বীথি: পর্ব–১

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এই বেলা তোকে লিখতে বসলাম।

কেবল টরোন্টো শহর নয়, সারা নর্থ আমেরিকার জন্যই আজকের এই দিনগুলো ইতিহাস হয়ে থাকবে। এটা ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস, কিন্তু ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝের সপ্তাহ থেকে বরফ শুরু হয়েছে, গত ২০ বছর এমন খারাপ বরফ আসেনি নর্থ আমেরিকায়।

কি ভীষণ ভয়াবহ, ভয়ংকর খারাপ আবহাওয়া গোটা কানাডা বা আমেরিকাজুড়ে। কেবলই বরফ আর ফ্রিজিং রেইন, আট বছরের কানাডার জীবনে এমন খারাপ আবহাওয়া দেখিনি। কিন্তু জীবন কি থেমে আছে, বল? কিছুই থেমে নেই সেই অর্থে, জীবন বয়ে যায় নিয়মমাফিক।

আজকেই সকালে, মনে পড়বে তোর আজকের দিনটা? গত সপ্তাহ থেকে ভুগছি জ্বরে আর ঠান্ডায়, তবু গিয়েছিলাম সেই ব্রাম্পটনে, প্রিয় অফিসের সেই ছিমছাম নিরিবিলি শহরে, ঢাকা থেকে কুমিল্লা যতটুকু দূর, আমার বাসা থেকে ব্রাম্পটন ততটুকু দূর। গাড়ি চালাচ্ছি ঠিকই কিন্তু মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম, পৌঁছে অফিসের রুমে বসতেই পারিনি, অমনি সহকর্মীরা ঠেলে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিল, সবাই বলছে, তোমার শরীর প্রথম, তারপর তো চাকরি, যাও এখনই, ডাক্তারের নোট নিয়ে বাড়ি ফিরে রেস্ট করো। আমি উপায়ন্তর না দেখে বরফ ঠেলে আবার ডাক্তারের কাছে ছুটি। সেখানে বসেই তোকে ফোন করেছিলাম ঢাকায়, তুই আমার সেই ক্লাস সিক্সের বন্ধু, ঢাকায় তখন সন্ধ্যা সাড়ে আটটা হবে, তোকে বললাম আমার চিঠি লেখার আইডিয়া, তুই তো অবাক, বললি, কি বলো তুমি? খুব মজা হবে তো তাহলে। ধানমন্ডি গার্লস স্কুলে গোলাপি জামা পরে আমরা একদল মেয়ে জীবন শুরু করেছিলাম, তুই আমার সেই বন্ধু বীথি। আমি সদ্য রংপুর শহর থেকে ঢাকায় এসেছি, আমার গায়ে চলনে–বলনে গ্রাম্য মেয়েদের জংলি বিহেভ, ধানমন্ডি স্কুলের খোলামাঠে খেলতে গিয়ে মেয়েদের ল্যাং মারতাম, জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে কথা বলতাম, ধানমন্ডি স্কুল কমপ্লেক্সের ভেতরে একটা আমলকীগাছ ছিল, কথা বলার আগেই গাছে চড়তে পাড়তাম, তোরা তখন ঢাকা শহরে ভবনে থাকা সভ্য মেয়ে, এসব জানবি কী করে? তবু কেমন করে যেন তুই-ই আমার প্রথম বন্ধু হলি।

কি সব দামি দিন ছিল সেসব, এখন ভাবলেও চোখ ভিজে আসে।

কত কত দিন তোর বাসায় কাটিয়েছি, সেই হিসাব কি আর আজকে মিলবে বল? চাচা–চাচি কেন যেন ভালোবাসতেন ভীষণ, ভীষণই আপন করেছিলেন আমাকে, আমার বিয়ের পরেও বেশ কয়েক বছর তোদের বাড়িতে আমার অবাধ যাওয়া–আসা ছিল, পরে জেনেছিলাম, চাচা মানে তোর বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন, আরও মিল ছিল আমাদের। কত মিল, তোদের/আমাদের বাড়ি রংপুর, তোর ছোট বোন মণি আর আমার বোন কণা বন্ধু ছিল, আসলে কি জানিস বীথি, এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, এসব মিল খোঁজার কি কোনো দরকার আছে?

বাংলাদেশের সে কোনো মেয়েই তো আমার প্রাণের বন্ধু, দেশের যেকোনো মানুষই তো প্রাণের মানুষ, দেশ আর দেশের মানুষ যে কী, সেটা কি ১৭ হাজার মাইল দূরে না এলে জানতাম কোনো দিন? কেউ কি জানে কোনো দিন? কাছে থেকে কি অভিমান বা বেদনা বোঝা যায়? কাছে থাকলে কি কোনো দিন কারও কদর হয় কখনো? ভালোবাসা বুঝতে হলে দূরে আসতে হয়, সব ছেড়ে দিতে হয়—এ কথা যে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, সেটা জানিনি কোনো দিন, কিন্তু আজকে, এই বিদেশবিভুঁইয়ে শুধু ঘুরেফিরে সে কথাই মনে পড়ে। ভাবি, রবি ঠাকুরের সেই গানের মতো—‘কেন দূরে গিয়ে গিয়ে ফিরে চাওয়া, শুধু যাওয়া/আশা...।’

একসময় দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়েছিলাম, দেশ ছেড়ে যে খুব খারাপ আছি, এমন কথা বলতে চাই না, কিন্তু যত বয়স বাড়ছে, কেবলই নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে। ভাবছি, দেশের প্রতিকূল পরিবেশে কেউ কি নেই? আমি কেন ফেলে এলাম তোদের সবাইকে? নিজের অতীত, বাবা–মা। যে দেশ আমাকে এতটা দিল, তাকে ফেলে এলাম; তাহলে তো আমি আসলেই নিমকহারাম।

জানিস বীথি, এই যে দুই জীবন, এই যে ফেলে আসা এক জীবন, আর বহমান এই জীবন। এই দুই জীবনের টানাপড়েন যাদের আছে, তারা আর কোনো দিন সুখী হবে না, কী হতে পারত আর কী হচ্ছে? এই যে জীবনের দোলাচল, এখান থেকে আর বুঝি মুক্তি নেই মানুষের? কেন আমার জীবন এমন হলো বীথি, তোর কাছে কোনো উত্তর আছে, বলবি আমাকে?

বীথি, মনে আছে তোর, আমরা চারজন প্রিয় বান্ধবী ছিলাম, আমি তুই, ইতু আর সোমা। আমরা চারজন একসঙ্গে বের হতাম ঈদের দিনে। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন, ইতু আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়লোকের মেয়ে ছিল, আর দেখতেও মনে হয় ও বেশি সাজুনি টাইপের ছিল। তাই চাচি ইতুকে ছাড়তে চাইত না একা। চাচি বলত, যদি লুনা থাকে ইতুর সঙ্গে, তাহলে ইতুকে যেতে দেব, মনে আছে তোর বীথি? তুই আর সোমা আমাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলতি, যা লুনা, ইতুকে নিয়ে আয়। আমরা চারজন ইতুর মায়ের কাছে ঈদের সালামির বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম ঢাকা শহরে। এই তো সেই ১৯৮০ সালের ঢাকা।

আর আজকের ঢাকা? মেলাতে পারিস বীথি? আমরা তিনজনই এখন নর্থ আমেরিকায় আর আমাদের ভেতরে সবচেয়ে ফ্যাশনপ্রিয় মেয়ে তুই, তোরই সবার আগে বিদেশ আসার কথা ছিল, ছোটবেলা থেকেই তুই-ই সবচেয়ে বেশি বিদেশে আসতে চাইতি, তোর বাবা আশরাফ চাচা আইএলওতে কাজ করতেন, মাসে ১৫–২০ দিন জেনেভায় থাকতেন, তোর জন্য কিনা আনতেন চাচা। ব্রেসলেটওয়ালা হাতঘড়ি, হেয়ার ড্রায়ার, হেয়ার স্প্রে, ব্যাগ, শ্যাম্পু, সাবান, পারফিউম—সব সব আনতেন। আর আমার তখনো ঢাকা শহরে দুই বছর হয়নি, অবাক নয়নে তোকে দেখা ছাড়া পথ কি, বল?

তুই স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হতি আর আমি অবাক হয়ে তোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম, বীথি কি করে এত সব করে? আমার মাথায় এসব কিছুই খেলত না, আমি কেবলই জানতাম, স্কুল যেতে হবে, বাসায় ফিরতে হবে, যদি আবার ফেল করি, মা মেরে ফেলবেন, কিন্তু আমি আবার ফেল করতাম, আবার মার খেতাম, ভীষণ একগুঁয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বলেই ছোটবেলার সুখের স্মৃতি মনে আসে না রে।

মনে আছে বীথি, একদিন স্কুলের ইংলিশ টিচার নাহার আপা তোকে ডেকে বলেছিল, এই মেয়ে, তুমি লুনার সঙ্গে মেশো কেন? ও তো কোনো পড়া পারে না। তুই অনেক পরে বলেছিলি সে কথা, এখোনো মনে পড়ে সেসব দিন।

সেই তুই এখনো বিদেশে আসতে পারলি না। দেশে ফোন করলেই বুঝতে পারি তুই বিদেশ আসতে চাস, কিন্তু কী উপায় বল? বাংলাদেশ থেকে আমি কি কেবল কষ্টই পেয়েছি বীথি? তাই কি দেশটাকে কোনো দিন ভুলতে পারলাম না?

ওই যে একটা কথা আছে না, মাই ইনার পেইন রিমাইনস মি, আই অ্যাম অ্যালাইভ।

বীথি, তোকে এবার বলব আমাদের জীবন, আমার চোখ দিয়ে তোকে দেখা, তোর চোখ দিয়ে আমাদের সময়কে দেখা, আমাদের চোখ দিয়েই আমাদের ভেতরকে দেখব, দেখব নিজেদের উল্টেপাল্টে—একদম আগাপাছতলা।

আদর বীথি। কথা হবে আবার।