটা কিশোরী মেয়েকে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামবর্ণের চেহারা। মুখমণ্ডল গোলাকার। চুলগুলো বেশ লম্বা। তবে অযত্নে চুলগুলোর সৌন্দর্য হারিয়েছে। শরীরে জামাটার এক পাশে খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। পায়ে জুতা নেই। বুঝতে পারছি মেয়েটি যথেষ্ট দরিদ্র। কিন্তু সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কেন? তার হাতে দেখা যাচ্ছে একটা নতুন প্যাকেট।
‘ভাইজান, এগুলা আফনের। এই নেন। এক আফা দিয়া গেছে।’
মেয়েটির কথা শুনে কিছুটা অবাক না হয়ে পারলাম না। অচেনা-অজানা একটা মেয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট এনে বলছে, এগুলো আমার! এদিকে আমারও খিদেয় পেটের ভেতর আগুন জ্বলছে। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।
‘আচ্ছা, তোর নাম কী?’
‘আমার নাম নুরী।’
‘নুরী, তোকে এই খাবার কে দিয়েছে?’
‘আমি ওনাকে চিনি না। উনি আমারে পঞ্চাশ টাকা দিয়া কইল, আফনার ঘুম ভাঙনের আগপর্যন্ত যেন এইহানে খাড়াইয়া থাহি।’
তার মানে এখানে আলো নামের মেয়েটি আসেনি তো! আসতেও তো পারে। তাদের যে সবখানে যেতে হয়। হয়তো কোনো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এই পার্কে গমন করেছিল। যা-ই হোক, খিদে আছে, আগে খেয়ে নিই। কিন্তু এই নুরী নামের মেয়েটিকে দেখে বড্ড মায়া লাগছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে সে ক্ষুধার্ত।
‘নুরী, তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
‘আমি যাই, ভাইজান।’
‘কোথায় যাবে?’
‘সামনে বস্তিতে যামু।’
‘আচ্ছা, তুই কী করিস?’
‘আমি কিছু করি না।’
মেয়েটি ভিক্ষা করে। এই কাজটা লজ্জার। আর তাই সেই আমাকে বলতে পারছে না যে সে ভিক্ষা করে। ভিক্ষা সেটাও ভালো। যদিও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব মোহাম্মদ বলেছেন ভিক্ষা কোরো না। কাজ করো। তারপরও আমাদের সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষেরা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে।
‘নুরী?’
‘জি ভাইজান।’
‘পঞ্চাশ টাকা ছাড়া তোর হাতে কত টাকা আছে?’
‘গুনি নাই তো।’
‘আচ্ছা শোন, তুই আমাকে ১০টা টাকা দিতে পারবি? আমি তোকে পরে দিয়ে দিব।’
নুরী কিছুটা অবাক হয়। এমন ঘটনা বোধ হয় তার জীবনে প্রথম ঘটেছে। কারণ, নুরী শুধু মানুষের কাছ থেকে নিয়েছে। আজ কাউকে দেবে, সেটা ভেবে অবাক হচ্ছে। নুরী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে অল্প কিছু টাকা আছে। সে আমাকে দেবে কি না, সেটাই ভাবছে। আমি আবার বললাম, ‘কিরে, টাকা দিবি না।’
নুরীর শ্যামবর্ণ মুখটা মলিন হয়ে যায়। টাকা দিতে তার একদম মন চাইছে না, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার ইচ্ছা হচ্ছে নুরীর কাছ থেকে ১০ টাকা নেবই। নুরী এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি সে দৌড় দেওয়ার ফন্দি আঁটছে। তার আগেই ওকে একটা ধমক দিয়ে বলি, ‘এই মেয়ে, শোন বলছি, তুই যদি ১০ টাকা আমাকে না দিস, তাহলে তোর কাছ থেকে সব টাকা আমি কেড়ে নেব। তুই জানিস না আমি কিন্তু অনেক বড় সন্ত্রাসী!’
নুরী ভয়ে কাঁপছে। কী অদ্ভুত দৃশ্য, মানুষ মানুষকে হাসাতে পারে আবার কাঁদাতেও পারে। নুরীর সঙ্গে আমার এমন ব্যবহার কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। অথচ আমি সেই বেঠিক কাজটাই করেছি। নুরী ১০ টাকার একটা নোট আমাকে দিল। সে চলে যেতে চাইলে আমি তাকে দাঁড় করাই। বিরিয়ানির প্যাকেটটা নুরীর হাতে তোলে দিই। নুরী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নুরীর মাথায় হাত বুলিয়ে ১০ টাকা নিয়ে চলে আসি। একটা ১২ কিংবা ‘৩ বছরের মেয়ে সবই বোঝে। নুরীও বোঝে। সে নিশ্চয়ই ভাবছে এত দামি খাবার লোকটা আমারে দিয়ে দিল। একটা আনন্দের অনুভূতি খেলা করবে নুরীর মনে। হয়তো এটাও ভাববে, লোকটা কত ভালো। অথচ একটু আগেও লোকটা ছিল নুরীর কাছে আতঙ্ক। এই সবই প্রকৃতির খেলা।

আরও পড়ুন

নুরী, যার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে রূপ-যৌবনের পূর্বমুহূর্ত, যার মন ছুঁয়ে যাবে বসন্ত। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। আচ্ছা, নুরী কি জানে আগামী দিনগুলোতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। না, এটা নুরীর জানার কথা নয়। আগামী দিনগুলোতে কী হতে চলেছে, এটা কারও জানার কথা নয়। তারপরও আমরা মানবজাতি অনেক কিছু জানতে পারি। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হয়, এটা আমরা অনায়াসে বলতে পারি। যদিও ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার না হয়ে অন্য কিছুও হয়। কৃষকের ছেলে ডাক্তার হয়, এটাও খুব কম ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু নুরী তো একটা ভিক্ষুক। তার মানে কি নুরী বড় হয়ে একজন ভিক্ষুকের বউ হবে? সেটা হলেও মন্দ হতো না। কিন্তু আমি তো দেখছি অন্য কিছু। যে নুরীর বাবা তার মেয়ের দেহ ঢাকার জন্য একটা ভালো জামা দিতে ব্যর্থ। যৌবন যাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তাকে দিয়ে করাচ্ছে ভিক্ষা! সেই নুরী আগামী দিনে শহরের বুকে কারও লালসার শিকার হবে না তো! পত্রিকা শিরোনাম হবে না তো! একটা সময় কলগার্ল হয়ে উঠবে না তো! একজন ছলনাময়ী হবে না তো! নুরীকে নিয়ে ভাবছি আর হাঁটছি। খিদে চলে গেছে। পকেটে নুরীর দেওয়া ১০ টাকার নোটটা পড়ে আছে।
রাত ১১টা বাজে। ঢাকা শহরে ১১টা মানে গ্রামের সন্ধ্যা হলো। আমার থাকা হয় দোতলায় একটা ছোট্ট রুমে। চোখে ঘুম আসছে না। বেশ কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীত শোনা হলো। ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে/ সহে না যাতনা দিবস গুনিয়া গুনিয়া বিরলে নিশিদিন ও বসে আছি শুধু পথে পানে/ সখী ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলই যাতনা ময়...।’
আলোর কল আসে। রিসিভ করতেই, ‘কী খবর মুরাদ সাহেব, কেমন আছ? আজকাল তো পার্কে গাছের নিচেও ঘুমাতে দেখি।’
‘ও, তাহলে বিরিয়ানি তুমিই পাঠিয়েছিলে।’
‘কেন, স্বাদ হয়নি?’
‘স্বাদ হবে না কেন, অবশ্যই যে খেয়েছে, নিশ্চয়ই সে স্বাদের বিষয়টা বলতে পারবে।’
‘তুমি খাওনি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘রিজিকে ছিল না বলে।’
‘ও, আচ্ছা।’
‘আচ্ছা, তুমি আমাকে পার্কে ডাক দিতে পারতে।’
‘একবার ভেবেছিলাম তোমাকে ডাক দিই। কিন্তু...’
‘ওকে, থাক, আর বলতে হবে না। আমি জানি।’
‘কী জানো?’
‘সেটাও বলতে হবে?’
‘বলো, আমি শুনতে চাই।’
‘পার্কে এসেছিলে, এটা সত্যি। তবে একা নয়, নিশ্চয় তোমার সঙ্গে কোনো একজন সঙ্গী ছিল।’
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘জানাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, একজন কলগার্লের কাজই অন্যকে আনন্দ দেওয়া। আজ হয়তো কারোর আনন্দের সঙ্গী হয়ে ঘুরতে পার্কে গিয়েছিলে। অমনি আমার দেখা পেলে। হিসাব ক্লিয়ার। তবে...’
‘তবে কী, বলো?’
‘আমাকে ডাক না দিয়ে তুমি ভালোই করেছ। সে সময় ঘুমের মাঝে এমন একজন দরদি মানুষের সান্নিধ্য অনুভব করলাম, যেন সেই মানুষটি হাজার বছরের চেনা। কত দিন তার হাতের পরশ পাই না। তুমি কি বলতে পারো আলো, সেই মানুষটি কে?’
‘আগে বলো তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করো না কত দিন?’
‘অনেক দিন হবে। কেন, তোমার তো জানার কথা।’
‘আমার জানার কথা! কীভাবে?’
‘সেই যে টিএসসিতে তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, এরপর আর নিজের গ্রামের বাড়িতে যাইনি। তবে আজ কুলিয়ারচরের কথা খুব বেশি মনে পড়ছিল।’
‘তুমি কি পাগল?’
‘জানি না।’
‘সেই যে এলে শহরে, এখনো যাওনি! হায় আল্লাহ, এই পাগলকে নিয়ে আমি কী করি!’
‘তুমিই জানো কী করবে।’
‘শোনো মুরাদ, পাগলামি কোরো না। স্বপ্নে তোমার কাছে তোমার মা এসেছিল। তুমি যাও, তোমার মায়ের কাছে ফিরে যাও।’
‘কী করব, বলো, তোমার মতো ছলনাময়ীর ফাঁদে পড়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছি যে।’
‘মুরাদ, তুমি কী চাও, স্পষ্ট করে বলো তো।’
আমি আর কিছু বললাম না। ফোনটা কেটে দিলাম। আলো যা ভাবার ভাবুক। আমি আর কিছু নাই-বা বললাম। তবে আলো নামের ছলনাময়ী মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সত্যিই স্বপ্নে আমার মা জননী এসেছিল। কত দিন দেখি না মায়ের মুখ। চেনা গ্রাম, চেনা পথ, যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
মামার ফোন। কথাও হলো। ঝিলমিল সকালে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। আমি যেন তাকে রিসিভ করি। বড়লোকের একমাত্র মেয়ে ঝিলমিল। আচ্ছা, ঝিলমিল কি আমাকে চিনবে? ও যদি না চেনে, আমি ওকে চমকে দেব কবিগুরুর দুটি চরণ গেয়ে। আমার হাতে থাকবে ফুলের বুকেট। ঝিলমিল আমাকে দেখবে। কিন্তু ডাক দেবে না। ভাববে আমি মুরাদ কি না। দ্বিধান্বিত মনে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। আমি তখন ঝিলমিলের সম্মুখে গিয়ে বুকেট বাড়িয়ে দেব। সেই সঙ্গে কবিগুরুর লেখা চরণ দুটি গেয়ে উঠব, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী...!’
লেখক: এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর