বীথি: পর্ব-৬
বীথি,
প্রতিটা মানুষের জীবনে রিয়েল চ্যালেঞ্জ বা সত্যিকার বাধা থাকতে হয়। সেই তাড়না থেকেই সৃষ্টিশীল মানুষ ছুটতে থাকে জীবনের অসীম ইতিবাচক সম্ভাবনার দিকে। কথাটা কি জানিস বা মানিস তুই, এই সত্য?
আজকে পর্যন্ত খুব রেডিমেড/গৎবাঁধা/সেটেল্ড লাইফ থেকে বিশাল কোনো মহৎ মানুষ বা বড় কোনো জগৎ বিখ্যাত কাজ হয়েছে, সেই উদাহরণ কিন্তু দুনিয়ায় নেই বললেই চলে। তোকে কেন কথাগুলো বলছি জানিস?
আজ রোববার, চারদিকে সুনসান নীরবতা, মনের গহিনে বয়ে বেড়ানো কথা শেয়ার করি তোর সঙ্গে।
আরও ২–৩ ঘণ্টা আগেই ঘুমে ভেঙে গেছে, সংসারে আসলে আর তেমন কোনো কাজ নেই। অনেক যুগ আগে, অন্তত ৫০–৬০ বছর তো বটেই, আমাদের গ্রামে মানে মাগুরা জেলায় আমার এক নানি ছিলেন। আমরা ছোটবেলায় তাঁকে ‘দারোগা নানি’ ডাকতাম।
নানির ৭ ছেলেমেয়েরা সবাই হাইলি সেটেল্ড। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। নানির এ ছেলেমেয়েরা অমানবিক কষ্ট করে, মানুষের বাসায় লজিং থেকে লেখাপড়া করেছে, ইনফ্যাক্ট আমার নানা বাসায় থেকে পড়েছেন। অন্যদিকে সেই অর্থে আমার আপন মামা–খালারা কিন্তু জীবনে কিছুই সাইন করেনি। আমার মায়েদের চার বোনের ভেতরে একটাই খালা খুব সফল হয়েছেন, তারও কারণ প্রতিবন্ধকতা বা বিপুল বাধা।
যাহোক, আমাদের সেই দারোগা নানি তাঁর ছেলেমেয়েদের দিয়ে ঘরের সব কাজ করাতেন, হয়তো কোনো মেয়ে ডাক্তারি ফাইনাল ইয়ারের পড়া পড়ছেন, নানি তাকে ডেকে বলতেন, ‘আমার বাসন মেজে, ঘর ঝাড়ু দিয়ে, তারপর পড়তে যা।’
নানির কথা হলো, পড়াশোনা তো তোরা তোদের জীবনে সঙ্গে করে নিয়ে যাবি, কিন্তু এ সংসারের জন্যও তো তোদের কিছু কাজ করে দিতে হবে, কারণ আমি জন্মদাত্রী মা।
আজকে কত বছর পরে হবে? এসব গল্প যখন শুনেছি তখন ক্লাস ৬–৭–এ পড়ি।
বাংলাদেশের প্রবীণ মহিলারা জীবন থেকে কত বড় বিষয় আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যান, তাই ভাবি।
তোকে বলেছি এই বহমান জীবনের কথা বীথি, ৭–৮ মাস ধরে ভাবছি একটা পার্টটাইম কাজ না নিলে আর চলতে পারব না, অন্তত গাড়িটা চালাতে পারব না।
তাই নাইয়াকে গতকাল কাছে ডেকেছিলাম।
গত রাতে এই ঘরে কাছে বসে বললাম, ‘বাবু বলো তো এই যে তোমাকে নিয়ে কষ্ট করছি, তুমি চাইলেই আমি ডলার খরচ করে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করতে পারি না, এর আসল কারণ কী?’
নাইয়া মানে আমার একমাত্র ছেলেকে এই শহরে অনেকেই বেস্ট ছেলে বলে জানে। বোনেরা বলে, ‘পাগলের ঘরে সোনার টুকরা ছেলে। কিন্তু আমি এসব শুনতে চাই না, আমি নাইয়ার জীবনে রিয়েল চ্যালেঞ্জকে নিশ্চিত করতে চাই।’
নাইয়া মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির উত্তর দেয়, ‘আম্মু, তুমি তো আমাকে ৩–৪ বছর ধরে এই একটা কথাই জিজ্ঞেস করছ, আমি উত্তর দিয়েছি আবার বলব?’
হ্যাঁ বাবু, আবার বলো।
নাইয়া এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি ছোটবেলায় ভালো করে লেখাপড়া করো নাই, যা পড়েছ সেটা দিয়ে এর চেয়ে বেশি ভালো চাকরি পাওয়া যাবে না। আবার সেটার জন্য নানি আপু–নানা ভাই রেস্পন্সেবল না, কারণ ওরা তোমাকে অনেকবার বলছে তুমি সেটা শোনোনি।
আরও শুনবা আম্মু?
বলি, হ্যাঁ বলো। ছেলে আবার বলে, ‘আম্মু, আমি যদি ঠিকমতো লেখাপড়া না করি তাহলে আমি তোমার মতো এন্ড আপ করব এবং রেস্ট আফ মাই লাইফ কষ্ট করতে হবে। আরও বলব, নাইয়া আরও বলতে থাকে—আম্মু আমার হায়ার ডিগ্রির জন্য তোমার কোনো সেভিংস নেই, কারণ তুমি সিঙ্গেল ইনকাম সোর্সে আমাকে রেইস করছ। কানাডায় এটা খুব কঠিন। তাই আমার একটাই অপশন ভালো করে লেখাপড়া করে হায়ার এডুকেশন কনফার্ম করা।’
বীথি, এই হলো একমাত্র ছেলের সঙ্গে আমার রিলেশান। আজ পর্যন্ত নাইয়ার কাছে, আমার খুব পার্সোনাল কোনো কথা একবর্ণও হাইড করিনি, কেন করব?
ঘরের ভেতরে যার সঙ্গে বাস, সেখানে যদি ওপেন না থাকি, সারাক্ষণ চোরের মতো থাকতে হয়, তাহলে বাকি জীবন তো কেবল লুকোচুরির খেলাই খেলতে হবে বীথি।
এবার আরও সৎ ও সত্য কথা বলে লেখা শেষ করি কেমন?
এই শহরে খুব কম মানুষের সঙ্গে ওঠবস করা হয়ে ওঠে, তার কারণ দুটি—
১. আমার চাকরি হচ্ছে মানুষকে নিয়ে, তাই আলাদা করে মানুষের সঙ্গ খোঁজার দরকার পড়ে না।
২. দিন শেষে আসলেই একটু একা থাকতে চাই গত ৫–৬ বছরে এই অভ্যাসটা তৈরি হয়েছে।
তারপরও মানুষের সঙ্গেই দেখা হয়, কথা হয়। সেদিন আমার পরিচিত একজন মানুষ, এই শহরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে এসছে, এক বছরেই কয়েক লাখ ডলার খরচ করে বাড়ি–গাড়ি–ছেলেমেয়ের প্রাইভেট স্কুল–কলেজ নিশ্চিত করেছেন। ৫০–৫২ বছর বয়স হবে, স্ত্রীও নাকি উনার ক্লাসমেট। আমাকে ফোন করে বলছে, আপা, ‘আমার ওয়াইফকে কোথাও একটু ব্যস্ত করতে চাই, ডলার কোনো প্রবলেম না, বুঝতে পারেন তো আপনি, আমি সারা দিন ব্যবসার কাজে বাইরে থাকি ও ঘরে বসে লোনলি ফিল করে, আমার ওপর সেটা চাপ তৈরি করে, আপনি কি কোনো সাজেশন দিতে পারেন?’
মূর্খের মতো প্রশ্ন করি ‘আসলে আপনার স্ত্রী কী করতে চান? সেটা জানেন আপনি? ভদ্রলোক আবার বলেন। আসলে আপা, আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি ঠিক রোজগারের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বলছি না, আমি বলছি কোনো কোর্স বা অন্য কিছু, যা করলে ও ব্যস্ত থাকবে, ডলার নিয়ে আপনি ভাববেন না।’
নিজেকে নিজের কাছে বোকা বোকা লাগে।
বীথি, আজকে এ শান্ত ঝলমলে সকালে ডিসিশন নিয়েছি, পার্টটাইম কাজটা পেয়ে গেলে জয়েন করতেই হবে। পরম করুণাময়ীর কাছে অশেষ ঋণী–জীবনের প্রয়োজনে এখনো অ্যাকটিভ আছি, সারা দিন পরে নিজের ঘরে একমাত্র সন্তান নিয়ে দুটো ডাল–ভাত খেতে বসলে বুঝতে পারি, এই ভাতের প্রতিটা দানা কষ্ট করে উপার্জন করেছি, এক মুহূর্তের জন্যও ভুলি না, আমার বাবা প্রথম জেনারেশন ঢাকায়, আমার নানা–দাদা কৃষক, আমার সন্তানকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
তোকে আদর বীথি।
**দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণ কাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected] এ