ছলনাময়ী-১০
গ্রাম থেকে মনির এসেছে। শহরে কোনো কিছু সে চেনে না। সকাল থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল ছেলেটা? ঝিলমিল বলছে, সকাল সকাল বের হয়েছে। সঙ্গে কোনো টাকাপয়সা আছে কি না, সেটাও জানা নেই। একটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তবে আমি চিন্তা করতে চাই না। কোনো কিছু না চিনেও ঘোরাঘুরির মজা আলাদা। মনির ঘোরাঘুরি করছে না। সে নিশ্চয়ই ঢাকার শহরে কাউকে খুঁজছে। আমি পুরোপুরি কোনো খবর জানি না। মনে হয়, ময়না নামের মেয়েটি ঢাকায় আছে। মনির ময়নাকে খুঁজছে। এ নেটওয়ার্কের যুগে মনিরের হাতে মোবাইল ফোন নেই। এটা অবশ্যই বেমানান। ওকে একটা ফোন কিনে দিতে হবে। ঝিলমিল বলল, ‘আমার ভয় করছে। শহরের অবস্থা ভালো না। যদি মনিরের কিছু হয়ে যায়।’
‘আরে না, তুমি যা ভাবছে, তা হবে না।’
‘গ্রামের মানুষ বলে কথা।’
‘গ্রামের মানুষকে তুমি অতটা বোকা ভেবো না। মনির অনেক চালাক একটা ছেলে। শহরের মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার বুদ্ধি তার আছে।’
‘যাই হোক ভালোই ভালোই ফিরে এলেই ভালো।’
ইচ্ছে ছিল গত রাতে নিরাদের বাসাতে গিয়ে চমকে দেব। কিন্তু সেটা হলো না। তাই ভাবছি আজ বিকেলে নিরার সঙ্গে দেখা করব। তার আগে মনিরের সন্ধানে বের হতে হবে। তার আগে মরিয়মের সঙ্গে কথা বলে কিছু তথ্য নিতে হবে। ময়না নামের মেয়েটি এখন কোথায় আছে। আর তাই মায়ের নম্বরে কল করলাম। রিং হচ্ছে। রিসিভ হচ্ছে না। আমি অপেক্ষা করছি। রিসিভ হলো, ‘কে মুরাদ?’
‘মা, আমি মুরাদ বলছি। মরিয়ম কোথায়? ওরে একটু ডাকো তো।’
‘কাছেই আছে। একটু ধর, দিচ্ছি। তোর শরীরটা কেমন আছে বাবা?’
‘ভালো।’
মা বলে কথা। গতকাল তাঁর কাছ থেকে এলাম। আজই জিজ্ঞেস করছে শরীর কেমন আছে। মা চিরকাল দায়িত্ববান থাকে। সন্তানকে কেয়ার করে। মরিয়ম ফোন ধরল, ‘ভাইয়া বলো।’
‘আচ্ছা, তুই আমাকে একটা তথ্য দিতে পারবি?’
‘কী তথ্য?’
‘ময়না নামের মেয়েটি কোথায় আছে বল তো?’
‘হঠাৎ ময়নার কথা জানতে চাচ্ছিস। মনির ভাইয়ের কোনো সমস্যা?’
‘মনির ঠিক আছে। তুই ময়নার খবর বল।’
‘ময়না ঢাকা চলে গেছে। শুনেছি, সে গার্মেন্টসে চাকরি নিছে।’
‘ওকে টু দ্য পয়েন্ট। এখন রাখছি পরে কথা হবে।’
আমি আর কথা বললাম না। তাহলে মজনু লাইলির জন্য শহরে এসেছে। এবার বিষয়টা ক্লিয়ার। মনির ময়নাকে খুঁজছে। খুঁজবেই তো। রজকিনীর জন্য চণ্ডীদাস ১২ বছর বড়শি বাইছে। আর ময়নার জন্য মনির সামান্য এই শহরে আসতে পারবে না। খুঁজে যা মনির। যদি ময়নাকে না পাস, তাহলেও খুঁজে যা। হয়তো দেখা যাবে খুঁজতে খুঁজতে তোর জীবন শেষ হয়ে যাবে। মৃত্যুর আগে জিরো পয়েন্টের সামনে এসে বলবে, তুমি ভালো থেকো ময়না। ইহকালে তোমাকে না পেলে পরকালে পাব। শত শত মানুষ তোকে দেখবে। ভিডিও করবে। ভাইরাল হবে। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়বে মনির–ময়নার প্রেমকাহিনি। ইতিহাসে আরেকট নাম সংযুক্ত হবে। প্রেমের নিদর্শন হবে। বাহ প্রেম বিষয় ভাবলেই মনটা কেমন জানি প্রেমময়ী হয়। কিন্তু এ প্রেমেও কত ছলনা হয়। ছলনা থেকে সৃষ্টি হয় একজন ছলনাময়ীর। কত জনে কত মনে কত কী হয়। শুধু এই প্রেমকে ঘিরে। পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে...। এ গানটি মোবাইলে রিংটোন দিয়েছি। ফোন রিসিভ করতেই রুমেল বলে উঠল, ‘কিরে আজকাল তো তোরে পাওয়াই যাচ্ছে না। তুই কী করিস বল তো?’
‘কাল গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। বাকি সময়টা হেঁটেছি। আজ একজনকে নিয়ে ভাবছি। এই হলো আজকালের খবর।’
‘কথা না পেঁচিয়ে স্পষ্ট করে বল।’
‘আসলে জগতে এই কথাটা প্রচলিত বটে। কথা প্যাঁচানো। সারা জীবন দেখে আসছি দড়ি প্যাঁচাতে, কাপড় প্যাঁচাতে, সাপকে প্যাঁচাতে, তুই বলছিস কথার প্যাঁচের কথা।’
‘শুন তোর এই ফালতু লজিক শুনার টাইম আমার নেই। এখন বল আজকে কী করছিস।’
‘তেমন কিছু না। তবে একটু পর একটা মিষ্টি মেয়ে সঙ্গে দেখা করতে যাব।’
‘ও আচ্ছা। আমি ভাবছিলাম তোকে নিয়ে ঘুরতে যাব।’
‘অসুবিধা নেই, আয় আমিও যাব। চলে আয় বিকেলে।’
‘আচ্ছা আমি আসছি।’
‘আমার তো খিদে লাগছে, কিছু টাকা পাঠা। পকেট খালি।’
‘বাসায় যা। আগে খেয়ে নে।’
ফোন রেখে দিলাম। বাসায় যাব না। খিদে থাকুক। খালি পেটে আরেকটা বিষয় উপলব্ধি করা যায়। যারা দুবেলা ঠিকঠাক খেতে পারে না। তাদের বোঝা যায়। তাই অনাহারিদের বুঝতে খেতে গেলাম না। দেখি কতক্ষণ থাকা যায়।
বিকেলবেলা। রুমেলে গাড়িতে বসে আছি। রুমেল ড্রাইভ করছে। আমার কথামতো গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে রুমেল। চলতে চলতে একেবারে নিরাদের বাড়ির সামনে। গেট লাগানো। হর্ন বাজাচ্ছি। দারোয়ান ওমর ফারুক গেটের ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। এসে দেখে বিএমডব্লিউ গাড়িতে আমি বসা। ফারুক কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আমি গ্লাস নামিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে মাথা বের করে বললাম, ‘গেট ওপেন।’
ছোট করে ইংরেজি বললাম। ইংরেজি বলে ভালো লাগছে। আরও ভালো লাগছে ফারুকের বিস্মিত হওয়া দেখে। রুমেলের কাছ থেকে একটা পাঁচ শ টাকার নোট নিয়ে ফারুককে দিলাম। ফারুক নিতে চাচ্ছিল না। আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘সেদিনের চায়ের বিল দেবেন। বাকিটা আপনার কাছে রেখে দিবেন। ফারুক বিনয়ীর সঙ্গে হাসিমুখে বলল, ‘জি আচ্ছা।’
ওমর ফারুক দ্রুত গেট খুলে দিল। আমরা গাড়ি নিয়ে কালাম ভাইয়ের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করি। কালাম ভাই বাড়িতে আছে কি না, জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলে, ‘ভাইজান কালাম ভাই তো বাসাতে নেই।’
‘নিরা আছে তো?’
‘জি ভাই, আপামণি আছে।’
আমি রুমেলকে নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করি। কলিং বেল বাজতে নিরা গেট খোলে। আমি বলি, ‘দুপুরের খাবার খাইনি। খিদায় পেট জ্বলে যাচ্ছে। আগে কিছু খাবারটাবার থাকলে দিতে পারো।’
রুমেল আমাকে বাধা দিতে চাইল। নিরা সামনে থেকে চলে গেল। আমি রুমেল ড্রয়িংরুমে বসে আছি। রুমেল বলল, ‘এটা আবার কেমন ভদ্রতা। একজনের বাসাতে এসে, মানুষ ভালো–মন্দ জিজ্ঞেস করে। আর তুই কি না খাবারের কথা বললি।’
‘শোন যার যেটার প্রয়োজন সে তো সেটাই চাইবে। তুই এখন চুপচাপ বসে নিরাকে দেখতে থাক। আমি খাবার খাব।’
‘নিরাকে দেখব মানে?’
‘এত সুন্দরী একটা মেয়ে। দেখলে ক্ষতি কী। ভালো করে তাকিয়ে দেখ, দেখবি চোখ ফেরাতে পারবি না।’
‘তুই না পারিসও বটে।’
‘আরে দেখ দেখ, আমার কথা শুনে নিরার দিকে একবার সুদৃষ্ট দে। দেখবি পৃথিবীতে সুন্দর কাকে বলে, সেটা জানতে পারবি।’
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিরা আমাদের সামনে চলে এল। হাতে প্লেটে নানা জাতের খাবার আছে। আপেল, আঙুর, কেক সঙ্গে শরবতও আছে। আমি বললাম, ‘এটা কী হলো! আমরা কি পাত্রী দেখতে আসছি নাকি যে ফলমূল খাব। আমি সাদা ভাত খাব।’
রুমেল বলল, ‘কী বলছিস এসব। উনি এত কষ্ট করে নিজের হাতে এসব নিয়ে এসেছে, আর তুই কি না..।’
‘আমি কী? বল আমি কী?’
‘আরে বাবা তুই কথাগুলোকে উল্টোভাবে নিচ্ছিস কেন?’
নিরা বলল, ‘প্লিজ আপনারা থামুন। ওকে মুরাদ সাহেব আপনার জন্য ভাতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তার আগে এখান থেকে অল্প কিছু খাবার খেতে পারেন।’
‘না, আমি ভাত খাব।’
‘আচ্ছা বেশ। ভাতের ব্যবস্থা করছি তো। আপাতত অল্প কিছু খেয়ে নিন।’
‘না, আমি ভাতই খাব।’
রুমেল বলে, ‘মুরাদ তুই এমন ব্যবহার করছিস কেন?’
‘কারণ, খিদেয় আমার পেট জ্বলছে। আমি ভাত খাব।’
‘খিদে লেগেছে বুঝলাম। কিন্তু এসব ফল, কেক খেলেও তো পেট ভরবে।’
‘না, আমি ভাত খাব।’
‘আচ্ছা ভাইয়া আপনি বরং খেয়ে নিন। আমি মুরাদ সাহেবের জন্য ভাত নিয়ে আসছি।’
এ কথা বলে নিরা ভেতরে চলে গেল। রুমেল চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মুরাদ কী হচ্ছে এসব!’
‘তার আগে বল নিরাকে কেমন দেখলি।’
‘মানে কী?’
‘মানে অতি সোজা। আমার পাগলামি দেখে নিরা আমাকে ইগনোর করবে। আর তোর সুন্দর কথার প্রেমে পড়বে। বুদ্ধিটা দারুণ না।’
‘এসব পাগলামির মানে হয়।’
‘আমাকে বুঝতে হবে না। নিরাকে বুঝতে চেষ্টা কর। নিরা এমন একটা সুন্দরী মেয়ে, যার চোখের দিকে তাকিয়ে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তুই কি ভালো করে দেখেছিস নিরাকে?’
‘দেখতে তো খুব সুন্দরী। কথাও সুন্দর। কিন্তু তোর পাগলামির কারণে ভালো করে দেখতে পারলাম কই?’
‘ও এই কথা চান্দু। আগে কইবা না?’
নিরা ভাত নিয়ে এসেছে। আমি দেখছি নিরাকে। একটা মেয়ে এত সুন্দর এত ভদ্র হয় কীভাবে? আজ সে মনে মনে তাকে আমার কাছে সঁপে দিয়েছে। সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। আজ সে ঠিক করেছে, আমি যা বলি সে তা–ই করবে। তাই আমিও কম না। জ্বালা কত প্রকার সেটা দেখাব। নিরা বলল, ‘মুরাদ সাহেব এই নিন ভাত ও গরুর মাংসের তরকারি। খেয়ে নিন।’
‘আমি মাংস খাব না।’
নিরা শান্ত গলায় বলল, ‘তাহলে কী খাবেন?’
‘আমি ভর্তা খাব।’
‘এখন আমি ভর্তা কোথায় পাব?’
‘অত কিছু বুঝি না, আমি ভর্তা খাব।’
রুমেল বলল, ‘কী ছেলেমানুষি করছিস। ভাত খাবি তাই ভাত দিল, সঙ্গে মাংস। এখন বলছিস ভর্তা খাবি, তোর মতিগতি বুঝলাম না?’
‘রুমেল তুই আমার সঙ্গে এসেছিস, তোর এতসব না বুঝলেও চলবে। নিরা বুঝলেই হবে, নিরা আমি ভর্তা খাব।’
নিরা চুপ করে বেরিয়ে গেল। ওমর ফারুককে দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে ভর্তা নিয়ে আসে। আমি দেখতে পাই, টাকি মাছের ভর্তা, আলুর ভর্তা, শর্ষের ভর্তা, চাঁপা শুঁটকির ভর্তা। নিরা বলল, ‘আরও কিছু লাগবে?’
‘শসা হলে ভালো হতো।’
নিরা একটু ন্যাকামো করে বলে, ‘তো এটা এভাবে বলেন, আমি শসা খাব।’
রুমেল তাকিয়ে আছে নিরার দিকে। সে নিশ্চয়ই ভাবছে, মেয়েটা কত সুন্দর করে কথা বলে। চুলগুলো তার কত সুন্দর।
ডাগর চোখের চাহনি। সবকিছুতে যেন মায়া লেগে আছে।
নিরা বলল, ‘কিছু বলছেন না যে।’
‘আমি শসা খাব।’
এটা বলতেই নিরা–রুমেল একসঙ্গে হেসে উঠল। আমি আর ওদের দিকে তাকালাম না। ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে শুরু করি। আমি খাচ্ছি। ইতিমধ্যে নিরা–রুমেলের কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে।
‘স্রষ্টার সৃষ্টি প্রতিটি বস্তুকে আপনার কাছে ভালো লাগবে, যদি আপনি প্রকৃতি বোঝেন, প্রেম বোঝেন, অনুরাগ বোঝেন।’
অপরিচিত দুটি মানুষ। একটু আগে কেউ কাউকে চিনত না। অথচ ঠিক এই মুহূর্তে দুজনই বেশ পরিচিত। রুমেল ছেলেটা বড্ড বেশি মিশুক। কথাও সুন্দর করে বলে। আর নিরা মেয়েটির রূপের বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। নিরা বলল, ‘আচ্ছা আপনি কী করেন?’
রুমেল বলল, ‘এখনো কিছু করা হচ্ছে না।’
‘বাহিরের গাড়িটা আপনার?’
‘না।’
‘তাহলে গাড়িটা কার?’
‘আমার বাবার।’
‘মানে?’
আমি বলে উঠি, ‘আরে অত মানেটানের দরকার নাই। নিরা তুমি ওরে চিনো না। ও অসম্ভব ভালো একটা ছেলে। ওর বাবার কোটি কোটি টাকা আছে। মামা হলেন মন্ত্রী।’
‘এই তুই থাম তো। এসব বলার কী আছে?’
‘আছে আছে, অনেক কিছু বলার আছে। এই জগতে না বলে কিছু হয় না। যেমন ধর তোর নিরাকে পছন্দ হয়েছে, এটা না বললে নিরা কি জানতে পারবে।’
‘তুই যে কী সব বলিস না।’
নিরা বলল, ‘প্লিজ মুরাদ সাহেব একটু সংযত হোন।’
‘আচ্ছা আমি কথা বললেই দোষ। ঠিক আছে আর কোনো কথা বলব না। এখনই চলে যাব। কালাম ভাইকে বলবা কাল আবার আসব।’
‘মুরাদ সাহেব আপনি রাগ করবেন না প্লিজ।’
‘আমি রাগ করলে কার কী আসে যায়। আমি এখন চলে যাব। এবং পায়ে হেঁটে যাব। রুমেল তুই থাক।’
‘কী বলিস এসব। আয় দুজন একসঙ্গে যাই।’
‘না আমি তোর সঙ্গে যাব না।’
এই বলে খাবার শেষ করে, দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসি।’
হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। আজকে আমার এত ভালো লাগছে কেন? রুমেলকে রেখে এলাম সুন্দরী নিরার কাছে। না জানি কী হয়। যদি কিছু হয়, হোক। নিরা কি রুমেলকে ফিরিয়ে দেবে? না এটা নিরা পারবে না। কারণ আমি নিরার চোখ দেখেছি। নিরার চোখে রয়েছে একসাগর ভালোবাসা। আমি নিশ্চিত নিরা–রুমেলের কেমিস্ট্রি জমে যাবে। হয়তো ওরা কথা বলতে বলতে ছাদে চলে যাবে। আকাশের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ যে প্রেম করে, যে প্রেমে পড়ে তাদের মন আকাশের মতো বিশাল হয়ে যায়। আকাশে মেঘ জমেছে। তবে বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের আগমন। একবার ঝিলমিলকে ফোন দিয়ে মনিরের খবর নেওয়া যায়। না থাক। আমি বরং কালাম ভাইকে একটা ফোন দিই। বেচারার বাসায় গেলাম। খেয়ে এলাম। একটু খবর তো নেওয়ার প্রয়োজন। কালাম ভাই ফোন রিসিভ করে বলে, ‘হ্যালো।’
‘আমি মুরাদ বলছি গুরু।’
‘মুরাদ, তুমি এখন কোথায়?’
‘আমি আছি জিরো পয়েন্টের সামনে।’
‘আমিও তো এখানে।’
কালাম ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে সামনাসামনি হয়ে গেলাম। আমাকে দেখে কালাম ভাই অনেক খুশি। সেটা বোঝা যাচ্ছে তার হাসিমাখা মুখটা দেখে। কালাম ভাই বলল, ‘চল বাসাতে চল।’
‘আমি এখন যেতে পারব না।’
‘কোনো কথা চলবে না। তুই এখন আমার সঙ্গে যাবি। শালা তুই একটা বদের হাড্ডি।‘
আমার কথার কোনো কাজ হলো না। একটু আগে যে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম সেই বাসাতে আবার যেতে হলো।
নিরাকে দেখা যাচ্ছে না। কালাম ভাই নিরাকে ডাক দিল। নিরা হাজির। আমাকে দেখে একটু অবাক হলো। আমি কিছু বলছি না। আমার ভাবসাব এমন যে, অনেক দিন পর এই বাসাতে এসেছি। আমি বললাম, ‘ভালো আছ নিরা?’
নিরা কোনো কথা বলল না। কালাম ভাই বলল, ‘মুরাদ তুমি বসো। রাতের ডিনার তুমি আমার সঙ্গে করবে। আমি একটু গোসল করে নিই।’
‘জি ভাই।’
কালাম ভাই গোসলে গেছে। আমি কালাম ভাইয়ের কক্ষে বসে আছি। নিরা আমার পাশে এসে বসেছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আমি তাকাচ্ছি না। একটা মেয়ে যখন একটা ছেলের কাছে এসে বসে, তখন সেই ছেলেটি মনে আলাদা একটা অনুভূতির জন্ম নেয়। কথা বলতে ইচ্ছে হয়। আমি চুপ থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। নিরার নীরব মুচকি হাসি আমাকে কথা বলতে বাধ্য করে। আমি বললাম, ‘এভাবে হাসবে না।’
‘কেন, হাসতে মানা আছে নাকি?’
‘না, মানা নেই, তবে...।’
‘তবে কী?’
‘তোমার হাসি দেখলে নিজেকে ঠিক রাখা দায়।’
‘ও আচ্ছা।’
‘রুমেল কখন গেল?’
‘আপনি যাওয়ার পরপরই।’
‘ও।’
‘আপনি আবার আসলেন।’
‘আর বলো না। কালাম ভাই এমনভাবে বলল যে, না আসলে শার্টের কলার ধরে নিয়ে আসবে। ভাবটা এমনই দেখলাম।’
‘হা হা হা।’
‘পরে ভাবলাম থাক, মার খাওয়ার চাইতে চলে যাই। তা ছাড়া নিরা নামের সুন্দরী মেয়েটাকেও আরেকবার দেখা হলো।’
‘কী?’
‘জি।’
‘আমি বুঝি সুন্দরী?’
‘শুধু সুন্দরী না, মারাত্মক সুন্দরী। যে রূপ দেখে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।’
‘তাই নাকি?’
‘আমি মিথ্যে বলি না। তুমি শুধু সুন্দর নও! আমার মনে হয়, পৃথিবীর সেরা সুন্দরী পাঁচটা মেয়ের মধ্যে তুমি একজন।’
‘তাই! আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলি, আপনি না, মিথ্যা কথাগুলো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারেন।’
নিরার কাছে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। তার মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ও মধুময় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কারণ, সে প্রেমকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। বড় আফসোস হচ্ছে, কেন জানি মনে হচ্ছে, যাকে নিরা ভালোবাসবে তাকে সে পাবে না। আমি বলি,
‘কালাম ভাইয়ের গোসল এখনো হয়নি।’
‘বুঝতে পারছি, আমার কথাগুলো আপনার কাছে বোরিং লাগছে। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি এখন চলে যাব। তার আগে আরেকটা কথা জানতে চাই, সেটা হলো, পৃথিবীতে সেরা পাঁচ সুন্দরীর একজন আমি। আপনার দৃষ্টিতে আমি কত নম্বর?’
‘তিন নম্বর।’
কালাম ভাই শরীর মুছতে মুছতে রুমে ডুকছে। আমি বললাম, ‘ভাই আমি যেতে চাই।’
কালাম ভাইয়ের নিষেধ যাওয়া যাবে না। কালাম ভাইয়ের কথামতো রাতের খাবারও খেলাম। শেষে ড্রয়িংরুমে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। নিরা এসে বলল, ‘কী ব্যাপার বাসায় যাবেন না?’
আমি কিছু না বলে চলে এলাম। পেছন থেকে নিরা ডাক দিল। আমি দাঁড়ালাম না। নিরা হয়তো আর কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমার চলে যাওয়া দেখছিল। আমি পেছনে তাকালে নিরাকে দেখতে পেতাম। কিন্তু আমি পেছনে তাকালাম না। এত মায়া ভালো না। এত প্রীতি ভালো না।
মনির বাসায় ফেরেনি। ঝিলমিল বকাঝকা করছে। আমি ঝিলমিলকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। সে কিছুতে আমার কথা শুনছে না। অবশেষে নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে গেলাম। মনিরের বিষয় পুলিশকে খুলে বলা হলো। পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এসব গল্প শোনার সময় আমার নেই। গ্রামের পুলা বলে সহজ বললা এটাও মানতে পারলাম না। এখনকার যুগে গ্রামের পুলারাই বেশি চতুর হয়।’
পুলিশ অফিসার তেমন সুবিধার লোক নয়। একটু ত্যাড়া বটে। ভাবভঙ্গিতে এমনটাই বোঝা যায়। আমার ইচ্ছে ছিল না পুলিশের সঙ্গে উল্টোপাল্টা করার। আমি বললাম, ‘জনাব জাফর উল্লাহ সাহেব, আপনি ফোনে কথা বলা শেষ করার পর আমি কিছু কথা বলব।’
জাফর উল্লাহ ভুরু কুঁচকে বলে, ‘আচ্ছা আমার নাম জানলেন কী করে?’
‘বোকা সাজবেন না। আমি বোকা লোক সহ্য করতে পারি না। আপনার ইউনিফর্মে লেখা আছে আপনার নাম।’
‘ও তাই তো। তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু ফোনের কথা মানে, আমি ফোনে কথা বলছি না তো।’
‘না এমনিতেই বললাম, যেকোনো সময় ফোন তো আসতেই পারে।’
অমনি জাফর সাহেবের নম্বরে কল আসে। জাফর সাহেব একবার ফোনের দিকে তাকায়, আরেকবার আমার দিকে তাকায়।
অবশেষে ফোনে কথা শেষ করে। এবং বলে, ‘বুঝলাম না কিছু।’
‘আপনার কিছু বুঝতে হবে না। তা ছাড়া পরকীয়া তো ভালোই চলছে।’
জাফর সাহেবের কপালের ভাঁজ ঘন হয়। চোখেমুখে আতঙ্কের চাপ। এরই মধ্যে আমি বলি, ‘ভয় পাবেন না। নিজের বউ রেখে অন্যের বউয়ের সঙ্গে যে ব্যক্তি ইটিশপিটিশ করে, তাকে বলে পরকীয়া।’
‘আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?’
‘যিনি আপনাকে ফোন করেছিল, তিনি তো আপনার বউ না।’
‘আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘বোকারা অনেক কিছু বোঝে না। কিন্তু করে থাকে। আপনি সেই দলের একজন। আমি জানি আপনি আপনার শ্যালিকার সঙ্গে প্রেম করেন। পরকীয়া বললাম না। একটু সম্মান করেই বললাম। গাছের আগাও খাচ্ছেন গোড়াও খাচ্ছেন, বাহ বাহ আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।’
জাফর উল্লাহ বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনার এত বড় সাহস, থানায় এসে, পুলিশের সঙ্গে উল্টোপাল্টা কথা বলছ, আপনি জানেন, আমি আপনাকে এখনই গ্রেফতার করতে পারি।’
‘এটা আমি জানি। আপনি বোকা মানুষ। চালাক হলে আমাকে গ্রেপ্তার করার চিন্তা মাথায় আনতেন না। শোনেন আপনার সঙ্গে আমার বেশি কথা বলার ইচ্ছে নেই। এই ধরেন আমার নম্বর। মনিরের বিষয় কোনো খবর পেলে জানাবেন। আমি চললাম। আপনি কী করেন, কী করে বেড়ান, সেটা আমার দেখার প্রয়োজন নেই। তবে মনিরের তথ্য খবর দিতে পারলে, আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।’
‘আমি আপনাকে যেতে দেব না।’
‘বোকামি করবেন না। আমাকে আটকাতে চাইলে, আগে এই নম্বরে একটা কল করে জেনে নিন আমি কে?’
‘এটা কার নম্বর?’
‘আপনি ফোন করে জেনে নিন না। আমার নাম মুরাদ। শুধু এইটুকু বলবেন।’
জাফর উল্লাহ ফোন করল। ওপাশ থেকে রিসিভ করা হয়নি। জাফর উল্লাহ বলে, ‘কী সব আজেবাজে নম্বর, ফোন রিসিভ করে না।’
‘হায় রে পুলিশ, মন্ত্রীর নম্বরকে বলে আজেবাজে নাম্বার।’
জাফর উল্লাহ ভুরু কুঁচকে তড়িঘড়ি করে বলে, ‘কী বলছ, এটা মন্ত্রীর নম্বর!’
‘কথা বলে দেখুন।’
‘কী মন্ত্রী?’
‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোহরাব খান।’
‘এটা স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোহরাব খানের নম্বর।’
‘হুম রাঘববোয়াল। যাকে এমন শায়েস্তা করেছি। শেষে মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়েছে। সেই তুলনায় তুই হলে আমার কাছে সামান্য একটা পুঁটিমাছমাত্র। চুনিপুঁটি।’
‘আপনি আমাকে তুই করে বলছেন!’
মন্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে শরীরে একটা ভাব চলে এসেছে। জাফর উল্লাহ ভয় পেয়ে গেছে। একজন পুলিশ এসে জাফর উল্লাহকে বলল, ‘স্যার কোনো সমস্যা?’
ইনি বোধ হয় কনস্টেবল পদে আছেন। ওসি সাহেবের আশপাশে তিনি থাকেন। আমি বললাম, ‘সমস্যা হলে আপনি কি সমাধান করতে পারবেন?’
‘আপনি চুপ করুন, আমি আমার স্যারের সঙ্গে কথা বলছি।’
‘আপনার স্যার এখন কথা বলবে না। সমস্যার কথা জানতে চাইলেন না। আপনার স্যার সমস্যার পাহাড় বানাইছে।’
‘আপনি স্যারের সঙ্গে তুই–তোকারি করছেন কেন?’
‘সেটা আপনি বুঝবেন না। আপনি এখন আমাদের কথার মাঝে ডিস্টার্ব করবেন না।’
‘থানায় এসে একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে এমন ব্যবহার সাধারণ ভদ্রতার মাঝেও পড়ে না।’
কনস্টেবলের কথা বলা দেখে ওসি জাফর উল্লাহ বোধ হয় মনে মনে খুব খুশি। সেটা বোঝা যাচ্ছে। তাই তিনি চুপ করে আছেন।
‘শোনেন জাফর হলেন আমার স্কুলজীবনের বন্ধু।’
এই কথা শুনে জাফর উল্লাহর ভুরু কুঁচকে যায়। কনস্টেবলেরও একই অবস্থা। আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমাদের বয়সের মিল নেই। আমরা কীভাবে স্কুলজীবনের বন্ধু হই। আসলে বিষয়টা হচ্ছে, জাফর ছিল একটা গাধা স্টুডেন্ট। ক্লাস ফাইভে দুবার ফেল, সেভেনেও একই অবস্থা।’
আবারও ভুরু কুঁচকে যায় দুজনের। জাফর সাহেবের ফোনে কল আসে। মন্ত্রীর কল। জাফর উল্লাহ বলেন, ‘মিস্টার মুরাদ, এটা দেখি মন্ত্রীর ফোন।’
‘কথা বলুন।’
‘কী বলব?’
‘এটা আপনার বিষয়। আমাকে চেনার জন্য যা প্রয়োজন তাই বলেন।’
এবার কনস্টেবল নড়েচড়ে দাঁড়িয়েছে। সে বেরিয়ে যেতে চাইল। আমি বললাম, ‘এই আপনি যাবেন না। আপনার প্রমোশন হবে। একদম দাঁড়িয়ে থাকবেন।’
জাফর সাহেব ফোন রিসিভ করছে না। আমি ফোনটা হাতে নিলাম। রিসিভও করলাম। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ফোনের কথা বলার ভলিউমটা হাই করে বললাম, ‘কেমন আছেন মন্ত্রী মহোদয় সাহেব।‘
‘কে বলছিলেন?’
‘আমি মুরাদ, চিনতে পেরেছেন।’
‘ও মুরাদ, আমি একটা মিটিংয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা এটা কি তোমার নম্বর।’
‘না, এটা ওসি জাফর সাহেবের নম্বর।’
‘তুমি কি থানায়?’
‘জি।’
‘কোনো সমস্যা?’
জাফর সাহেব অনুরোধের ভঙ্গিতে ইশারা করলেন ফোন রেখে দিতে। আমিও ফোন রেখে দিলাম। তারপর বললাম, ‘আপনার নামটা জাফর, নামের আগে মীর শব্দটা লাগাতে বাধ্য করবেন না।’
এদের সামনে থেকে চলে এলাম। কনস্টেবলও শেষে ভয় পেয়েছে খুব।
থানাতে বেশিক্ষণ থাকতে ভালো লাগে না। জাফর সাহেব ভাবছে, আমি খুব ভয়ংকর মানুষ। মানুষ মানুষকে ভয় পায় তখনই, যখন নিজের মধ্যে দোষত্রুটি থাকে। মনিরের জন্য থানায় আসা। এখন মনির কেমন আছে? সে কি তার ভালোবাসার মানুষ ময়নাকে খুঁজে পেয়েছে। আমার মনে হয় সে পাবে। এই জগতে সবাই খুঁজে বেড়ায়। আচ্ছা মুরাদ কি খুঁজে? সেটা জানার বিষয়। নিরাকে দেখতে ভালো লাগে। ঝিলমিলকেও। আলোকে? আলোর কথাটা একটু ভিন্ন। সে আসলে সমাজের আর দশটার মেয়ের মতো না। তার হাতটা আরও দশটা হাতের সঙ্গে মিশে যায়। আলিঙ্গনে মাথে। কত সুন্দরী একটা মেয়ে। রূপেগুণে গুণান্বিত। যাকে দেখলে চাঁদ চুপসে যায়। সূর্যের প্রখরতা কমে যায়। জগতের সেরা কিছু নিয়ে আলোর আগমন। কতজনে, কতমনে আলো নামের মেয়েটির শরীরের স্পর্শ পেয়েছে, তার হিসাবটা হয়তো আলোরই অজানা। আচ্ছা আলো তো আমাকে চায়। আমি কি আলোকে চাই? কে দেবে এর উত্তর? উত্তর দিতে মন নামের পাখি সাঁই দেয় না। শুধু উড়ে বেড়ায়। শত শত উত্তরের ভিড়ে ছলনা শব্দটি বেরিয়ে আসে। আর তাই তো সে ছলনাময়ী।