স্লোভেনিয়ার রোজা ও ইফতারে বলকানের চিত্র, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি

আঙুরের পাতা কিংবা বাঁধাকপির আলিঙ্গনে ভাপে রান্না হওয়া মাংসের কিমা, যা দোলমা বা শার্মা নামে সমাদৃতছবি: লেখকের পাঠানো

মধ্য ইউরোপে ৭ হাজার ৮২৭ বর্গমাইল আয়তনের ছোট দেশ স্লোভেনিয়া। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, স্পেন, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক বা ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোর ভিড়ে স্লোভেনিয়া সব সময় নিভৃতে থেকে যায়। এমনকি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছেও স্লোভেনিয়া এখনো সে অর্থে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠেনি। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, গ্রিস, স্পেন বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর রাস্তাঘাট, যেখানে সব সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিবাসীদের পদচারণে মুখর থাকে, সেখানে স্লোভেনিয়ার ক্ষেত্রে মাল্টিকালচারাল শব্দটি কেন জানি এখনো সে অর্থে বিমূর্ত হয়ে ওঠে না।

বিশ্বের অন্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও রমজান আসে, উদ্‌যাপিত হয় অনেকটা অনাড়ম্বরপূর্ণভাবে। তবে এটি সত্য, যে ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মের পর ইসলাম স্লোভেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৩ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

স্লোভেনিয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই বসনিয়ান, মেসিডোনিয়ান, কসোভোর ও মন্টিনিগ্রিন বংশোদ্ভূত। ইতিহাসের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে তাদের এই অভিবাসনের কাহিনি। ১৯১৮ সালের ১ ডিসেম্বর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টেনিগ্রো, মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া ও কসোভো একত্র হয়ে যুগোস্লাভিয়া গঠন করে। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার অন্য অংশের তুলনায় স্লোভেনিয়া ছিল শিল্প ও অবকাঠামোগত দিক থেকে বেশ এগিয়ে। জীবনযাত্রার মানেও এটি অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে উন্নত ছিল। অন্যদিকে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া ও কসোভোর অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর ছিল। যদিও আজকের মানচিত্রে যুগোস্লাভিয়া নামের কোনো দেশ নেই, তবু স্বাধীনতার তিন দশক পেরিয়েও এসব দেশ শিল্পের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে পারেনি। তাই যুগোস্লাভিয়া শাসনামল থেকেই বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া ও কসোভোর সাধারণ মানুষ উন্নত জীবনের আশায় স্লোভেনিয়ায় পাড়ি জমাতে শুরু করে। কালের প্রবাহে তারা এ দেশেই স্থায়ী হয়ে যায়, নতুন শিকড় গজিয়ে তোলে।

ইফতারির টেবিল থেকে উঠে যাওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ ঘন গরম কফিতে চুমুক না দিলে অনেকের কাছে সারা দিনের রোজা যেন তার পূর্ণতা পায় না
ছবি: লেখকের পাঠানো

আজও স্লোভেনিয়ার কলকারখানার শ্রমিক কিংবা নির্মাণশিল্পের কর্মী বলতে বোঝায় বসনিয়ান, সার্বিয়ান ও মেসিডোনিয়ানদের। অন্যদিকে মেসিডোনিয়া ও কসোভো থেকে স্লোভেনিয়ায় পাড়ি জমানো অভিবাসীদের একটি বৃহৎ অংশ বেকারিশিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং স্লোভেনিয়ার বেশির ভাগ বেকারির মালিক তাঁরাই। এই অভিবাসীরা মূলত আলবেনীয় ভাষায় কথা বলেন এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে চলেন। স্লোভেনিয়ার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দেশটির অজপাড়া গাঁ কিংবা মফস্‌সল এলাকাতেও হালাল খাবারের দোকান খুঁজে পাওয়া খুব একটা কঠিন নয়। এমনকি কোনো দূরবর্তী গ্রামেও অনেক সময় নামাজ পড়ার জন্য নির্ধারিত জায়গার দেখা মেলে। ইসলাম স্লোভেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও সরকারিভাবে একটি মসজিদ বরাদ্দ পেতে দেশটির মুসলিমদের ২০২০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা এই অভিবাসীদের জীবনসংগ্রাম যেন এক নীরব কাব্য, যা লেখা হয়েছে শ্রম, স্বপ্ন আর আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ছুটে চলার অদম্য আকাঙ্ক্ষায়।

বিশ্বের অন্য দেশের মুসলিমদের মতোই স্লোভেনিয়ার মুসলিমরাও খেজুর মুখে দিয়েই ইফতার শুরু করেন। বসনিয়ান ভাষায় খেজুরকে বলা হয় ‘হুরমে’।

রোজার মাস এলে আমাদের দেশে এক অপূর্ব আমেজ জেগে ওঠে, যেন মানুষের হৃদয়ে আনন্দের স্পন্দন বয়ে যায়। গলির মোড়ে, রাস্তার ধারে, এখানে-ওখানে ইফতারির পসরা সাজানো থাকে, যেন উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়ে। বেগুনি, জিলাপি, ছোলা-বুট আর মুড়ির সঙ্গে পেঁয়াজু ও হালিমের সুবাস না মিশলে এ দেশের ইফতার যেন প্রাণ পায় না, যেন তা এক অসম্পূর্ণ কাব্য থেকে যায়। অন্যদিকে বলকানের মুসলিমদের রোজার আবহ আমাদের দেশের উচ্ছ্বাসের তুলনায় কিছুটা ম্লান, সাদামাটা। বলকানের মাটিতে বসবাসকারীদের খাদ্যতালিকা যেন এক অপূর্ণ কবিতা, যদি না সেখানে গ্রিলে ঝলসানো মাংসের সুগন্ধ মেশে, আজভার নামের সেই বিশেষ রোস্টেড রেড পিপার সসের মায়াবী স্পর্শ থাকে, আর ভিনেগারে ডোবানো শসার গার্কিনসের খটমিঠে স্বাদ না মেলে। ইফতারের সময়ও এই ঐতিহ্যের কোনো ব্যতিক্রম ঘটে না। প্রতিটি প্লেটে এই স্বাদের সমাহারই যেন পূর্ণতার ছোঁয়া এনে দেয়।

বলকানের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত রয়েছে বুরেক
ছবি: লেখকের পাঠানো

প্লেস্কাভিচা, গরু ও ভেড়ার মাংসের তৈরি সুস্বাদু কোফতা ও কাবাব বা চেভাপি ছাড়া স্লোভেনিয়ায় মুসলিমদের ইফতার কল্পনা করাই কঠিন। বলকান অঞ্চলের নিজস্ব স্বাদ বহনকারী এই প্লেস্কাভিচাকে অনেকেই যুগোস্লাভিয়া অঞ্চলের বার্গার বলেন। আমাদের খাবারের মতো বলকানের রান্নায় মসলার আধিক্য নেই। লবণ ও কখনো সামান্য গোলমরিচের সংযোজনেই তাঁরা মাংসের স্বাদকে অনন্য করে তোলেন। আর সঠিক পদ্ধতিতে গ্রিল করার মধ্য দিয়ে কাঁচা মাংসের প্রকৃত রসনা যেন অমৃতে পরিণত হয়। বিশ্বের অন্য দেশের মুসলিমদের মতোই স্লোভেনিয়ার মুসলিমরাও খেজুর মুখে দিয়েই ইফতার শুরু করেন। বসনিয়ান ভাষায় খেজুরকে বলা হয় ‘হুরমে’। সমুন, এক নরম ফ্ল্যাটব্রেডের সৌকর্য, মুরগির মাংস, সবজি ও ঢ্যাঁড়সের মেলবন্ধনে রচিত বেগোভা নামের এক বিশেষ স্যুপ বা চরভা, সুহো মেসো নামে খ্যাত স্মোকড ও কিউর করা মাংসের স্বাদ, আর আঙুরের পাতা কিংবা বাঁধাকপির আলিঙ্গনে ভাপে রান্না হওয়া মাংসের কিমা, যা দোলমা বা শার্মা নামে সমাদৃত—এসবই বলকানের মুসলিমদের মতো স্লোভেনিয়ার মুসলিমদের ইফতারের পাতে জনপ্রিয় খাবার হয়ে উঠেছে। গ্রিলে ঝলসানো টমেটো, বেগুন ও প্যাপরিকা, সুগন্ধি অলিভ, নানাবিধ বাদাম ও শুকনা ফলের সমাহার—এগুলো যেন তাদের ইফতারির তালিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে বাদ দিলে যেন সেই স্বাদের উৎসবটাই ম্লান হয়ে যায়। আর পনির ও ক্রিমসদৃশ কাইমাক? এ দুই তো তাদের ইফতারের পাতে এক অপরিহার্য রাজা, যার কদর আলাদাই।

স্লোভেনিয়ায় মুসল্লিরা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে খেজুরের মিষ্টতায় রোজা ভাঙেন, তৃষ্ণার জ্বালা মিটিয়ে মাগরিবের নামাজের জন্য দ্রুত পা বাড়ান। নামাজ শেষে তবে বসে ইফতারের আসর—একটি শান্ত–স্নিগ্ধ সমাপ্তি, যা দিনের ক্লান্তিকে আলতো করে বিদায় জানায়।

বলকানের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত রয়েছে বুরেক, এক বিশেষ পাই বা সুস্বাদু পেস্ট্রি, যা জীবনের স্বাদে মিশে আছে অবিচ্ছেদ্যভাবে। বুরেকের রূপ নানাবিধ—মাংসের কিমায় ভরা মিশ বুরেক, পনিরের কোমলতায় মোড়া চিজ বা সির বুরেক, পালংশাকের সবুজ সমারোহে বুরেক স্পিনিচ, এমনকি পিৎজা বুরেকের আধুনিক ছোঁয়া। একটুকরা বুরেক, সঙ্গে টক দইয়ের শীতল স্পর্শ সারা দিনের রোজার পর ক্লান্ত দেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়, যেন নতুন এক প্রবাহে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক ও গ্রিসের পাশাপাশি বলকানের দেশগুলোতে বাকলাভা একই রকম জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। এ ছাড়া বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া ও কসোভোর মতো দেশগুলোর মানুষের ইফতারের পাতে স্থান করে নেয় এক অনন্য মিষ্টান্ন, যার নাম তুফাহিয়া—একটি বিশেষ ডেজার্ট বা পুডিং। পোচ করা আপেলের গর্ভে আখরোট আর চিনির সুস্বাদু মিশ্রণ ভরে, তার ওপর হুইপড ক্রিমের নরম মুকুট সাজিয়ে তৈরি হয় এই তুফাহিয়া, যেন স্বাদের কাব্য।

যুগোস্লাভিয়া অঞ্চলে বার্গার হিসেবে পরিচিত প্লেস্কাভিচা
ছবি: লেখকের পাঠানো

ইফতারির সময় পানীয় হিসেবে টেবিলে আসে লেমোনেড থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফলের রস, বোজা, আইরেন কিংবা কম্পোট। বোজা একপ্রকার ফার্মেন্টেড শরবত। আইরেনকে আমাদের দেশের ঘোলের সঙ্গে তুলনা করা যায়, একটি স্নিগ্ধ ও পরিচিত স্বাদ। আর কম্পোট? আপেল, পেয়ার ও প্লামের মতো ফল জ্বাল দিয়ে তৈরি এক বিশেষ শরবত, যেন ফলের রসে ঘন হয়ে ওঠা এক কথন। ইফতারির টেবিল থেকে উঠে যাওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ ঘন গরম কফিতে চুমুক না দিলে অনেকের কাছে সারা দিনের রোজা যেন তার পূর্ণতা খুঁজে পায় না। তবে এই কফির স্বাদ আমাদের চিরচেনা কফির মতো নয়, বরং এর মধ্যে মিশে থাকে এক অনন্য আভিজাত্য।

মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক ও গ্রিসের পাশাপাশি বলকানের দেশগুলোতে বাকলাভা একই রকম জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে
ছবি: লেখকের পাঠানো

রমজানের পবিত্র মাসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মসজিদের তরফ থেকে রোজাদারদের মধ্যে ইফতারি বিতরণের এক প্রাচীন রীতি প্রচলিত আছে, যেন সন্ধ্যার আলোয় এক অমৃতস্পর্শী ভালোবাসার বন্ধন গড়ে ওঠে। কিন্তু স্লোভেনিয়ার মাটিতে এমন সংস্কৃতির জন্ম এখনো হয়নি, যেন কোনো অলিখিত গল্পের পাতা এখানে ফুটে ওঠার অপেক্ষায়। সত্যি কথা বলতে, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো বা কসোভো থেকে আগত যে অধিবাসীরা এখানে বসবাস করেন, তাঁদের অধিকাংশই স্লোভেনিয়ার মানদণ্ডে দিন এনে দিন খাওয়ার জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। তবু তাঁদের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে এক অদম্য উদারতা। এ কারণেই অনেক মুসল্লি নিজের উদ্যোগে মসজিদে ইফতারের আয়োজন করেন, যেন সামান্য প্রয়াসে একটি সামূহিক আনন্দের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে।

স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানায় দেশটির ইতিহাসে প্রথম সরকারি মসজিদ
ছবি: লেখকের পাঠানো

রাজধানী লুবলিয়ানায় অবস্থিত দেশটির একমাত্র সরকারি মসজিদে রোজাদারদের জন্য ইফতারির ব্যবস্থা থাকে বটে, তবে তা পকেটের পয়সায় কিনতে হয়—একটি সূক্ষ্ম বৈপরীত্য, যা আত্মার উদারতার সঙ্গে বাস্তবের কঠোরতাকে মিলিয়ে দেয়। আমাদের দেশে রমজানের সময় মাগরিবের আজানের পর রোজাদারেরা প্রথমে ইফতারির মাধ্যমে রোজা ভাঙেন। তারপর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে মাগরিবের নামাজের জন্য মসজিদে একত্র হন, যেন সময়ের স্রোতে এক পবিত্র সমাগমের আহ্বান বেজে ওঠে। অন্যদিকে স্লোভেনিয়ায় মুসল্লিরা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে খেজুরের মিষ্টতায় রোজা ভাঙেন, তৃষ্ণার জ্বালা মিটিয়ে মাগরিবের নামাজের জন্য দ্রুত পা বাড়ান। নামাজ শেষে তবে বসে ইফতারের আসর—একটি শান্ত–স্নিগ্ধ সমাপ্তি, যা দিনের ক্লান্তিকে আলতো করে বিদায় জানায়।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]