ছলনাময়ী-৬
ঢাকার শহরের এই এক সমস্যা, বৃষ্টি হলে কিছু কিছু জায়গা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। জনমানবের আবর্জনা দেখতে ভালো লাগে না। সেটা মানুষের মুখ দেখলে বোঝা যায়।
পুরানা পল্টনের একটা মোড়ে আবর্জনার স্তূপ বৃষ্টির পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই আবর্জনার ওপর দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। হেঁটে যাওয়ার সময় নাকে কাপড় ধরে যাচ্ছে। গন্ধটা খুব একটা বেশি নয়। চাইলে এ গন্ধকে সহজভাবে নেওয়া যায়। কিন্তু মানুষ সেটা করছে না। আমি দাঁড়িয়ে আছি এই আবর্জনা স্তূপের পাশে। আমার নাকে তেমন গন্ধ আসছে না। আমাকে যদি কেউ ঠিক এ মুহূর্তে দুটি আলুর গরম শিঙাড়া এনে দেয়, আমি এইখানে দাঁড়িয়ে আরাম করে খেয়ে ফেলতে পারব। অবশ্যই আমার শিঙাড়া খাওয়া দেখে কিছু লোক অবাক হবে, কিছু লোক মনে মনে বকা দেবে, আবার কেউ কেউ হাসবে। এটাই আমাদের স্বভাব। আচ্ছা, এখন যদি কেউ আমাকে শিঙাড়া এনে দিত, তাহলে বিষয়টা মন্দ হতো না।
কিছুটা দূরে, সামনে একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। হাতে আছে পান–সিগারেট। ছেলেটি ঠিক আমার দিকে আসছে। মাঝে এক ভদ্রলোক পানের জন্য ছেলেটিকে দাঁড় করায়। ছেলেটা পলকের মধ্যে এক খিলি পান বানিয়ে লোকটিকে দেয়। ভদ্রলোক ডান হাতে পানটি হাতে নিল এবং বাঁ হাতে খিলি পানের কোনার কিছুটা অংশ ছিঁড়ে ফেলে দিল।
তারপর আয়েশ করে পানটি মুখে ঢুকিয়ে দিল। একটা চমৎকার দৃশ্য ছিল। লোকটির পরনে লুঙ্গি আর ফুলহাতা শার্ট ছিল। হাতার অর্ধেকটা ভাঁজ করে রেখেছে। একটা চশমাও আছে। কিন্তু চশমাটা চোখে নেই, কপালেও নেই। এ লোকটির চশমাটা রাখা আছে মাথার ওপরে তালুতে। তাতেও লোকটিকে বেশ লাগছে। বোঝা যাচ্ছে, সে একজন ঢাকাইয়া। পান মুখে দেওয়ার পর একটা সিগারেটও নিল। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাল। পান চিবাচ্ছে, সঙ্গে সিগারেট। সিগারেটের প্রথম টান দিয়ে, চশমাটা চোখে পড়ল। তারপর লোকটা ওপরে তাকিয়ে প্রথম টানের ধোঁয়াটা হাওয়ার সঙ্গে ছেড়ে দিল। দৃশ্যটা চমৎকার ছিল বললেও ভুল হবে। তার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। তবে শেষের দৃশ্যটি দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ দেখতে হলো। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে, যা মানুষ দেখতে চায় না। মানুষের ওপর অত্যাচার, জুলুম, খুন, মানুষকে ঠকানো, এমন অনেক কাজই আছে, যা মানুষ দেখতে চায় না। এখানে যা হলো, পান–সিগারেট নিয়ে ছেলেটিকে একটা টাকাও দেয়নি এই ভদ্রলোক। আমি দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেলাম এই ভদ্রলোকটির কাছে। পান বিক্রেতা দাঁড়িয়ে আছে। লোকটিকে বললাম,
‘ভাইজান?’
লোকটি আমার দিকে না তাকিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি আবার একটু উচ্চকণ্ঠে বললাম,
‘ভাইজান?’
লোকটা দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি হাসিমাখা মুখে তাকিয়ে আছি। লোকটি বলল,
‘কে তুই?’
শুরুতে তুই সম্বোধন। এতে বুঝতে পারলাম লোকটা তেমন সুবিধার নয়। এই জগতে ব্যবহারে মাধ্যমে ভালো–মন্দ বোঝা যায়। কথায় আছে না, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। লোকটার বংশ খানদানি, এটাও বোঝা যাচ্ছে। আমি বললাম,
‘আপনি পান–সিগারেটের দাম দিতে ভুলে গেছেন।’
অমনি লোকটি আমার গালে এক থাপ্পড় মারল। থাপ্পড়ও যেনতেন থাপ্পড় না, একেবারে চাপার দাঁত নড়ে গেছে। এক–দুটো দাঁত পড়ে গেল কিনা, সেটাই ভাবছি। এদিকে পান–সিগারেট বিক্রি করার ছেলেটা এক দৌড়ে গায়েব। আমি বেচারা দাঁড়িয়ে আছি। লোকটা আরেকটি থাপ্পড় দেবে বলে হাত ওঠাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দুটি হাত ছড়িয়ে উচ্চ ধ্বনিতে বলে উঠি,
‘স্টপ! ডোন্ট শুট! আই এম ওকে। স্টপ ইজ স্টপ। ডোন্ট শুট।’
আমার কথা শুনে লোকটি স্তব্ধ হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে। লোকটি বলল,
‘কে, কে আপনি?’
তুই থেকে একেবারে আপনিতে চলে এসেছে। সে অলরেডি আমাকে বড় ধরনের কেউ ভেবে নিয়েছে। আমি বললাম,
‘আমাকে চেনা এত সহজ না। তবে আমি তোকে ঠিকই চিনেছি। এত দিন তোকে খুঁজছিলাম। আজ হাতেনাতে পেয়ে গেলাম। তোর একটা সুন্দরী বোন আছে। তাকে তুই খুব বেশি ভালোবাসিস। তুই এই এলাকার পাতি রংবাজ।’
এইটুকু বলতেই লোকটার পকেটে মোবাইল বেজে ওঠে। লোকটা আতঙ্কিত মনে পকেট থেকে মোবাইল বেড় করে। কিন্তু রিসিভ করছে না। মোবাইল হাতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
‘নিশ্চয় তোর বোন তোকে ফোন দিয়েছে?’
লোকটা হ্যাঁ–বোধক মাথা নাড়াল। আবার হয়তো এটাও ভাবছে, আমি কীভাবে বলে ফেললাম যে ওর বোন ফোন করেছে। আন্দাজে বললেন, আর সেটাই লেগে গেছে। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করি। মেয়েটি বলছে,
‘হ্যালো ভাইয়া তুমি কোথায়?’
‘আপনার ভাইয়া এখন আমার হাতে বন্দী। একটু নড়াচড়া করলে আমার লোকেরা আপনার ভাইকে গুলি করবে।’
‘কী বলছেন এসব, আপনি কে?’
‘আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার নাম মুরাদ।’
‘আপনি আমার ভাইকে আটকালেন কেন?’
‘কারণটা আমি আপনার সামনাসামনি বলতে চাই। আপনি চলে আসুন, পল্টন মোড়ে। আর হ্যাঁ, চালাকি করবেন না। চালাকি করলে আপনার ভাইকে...।’
বলে একটা রহস্যের হাসি দিলাম। লোকটা আমার হাসি দেখে আরও বেশি আতঙ্কিত হলো। আমাদের চারপাশে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। ঢাকার শহরে এই এক আজব লীলা। কিছু হোক আর না হোক, মানুষ ছুটে আসে। লোকটা এখনো এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে। সেই সঙ্গে জড়ো হওয়া মানুষগুলোও এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে। ওরা দেখছে, আসলে আমার লোকজন বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কি না। যদি একটা ছাদে দুজন লোক দেখা যাচ্ছে। তারা দাঁড়িয়ে আছে ছাদের রেলিং ঘেঁষে। এদের দিকে তাকাচ্ছে অনেকে। ওরা তো আর জানে না আমি অভিনয় করছি। একজনে বলে উঠল,
‘আরে কালাম ভাই! কী হয়েছে আপনার?’
আমি বললাম,
‘আপনার কালাম ভাই এখন কোনো কথা বলতে পারবে না। উনি কথা বললে গুলি খাবে।’
‘কে করবে গুলি? কার এত সাহস...?’
‘এই চুপ!’
লোকটা চুপ না হয়ে আরও জোরে উচ্চবাচ্য করে চলেছে। আর অমনি কষে দিলাম একটা চড়। এক চড়ে লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। চারপাশের সবাইকে বললাম,
‘আপনারা কেউ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সবাই যার যার কর্মস্থলে চলে যান।’
আমার এ কথায় বেশ কয়েকজন চলে গেছে। আমি কালাম মিয়াকে বললাম, ‘কালাম ভাই, আমি আসলে বড় কোনো মানুষ না। যাচ্ছিলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোহরাব খানের কাছে। এখানে ময়লার স্তূপ দেখে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির পানিতে আবর্জনাগুলো কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই দৃশ্য দেখছিলাম। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল গরম-গরম দুটো শিঙাড়া খেতে। এরই মাঝে দেখলাম আপনি পান–সিগারেট বিক্রেতা ছেলেটার কাছ থেকে পান সিগারেট খেয়ে তার টাকা দিলেন না, যেটা আপনি ঠিক করেননি। আপনি একজন রংবাজ মানুষ। টাকারও কোনো কমতি নেই। মানুষের কাছ থেকে উচিত কথা শুনলে, তার জবাব দেন হাত দিয়ে। আপনার চামচারও অভাব নেই।’
কালাম মিয়া বলল, ‘আমি এখন কী করব?’
‘তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু পান–সিগারেটের টাকাটা দিয়ে দিলেই হবে।’
‘এখন দেব কি?’
‘আরে না। পরে একসময় ছেলেটার সঙ্গে দেখা হলে দিয়ে দেবেন। এখন আপনি আমাকে গরম-গরম শিঙাড়া খাওয়াতে পারেন।’
আমার শিঙাড়া খাওয়ার কথা শুনে চামচা ও কালাম মিয়া খানিকটা অবাক হলো। আশপাশে কয়েকজন এখনো আছে। তারাও তাকিয়ে আছে। মানুষ এমনই সাধারণ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে অবাক হয়। আমি আবার বললাম,
‘কালাম ভাই, দেরি করবেন না, এই চামচাকে দিয়ে দুটো শিঙাড়া আনান তো। সঙ্গে পেঁয়াজ যেন থাকে। দুটো পোড়া মরিচ হলে আরও ভালো। তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়। আমার হাতে আবার সময় নেই। মন্ত্রীর কাছে যেতে হবে। ভাবছি আজকে চড় দিবস পালন করব।’
কালাম ভাই চামচাকে পাঠিয়েছে শিঙাড়া আনতে। আমি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব, এ কথাটা শুনে কালাম ভাই ভেবে নিয়েছে, ওপরে আমার হাত আছে। কালাম ভাই বলল,
‘একটা কথা জানার ইচ্ছে ছিল।’
‘জি, বলে ফেলুন।’
‘আপনি যে বললেন আজকে চড় দিবস পালন করবেন, এটা ঠিক বুঝলাম না।’
‘বুঝবেন, বুঝিয়ে বললেই বুঝবেন। আসল কথা হলো, আমাকে যে এক ঘা দেয়, আমি তাকে তিন ঘা দিই। এটা আমার ব্রত। তবে আমার কাজটুকু আমি নিজস্ব বিবেচনা থেকে খণ্ড খণ্ড বিভক্ত করে করি। এই ধরুন, আপনি আমাকে চড় দিলেন। তার বিনিময়ে আমি আপনাকে তিনটি কষে চড় দিতাম। তিনটির মাঝে একটি আপনার চামচাকে দিয়েছি। আরও বাকি রইল দুটি। আজকের দিনের মধ্যে দুটি চড় কাউকে না কাউকে দিতেই হবে।’
‘আপনি কি আমাকে চড় দেবেন?’
‘না। কারণ, আপনার সুন্দরী বোন আপনাকে নিতে আসবে। যতটুকু বুঝতে সক্ষম হলাম, আপনি আপনার বোনকে খুব বেশি ভালোবাসেন। আপনার বোনও আপনাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। একটু পর এক বোন এসে যখন দেখবে তার শ্রদ্ধাভাজন ভাইকে কেউ চড় মেরেছে, সেটা হবে এই পৃথিবীর বুকে খুব বেশি অসুন্দর দৃশ্য। আমি সেই দৃশ্যটি দেখতে চাই না।’
শিঙাড়া চলে এসেছে। দুটি নয় অনেকগুলো। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, পোড়া মরিচ, সবই আছে। আমি একটা শিঙাড়া হাতে নিয়ে চলে এলাম। কালাম ভাই বলছে,
‘শিঙাড়াগুলো নিয়ে যেতে।’
‘আপনার আদরের বোন এখনই চলে আসবে। শিঙাড়াগুলো দুই ভাই–বোন মিলে খাবেন।’
আমি হাঁটছি, কিছুটা পথ যাওয়ার পর পেছনে দৃষ্টি দিলাম। দুটি মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছি, কালাম ভাই ও তার বোন তাকিয়ে আছে। এটাই জীবন। একটু আগে যে মানুষটা রেগে গিয়ে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল, সেই মানুষটাই কিছুটা সময়ের ব্যবধানে একবুক মায়া নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই পৃথিবীটা আসলে মায়ার পৃথিবী।
সূর্যমামা পশ্চিমে হেলে যাচ্ছে। মন্ত্রী সোহরাব খানের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তার আগে রুমেলের দেওয়া ফাইলটা নিতে হবে। এখন আবার বাসায় যেতে হবে। বাসার গেটের সামনে দারোয়ান রহমান চাচার হাসি মুখ। দেখতে বেশ লাগছে। তবে হাসিটা অতি আনন্দের। সেটা বুঝতে পারছি। আমি বললাম,
‘রহমান চাচা, কী খবর? খুব বেশি আনন্দে আছ মনে হচ্ছে। মেয়ের বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে?
‘মেয়ের বিয়ে না, মেয়ে ফিরে এসেছে।’
‘মানে কী? গ্রাম থেকে তোমার মেয়ে ঢাকায় চলে এসেছে!’
‘গ্রাম থেকে না, আমেরিকা থেকে এসেছে।’
বুঝতে আর বাকি রইল না, ঝিলমিল এসেছে। আমি রহমান চাচার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বললাম,
‘কী ব্যাপার চাচা, বড় লোকের মেয়েকে নিজের মেয়ে বানিয়ে ফেললে!’
চাচা খুব সহজ–সরল মানুষ। আমি জানি, এই পৃথিবীতে যতজন ভালো মানুষ আছে, এদের মধ্যে রহমান চাচা একজন। আমার কথার জবাবে চাচা বলল,
‘মেয়েই তো, ছোট সময় ঝিলমিল মামুনিকে কত কোলে নিয়েছি। কত আদর করেছি। আজ এত বছর পর দেশে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঝিলমিল মামুনি বলে, রহমান চাচ্চু, তুমি ভালো আছ তো? মেয়েটা বিদেশে থাকলে কী হবে, মানুষের প্রতি তাঁ=র ভালোবাসার কমতি নেই। তা না হলে আমার মতো একজন চাকরকে জড়িয়ে বলতে পারে, আমি তোমার মেয়ে।’
রহমান চাচার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। এই পানি যেনতেন পানি নয়। এই পানি একজন সৎ মানুষের আনন্দের পানি। আমি চাচাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করি। ঝিলমিল বসে আছে ব্যালকনিতে। আমি পেছন থেকে গেয়ে উঠি,
‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী...’
ঝিলমিল আমার দিকে আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। আর রূপ তো সেই। যার কোনো তুলনা হয় না। যা হোক, এখন কী হবে কে জানে? অমনি ঝিলমিল বলে উঠে,
‘তুমিই তাহলে মুরাদ ভাই?’
‘আজ্ঞে জি, এই অধমই মুরাদ।’
‘আমার সঙ্গে ঢং করবে না বলে দিচ্ছি। আর তুমি আমাকে আনতে এয়ারপোর্টে যাওনি কেন?’
‘ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিল বলে যেতে পারিনি।’
‘কয়টায় উঠেছিলে।’
‘এই তো ১১টা বাজে।’
‘বাহ, কী চমৎকার কথা। আমি এয়ারপোর্টে এলাম ১০টায়, আর মহারাজের ঘুম ভাঙল ১১টায়।’
‘থাক, বাদ দাও না। তুমি তো বাসায় চলেই এসেছ।’
‘বাসায় তো চলেই এসেছি, তুমি জানো এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসতে আমার কত কষ্ট হয়েছে!’
‘কেন, কোনো ঝামেলা হয়েছিল নাকি?’
‘থাক, আমি আর এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’
‘সেই ভালো। তুমি বরং একটু বিশ্রাম নাও। আমি এখন আসি।’
আজ আর কোথায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঝিলমিল বাসায় একা। কেন যে মেয়েটা একা একা চলে এল আমেরিকা থেকে। আচ্ছা, ওর জন্য কি আমার কিছু করার আছে। শত হলেও তো ওদের বাসায় আমার থাকা হয়। আচ্ছা, এ মুহূর্তে সে আমার ওপর রেগে আছে। সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে ছাদে যাব। ঢাকার শহরের অদ্ভুত কিছু দৃশ্য দেখাব, যেটা তার ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। ঝিলমিল কত সুন্দরী একটা মেয়ে। চোখটা একেবারে লাল পদ্ম ফুল। মুখটা ভর্তি মায়া। কিন্তু আমি তো মায়ার কিছু দেখলাম না। দেখেছি আগুন। এমন আগুন, যেন ওকে ছুঁলে পুড়ে যাব। কাজের বুয়া মরিয়ম এসে বলে গেল, ঝিলমিল আমাকে ডাকছে। আমি আর দেরি করলাম না। সোজা ঝিলমিলের সামনে চলে এলাম। ঝিলমিল আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি যে আমাকে আনতে যাওনি, এতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। আর তাই আমি ঠিক করেছি, তোমাকে শাস্তি দেব।’
‘যথা আজ্ঞা মহারানি।’
‘এখন থেকে আমি যা বলব, তুমি তা–ই করবে?’
‘হুকুম তামিল করুণ মহারানি।’
ঝিলমিল আমার কথা শুনে হেসে দিল। আর বলল,
‘মুরাদ ভাইয়া, তুমি তো ভারি দুষ্টু। আমার প্রতিটি কথার উত্তর দিচ্ছ আগের কালের রাজা–বাদশাগর সিনেমার অ্যাক্টরদের মতো।’
আমিও একটু হেসে বলে উঠি, ‘গোস্তাকি মাফ করবেন মহারানি।’
‘কী? আবারও!’
‘আজ্ঞে...’
ঝিলমিল আমার মুখ চেপে ধরে বলে,
‘আর একটা কথা বললে খবর আছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।’
ঝিলমিল ছোট সময় যতটা চতুর ছিল, এখন তেমনই আছে। আমেরিকা থেকে এসেছে। কিন্তু দেশের কালচার একটুও ভোলেনি। আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলছে, মনে হচ্ছে আমাদের প্রতিদিনই কথা হয়। আচ্ছা ঝিলমিল যে পৃথিবীর দশটা সুন্দরীর মাঝে সে একজন, সেটা কি সে জানে? আমি বললাম,
‘ঝিলমিল?’
ঝিলমিল আমার দিকে তাকাল। আমি তার লম্বা চুল একটু নাড়িয়ে বললাম,
‘তুমি যে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মেয়েদের মাঝে অন্যতম সুন্দরী, সেটা কি তুমি জানো?’
‘জানি, আমি সুন্দরী একটা মেয়ে। সেটা মা–বাবা বলত। প্লাস বন্ধুরাও বলত। কিন্তু সেরা সুন্দরীদের একজন, সেটা জানতাম না। বুঝতে পারছি, তুমি আমাকে হাওয়া দিচ্ছ।’
‘শুধু সেরাদের একজন না। তুমি হলে পৃথিবীর সেরা দশজন সুন্দরীর মধ্যে একজন।’
‘বাহ্, এই জরিপটাও করে ফেলেছ। তাহলে তো গিনেস বুকে আমার নাম থাকার কথা।’
‘এটা গিনেস বুক কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। তোমার মতো একটা সুন্দরী ললনার তথ্য নেই তাদের কাছে।’
‘তাদের ব্যর্থতা কি না, সেটা আমার বোধগম্য নয়। তবে তুমি যে সুন্দরী মেয়ে পটাতে ভালো জানো, সেটা বোঝা যাচ্ছে। মাথায় রেখো, আমি তোমার মামাতো বোন। আর আমি পটে যাওয়ার মতো মেয়ে নই। এখানে থেকো, আমি আসছি।’
আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার মনে হচ্ছে ঝিলমিল আমাকে কিছু দেবে। ঝিলমিলের হাতে একটা সাদা বক্স দেখতে পাচ্ছি। মোবাইল হতে পারে। সে আমাকে নতুন মোবাইলটা দিয়ে বলল, ‘আমি জানি, তোমার মোবাইলটা ভালো না। এখন থেকে এটা ইউজ করবে। আর ফেসবুকে আজকে একটা প্রোফাইল পিকচার আপলোড দেবে।’
‘যথা আজ্ঞা মহারানি।’
‘আবার...’
আমি হেসে দিলাম। ঝিলমিলও হেসে উঠল। যে হাসি দেখলে পৃথিবীর সব দুঃখ মোচন হয়ে যাবে।
মন্ত্রী সোহরাব খানের সঙ্গে দেখা করা হলো না। গতকাল দুটি চড়ও কাউকে দেওয়া হলো না। ঝিলমিলের মান–অভিমান ভাঙাতে, বিকেল–রাত অবধি ওর সঙ্গেই কাটাতে হলো। যা হোক, আজ একটু কালাম ভাইয়ে সঙ্গে দেখা করলে মন্দ হয় না। কালাম ভাই রংবাজ মানুষ। তাকে তাঁর মহল্লার সবাই চেনে। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচলের কমতি। গেটের ভেতর দিয়ে লক করা। অপেক্ষা করছি। ভেতর থেকে সিকিউরিটি গেটের ছোট্ট দরজাটা খুলে বাইরে আসে। আমি সালাম দিলাম। সিকিউরিটি সালামের উত্তর দিল। আমি বললাম,
‘কালাম ভাই আছে?’
‘জি আছে।’
‘আমি ওনার সঙ্গে দেখা করব।’
‘ভাইসাব কিছু মনে কইরেন না, আফনি এইখানে একটু খাড়ান, আমি যামু আর আমু। আফনের নামটা যেন কী?’
‘আমার নাম মুরাদ। নাম বললে না-ও চিনতে পারে। আপনি বলবেন, গতকালের চড় খাওয়া লোকটা এসেছে।’
আমার কথা শুনে মাঝ বয়সী সিকিউরিটির ভুরু কুঁচকে বলে,
‘মানে কী?’
‘মানে অতি সহজ, কালাম ভাই গতকাল আমাকে চড় মেরেছিল।’
‘এই মিয়া, ফাইজলামি করেন আমার সঙ্গে। কালাম ভাই আফনারে চড় দিছে, এরপরও আফনি কালাম ভাইয়ের সঙ্গে দেহা করতে আইছেন? আফনার এ কথা আমার বিশ্বাস করতে অইবো।'
‘আচ্ছা আপনি বিশ্বাস করেন বা না করেন, এতে কোনো সমস্যা নাই। এখন সামনে থেকে সরেন, আমি ভেতরে যাব। তা না হলে কিন্তু খবর আছে?’
‘হায় হায়, এই বেডা কয় কী, এ তো দেখতাছি আস্ত একটা বদমাশ।’
‘প্রথমে ভাবছিলাম, তুই একটা ভালো মানুষ। এখন বুঝতে পারছি তুই একটা ইতর ও মন্দ প্রকৃতির মানুষ।’
‘কী, তুমি আমারে গালি দিতাছো। আমি অহনে গিয়া কালাম ভাইকে বলমু, তুমি আমারে গালি দিছো, সঙ্গে একটা চড়ও দিছো!’
‘একটা না, বলবে দুইটা চড় দিছি।’
‘হ, তাই বলমু।’
এই বলে নিরাপত্তাকর্মী বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিল, আমি তাকে ডাক দিয়ে দাঁড় করিয়ে দুই গালে কষে দুটি চড় মারি। তারপর বলি,
‘মিথ্যা বলা মহাপাপ। তোর কথাটা সত্যি করে দিলাম। যেন তোর পাপ না হয়।’
নিরাপত্তাকর্মী হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয়। এরপর আমি বাড়ির ভেতরে চলে আসি। বেলা ১১টা বাজে। এখনো কালাম ভাই ঘুমাচ্ছে। এটা অবশ্য ঢাকাইয়া একটা খানদানি। ১১টা–১২টা পর্যন্ত ঘুমায়। তবে ওরা আবার রাতও জাগে। কাজের মেয়ে জেনি দরজা খুলে দিয়েছে। জেনি বলেছে, কোনো শব্দ যেন না করি। তারপরও আমি কালাম ভাইকে ডাকতে যাব, ঠিক সেই সময় একটা মিষ্টি কণ্ঠ কানে আসে।
‘আপনি কি গতকালের লোকটা?’
আমি কোনো জবাব দিলাম না। আমি বুঝতে পারছি, কালাম ভাইয়ের বোন সে। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে আমার সঙ্গে খুব একটা ভালো ব্যবহার করবে না।
‘কী হলো, কিছু বলছেন না যে?’
‘জি।’
‘আপনার তো সাহস কম না। গতকাল আপনি ভাইকে থ্রেট করে আজ আবার আমাদের বাসায় চলে এসেছেন। আপনি এই মুহূর্তে আমাদের বাসা থেকে বেরিয়ে যান।’
আমি কিছু বলার আগেই কালাম ভাই জেগে বলল,
‘কে? মুরাদ, তুমি কখন এলে?’
‘জি ভাই, এখনই এসেছি।’
‘না ভাইয়া, তুমি কোনো কথা বলবে না। উনি এখন, ঠিক এই মুহূর্তে চলে যাবে।’
‘নিরা, বোন আমার, ছেলেটাকে একটু বসতে দে, শত হলেও সে আমাদের বাসার মেহমান। আর মেহমানের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে না, বোন।’
‘না, উনি আমাদের কোনো মেহমান না। উনি একটা খারাপ মানুষ। উনি এখানে আসার আগে আমাদের সিকিউরিটিকে মেরে এসেছে।’
আমি তখন বললাম, ‘প্লিজ, আমার কথাটুকু শুনুন।’
‘আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি চলে গেলে আমি খুশি হব, প্লিজ।’
আমি আর কোনো কথা বললাম না। নিরার কথার পাল্টা জবাব দিতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা না করে চলে এসেছি। সুন্দরী মেয়েদের রাগ দেখতে সুন্দর লাগে। তবে নিরার রাগটা একটু ভিন্ন ছিল। একদিন সে রাগটাও বিদায় নিবে। একদিন আমাকে সে বসতে বলবে, এমনটা কেন জানি মনে হচ্ছে। মেজাজটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। একটা চা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে চা চাইলাম। দোকানে মানুষের ভিড়। চা দিতে দেরি হচ্ছে। দোকানিকে বললাম,
‘কী ভাই, চা দেওয়া যাবে?’
‘ভাইজান, চা বাসায় গিয়ে খাবেন। চলেন কালাম ভাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’
কালাম ভাইয়ের বাড়ির সিকিউরিটি এসে বলল। আমি সিকিউরিটিকে বললাম,
‘আপনি গালে কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন।’
সিকিউরিটি গালে হাত দিয়ে বলে, ‘থাক সে কথা। আগে বাসায় চলেন।’
‘আচ্ছা সিকিউরিটি সাহেব, আপনার নাম কী, তা জানতে পারি?’
‘আমার নাম ওমর ফারুক। আমারে সাহেব বলবেন না, আমি সামান্য একজন দারোয়ান মাত্র।’
দোকানদার চা দিল। আমি বললাম, ‘আরও একটা চা দেওয়া যাবে?’
দোকানদার বলল, ‘জি ভাই, দিচ্ছি।’
দোকানদারের এ কথাটায় একটু আতঙ্ক অনুভব করলাম। এটা কী কালাম ভাইয়ের বাড়ির সিকিউরিটি খাবে বলে। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কাপ চা বানিয়ে দিয়ে দোকানদার বলে, ‘ভাই সাহেব, কিছু মনে করবেন না। আপনি কালাম ভাইয়ের লোক, সে কথা আগে জানতাম না।’
ওমর ফারুক চা খাবে না। আমি রিকোয়েস্ট করছি, তারপরও খাবে না। এরপর চোখ একটু বড় করে বললাম চা খেতে। তখন চা নিয়ে খেতে শুরু করল। দুজনেরই চা খাওয়া শেষ। পকেটে হাত দিয়ে দেখি মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি। ওমর ফারুককে বললাম,
‘সঙ্গে টাকা আছে?’
‘না ভাই, টাকা নাই তো।’
চা দোকানদার বলছে,
‘ভাইজান আপনার টাকা লাগব না।’
‘অবশ্যই টাকা নেবেন। আমি কি কালাম ভাইয়ের মতো রংবাজ নাকি। আপনার টাকা আমি পরে এসে দিয়ে যাব।’
ওমর ফারুক বলল, ‘এবার চলেন ভাই সাহেব আমার সঙ্গে।’
‘না ওমর ফারুক সাহেব, আমি যাব না। আমি যেখান থেকে চলে আসি, সেখানে যাই না। আপনি চলে যান।’
‘ভাই সাহেব, কী কন? আমারে মাইরালাবো যদি আফনারে সঙ্গে না নিয়ে যাই।’
‘সমস্যা নাই। যদি আপনাকে মেরেই ফেলে, তাহলে আপনি আমাকে বলে যেতে পারেন, আপনার কবর কোথায় দেব। অনেকের তো স্বপ্ন থাকে মায়ের কবরের পাশে কিংবা বাবার কবরের পাশে কবর দেওয়ার।’
ওমর ফারুকের মুখটা মলিন হয়ে যায়। আমি কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করি। অমনি পেছন থেকে একটি ডাক কানে আসে,
‘এই যে শোনেন?’
মাথাটা ঘুরিয়ে দেখি নিরা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে। ভাবতে অবাক লাগে। নিরা আবার বলে ওঠে,
‘শোনেন, আপনার সঙ্গে কথা বলার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তবে ভাইয়া রেগে আছে। আমার কথায় আপনি চলে এসেছেন বলে সে খুব রাগ করেছে।’
‘এটা আপনাদের বিষয়। আমি চললাম।’
‘প্লিজ, আপনি যাবেন না।’
নিরার আবদার আমার রাখতে হলো। চলে এলাম কালাম ভাইয়ের কাছে। কালাম ভাই বলল,
‘তুমি এসেছ, আমি অনেক খুশি হয়েছি। বসো, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।’
‘আমার সময় কম ভাইয়া। আমি এখন চলে যাব।’
‘চলে যাবে...! আচ্ছা এবার বলো, আমার কাছে কেন এসেছিলে?’
‘আপনাকে সঙ্গে নিয়ে একটা জায়গায় যাব বলে এসেছিলাম।’
‘ভাইয়া কোথাও যাবে না।’
‘নিরা, আমাদের কথার মাঝে তুই কোনো কথা বলবি না। যা দেখ, দুপুরের খাবারের কী আয়োজন হয়েছে। আজ আমরা সবাই একসঙ্গে খাব।’
‘কিন্তু আমার যে এখন চলে যেতে হবে।’
‘আরে রাখো তোমার চলে যাওয়া। তুমি এসেছ আমাকে নিয়ে কোথায় যাবে। এখন আমিও তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার পরে।’
আমি বসে আছি। কালাম ভাই গোসলে গেছে। গোসল করে তারপর খাবে। নিরা আমাকে বলছে, ‘এবার খুশি তো। আমার ভাইকে কবজা করে। একবার বলবেন কি ভাইয়াকে নিয়ে কোথায় যাবেন?’
‘মন্ত্রীর অফিসে যাব?’
‘কী?’
‘বন্ধু রুমেল একটা ফাইল দিছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোহরাব খানকে দেওয়ার জন্য। গতকাল দেওয়ার কথা ছিল। আপনার ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা এবং বাসায় ছোট বোন আসাতে গতকাল ফাইলটা মন্ত্রীকে দেওয়া হয়নি।’
‘মন্ত্রী অফিসে যাবেন, এটা আপনার ব্যাপার। এর মধ্যে ভাইয়াকে জড়ালেন কেন?’
‘আমি বুঝতে পারছি, কালাম ভাই আমার সঙ্গে যাক, সেটা আপনি চান না।’
‘অবশ্যই আমি চাই না, আপনার মতো ফালতু একটা লোকের সঙ্গে আমার ভাই কোথাও যাক।’
‘আপনার কথাই ঠিক, আপনার ভাই আমার সঙ্গে যাবে না। কারণ, একটু পর কালাম ভাই এসে বলবে, তার একটা কাজ পড়ে গেছে। সে যেতে পারবে না।’
‘আপনি কি ভাইয়ার মতো আমাকেও বোকা বানাতে চান?’
‘কালাম ভাই বোকা না। তিনি অতি চতুর একজন মানুষ। তবে অতি চালাক মানুষও মাঝেমধ্যে বোকা হয়। সে ক্ষেত্রে আপনার কথা সত্য হতেও পারে।’
‘গতকাল আপনি কীসব বলেছেন, ভাইয়া তো বলছে, আপনি মনীষী টাইপের মানুষ। আপনার মাঝে নাকি অলৌকিক শক্তি আছে।’
আমার পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। রুমেলের ফোন। সে বলছে,
‘মুরাদ, ফাইলটা মামার কাছে পৌঁছে দিয়েছিস?’
‘না, তবে এখন যাব।’
‘তুই এখন কোথায়?’
‘পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মেয়েদের একজনের সামনে বসে আছি। সে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে খাওয়াবে বলে।’
‘বাহ, দারুণ তো। আচ্ছা শিখার সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘আরে বাদ দে তো শিখাটিখা। তুই বরং নিরাকে একবার দেখ। পাগল হয়ে যাবি।’
নিরা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, ‘এই, আপনি কী বলছেন?’
‘আমার শিখাকে চাই।’
বলে রুমেল কল কেটে দিল। আমি নিরার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘চেঁচাচ্ছ কেন?’
নিরা ভুরু কুঁচকে বলে, ‘আপনার সাহস তো কম নয়।’
কালাম ভাই চলে এসেছে। এসেই বলল,
‘মুরাদ, আই এম সরি। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারছি না। কারণ, আমার অন্য একটা কাজে এখনই বের হতে হবে।’
‘ওকে ভাই, আপনি বরং আপনার কাজেই যান।’
কালাম ভাই খেতে বসেছে। আমি এখন খাব না। সেটা বিনীতভাবে কালাম ভাইকে বুঝিয়েছি। আর তাই কালাম ভাই একা একা খাচ্ছে। আমি নিরাকে তার রুমে আসতে বলি। সে আসতে চাইছে না। একটু অনুরোধও করি। নিরা তারপর রুমে এল। আমি নিরাকে বলি, ‘আমাকে একটা হেল্প করবেন প্লিজ?’
নিরা একটু রেগে বলে, ‘কী হেল্প?’
‘আমাকে ১০০ টাকা দিতে হবে। আমার কাছে কোনো টাকা নাই।’
‘দিতে পারি, তবে একটা শর্তে।’
‘কী শর্ত?’
‘আপনি আর কোনো দিন এই বাসাতে আসবেন না।’
‘তাহলে আপনার টাকা ফেরত দেব কী করে?’
‘দিতে হবে না।’
‘যদি আপনি বলেন আসার জন্য।’
‘মাথা খারাপ! আমি আপনাকে আসতে বলব!’
‘যদি বলেন?’
‘আমি বললেও আসবেন না।’
‘ঠিক আছে।’
আমি নিরার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ঝিলমিলের কল আসে। রিসিভ করব কি না, সেটা ভাবছি। নাহ্, ঝিলমিলের সঙ্গে কথা বললে বাসায় চলে যেতে হবে। আচ্ছা, নিরা কি সত্যিই আমাকে অপছন্দ করে? জানি না। কেন জানি মনে হচ্ছে নিরা খুব ভালো গাইতে পারে। একদিন নিরার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনব। আচ্ছা, নিরা কি কখনো আমাকে রবীন্দ্রসংগীত শোনাবে?
রুমেলের শিখা, আমার আলো। আমার আলো! কত সহজে বলে ফেললাম, আমার আলো। আসলে কি আলো আমার। আলো আর শিখা দুটি নামের মানুষ মূলত একজন। আর তাই তো সে ছলনাময়ী। আচ্ছা ছলনাময়ীকে একটা ফোন দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই ভরদুপুরে আলো কী করছে? বোধ হয় আলো শুয়ে আছে। একটা কল করলে মন্দ হয় না। কল করলাম। রিসিভ করল না। দ্বিতীয়বার কল দিলাম না। আলো যদি কল ধরত, তাহলে তো একগাল হেসে জুড়ে দিত দরদি কণ্ঠে আলাপন। আমি হাঁটছি। আমি জানি, আলোর কণ্ঠে শুধু মায়া। শুধু প্রেম, যা আমাকে কাছে টানতে চায়। প্রকৃতির নিয়ম বোঝা বড় দায়। এক মেয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। আরেক মেয়ে ঘরে নিতে চায়। আর ছলনাময়ী মায়া মাখানো কথা বলে আমাকে ফাঁসাতে চায়।
লেখক: এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর।