কানাডা আগমনের নেপথ্য-কথা: পর্ব-১
১ জুলাই, ২০০৬। বৃষ্টিস্নাত বিকেলবেলায় আমরা কানাডার সবচেয়ে জনবহুল শহর টরন্টোর পিয়ারসন্স বিমানবন্দরে এসে পোঁছাই। এখানে আসার আগেই যে তথ্যটি জেনেছিলাম, সেটি হচ্ছে টরন্টো শহরে কানাডার সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অভিবাসীর বাস। বিশেষ কোনো জাতিগোষ্ঠীর অভিবাসী নয় বরং সারা পৃথিবী থেকে আসা অভিবাসীদের প্রথম পছন্দের শহর হচ্ছে টরন্টো। ফলে শহরটিতে গড়ে উঠেছে একটি সহজাত মাল্টি-কালচারাল ভাইভ। আর যে জিনিসটি জানতাম না, সেটি হচ্ছে আমাদের আসার তারিখটির মাহাত্ম্য। ১ জুলাই হচ্ছে কানাডার ন্যাশনাল ডে, যাকে এ দেশে ‘কানাডা ডে’ বলে।
১৮৬৭ সালের এই দিনটিতে ইউনাইটেড কানাডাস, নোভা স্কশিয়া ও ব্রানসউইক—এই তিনটি পৃথক কলোনি একত্র হয়ে ব্রিটিশ এম্পায়ারের অধীনে কানাডা নামে একটি ডমিনিয়নে রূপান্তরিত হয়। তাই একসময় ‘কানাডা ডে’-কে ‘ডমিনিয়ন ডে’ বলা হতো। সেই থেকে দিনটি একটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কাকতালীয়ভাবে টরন্টোতে আসার জন্য দিনটি বেছে নেওয়ায় যে সুবিধাটি পাওয়া গেল সেটি হলো প্রতিবছরেই এটি একটি ছুটির দিন হিসেবে পাওয়া যাবে।
টরন্টো শহরে এই আমাদের প্রথম আসা—তাও আবার একেবারে তল্পিতল্পাসহ। পোর্টারের সাহায্য নিয়ে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পেরিয়ে যখন অ্যারাইভাল লাউঞ্জে এলাম, বাইরে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেওয়ার ধকলে কিছুটা হলেও ক্লান্ত আমরা। লাউঞ্জের কাচের দেয়ালের বাইরে বর্ষণসিক্ত টরন্টো শহরের প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ জীবনের চিত্র চোখে পড়তেই ক্লান্তির ভাবটা কেটে গেল অনেকটাই। টরন্টোতে আমাদের আগমন প্রথম হলেও কানাডায় কিন্তু নয়। বছর তিনেক আগে আমরা ভ্যানকুভার শহরে পাঁচ দিন কাটিয়ে গেছি, সেই সঙ্গে শেষ করেছি ‘ল্যান্ডেড ইমিগ্রান্ট’-এর প্রাথমিক সব আনুষ্ঠানিকতা। ফলে টরন্টোতে আমরা প্রবেশ করলাম কানাডার অভিবাসী হিসেবে।
আমাদের রিসিভ করতে এসেছে আমার ক্যাডেট কলেজের সহপাঠী আজমী। ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করার পর আমি আর আজমী দুজনেই চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে বেইজিংয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আন্ডারগ্রেড করতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। আজমী বছর পাঁচেক আগে ইমিগ্রান্ট হয়ে টরন্টোতে আসে। আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বড় স্যুটকেস আর কিছু হ্যান্ডব্যাগ। এত সব লাগেজ আজমীর গাড়িতে আটবে না, তাই একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করা হলো। সব লাগেজ নিয়ে আমি একা উঠে পড়লাম সেই মাইক্রোবাসে। আমার স্ত্রী ও পুত্র উঠল আজমীর গাড়িতে। অচেনা পথঘাট—অন্ধকারে গাড়ি ছুটে চলল হাইওয়ে ধরে বৃহত্তর টরন্টো এলাকার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত উইটবি শহরের অভিমুখে।
অভিবাসন ভিসা নিয়ে কানাডায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না আমাদের জন্য। সময়টা তখন ২০০৬-এর গোড়ার দিক। সাত ছুঁই ছুঁই বয়সের একমাত্র পুত্রসন্তানকে নিয়ে আমাদের ছোট্ট পরিবার। বসবাস সিঙ্গাপুরে। আমি সিঙ্গাপুরের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের একটি প্রজেক্টে সিনিয়র সফটওয়্যার প্রকৌশলী আর আমার স্ত্রী জন হপকিন্স হসপিটালের সিঙ্গাপুর শাখায় ক্যানসার সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত। আমাদের সন্তান সবে প্রাইমারি ওয়ানের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ করেছে। এই অবস্থায় সবকিছু ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি দেশে অভিবাসী হিসেবে চলে আসাটা ঠিক হবে কি না, সেটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হয়েছে আমাদের। সবকিছু বিবেচনা করে একসময় আমরা সিদ্ধান্ত নিই কানাডায় যাওয়ার।
টরন্টোর ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি তখন অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তায় উঠেছে। দুপাশে বাড়িঘরের তেমন চিহ্ন নেই, সবকিছু যেন অন্ধকারে ডুবে আছে। অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেন যেন সদ্য ছেড়ে আসা সিঙ্গাপুরের কথাই মনে হচ্ছিল বারবার। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ারের পদ নিয়ে সিঙ্গাপুরে আমি প্রথম আসি ১৯৯৭-এর ডিসেম্বরে। সেই থেকে একটানা সিঙ্গাপুরে। মাঝে বিয়ে ১৯৯৮-এর মে মাসে। সিঙ্গাপুরের পার্মানেন্ট রেসিডেন্সের প্রাপ্তি সেই বছরেরই অক্টোবরে এবং বিয়ের বছর ঘুরতেই ১৯৯৯-এর জুলাইতে আমাদের সন্তানের জন্ম।
আমার সিঙ্গাপুরে আসাটাও ছিল অনেকটা ঘটনাচক্রে। চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি নিতে বেইজিংয়ে যাই ১৯৮৭ সালে। প্রথম বছর চীনা ভাষা এবং পরবর্তী চারটি বছর সফটওয়্যার প্রকৌশলে অধ্যয়নের পর ১৯৯২-এর মাঝামাঝি সময়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। হংকংয়ে মাস তিনেক চাকরি পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে ঢাকায় ফিরি। দেশে তখনো ব্যাপক হারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা তৈরি হয়নি। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে এবং সরকারি কিছু দপ্তরে অল্প কিছু পদ তৈরি হচ্ছে। শুধু অল্পসংখ্যক উৎসাহী উদ্যোক্তা তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোতে সফটওয়্যার নিয়ে পরীক্ষামূলক কিছু কাজ করছেন। সে রকমই একটি প্রতিষ্ঠান ‘নিউ এজ গার্মেন্টস লিমিটেড’। সেখানকার সফটওয়্যার প্রোগ্রামার বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ায় নতুন লোক খোঁজা হচ্ছিল। আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আমার কাছে সেই খবর আসে। মৌখিক পরীক্ষা শেষে হাতে-হাতে অফার লেটার পাই। জীবনের প্রথম প্রফেশনাল জব। এর আগে অবশ্য বেইজিংয়ে অবস্থিত কলম্বিয়া দূতাবাসে ‘কম্পিউটার ট্রেইনার’ হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরি করেছি।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
‘নিউ এজ গার্মেন্টস’-এ আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল প্রোডাকশন ট্র্যাকিংয়ের ওপর সফটওয়্যার তৈরি করা। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের সাধারণ কর্মপদ্ধতি হচ্ছে অনেকটা এ রকম—প্রথমে বিদেশি ক্রেতারা ব্যাংক-চুক্তিপত্র অথবা লেটার-অব-ক্রেডিট প্রদানের মাধ্যমে ‘ক্রয় আদেশ’ নিশ্চিত করে, পরে সেই চুক্তিপত্রের বিপরীতে আমদানি করা হয় কাপড়, সুতা, লেবেল, বোতাম ও অন্য আনুষঙ্গিক পণ্য। তারপর সেগুলো দিয়ে পোশাক তৈরি করে পর্যায়ক্রমে রপ্তানি করা হয়। প্রতিবার রপ্তানি শেষে পোশাকের পরিমাণ অনুসারে মূল্য পেয়ে যায় গার্মেন্টস কোম্পানি। সেই মূল্য থেকে আমদানি করা সুতা, কাপড়ের বকেয়া মূল্য পরিশোধ করা হয়। আমার সফটওয়্যারের কাজ হচ্ছে এসবের হিসাব রাখা। একেবারে গোড়া থেকে কাজ শুরু করতে হয় আমাকে—সকাল নটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ডুবে থাকি কাজে। কাজ শেষে প্রায়ই চলে যাই শাহবাগের মোড়ে আর্টস কলেজের চত্বরে। চীন থেকে পাস করে আসা আরও কয়েকজন বন্ধু এসে জড়ো হয় সেখানে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আড্ডার ফাঁকে বেশ আঁচ করতে পারি যে অনেকেই আবার দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। ব্যতিক্রম শুধু দুজন—শামীম ভাই আর ফখরুল মামু। আজ তাঁরা দুজনেই অবশ্য না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বন্ধুদের ভেতর যারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে আগ্রহী তাদের সবার ভেতর একটা সাধারণ অনুধাবন হচ্ছে যে এদেশে পড়ে থাকলে নিজের এবং আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এটা শুধু আমার সেই বন্ধুদের অনুধাবন নয়, দেশের জনগণের একটা বড় অংশই তখন একইভাবে চিন্তা করছে। বলা যায় এই চিন্তাধারাটা পরিণত হয়েছে একটা ন্যাশনাল সাইকিতে। ব্যবসায়িক বুদ্ধিসম্পন্ন একটি মহল জনগণের এই পালসকে কাজে লাগাতে এগিয়ে এলেন। প্রতিষ্ঠিত হলো কানাডিয়ান প্রাক্তন ইমিগ্রেশন অফিসারদের সঙ্গে পার্টনারশিপে একধরনের এজেন্সি, যাদের কাজ হলো অর্থের বিনিময়ে কানাডার ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া। আগ্রহী মানুষের লম্বা লাইন পড়ল সেই সব এজেন্টের দরজায়। ‘ইমিগ্রেশন টু কানাডা’ পরিণত হলো ‘টক অব দি টাউনে’। আমার পরিচিত একজন এ রকম এক এজেন্সির মাধ্যমে কানাডায় অভিবাসী হয়ে এসেছে তখনকার আমলের চার লাখ টাকার বিনিময়ে।
আমি অবশ্য ‘ইমিগ্রেশন’-এর চেয়ে ‘এডুকেশন’-এর ব্যাপারে আগ্রহী হলাম বেশি। অগ্রজ সাত ভাই–বোনের সবারই পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি রয়েছে। তাই তাদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে খণ্ডকালীন স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হলাম বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস—বিকেল বেলায়। দুর্ভাগ্যবশত, বুয়েটের এই পার্টটাইম মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্সটা আমাকে পরে ছেড়ে দিতে হয় ফুলটাইম কাজের চাপে। ‘নিউ এজ’ গার্মেন্টসে আমি তখন সফলভাবে আমার প্রথম প্রজেক্ট ‘এল-সি ম্যানেজমেন্ট’ শেষ করে দ্বিতীয় প্রজেক্ট ‘স্টোর ইনভেন্টরি’র কাজও প্রায় শেষ করে ফেলেছি। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে চেয়্যারমান সাহেবের বিশেষ আগ্রহ থাকার কারণে কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে সরাসরি তাঁকেই নিয়মিত অবহিত করতে হতো আমাকে। তিনি নিজে আমার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে কাজে ঢুকিয়েছেন। সফটওয়্যার তৈরির সময় সিস্টেমের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় ডিফাইন করে দিয়েছেন। যেকোনো ধরনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁর অসাধরণ উপস্থিত বুদ্ধি চোখে পড়ার মতো। দিনের পর দিন তাঁর নির্দেশনায় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ করতে করতে একসময় আবিষ্কার করলাম যে তিনি যতটা না আমার বস, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘মেন্টর’। তাঁর অনেক উপদেশ আমি ‘লাইফ লেসন’ হিসেবে এখনো মেনে চলি। ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি বেইজিং থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার দুই বছর পর একই ইউনিভার্সিটিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন কোর্সে ভর্তির সুযোগ আসে আমার। আমার বেইজিং যাওয়ার খবরে ‘নিউ এজ’ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যানের মুখে কিছুটা হলেও আশাভঙ্গের ছায়া দেখতে পাই। তবে তিনি সব সময় আমার ক্যারিয়ারের জন্য সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। তাই এখনো যখন বাংলাদেশে বেড়াতে যাই, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ভুলি না। তিনিও তাঁর শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে সময় দেন। চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন: কানাডা আগমনের নেপথ্য-কথা: পর্ব -২