বীথি: পর্ব-৪

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বীথি,

তোর মনে আছে, আমাদের  ক্লাসে একটা ছোটখাটো মেয়ে ছিল, মুনা নাম। পেছনের বেঞ্চিতে বসত, টিফিন প্রিয়ডে গান শোনাবে বলে আমাদের কাছে এসে বসত। ও চিত্রা সিং–এর গান গাইত—‘মনে করো যদি সব ছেড়ে হায় চলে যেতে হয় কখনো আমায়, মনে রবে কি রজনী ভরে’ এ রকম কি গানের লাইনগুলো বীথি?

এর বেশি কিছু মনে পড়ে না। এমন গান শুনে, জীবনের মর্ম উদ্ধার করার মতো বড় আমি তখনো হয়নি, কিন্তু মুনার হয়েছিল। কিছু কিছু মেয়ে অনেক আগেই মহিলা হয়ে যায়, বড় হয়ে যায়, আজকে এত বছর পর মুনার গল্প শুনে মনে হচ্ছে আসলেই মুনা আমাদের অনেক আগেই বড় হয়ে গিয়েছিল। নইলে এমন করে জীবনকে যাপন করে কী করে? বীথি, সেই যে ধানমন্ডি গার্লস স্কুলে আমরা প্রায় দেড় শ মেয়ে পড়তাম, তিনটা সেকশনজুড়ে, আজকে যদি তুই সেই দেড় শ মেয়ের ভেতরে মাত্র ৫০টা মেয়ের জীবন খুব কাছে থেকে দেখিস, সবার জীবনকে সবার জীবনের জায়গায় দাঁড়িয়ে জানার ও বোঝার চেষ্টা করিস, দেখবি তুই বোকা বনে যাবি। তোর নিজের জীবনের যে কঠিন বাধাগুলো তোকে প্রতি সেকেন্ডে তাড়িয়ে বেড়ায়, তোর মনে হবে সেগুলো খুব সামান্য।

আরও পড়ুন

গত ১২ বছর নিজেকে নিজে এইভাবেই কাউন্সেলিং করে সাহস নিয়ে বেঁচে আছি। গত সপ্তাহে মুনার জীবন আর একবার বিস্ময় আর অবাক করে দিল, ভাবলাম তাহলে তো মুনাও জীবনের পার্ট? এই পৃথিবীতেই তো মুনার বাস?

আমাদের বন্ধু মুনার বিয়ে হয় ক্লাস নাইনে। বিদেশি বাঙালি ছেলে, মুনার চেয়ে ১৮ বছরের বড়, মুনা ৩১ বছর আগে কানাডার ক্যলগ্যরিতে চলে আাসে। সময়ের আবর্তে মুনার দুই ছেলে হয়, সময় গড়াতে থাকে, স্বামী মুজিব নাকি রাত করে ফিরত, মদ্যপ আর মেয়ে মানুষের জুড়ি ছিল না তার। এদিকে টাকা থাকলে নাকি সব ঢাকা পড়ে যায়। বাংলাদেশে মুনাদের গরিব পরিবারে দেড় শ–দুই শ ডলারও মুজিব পাঠাত মাসে মাসে। মানুষ কি আর সব দিক থেকে...হয়, বল?

সবচেয়ে নোংরা আর নিচু মানুষের ভেতরেও উজ্জ্বল কিছু একটা থাকে, নইলে মানুষ কেন? মুনার জীবনের গল্প এখানে শেষ হলেই ভালো হতো হয়তো। তাহলে এই শীতের সকালে লেপের ওম থেকে বেরিয়ে এই লেখা লিখতে হতো না হয়তো–বা।
কিন্তু কী করা বল?

আরও পড়ুন

মুজিব যেমন জানত না জীবন তার স্বেচ্ছাচারিতার কী জবাব দেবে, তেমনি মুনাও জানত না মধ্য চল্লিশে তার জীবনের কী স্বর্ণযুগ অপেক্ষা করে আছে। আসলে আমরা কেউ-ই আগামী সময়ের কথা জানি না। তবুও আমরা কথা দিই, কমিট করি আবার সেই প্রতারণার জীবনের সঙ্গেই বোঝাপড়া করে বেঁচে থাকি।

মুজিব যখন মুনাকে বিয়ে করে বিদেশে নিয়ে আসে, তখন মুজিবের মধ্য চল্লিশ। মুজিবের কাছে মুনার শরীরের আবেদন কয়েক দিনেই শেষ হয়ে যায়। সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। শরীর আর চিন্তাচেতনা যদি এক জায়গায় না মেলে, তাহলে কেবল শরীরের খেলা আর কদিন বলো? ২৫ বছর বয়সেই দুই সন্তান নিয়ে মুনা টালমাটাল হয়ে পরে বিদেশে নতুন জীবন, এদিকে স্বামী মন দিয়ে কাছে টানে না, মুনা বিহ্বল হতে থাকে প্রায়ই।

১০ বছর পর মুনা একটা ছোট কল সেন্টার-এ কাজে ঢোকে। মুজিবের বয়স যেহেতু পড়তির দিকে, ছেলেমেয়েরা বেশ বড় হয়ে গেছে, মুজিব তাই মুনার কাজে যাওয়াকে উৎসাহ দেয়। মুজিব বরং দুটো বাড়তি পয়সার জন্য লালায়িত হয়, শুরু হয় মুনার অন্য জীবন।

আরও পড়ুন

এত দিনে মুনা ইংরেজি ভাষাকে রপ্ত করেছে পুরোদস্তুর। কাজের জায়গায় পরিচয় হয় শ্রীলঙ্কান ছেলে সিভার সঙ্গে, মুনার অবদমিত ইচ্ছা উসকে ওঠে, ছেলেমেয়েরা চলে যাওয়ার পরে বাড়ি ফাঁকা পেলে মুনা আর সিভা বাড়িতেও সময় কাটায়।  

একদিন মুনা খবর পায় মুজিব হার্ট অ্যাটাক করেছে, সরাসরি বিছানা নিতে হয় মুজিবকে। তখন মুজিবের বয়স ৬৩, মুনা জানে এই শেষ, বাকি জীবন সিন্দাবাদের ভূতের মতো  মুজিবকে টানতেই হবে মুনার।

এবার মুনা মুজিবের সামনেই সিভাকে নিয়ে বাড়ি আসে। প্রথম দিকে মুজিব গলা দিয়ে গো গো করে শব্দ করত। কথা তো বলতে পারে না, হুইলচেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকে।

মুনা একদিন মুজিবের সামনে খুব শক্ত করে বলে, ‘একটা শব্দ করলে গলা চিপে ধরব।’ বলেই সিভাকে নিয়ে সশব্দে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে মুনা।

জানিস বীথি, মুনার যে কাজিন আমাকে মুনার কথা বলছিল তাকে বললাম, ‘আপা থাক, আমি আর শুনব না, বাদ দেন।’

সেই কাজিন বলে, ‘কেন শুনবেন না? আমি তো আপনার লেখা পড়ি। আপনি তো মনে করেন সব মেয়ে কেবল কষ্টই করে।’  

দ্যাখেন তো মুনা কে?  জানেন, মুনা নাকি একদিন সিভার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে গিয়ে বলেছিল, ‘তোমার কি মনে হয় আমার শুধুই শরীর আছে? আমার কি কোনো যোগ্যতা নেই? কী মনে করো তুমি?’

জানিস বীথি, মুনাকে বিয়ে করে আনার পর মুজিব বলেছিল, প্রথম বিয়ের রাতে শরীর ছাড়া আর কী আছে তোমার। মুনা ভুলতে পারেনি সেই অবারিত দুঃখ।

মুনা ভুলতে পারেনি ওর প্রথম বাসর, তাই হয়তো প্রতিশোধ নিতে নিতে ক্লান্ত।
আহা বীথি, আমাদের ছোটবেলার  স্কুলে পড়া সেই মেয়ে যে গান শোনাত—‘মনে করো যদি সব ছেড়ে হায়’।

তোকে আদর বীথি। বুকের ভেতরে কেমন বোবা কষ্ট  হচ্ছে রে।