বীথি: পর্ব-২

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ধানমন্ডি স্কুলের তিনটে সেকশন মিলিয়ে প্রায় দেড় শ মেয়ের ভিড়ে আমাদের বি সেকশনে পড়ত, মীরার কথা মনে আছে তোর? সেই যে দুই বেণি করে তেল–চপচপে মাথায় আমাদের সঙ্গে এসে বসত, একটু খেত বা আনস্মার্ট মীরা। মীরার গা থেকে কেমন একটা গ্রাম্য বোঁটকা গন্ধ আসত আর সেই সময়ে তুই তো পারফিউম দিয়ে স্কুলে আসতি।

ইনফ্যাক্ট মীরাকে মনেই করতে পারি না, কিছুতেই না। কিন্তু মীরার মনে আছে। আমাকে বলে, কী বলো লুনা? তোমাকে ক্লাসের সবাই চেনে, তুমি যে দুষ্টু ছিলা। বলি, দুষ্টু না বান্দর বল, মীরা।

যা–ই হোক, আজ তোকে মীরার গল্প করব। গত ৫ বছরে মীরা আমার বন্ধু হয়েছে, খুব ভালো বন্ধু। যদিও ও আমেরিকায় থাকে, অনেক অনেক দূরের একটা শহরে, আমাদের যোগাযোগ হয় ফোনে আর স্কাইপে; কিন্তু মীরা এখন এই দুই চোখে সবচেয়ে আধুনিক মেয়ে। মীরার জীবন বলতে গিয়ে তোকে বলা দরকার, মানুষের জীবনে ড্রাইভিং ফোরস বা ইনার মোটিভেশন বা সঠিক চালিকা শক্তির কথা; যা না থাকলে মানুষ আগায় না।

প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জীবনের রাজতিলক।

ওই যে ছোটবেলায় বাবা–মা বলতেন, মন দিয়ে পড়ো, ক্লাসে প্রথম হও, ভালো রেজাল্ট করো—এসব একটা সময়ের পর আর কাজ করে না, যদি তোর জীবনে রিয়েল ড্রাইভ না থাকে। মনে করে দেখ, আমাদের সময়ের কটা প্রথম হওয়া মেয়ে জীবনে আসলেই সফল হয়েছে? বীথি, আমরা এখন সবাই ৪৫ পার হওয়া মানুষ।

সেই তুলনায় মীরার অ্যাচিভমেন্ট আকাশছোঁয়া। কী করে মীরা এত দূর এল?

এই লেখা লিখতে বসার আগে মীরার সঙ্গে কথা বললাম পাক্কা দেড় ঘণ্টা। ছুটির দিন, মীরা জানাল, ওর জীবনে আর কী কী করার বাকি আছে। মন বলে, এই কি সেই মেয়ে, যার সঙ্গে স্কুলে থাকতে না পারতে কথা বলতাম? মীরা থাকে আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ছোট একটা গ্রামে। আমেরিকায় আছে ২৮ বছর।

মীরা নাকি এইচএসসি পাস করার আগেই বিয়ে করে ফেলেছিল। পাড়ার ছেলের সঙ্গে ভালোবাসায় জড়িয়ে গিয়েছিল, তাই বিয়েটা করতেই হয়েছিল। কারণ, ফরমাল বিয়ের আগেই ও প্রেগন্যান্ট হয়েছিল। এরপর শুরু হয় মীরার আসল জীবন। তরুণ প্রেমিক ছেলে হয়ে ওঠে সবচেয়ে দায়িত্বহীন মানুষ। শ্বশুরবাড়ির যৌথ জীবনে মীরা অমানবিক কষ্ট করে, বয়সে মীরাও ছোট; কিন্তু মেয়েদের বিয়ের পর আর ছোট থাকে না। তখন মীরার জীবনে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, বাচ্চার দুধ কেনার টাকা নেই, অথচ স্বামী জোর গলায় কথা বলতে পারে না, যেহেতু কামাই নেই। এদিকে মীরার যাওয়ার জায়গা নেই, বাবা–মায়ের কাছে কোনো সাহসে ফিরবে?

ভালোবাসার দায়িত্ব নিলে নীল যন্ত্রণাকে বরণ করতে হয়। আর সেখানে যদি স্বামী দায়িত্বহীন হয়, সেই ভোগান্তি যে কতখানি, সেটা কেবল সেই মেয়েই বলতে পারে। মীরা পড়েছিল সেই গ্যাঁড়াকলে। কিন্তু সময় গড়াতে থাকে, মীরার স্বামী তার পরিবারের সহযোগিতায় বিয়ের ৬ বছর পর আমেরিকায় আসে।

কিন্তু আমেরিকায় এলেই কি মানুষ বদলে যায়, বীথি?

কানাডায় বাঙালি পরিবারগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে জেনেছি। মানুষ (কী নারী, কী পুরুষ) তার সব আচরণ, অভ্যাস আর চিন্তাচেতনাকে বিদেশে আসার সময় লাগেজে করে নিয়ে আসে। সুতরাং যে সমস্যার সমাধান দেশে হয় না, সেটা বিদেশে এলেই ঠিক হয়ে যাবে, এটা ১০০ ভাগ ভুল।

বরং বিদেশে এলে বেশির ভাগ বাঙালি মেয়ে অনেক বেশি উন্নতি করে। কারণ বিদেশে, বিশেষ করে নর্থ আমেরিকায় সোশ্যাল সিস্টেমের কারণে মেয়েরা দ্রুত অ্যাডভান্টেজ পজিশনে চলে যায়, যা মীরার জন্য ১০০ ভাগ কার্যকর হয়েছে। মীরার স্বামীর বদলে মীরাই আমেরিকারতে আগে কাজ পায়। যদিও অড জব; কিন্তু হাতে ডলার আসতে শুরু করলে মানুষ বাস্তবতা উপলব্ধি করে আর নিজের শক্তিকেও চিনতে পারে দ্রুত সময়ের মধ্যে।

বাংলাদেশে যে মেয়ে সামাজিক চাপে নিজের মেধা আর শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে না, নর্থ আমেরিকায় সেই মেয়ে খুব কম সময়ে নিজেকে চিনতে পারে, যেকোনো কাজেই নিজের দায়িত্ব প্রমাণ করে তরতর করে আগাতে থাকে মীরা।

আরও পড়ুন

কিন্তু তার পরও আমরা বাঙালি মেয়েরা বাঙালিই থেকে যাই যুগ যুগ ধরে। মীরাও তা–ই ছিল। সংসার জীবনের অমানবিক নির্যাতন, দারিদ্র্য, কষ্ট ছাপিয়ে মীরা নাকি মোট ৭ বার বাসা থেকে বের হয়ে অ্যাবিউস শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিল।

ভার্জিনিয়ার সব কটা সোশ্যাল অফিস ওর ঝাড়া ঝাড়া হয়ে গেছে। সব ফ্যামিলি ভায়োলেন্স কাউন্সিলারই ওকে চেনে, তবু সংসার থেকে ফাইনালি মুক্তি মেলেনি মীরার।

বিদেশে ডিভোর্স করা কত ঝক্কি আর কত বেশি কোর্টকাচারি করতে হয়, সেটাও ভুক্তভোগীরা জানে। এদিকে মীরা যত বেশি সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে, ওর স্বামী শফিক তত বেশি মাত্রায় অত্যাচার করেছে। মীরা বলে, আসলে জানো লুনা, পুরোটাই ইনফিউরিটি জটিলতায় ভোগা। আমার রোজগারে সংসার চলছে, শফিক নিজে কোনো কাজে সেটেল করতে পারে না দায়িত্বহীন আচরণের কারণে।

সুতরাং বাচ্চারা চোখের সামনে বাবাকে অথর্ব বসে থাকতে দেখত, এসব মিলিয়ে শফিক রাগ আর ক্ষোভ ঝাড়ত আমার ওপর, আমি কী করব বলো? সারা দিন গাধার মতো কাজ করে বাড়ি ফিরে নরকযন্ত্রণা বহন করতে হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু আমি চেষ্টা করছি, আমার দিক থেকে একটাই সান্ত্বনা, লেভেল বেস্ট করেছি সংসার টেকাতে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এই বলে মীরা হেসে ওঠে। শোন লুনা, আমার ৪ ছেলে–মেয়ে, সবাই পড়াশোনায় সেরাদের চেয়ে সেরা। বড় মেয়ে আমেরিকার সেরা স্কুলে চান্স পেয়েছে, এই বছর ওর ইউনিভার্সিটির দুই বছর শেষ হলো। বাকি তিনজন ৪ বছরের মধ্যে হাইস্কুল শেষ করবে।

মীরা একটা অফিসে প্রায় সাত বছরের ওপরে কাজ করছে। অফিস ওর জীবনের আপস/ডাউন মোটামুটি জানে। শফিক দেখেছে, শত বিপদ আর কষ্টের মধ্যেও কী করে অফিসের কাজে অবিচল থেকেছি, এ বছর সিজিএ কোর্স শেষ করব আশা করছি, এরপর তো আমি যেকোনো অ্যাকাউন্টিং ফার্মে অনেক বেশি চাকরিতে জয়েন করতে পারব। তত দিনে আমার ডিভোর্সের ফরমাল পেপারসের কাজ শেষ হয়ে যাবে আশা করি। এরপর আর আমাকে পায় কে? আমি সারা দুনিয়া চষে বেড়াব, তাই না বলো?

স্কাইপো মীরার চোখের কোনায় চিকচিকে জল টের পাই। মীরা বলে, শফিক আসলে কোনো দিন আমাকে ভালোই বাসেনি। সৎ ভালোবাসার সঙ্গে দায়িত্ব থাকে, চারটে সন্তানের কারও বড় হওয়া বা পড়ার জন্য শফিকের কোনো অবদানের কথা মনে পড়ে না, কেবল বাবা ডাকলেই বাবা হয়?

যাক সেসব। লুনা, তুমি কিন্তু আসবে ভার্জিনিয়াতে, নতুন ল্যান্ড্রোভার গাড়ি কিনেছি, তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব, কেমন।

বীথি, এই হলো আমাদের মীরা।

মনে পড়ে তোর, সেই যে কালো করে নত মুখের মেয়েটা, আজ কেমন মুখ উজ্জ্বল করে আছে, বেঁচে আছে সাহসের সঙ্গে, ভাবতে পারিস বীথি?

আদর তোকে, আবার কথা হবে।

*দূর পরবাসে লেখা পাঠান [email protected]