দ্বিতীয় জীবন: পর্ব–১
কানাডায় বাইপাস হয়েছে। চিকিৎসক এবং নার্সদের যে সেবা পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। পাঁচ পর্বের প্রথম পর্ব পড়ুন আজ...
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লিখেছিলেন, ‘সবচেয়ে কঠিন শিক্ষা হলো, জীবন থেমে থাকে না। তুমি যতই ভেতর থেকে ভেঙে পড়ো, যতই ক্লান্ত হও, জীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করবে না।’ কথাটি নির্মম, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে সত্য। জীবনের ধর্মই হচ্ছে নিরন্তর ছুটে চলা। এই ছুটে চলার ধরন অবশ্য মোটাদাগে দুই রকমের। প্রথমটি হচ্ছে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত ছুটে চলা। যেমন ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার তাড়া। সময়মতো বাস কিংবা সাবওয়ে ধরতে না পারলে অফিসে লেট হওয়ার টেনশন।
তারপর অফিসের কাজের তাড়া। ডেডলাইনের আগেই জমে থাকা কাজগুলো ডেলিভারি দেওয়ার তাড়া। এই তাড়াগুলো আমাদের প্রতিনিয়তই তাড়িয়ে বেড়ায়। আর দ্বিতীয় রকমের ছুটে চলাটা হচ্ছে নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতা বা নিজেকে অতিক্রমণের চেষ্টা। পেশাদারত্বের দৃষ্টিতে এর আবার ব্যাখ্যা আছে, ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য তোমাকে প্রতিনিয়তই তোমার কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন নতুন স্কিলসেট তোমাকে অর্জন করতে হবে, যাতে তুমি ইন্ডাস্ট্রিতে ‘এমপ্লয়েবল’ থাকতে পারো।
এটা একধরনের ‘ইঁদুর দৌড়’ যার কোনো শেষ নেই। আমরা যেকোনো পেশাতেই জড়িত থাকি না কেন, কমবেশি আমরা সবাই এই ছুটে চলার ভেতরই রয়েছি। কিন্তু যেটা শুনতে আরও বেশি আশ্চর্যজনক লাগবে সেটা হলো আমরা কিন্তু নিজেরাও টের পাই না যে আমরা একটি র্যাট-রেসের ভেতরই রয়েছি প্রতিনিয়ত। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।
আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্ত আছি কানাডার এক শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের ক্রেডিটসংক্রান্ত একটি সফটওয়্যারের সঙ্গে। প্রথমে আমি ‘সল্যুশন ডিজাইনার’ হিসেবে যুক্ত ছিলাম এই সফটওয়্যারের বিজনেস লজিক, কোড ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে। আমার বর্তমান পজিশন ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার। এই ক্রেডিট সফটওয়্যারে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ফিচার যোগ হচ্ছে। সেই ফিচারগুলো কীভাবে যোগ করা হবে, সেটার ‘বিজনেস রিক্যুয়ারমেন্ট’ বুঝে ‘সল্যুশন ডিজাইন’ করা আমার কাজের একটি বড় অংশ।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
তারপর আছে ডেলিভারি প্ল্যান। কবে এই ফিচারগুলো সফটওয়্যারের সঙ্গে যুক্ত হবে, যাতে ‘এন্ড ইউজার’দের কাছে এই ফিচারগুলো সময়মতো পৌঁছে যায়, সেটারও একটি ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করতে হয় আমাকে। এই ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করার জন্য আমাকে বসতে হয় বিভিন্ন টিমের বিজনেস এনালিস্ট, টেক লিড আর কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স-এর লোকজনের সঙ্গে। প্রথমে তাদের ফিচারগুলোর ‘বিজনেস রিক্যুয়ারমেন্ট’ সম্পর্কে ক্লিয়ার আইডিয়া দিতে হয়, যাতে বিজনেস অ্যানালিস্ট রিকোয়্যারমেন্টকে ‘ইউজার স্টোরি’তে কনভার্ট করতে পারে আর কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স টিম তৈরি করতে পারে, তাদের ‘টেস্ট সিনারিও।’ এরপর ডেভেলপমেন্ট টিমের টেক লিড ‘সল্যুশন ডিজাইন’ দেখে একটা হাই লেভেল আইডিয়া পায় কোথায় কোড লজিক অ্যাড করতে হবে।
তারপর তাদের টিম ক্যাপাসিটির ওপর নির্ভর করে তারা এস্টিমেট দেয় কখন তারা ফিচারগুলো ডেলিভারি দিতে পারবে। সেই এস্টিমেটের ভিত্তিতেই তৈরি হয় ‘রোডম্যাপ’। তারপর সেই ‘রোডম্যাপ’-কে প্রেজেন্ট করতে হয় ‘কোয়ার্টারলি প্ল্যানিং’-এর মিটিংয়ে। তারপর শুরু হয় আসল কাজ। আর তখন আমাকে খেয়াল রাখতে হয় কেউ যেন কাজে পিছিয়ে না পড়ে।
পড়লে তাদের দিতে হয় সাপোর্ট এবং সেই সঙ্গে তাড়া। আবার এরই মাঝে নেক্সট কোয়ার্টার-এর জন্য নতুন ফিচারের ‘সল্যুশন ডিজাইন’-এর কাজ শুরু হয়ে যায়। এত কিছুর পর আমাকে গাইড করতে হয় বিভিন্ন লেভেলের বেশ কয়েকজন ডেভেলপার বা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে। তাদের সঙ্গে সপ্তাহে এক দিন ‘ওয়ান-অন-ওয়ান’ মিটিং হয়। তাদের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের জন্য টার্গেট সেট করে দিতে হয়। বছর শেষে সেই টার্গেট তারা কতটুকু অর্জন করতে পারল, সেটা বিচার করে দিতে হয় পারফরম্যান্স গ্রেডিং যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তাদের ইয়ার-অ্যান্ড বোনাস আর ইনক্রিমেন্ট। আমাকেও ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের জন্য আমার ম্যানেজারের কাছে প্রেজেন্ট করতে হয় আমার প্ল্যান। ম্যানেজারও একইভাবে পারফরম্যান্সের ওপর নির্ধারণ করে আমার বোনাস আর ইনক্রিমেন্ট। এই হচ্ছে আমার কাজের রুটিন। কর্মজীবনের একঘেয়েমি দূর করার জন্য আছে ভ্যাকেশন। কিন্তু অনেক সময় কাজের তাড়ায় সেই ভ্যাকেশন আর নেওয়া হয় না সময়মতো।
আমার শরীরটা যে আগের মতো নেই, প্রথম সেটা টের পাই গত বছরের মাঝামাঝিতে। অফিসে যাওয়ার জন্য আমাকে সাবওয়েতে নামতে হয় ইউনিয়ন স্টেশনে। সেখান থেকে আমার অফিস সাত মিনিটের হাঁটাপথ। প্রথমে ইউনিয়ন স্টেশন থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে হয় ফ্রন্ট স্ট্রিটে। সিঁড়িটা বেশ খাড়া এবং লম্বা। পায়ে হেঁটে সিঁড়ি টপকিয়ে ওপরে ওঠার পর আমি যে হাঁপিয়ে উঠছি, সেটা টের পেতে শুরু করি। বাধ্য হয়ে সিঁড়ি না ভেঙে এস্কেলেটরে করে এই পথ পাড়ি দেওয়া শুরু করলাম। তবে বুঝতে পারলাম যে সাবধান হতে হবে। এমনিতে নিয়ম করে সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন ঘণ্টাখানেক বেশ জোরে হাঁটি, যাকে বলে ‘ব্রিস্ক ওয়াকিং’। তখন কিন্তু তেমন হাঁপিয়ে উঠি না। খাবারের ব্যাপারে ঠিক ক্যালরি মেপে না খেলেও ‘হেলদি ডায়েট’-এর দিকে নজর ছিল সব সময়ই।
আমার কোলেস্টেরল লেভেল কিছুটা হাই আর সুগারের লেভেল ছিল ডায়াবেটিসের দ্বারপ্রান্তে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ কার্ব কম খাও। মেনে চলার চেষ্টা করেছি সব সময়। তারপরও যখন লম্বা সিঁড়ি ভাঙতে হাঁপিয়ে ওঠা শুরু করলাম, তখনই মনে মনে ঠিক করলাম হার্টের একটা থরো চেকআপ দরকার। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় হয়ে উঠছিল না। তারপরও ডিসেম্বরের ছুটিতে যখন একদিন মাথাব্যথার কারণে অসময়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম, তখন সেটা স্ত্রীর চোখ এড়ায়নি।
ফলে এ বছরের জানুয়ারিতে তারই জোরাজুরিতে করিয়ে ফেললাম ইকোকার্ডিওগ্রাম আর স্ট্রেস টেস্ট। স্ট্রেস টেস্ট-এর ফলাফল ভালো আসেনি। কার্ডিওলজিস্ট সাজেস্ট করলেন এনজিওগ্রাম করাতে। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কবে ডাক পাব সেই টেস্টের। কিন্তু ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ সোমবার সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বুকে সামান্য ডিসকমফোর্ট বোধ করায় স্ত্রীসহ সোজা চলে গেলাম ডাউনটাউন টরন্টোতে অবস্থিত টরন্টো জেনারেল হসপিটালের জরুরি বিভাগে। যাওয়ার আগে নিয়ম অনুসারে অফিসের ল্যাপটপ থেকে ম্যানেজার আর টিমকে ই–মেইল করে জানালাম, ‘আই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল, টেকিং আ ডে অব টু রেস্ট।’ বেলা ১১টায় একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল, যেখানে আমার কিছু ইনপুট-এর জন্য অন্য একটা টিম অপেক্ষা করছে, সেই মিটিংটা রিশিডিউল করলাম পরের দিন ১১টায়।
সকাল নয়টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছাই। ইমার্জেন্সি বিভাগকে এ দেশে সংক্ষেপে ইমার্জ বলে। প্রথমেই রেজিস্ট্রেশনের পালা। একজন ট্রিয়াজ নার্স আমার হেলথ কার্ড স্ক্যান করতেই কম্পিউটারে আমার নামধামসহ অন্য তথ্য স্ক্রিনে চলে আসে। তাঁকে চেস্টের ডিসকমফোর্ট-এর কথা জানালাম। কমপ্লেইনের বিশদ বিবরণ কম্পিউটারে রেকর্ড করে নার্স আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। সাধারণত ইমার্জেন্সিতে অপেক্ষার পালা রোগীর সিচুয়েশনের ওপর নির্ভর করে। নন–ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে ঘণ্টা চার–পাঁচ লেগে যেতে পারে রেজিস্ট্রেশনের পর। রেজিস্ট্রেশনের সময় অভিজ্ঞ ট্রিয়াজ নার্স রোগীর কন্ডিশন কতখানি গুরুতর, সেটার ওপর নির্ভর করে তার কেইসটা হ্যান্ডেল করে। ১০ মিনিটের ভেতর আরেকজন নার্স এসে ভেতরে নিয়ে গেলেন সেকেন্ডারি ট্রিয়াজের জন্য।
এবার তারা ইসিজি করল এবং সেই সঙ্গে বেশ কিছু ব্লাড নিল ল্যাব টেস্টের জন্য। তারপর বাঁ হাতের তালুর উল্টো পাশে একটা ক্যানুলা চ্যানেল ওপেন করল, যাতে যেকোনো সময় আইভি দেওয়া যায়। আবারও অপেক্ষার পালা। তারা ব্লাড টেস্টের রেজাল্ট আধা ঘণ্টার ভেতর হাতে পেয়ে আমাকে সোজা ভেতরে নিয়ে বেডে দিল। বেডটা করিডরের এক পাশে। মাথার দিকটা বেশ উঁচু করে সেই বেডে শুইয়ে দিল। একজন নার্স এসে তার পরিচয় দিল, আমি অ্যালেক্সা, তোমার নার্স, কিছুক্ষণের ভেতর আমাদের ডিউটি ডক্টর দেখতে আসবে। অ্যালেক্সা নাম শুনে আমি এবং স্ত্রী দুজনই একই সঙ্গে একটু অবাক হতেই সে মৃদু হেসে আমাদের জানাল যে অ্যামাজনের জেফ বেজোস তাঁর নামকে পুরো পৃথিবীতেই সুপার পপুলার করে দিয়েছেন। তার এই মৃদু রসিকতায় সবাই একটু প্রাণ খুলে হাসলাম। যাহোক, ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা। সবকিছুই তাড়াতাড়িই এগোচ্ছে।
ঘণ্টাখানেকের ভেতর ডিউটি ডাক্তার ওয়েবার এলেন। বয়সে তরুণ ওয়েবার আমার হিস্ট্রি নেওয়া শুরু করলেন। স্ত্রী এই সময় বেশ গুছিয়ে হিস্ট্রি বলে গেলেন। বিশেষ করে আমার ফ্যামিলিতে প্রায় সবারই যে হার্টের সমস্যা রয়েছে, সেটা বেশ গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হলো। আমার স্ত্রী বেইজিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিবিএস করা। পাস করেই উনি তাঁর পিতার কর্মস্থল সৌদি আরবের জেদ্দায় চলে যান। সেখানে কিং ফাহাদ হসপিটালের কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টে বছরখানেক কাজ করেছিলেন। ফলে ওয়েবারের সঙ্গে তার আলাপগুলো হচ্ছিল প্রফেশনাল লেভেলে। ওয়েবার আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন কি করলে বা কোনো ম্যানুভারে বুকে ডিসকমফোর্ট অনুভব করি। আমি তাঁকে বললাম, সিঁড়ি ভাঙলে।
বিশেষ করে ইউনিয়ন স্টেশনের সেই খাড়া আর লম্বা সিঁড়িটা। ওয়েবার কিছুক্ষণ পরে কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের একজন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে এলেন আমার কন্ডিশন অ্যাসেসের জন্য। সেই ডাক্তারও হিস্ট্রি নিলেন। সিঁড়ি ভাঙলে হাঁপিয়ে উঠি, সেটার জন্য উনি বললেন, জরুরি ভিত্তিতে আমার একটা এনজিওগ্রাম হওয়া উচিত। ফলে ওয়েবার আমাকে হসপিটালে ভর্তি করে নিলেন। সেই সঙ্গে পরদিন সকালে এনজিওগ্রামের স্লট বুক করলেন। তখন ঘড়িতে বাজে দুপুর ১২টার একটু বেশি। হসপিটালে ভর্তির কথা জানতে পেরে প্রথমেই দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং বন্ধু ডুয়োংকে ফোন করে ঘটনা জানালাম। বললাম, হয়তো আগামী কয়েক দিন আমি অফিসে যেতে পারব না। তবে আগামীকাল এনজিওগ্রামের রেজাল্টের ওপর নির্ভর করবে কবে নাগাদ অফিসে যেতে পারব। আমার ম্যানেজারকে টেক্সট মেসেজ দিলাম।
দীর্ঘ ১৯ বছরের টরন্টো জীবনে কখনো হাসপাতালে ভর্তি হইনি। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় কিছুটা শঙ্কিত। কিছুক্ষণের ভেতর একজন বয়স্ক মহিলা এসে জানালেন যে তিনি ‘অ্যাডমিশন’ ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছেন। আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন প্রাইভেট কেবিনে থাকার জন্য আমার ইনস্যুরেন্স আছে কি না। হাসপাতালে যখন কোনো রোগীকে ভর্তি করা হয়, তখন তিন ক্যাটাগরির রুমের অপশন রয়েছে তার। প্রথম ক্যাটাগরি হচ্ছে প্রাইভেট কেবিন, যেখানে রোগীকে রাখা হয় একটি সিঙ্গেল রুমে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সেমি-প্রাইভেট কেবিন, যেখানে এক রুমে দুজন রোগী থাকে। আর শেষ ক্যাটাগরিটি হচ্ছে ওয়ার্ড, যেখানে সাধারণত একটি বড় রুমে চার থেকে ছয়জন রোগীকে রাখা হয়। ওন্টারিও হেলথ ইনস্যুরেন্স প্ল্যান বা ‘ওহিপ’ কানাডিয়ান সিটিজেন কিংবা পার্মানেন্ট রেসিডেন্টের জন্য ওয়ার্ডে থাকার ব্যয়ভার বহন করে থাকে অর্থাৎ রোগীকে নিজের পকেট থেকে কোনো পয়সা দিতে হয় না। হাসপাতালে থাকাকালে সব ধরনের মেডিকেল প্রসিডিউর এবং মেডিসিনের খরচও ‘ওহিপ’ কাভার করে থাকে।
এখানে বলে রাখা ভালো ‘ওহিপ’-এর ফান্ডিংয়ের একটি বড় অংশ আসে আমাদের অর্থাৎ কানাডিয়ানদের ট্যাক্স ডলার থেকে। প্রাইভেট কিংবা সেমি-প্রাইভেট কেবিনের জন্য হাসপাতাল থেকে নির্ধারিত একটি রেন্ট চার্জ করা হয়। রোগী নিজ পকেট থেকে কিংবা রোগীর ইনস্যুরেন্স সেই রেন্ট পে করে। আমার ইনস্যুরেন্স সেমি-প্রাইভেট কাভার করে। আমার জন্য সেমি-প্রাইভেট কেবিনের রুম খোঁজা শুরু হলো। যদি কোনো ইনস্যুরেন্স না থাকত, তবে আমাকে এই সেমি-প্রাইভেট কেবিনে থাকার জন্য প্রতি রাতের জন্য গুনতে হতো সাড়ে তিন শ ডলার। আমাকে জানানো হলো, সিট পাওয়ার আগে আপাতত ইমার্জ-এর এই বেডে শুয়েই অপেক্ষা করতে হবে। লাঞ্চের সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে নার্স অ্যালেক্সা এক সময় আমাকে আর আমার স্ত্রীকে দুটো স্যান্ডউইচ দিয়ে যায়। টরন্টো জেনারেল হসপিটালের ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টের নার্সদের এখতিয়ারে এই জাতীয় স্ন্যাক্স মজুত থাকে, সেটা আগে জানা ছিল না।
স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরে ওয়েবার এসে জানালেন, এনজিওগ্রামের জন্য একটা স্লট ফাঁকা পাওয়া গেছে। কিন্তু আমি যে মাত্রই স্যান্ডউইচ খেয়েছি, সেটা জানতে পেরে তিনি আমাকে আগামী চার ঘণ্টা ‘নাথিং বাই মাউথ’ অর্থাৎ কোনো কিছু না খেয়ে থাকার উপদেশ দিলেন। আর যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে আর কোনো স্লট না পাওয়া যায়, তবে আগামীকাল সকালের জন্য বুক করা স্লটেই এনজিওগ্রাম করা হবে। সে ক্ষেত্রে রাত ১২টা থেকে ‘নাথিং বাই মাউথ’। এবার আমার শুরু হলো দ্বিমুখী অপেক্ষার পালা। কখন হাসপাতালের সিট খালি হবে আর আমাকে সেখানে নেওয়া হবে। কখন আবার এনজিওগ্রাম করার স্লট পাওয়া যাবে। এই দ্বিমুখী অপেক্ষার ভেতরই শুরু হয়ে গেল আমার মেডিকেল ট্রিটমেন্ট। আমার রেগুলার ওষুধগুলোর সঙ্গে যোগ করা হলো একটা ব্লাড থিনার ট্যাবলেট। আর আইভি চ্যানেলে ‘হেপারিন’ নামে আরেকটি ব্লাড থিনার। সেই সঙ্গে মাপা শুরু হলো আমার ‘রেসিডুয়্যাল ইউরিন’।
পেশাব করার পর তলপেটে আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানিং মাধ্যমে মাপা হয় কী পরিমাণ ইউরিন এখনো রয়ে গেছে। এসব করতে করতে এক সময় রাত হয়ে এলে স্ত্রী বাসায় চলে যায়। আমি অপেক্ষা করতে থাকি কখন সিট খালি হবে। এক সময় মনে হলো হয়তো আজকের রাত্রিটা ইমার্জ-এর এই বেডেই কাটিয়ে দিতে হবে।
রাত নয়টায় অ্যালেক্সার ডিউটি শেষ হয়ে গেলে বদলি নার্স স্টিভেন এসে জানিয়ে যায়, সে এখন আমার দায়িত্বে। আজ রাতে আমার আর এনজিওগ্রাম করার সম্ভাবনা নেই, সেটা জানার পর আমি স্টিভেনকে স্যান্ডউইচ দেওয়ার অনুরোধ করি। কারণ, রাতে হাসপাতালের বেডে নিয়ে গেলেও সেখানে আমার জন্য কোনো ডিনার থাকবে না। আবার রাত ১২টা থেকে ‘নাথিং বাই মাউথ’ শুরু হয়ে যাবে। স্টিভেন যখন স্যান্ডউইচ আর সঙ্গে ইয়োগার্ট নিয়ে এল, ঠিক তখনই হুইলচেয়ার নিয়ে সেই প্রত্যাশিত লোকটির আবির্ভাব ঘটল, যে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। যাহোক, সে আমাকে ডিনার করার জন্য কিছুটা সময় দিল। ডিনার শেষ হতেই আমাকে নিয়ে হাজির হলো হাসপাতালের পিটার মাঙ্ক বিল্ডিং-এর পাঁচতলায়। তখন রাত সাড়ে ১০টা। আমার জন্য সিট বরাদ্দ ১৮৮ নম্বর রুমের জানালার সঙ্গে লাগোয়া বেড নম্বর ২। এই রুমে বেড দুটি। বেড নম্বর ১-এ এক পৌঢ়া মহিলাকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। পরে জেনেছিলাম নাম এলিজা। অধিকাংশ সময়ই তিনি অচেতন। আমি হুইলচেয়ার থেকে নেমে বেডে বসতেই দুজন নার্স এসে উপস্থিত।
তাদের ভেতর একজন জানাল যে তার নাম এরিকা এবং আগামীকাল সকাল সাতটা পর্যন্ত সে আমার দায়িত্বে। এরিকা হচ্ছে একজন ট্রেইনি নার্স। তার সাথে থাকা নার্স জিঙ্কি হচ্ছে তার সুপারভাইজার। আমাকে তারা সেটল ডাউন করতে অর্থাৎ আমার নিজস্ব জামাকাপড় ছেড়ে হাসপাতালের গাউন পরা থেকে শুরু করে কীভাবে বেডটিকে বিভিন্ন সুইচের মাধ্যমে মাথা এবং পায়ের দিক উঁচু কিংবা নিচু করা যায়, কীভাবে নার্সকে কল করার জন্য সুইচ টিপতে হয়, সেগুলো বুঝিয়ে দিল। প্রথমে এরিকা ব্লাডপ্রেশার, টেম্পারেচার আর অক্সিজেন স্যাচুরেশন মেপে রেকর্ড করে নিল। এই তিনটিকে তারা একত্রে ভাইটালস বলে। দিনের ভেতর বেশ কয়েকবার তারা সব রোগীর ভাইটালস রেকর্ড করে। ভাইটালসের পর আমার ব্লাড সুগার মাপা হলো।
এরপর তারা সার্বক্ষণিকভাবে আমার হার্টের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য টেলিমেট্রি নামের একটা ডিভাইস চালু করল। সাইজে একটা মোবাইল ফোনের চেয়ে কিঞ্চিৎ বড় এই ডিভাইসটির সাথে লাগানো সাত থেকে আটটি প্রোব আমার চেস্টের বিভিন্ন জায়গায় স্টিকার দিয়ে লাগানো হলো। ডিভাইসটিকে একটা ক্রস-বডি-ব্যাগের সাহায্যে শরীরে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। এবার এরিকা ব্লাড নেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই আমি সতর্ক করে দিলাম যে আমার ভেইন খুঁজে পাওয়া কিছুটা ডিফিকাল্ট। বেশ কয়েকবার গুঁতাগুঁতি করে তারপর তারা জায়গামতো নিডল ঢোকাতে সমর্থ হয়।
আমার সাবধান বাণী শুনে এরিকা মনে হয় কিছুটা ভড়কে গেল। কারণ সে জিঙ্কিকে অনুরোধ করল আমার ব্লাড নিতে। ব্লাড নেওয়ার পর তারা আমাকে রাতের ওষুধগুলো খাইয়ে বিদায় নেওয়ার সময় আরও একবার মনে করিয়ে দিল যে রাত ১২টা থেকে ‘নাথিং বাই মাউথ’। কারণ আগামীকাল সকালে আমার এনজিওগ্রাম।
চলবে...
আগামীকাল পড়ুন: দ্বিতীয় জীবন: পর্ব–২
লেখক: কাজী সাব্বির আহমেদ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কানাডা