বীথি: পর্ব-৩

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বীথি,

আবার সপ্তাহ ঘুরে গেল। আজকে শুক্রবার। কাল–পরশু দুই দিন ছুটি বলেই শুক্রবারের রাতকে ‘ঈদের রাত’ মনে হয়। সবচেয়ে বেশি নির্ভার লাগে আজকের রাত।

ফুট করেই আবার সোমবারটা চলে আসবে।

জানিস বীথি, একটা কথা ভীষণ সত্য মনে হয়। এই যে মানুষের জীবনে সময় চলে যায়, এটাই মানবজীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিক। বল, কেমন হতো, যদি সময় থেমে থাকত? যদি বলা হতো, তোমার জীবনের এ ঘটনার কারণে তোমার সময় থেমে থাকবে? ভাবলে অবাক লাগে।

আজকে অফিস লেট স্টার্ট, মানে অফিস শুরু করব দেরিতে, তাই এ বেলা চা নিয়ে তোকে লিখতে বসলাম। কিন্তু সকালে উঠেই ছেলেকে স্কুলে নামাতে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে ছেলের কথা শুনি আর ভাবি, তাহলে এভাবেই নিজের প্রিয়জনেরা আস্তে আস্তে বদলে যায়। আর আমরা ভাবি, আমার স্বামী, আমার সন্তান, আমার বন্ধু কী করে এমন কাজ করে? এমন কথা ভাবে কী করে?

আজকে আবারও বরফ পড়েছে শহরজুড়ে। ছেলে গাড়িতে উঠতে গিয়ে আমাকে বলে, ‘আম্মু, বড় হলেই ডালাস বা ফ্লোরিডা চলে যাব, বরফের দেশে থাকব না।’

বললাম, ‘আর আমার কী হবে, বাবু? আমি কি একা একা এই বরফের সঙ্গে যুদ্ধ করব?’ ছেলে চুপ। আমি আবার বলি, ‘বলো তুমি বাবু, আমি কী করব?’

‘তুমি তো অনেক ওল্ড হয়ে যাবা মা,’ ছেলের উত্তর। যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে বলি, ‘বাবু, তুমি তো একদিন অনেক ছোট ছিলা, বাজান। সেদিন তো আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাইনি, তাহলে আমি ওল্ড হলে তুমি আমাকে ফেলে যাবে কেন?’ বাবু আবার চুপ। আমি বলি, ‘কি হলো, উত্তর দাও।’ ও আবার বলে, ‘এটা তো এক কথা না, মা।’

আরও পড়ুন

‘অফকোর্স এক বাবা। শিশু ও ওল্ড বোথ আর হেল্পলেস, সো দুজনই এক। তুমি যখন অনেক ছোট ছিলা, মাত্র ১১ মাস, আমি তখন থেকে তোমাকে নিয়ে বেঁচে আছি। আমি তো তখন অনেক ইয়াং ছিলাম। কই, আমি তো তোমাকে ফেলে যাইনি? তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে তোমার লাইফের কথা ভাবো কী করে?’ ছেলে আবার চুপ।

এবার বলি, ‘বাবু, আই অ্যাম নট ফোরসিং ইউ। জোর করে আমি কিছু করব না। কিন্তু তুমি একবার ভাব, তোমার এই চিন্তা কি ঠিক?’

বাবুকে নামিয়ে দিয়ে নিজের সংসারে ঢুকে পড়ি, বীথি। আমার একান্ত ভুবন এটা।

এই শহরে আট বছর ধরে একান্ত ভুবন সাজিয়েছি। সংসারের প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে অসম্ভব আবেগ জড়িয়ে আছে। ছোট একটা শোপিস দেখলেই বলতে পারি, ঘর সাজানোর জন্য কোথায় থেকে এনেছিলাম এটা। এভাবে প্রতিটি জিনিস—সবই একটা একটা পিস করে জোগাড় করা। একবারে দোকানে গিয়ে সেট মিলিয়ে ঘর সাজাইনি, সাজাতে পারিনি রে বীথি। আমার জীবনটাই তো তেমন নয়। তুই তো জানিস সব, তবু বলছি তোকে।

ঘর কী করে তেমন হবে? কিন্তু সে নিয়ে কোনো কষ্ট নেই; বরং অহংকার আছে। কি ভীষণ একাকী হয়ে যাচ্ছি দিন দিন, তুই কি জানিস বীথি? আজকে যে ছেলেকে প্রশ্ন করছি, একদিন এই ছেলেকে আশ্রয় করে বেঁচেছি বীথি।

ছোট ১১ মাসের ছেলে নিয়ে সাহসী হয়েছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, ‘আমার তো সন্তান আছে, কেন অন্যায় মানব? কেবল ভাত–কাপড় আর সামাজিক কারণে নিজের ওপর জুলুমকে কেন প্রশ্রয় দেব?’ আমরা সবাই তা–ই বীথি।

একটা কিছু আঁকড়ে ধরি প্রবলভাবে। বাংলাদেশে গরিব মানুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, নিজের ছোট মাটির ঘর, সংসার, সন্তান যেভাবে আঁকড়ে ধরে জরিনা বা রহিমারা বেঁচে আছে, সেখানে টরোন্টো শহরের বাঙালিপাড়ার টিসডেল প্যালেসের দীপিদের সঙ্গে খুব বেশি ফারাক নেই জানিস। জরিনারা হয়তো খোলাখুলি বলতে পেরেছে, ‘আপা, বাচ্চার বাপে আরেক জায়গায় গিয়া শুইলে লাগাক গিয়া, হ্যার অন্য মাগি লাগব, কিন্তু আমি আমার সংসার ছারুম না।’

আরও পড়ুন

দীপিরা কথাটা খোলাখুলি বলে না, বা বলতে পারে না। ওরা এভাবে বলে, ‘আপা অনেক দিন হয়ে গেছে, সন্তানরা বড় হয়েছে, যত সমস্যাই থাকুক না কেন, এখন আর নতুন করে ভাবতে পারি না।’

অন্যদিকে জগজ্জয়ী বিখ্যাত মানুষ অমিতাভের স্ত্রী জয়াভাদুরী নাকি অমিতাভ–রেখার প্রেমের সেই অদম্য দিনগুলোয় মিডিয়াকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি অমিতাভ বা সংসার কোনোটাই ছেড়ে যাবেন না। তাহলে বল, কারও সঙ্গেই কি কারও কোনো বেসিক ফারাক আছে?

জরিনা, দীপি, জয়াভাদুরী—তিনজনের কারও মনেই কি কোনো অবসরে বা নীরব শান্ত সময়ে এটুকু মনে হয়নি, যে মানুষটাকে নিয়ে বেঁচে আছি, সে আমার থাকেনি। আমার প্রতি সৎ থাকেনি। আমাকে অসম্মান করতে পিছপা হয়নি—এমন কথা কি কারো মনেই আসেনি একবারের জন্যও?

যে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সারা লেখালেখিতে একাগ্র ভালোবাসা বা বন্ধনের কথা বলেছিলেন, তিনিও কি গুলতেকিনকে ছেড়ে দেওয়ার সময় একবারও নিজের দিকে ফিরে তাকাননি? একবারও কি নিজের বলা কথাগুলো ভাবেননি?

ভালোবাসা নিয়ে এমন ভাবনাগুলো খুব নাড়া দেয় বীথি। এত বয়স হয়ে গেছে তবু ভাবি, সত্যিকার ভালোবাসা ছাড়া মানুষ আর কিসের সঙ্গে আপস করে?

নিজের ওরসজাত ছেলের সঙ্গেও যেন জোর করতে না হয় বীথি।

বেঁচে থাকার জন্য ভালোবাসাটা ভীষণ জরুরি। কিন্তু আপস করে কি কারও মন পাওয়া যায় কোনো দিন? সংসারে টিকে থাকা আর মনে টিকে থাকা কি এক কথা?

তোকে অনেক আদর। আবার ফিরব তোর কাছে।

*লেখক: লুনা শীরিন, কানাডা

* দূর পরবাসে লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]