বীথি: পর্ব-৭

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বীথি,

জীবনের একেকটা সময় একেক রকমের অনুভূতি দিয়ে মনটা ভরা থাকে, সেটি কখনোই আগে থেকে অনুভব করা সম্ভব নয়।

ছোটবেলায় মা বলতেন, ‘ভালো করে পড়াশোনা করো, না হলে জীবনে অনেক কষ্ট পাবে।’ তখন কি মায়ের কথা অনুভব করেছিলাম বা শুনেছিলাম পুরোটা?

আজকে যখন সেটি উপলব্ধি করতে পারি, তখন আর সেই সময়টা নেই হাতে।

প্রত্যেক মানুষকেই আলাদা আলাদাভাবে এই উপলব্ধির পথ দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, পৃথিবীর একজন মানুষেরও এ পথ থেকে মুক্তি নেই। আবার আমরা অনেকেই অন্য মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে জেনে যাই যেকোনো ঘটনার কার্যকারণ। তারপর বলি নিজেকেই, না না, আমি এসবের ভেতরে নেই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

অথচ সেই আমিই যখন একই কাজ করি, তখন বুঝতে পারি না, নিজেকে সান্ত্বনা দিই, আমি তো ওর মতো নই, আমার ব্যাপারে এটা হবে না। কিন্তু দেখা যায়, পরে আমার ব্যাপারে যা ঘটল, সেটি আগের জানা ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ। একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেছিল, প্রত্যেক মানুষই নিজের জিব দিয়ে জীবনের স্বাদ বুঝে নিতে ভালোবাসে।

এসব নিয়ে ভাবি সারাক্ষণ। মানুষের জটিল সম্পর্কের জাল, আবার ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা। কোনো একজন মানুষকে হয়তো খুব আপন করে পেয়েছিলাম, বন্ধু হিসেবে কাছের মানুষ হিসেবে, মনে হয়েছিল, এই যে মানুষ, এই যে বন্ধু, কত সুন্দর, কত উদার এই পৃথিবী।

সময় গড়াতে গড়াতে একদিন সেই চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যেতে থাকে। বলা কথাগুলো কেউ রক্ষা করতে পারি না। হয়তো আমিই পারি না। মনে মনে ঠিক করে রাখি, দূরত্ব রেখে মিশব, কোনো স্বার্থে জড়িয়ে যাব না। কিন্তু প্রমিজ করে কি বন্ধুত্ব হয় বীথি, বল?

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

সেই যে তোর মনে আছে, আমাদের সঙ্গেই অন্য স্কুলে পড়ত নিশি মেয়েটা? কী ভীষণ আধুনিক! সেই ১৯৮০ সালে ক্লাস এইটে থাকতে নিশি লন টেনিস খেলতে যেত ঢাকা ক্লাবে, আমার তখনো গ্রাম্য ভাব কাটেনি। নিশিকে একটা জন্মদিনের কার্ড লিখতে গিয়ে এক বাক্যে তিনটি বানান ভুল করেছিলাম। সে কথা ভাবলে এখনো গা শিরশির করে। সেই নিশিকে পরে ওর মা, মানে আন্টি জোর করে আমেরিকায় এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। নিশি তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।

আমি তার এক বছর আগেই বিয়ে করেছি, ঢাকা শহরে নারী আন্দোলন করি, ঢাকা শহরে অনেক চেনাজানা ছিল সেই সময়ে। নিশি এসে ঘটনা খুলে বলতেই আমি তাকে হোমরাচোমরা এক নারী নেত্রী ও আইনজীবীর কাছে নিয়ে গেলাম। উনি পরের দিনই নিশির বাবাকে ডেকে পাঠালেন। এর অনেক পরে জেনেছিলাম, নিশির নাকি দুই দিনের মাথায় সেই লোকের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যায়। আর নিশি বিয়ে করে ওর ভালোবাসার ছেলেকে।

কিন্তু আমার সঙ্গে নিশির সম্পর্কটা আর টেকেনি। নিশির মা–বাবা, মানে আঙ্কেল–আন্টিসহ ওর ভাইবোনেরা ওর ডিভোর্সের জন্য আমাকেই দায়ী করেছিল। কাউকেই বোঝাতে পারিনি, নিশিই আমার কাছে দিনের পর দিন এসে কেঁদেছিল। কী করে বোঝাব বল বীথি। যখন নিশি মুক্তি পেয়ে গেল তখন ওর প্রেমিকই প্রথম নিশিকে আমার সঙ্গে মিশতে বারণ করেছিল। সেই নিশি আজ লন্ডনে থাকে, স্বামীর সঙ্গে নামকাওয়াস্তের সম্পর্ক; কিন্তু ওর বড় বোন পলি আপা থাকে টরন্টোতে। আপার সঙ্গে খাতির হলো নতুন করে।

আরও পড়ুন

আস্তে আস্তে আপার কাছে জানলাম নিশির কথা। আদ্যোপান্ত জানলাম। আপা বলল, ‘তোমার কথা নিশি বলে খুব। ফোন কোরো একদিন ওকে।’ আমি ভাবি, জীবন থেকে ভুল–বোঝাবুঝির কারণে বেরিয়ে গেছে ১৮টি বছর। আমি আসলেই কেবল নিশির কষ্টের পাশেই দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আর এই পেলাম বীথি।

অপরাধ আমার জানিস, আজকে সে কথা খুব বিশ্বাস করি। সেদিন নিশিকে যদি বলতে পারতাম, তোর সমস্যার তুই সমাধান কর, আমি কিছু জানি না, তাহলে হয়তো ঠিক কাজ করা হতো। আজকে হয়তো নিশি লন্ডন থেকে ২০ বছর পরে ফোনে আবার কাঁদত না, আবার বলত না—‘জানো লুনা, ভালোবাসা হচ্ছে একটি সাময়িক মোহ। নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না করে বিয়ে করাটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল। এ ভুল থেকে আর কোনো দিন বের হওয়া যায় না।’

আরও পড়ুন

বল বীথি, সেই মেয়ে নিশি, কী বলব আমি?

আমার নিজের জীবনেই কি কম ভুল? অন্য সবার মতোই আমার জীবনেও ভুল আর ভুল। কিন্তু সান্ত্বনা একটাই, আমার সব ভুলের দায়িত্ব আমার একার।

পৃথিবীর আর একজন মানুষকেও আমি আমার জীবনের জন্য দায়ী করব না।

ওই যে মনে পড়ে উত্তম–সুচিত্রার ‘হারানো সুর’ ছবিতে, সুচিত্রা হাসপাতালে সেই সিনিয়র চিকিৎসককে কী গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে বলে, ‘ভুল করাও যে কোনো মানুষের এক মস্ত বড় অধিকার।’

কাল আবার অফিস শুরু বীথি। আদর তোকে।

**দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]–এ