বীথি: পর্ব-৫
বীথি,
আমাদের ক্লাসের সি সেকশনে পড়ত; ঝুমাকে মনে পড়ে? গার্লস গাইড করত? সেই যে নূরের চাঁপা আপার মেয়ে? নূরের চাঁপা আপা আমাদের বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন, আমাকে খুব বকতেন, যদিও সঙ্গত কারণেই।
আজ তোকে একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। টরন্টোয় আসার দুই বছর পর ঝুমার স্বামী রুবেল এসেছিল কানাডায়, কী যেন অফিসের কাজে, উঠেছিল বেবী আর রাশেদ ভাইয়ের বাসায়। বেবী ডে শিফটে কাজ করে আর রাশেদ ভাই সন্ধ্যার শিফটে। ওরা এই ব্যস্ততার ভেতরও রুবেলকে অনেক সময় দিয়েছে। গাড়ি চালিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখানো, ডাউন টাউন দেখানো, সিএন টাওয়ার, সবই সামলানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তবু নাকি রুবেল চার-পাঁচ দিন পর থেকেই রাশেদ ভাইকে বলতে থাকে, ‘আসল জিনিস কবে দেখাবেন?’
রাশেদ ভাইয়ের এমনিতেই কাজ নিয়ে, বাড়ি–গাড়ির মূল্য পরিশোধ করা নিয়ে মাথাখারাপ অবস্থা, উনি বুঝতেই পারেননি রুবেল কী বলতে চায়। চলে যাওয়ার দুদিন আগে রাশেদ ভাইকে নিভৃতে ডেকে রুবেল বলে, ‘কী বলব বলেন, আসলে কানাডায় আসা তো অনেক খরচ, অনেক কিছুই তো দেখলাম, কিন্তু ওই নাইট ক্লাবে যদি না যাই, তাহলে তো বন্ধুদের কাছে মান-সম্মান থাকে না, কাল তো আপনার ছুটি, চলেন শুধু আমি আর আপনি যাই।’
এ–ই হলো রুবেলের আসল কথা।
রাশেদ ভাই এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পান। তিনি হেসে ওঠে, ‘আরে এটা বলতে আপনার ১৫ দিন সময় লাগল রুবেল সাহেব? আপনি কি ভেবেছেন, টিভিতে বাংলাদেশে বসে সেসব ছোট ছোট কাপড় পরা বিদেশি মেয়ে দেখেন, ওরা খুব সহজলভ্য?
এবার নাকি রুবেল মাথা চুলকাতে থাকে। বীথি, এ কথা এখানেই শেষ, কিন্তু আবার শেষ নয়।
রাশেদ ভাই কানাডা আর আমেরিকায় মিলিয়ে আছেন ৩৪ বছর। উনি বিদেশে আসার পর, ছোট পাঁচ ভাইবোনের পড়াশোনা করানো, বোনদের বিয়ে দেওয়া, তত দিনে নিজের বিয়ে–সংসার, আবার সেই বাংলাদেশে বয়স্ক মা–বাবাকে দেখাশোনা করা, অন্যদিকে সারাক্ষণ মাথার ভেতর দুটা বাড়তি ডলার আয় করার চিন্তা, উনি কী করে রুবেলের মতো ‘আসল জিনিসের’খোঁজ রাখবেন, বল? উনি তো নিজের বউয়ের সঙ্গেই ‘আসল কাজ’ ঠিকমতো করতে পারেন না, উনি ডলার খরচ করবেন কী করে?
তোকে একটা কথা বলি বীথি। তোর বোন তো কানাডায় থাকেন, ওনার কাছে জানতে চাস তো, উনি যতবার নায়াগ্রা জলপ্রপাতে গেছেন, কতবার উনি বিভিন্ন রাইডে চড়েছেন? লক্ষ করে দেখবি, আমরা যারা নায়াগ্রায় যাই, সবাই ওই পানির স্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দিই, কারণ ওখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ডলার লাগে না। খুব অবাক হয়ে ভাবি জানিস বীথি, একজীবনে বিদেশে না এলে, নিজে উপার্জন করে কী করে জীবনে সামান্য আনন্দ পেতে হয়, সেই অনুভূতি হয়তো কোনো দিনই হতো না। হয়তো কোনো দিন জানতেই পারতাম না, কষ্ট করে সফল হওয়ার আনন্দ কী!
আমার যে বড় বোন আর বোনজামাই অড জব করে নিজেদের আনন্দ আর সুখ বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশে আমাদের ডলার পাঠাত বছরের পর বছর, আমাদের বাকি তিন বোনের বিয়ের গয়না পাঠিয়েছিল, বিদেশে না এলে জানতেই পারতাম না যে বড়পা আর বড়দা ওদের শেষ রক্ত দিয়ে আমাদের জন্য করেছে।
লাইন অব ক্রেডিট থেকে হাজারো ডলার ঋণ নিয়ে আমাদের আনন্দ কিনেছে বড়পা, আর আমরা বাংলাদেশে বসে নষ্ট–নোংরা সামাজিকতার নামে সেই কষ্টের ডলার খরচ করছি। বাংলাদেশে বসে ভাবতাম, বোন বিদেশে থাকে, ডলার না পাঠালে বড় বোন কিসের?
আজ হাড়ে হাড়ে বুঝি, এ রকম চিন্তা করার আগে বাংলাদেশের যেকোনো পরিবার যেন গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়। এর চেয়ে ভয়াবহ পাপ বা অন্যায় আর কী হতে পারে? আমি খুব চাই, আমার এই লেখা বিদেশি বাঙালিরা পড়ুক। তারা পড়ুক, যারা বরফ আর সস্তা খাবার খেয়ে দেশে মা–বাবাকে ২০–২৫ বছর ধরে টাকা পাঠিয়েছে।
আর তার বদলে পেয়েছে নির্মম ও অমানবিক উপেক্ষা অবহেলা আর অপমান।
তারা বলুক, লুনা আপনি ভুল বলছেন, আমাদের অনুভূতি আপনার মতো নয়। আমি সেই কথা শুনতে চাই। আমি দেখতে চাই, স্কুলশিক্ষক নূরের চাঁপার মেয়েজামাই বিদেশে এসে নিজের ডলার উপার্জন করে আসল আর নকল জিনিস খুঁজে বের করবে। সেদিন হয়তো উপলব্ধি করবে, নাইট ক্লাবে যাওয়ার আগেও বেশ কিছু কাজ বাকি থাকে। সেগুলো না করলে নাইট ক্লাবের চিন্তা আসবে কী করে মাথায়?
রাশেদ ভাইয়ের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে যখন বিদেশে আসেন, তখন তিনি জানেন যে পরিবারের সবার কাছে ধার করে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে বিদেশে এলে বাকি পুরোটা জীবন তার দায়ভার বহন করতে হয়। তখন আর নাইট ক্লাবের চিন্তা আসে না।
আজ আর না, এখুনি ছুটতে হবে, সেই ব্রাম্পটন, প্রিয় অফিস, অনেকটা পথ।
আদর বীথি। আবার ফিরব তোর কাছে।
দূর পরবাসে লেখা, ভ্রমণ কাহিনি, গল্প, নানা আয়োজন পাঠান [email protected] এ