দ্বিতীয় জীবন: পর্ব–৩
কানাডায় বাইপাস হয়েছে লেখকের। চিকিৎসক এবং নার্সদের যে সেবা পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। পাঁচ পর্বের তৃতীয় পর্ব পড়ুন আজ...
ঠিক ১২টার সময় গরম গরম লাঞ্চ চলে আসত। ব্রেকফাস্টের মতো একেক দিন একেক আইটেম। আমার জন্য লো-কার্ব ডায়েটের অর্ডার দিয়েছেন ডাক্তার। তার মধ্যেও দেখি তারা ‘লাসানিয়া উইথ বিফ’ দিয়েছে বেশ কয়েকবার। সাধারণত লাঞ্চের ঠিক আগে আগেই আমার স্ত্রী এসে পৌঁছাত। সেও বাসা থেকে আমার জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসত। আমার পক্ষে সব খাবার খাওয়া সম্ভব হতো না। লাঞ্চের পর আমি এবং স্ত্রী টিম হর্টনসের কফি খাওয়ার জন্য এলিভেটর দিয়ে একদম ফার্স্ট ফ্লোরে নেমে যেতাম। সেখান থেকে কফি নিয়ে আবার উঠে আসতাম চারতলায়। সেখানে উঁচু ছাদের কাঁচঘেরা একটা চত্বরে বসার জন্য বেশ কিছু টেবিল–চেয়ার পাতা রয়েছে। সেখানে কফি নিয়ে বসতাম। এই চত্বরে বেশ কিছু সবুজ তরতাজা গাছও রয়েছে। তাই এখানে বসলে মনে হতো প্রকৃতির অনেকটা কাছে চলে এসেছি। তবে আমাকে চলাফেরা করতে হতো একটা স্যালাইনের স্টান্ডসহ; কারণ, আমাকে সব সময়ের জন্য ব্লাড থিনার হেপারিন দেওয়া হতো। আমাকে দেখার জন্য বন্ধুবান্ধবেরা এলে তাদেরও নিয়ে এখানে চলে আসতাম। একদিন আমি আর বন্ধুরা এখানে বসে গল্প করছিলাম। তখন ছবি তোলার জন্য আমাদের ঠিক পেছনে বসা এক বয়স্ক লোককে অনুরোধ করাতে উনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে ছবি তুলে দিলেন। হাসপাতালের গাউন পরা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কেন এখানে এসেছি। আমি যখন বললাম বাইপাস হবে, তখন আমাকে অভয় দিয়ে বললেন যে ইউ আর ইন দ্য গুড হ্যান্ডস। কথায় কথায় জানালেন প্রায় এক বছর আগে এই হাসপাতালে উনার হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে যখন তাঁকে এই হসপিটালে আনা হয়, তখন নাকি তাঁর ব্লাডপ্রেশার ছিল থার্টি বাই টেন, যেখানে একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক ব্লাডপ্রেশার হচ্ছে হানড্রেড টোয়েন্টি বাই এইটি। তাঁর হার্ট পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাওয়ায় তাঁকে আর্টিফিশিয়াল হার্টের সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। তাঁর বাঁচার একমাত্র আশা ছিল হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট। প্রায় মাসখানেক পর তাঁর ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় এবং তিনি এক নতুন জীবন ফেরত পান। ২৫ বছর বয়স্ক একজন হকি প্লেয়ারের হার্ট নিয়ে উনি এখন বেশ সুস্থ আছেন। প্রতিদিন ১০ কিলোমিটারের ওপর হাঁটাহাঁটি করেন এবং সেই সঙ্গে এক ঘণ্টা সাঁতার। খুব শিগগরি তিনি যে তাঁর কটেজে যেতে পারবেন, সেটাও তিনি জানালেন আমাদের। তিনি যে তাঁর দ্বিতীয় জীবন বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন, সেটা তাঁর চোখে–মুখের অভিব্যক্তিতে বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এর আগে কখনো তাঁর মতো হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের রোগীকে সামনাসামনি দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের কারও হয়নি। তাই তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা বেশ চমৎকৃত হলাম।
নার্স এসে জানাল আমাকে এখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি তাকিয়ে দেখলাম স্ত্রী এবং ছেলে আশেপাশেই রয়েছে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর্ব শেষ না হতেই দেখি দুজন লোক এসেছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সাপারের সময় ছিল বিকেল পাঁচটাতে। তার আগে আরও একবার আমার রক্ত নেওয়া হতো। সেই সঙ্গে ভাইটালস আর ব্লাড সুগার মাপা তো আছেই। সাপার শেষ করার পর পরই আমার স্ত্রী বাসায় চলে যেত। কোনো কোনো দিন আমার ছেলেও আসত তার ইউনিভার্সিটির ক্লাসের শেষে। তখন মা আর ছেলে একত্রে বাসায় ফিরে যেত। সন্ধ্যার পর আমি আমার আই-প্যাডে কোনো একটা বই খুলে পড়তে বসতাম। কখনো কখনো আবার লিখতে বসে যেতাম। আমি আমার বেইজিংয়ের সাত বছরের প্রবাসজীবন নিয়ে একটি ধারাবাহিক স্মৃতিকথা লিখে যাচ্ছি একটি পত্রিকায়। সেই লেখাটার কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। বাসা থেকে আনা স্ন্যাকস–জাতীয় খাবার থাকত হাতের নাগালে। রাতে যদি কখনো কিছু খেতে ইচ্ছা হতো, তখন সেগুলোর সদ্ব্যবহার হতো। ঠিক সাতটায় নার্সদের ডিউটি চেঞ্জ হয়, তখন নতুন নার্স এসে আমাকে তাঁর নাম বলে যেত। কোনো কারণে রোগীকে যদি বোতাম টিপে নার্সকে কল করতে হয়, তখন তাঁকে তাঁর নার্সের নাম বলতে হয়। সেই কারণেই হয়তো এই ব্যবস্থা। রাত ১০টার দিকে রুমের লাইট বন্ধ করে ঘুমাবার আয়োজন করতাম। রুমের দরজা কখনো বন্ধ করা হতো না বলে করিডোরের হাল্কা আলো আসত রুমে। তাতে অবশ্য ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটত না। আমার পাশের বেডের পৌঢ়া এলিজাকে আমি কখনই সচেতন অবস্থায় দেখিনি। নার্সেরা তাঁকে খুব যত্ন করে সময় নিয়ে দুই বেলা অল্প অল্প করে খাইয়ে দিত। তখন হয়তো তিনি কিছুটা সচেতন হতেন। কিন্তু তাঁকে কখনো মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করতে শুনিনি। তাঁকে দেখার জন্য কখনো কখনো তাঁর ছেলে কিংবা মেয়ে আসতেন, কিন্তু তাঁরা ঘণ্টাখানেকের বেশি থাকতেন না। এলিজার জন্য আমার বেশ খারাপ লাগত।
কথায় কথায় জানালেন প্রায় এক বছর আগে এই হাসপাতালে উনার হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে যখন তাঁকে এই হসপিটালে আনা হয়, তখন নাকি তাঁর ব্লাডপ্রেশার ছিল থার্টি বাই টেন, যেখানে একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক ব্লাডপ্রেশার হচ্ছে হানডেড টোয়েন্টি বাই এইটি।
দেখতে দেখতে আমার সার্জারির দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। আমাকে আগে জানানো হয়েছিল, সার্জারির আগের দিন সার্জেন এসে কথা বলবেন। ফলে সার্জারির আগের দিন আমি এবং স্ত্রী দুজনেই সার্জেনের অপেক্ষায় সারাদিন রুম থেকে আর বের হইনি। কারণ, সার্জেন এসে যদি না পান। সন্ধ্যা হয়ে এল, কিন্তু সার্জেনের দেখা নেই। মাগরিবের সময় প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি নামাজ পড়ে নিলাম। ঠিক তখনই ষাটোর্ধ্ব, লম্বা হালকা–পাতলা গড়নের এক লোক এসে আমার খোঁজ করলেন। আমরা মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, উনিই হচ্ছেন আমাদের কাঙ্ক্ষিত সার্জেন। আমার পরিচয় পেয়ে প্রথমেই উনি নিজের নাম বললেন, এন্থনি রাফ-এডওয়ার্ডস। তারপর তিনি বাইপাস সার্জারির কিছু প্রটোকল ব্যাখ্যা করলেন, যেমন আজ রাত ১২টার পর থেকে ‘নাথিং বাই মাউথ’। এই ধরনের অপারেশনে মৃত্যুর হার কম, সেটাও তিনি উল্লেখ করলেন। আরও বললেন যে আগামীকাল সকাল নয়টার দিকে প্রথমে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে প্রি-অপারেটিভ স্টেশনে, যেখানে অপারেশনের জন্য আমাকে রেডি করা হবে। তবে সেখানে যাওয়ার আগে একটা বিশেষ ধরনের সাবান দিয়ে গোছল করে রেডি হতে হবে। সবশেষে আমাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না, জানতে চাইলেন। আমি আমার শর্ট টার্ম ডিসেবিলিটির ফর্মের একটা অংশ যে তাঁকে পূরণ করতে হবে, সেটা উল্লেখ করলাম। উনি বললেন অপারেশনের পর তিনি সেটা অবশ্যই পূরণ করে দেবেন। সার্জেন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে স্ত্রীও বাসায় চলে যান। তাঁকে আগামীকাল সকাল নয়টার আগেই আবার চলে আসতে হবে। রাতে আমার দায়িত্বে থাকা নার্স এসে জানালেন, ভোর ছয়টা থেকে শুরু হবে আমার প্রস্তুতি।
ঠিক ভোর ছয়টাতে যে আমার ঘুম ভাঙালেন, তাঁর পরিচয় হচ্ছে ‘শেভার ম্যান’। তাঁর কাজ হচ্ছে রোগীকে শেভ করে তৈরি করা। আমার বিছানাতে অনেকগুলো টাওয়েল বিছিয়ে সে বেশ যত্নের সঙ্গে আমার বুকের এবং পায়ের লোম একটি ইলেকট্রিক শেভারের সাহায্যে শেভ করে দিলেন। তিনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর এল ওজন নেওয়ার টেকনিশিয়ান। ওজন রেকর্ড করা হলো, ৭৭ কেজি। আমি যখন ৯ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হই, তখন আমার ওজন ছিল ৭৯ কেজি। এই ৯ দিনে ওয়েট লস ২ কেজি। এটা অবশ্য গত কয়েক দিনের লো-কার্ব এবং পরিমিত খাবারের জন্য হয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। এরপর নার্স এসে হাতের সঙ্গে লাগানো হেপারিনের আইভি চ্যানেল খুলে দিলেন। আমি খেয়াল করে দেখলাম, নার্স সঙ্গে করে এক বিশেষ ধরনের লিকুইড সোপ নিয়ে এসেছেন। সেটা দিয়ে আমাকে ভালো করে গোসল করে নিতে বললেন। গোসলের সময় আয়নাতে নিজের চেহারা দেখার সময় মনে হলো, এরপর যখন আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখব, তখন আমার বুকের মধ্যে একটি কাটা দাগ থাকবে। সেটা ভেবে মনটা একটু দমে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই মনে সাহস এল এই ভেবে যে আল্লাহ নিশ্চয়ই এর বিনিময়ে আমার জন্য উত্তম কিছু রেখেছেন। গোসল সেরে আসার পর হাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় ছিল। আবার শুয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে আটটার দিকে স্ত্রী আর ছেলে চলে এল। তারা এসে আমার সব জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিল; কারণ, অস্ত্রোপচারের পর আমাকে নেওয়া হবে চারতলার অন্য এক রুমে। আমি আর এই রুমে ফিরে আসব না। ঠিক ৯টার সময় আমাকে প্রি-অপারেটিভ স্টেশনে নেওয়ার জন্য ট্রলি নিয়ে হাজির হলো একজন মহিলা। আমি তখনো পুরোপুরি রেডি হয়ে উঠিনি দেখে হাসিখুশি চেহারার ইস্ট ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত মধ্য বয়স্কা সেই মহিলা আমাকে বললেন, ‘নো রাশ, টেইক ইয়োর টাইম।’ এটা যে প্রচ্ছন্নভাবে আমাকে তাড়াতাড়ি করার জন্য বলা, সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি করে তাঁর ট্রলিতে উঠে বসলাম। আসলে শুয়ে পড়লাম। তিনি আমাকে নিয়ে চলা শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার জিনিসপত্র নিয়ে স্ত্রী আর ছেলেও চলল। গন্তব্য প্রি-অপারেটিভ স্টেশন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
প্রি-অপারেটিভ স্টেশনে পৌঁছে দেখি সেখানে রয়েছে পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা সারি সারি বুথ। বেশির ভাগ বুথেই রোগী রয়েছে। আমার ট্রলিটি একটি খালি বুথের ভেতর ঢুকে গেল। আমার আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই একজন নার্স এসে কমম্পিটারে আমার রেকর্ড চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেই ব্যস্ততার এক ফাঁকে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ডিড ইয়োর সার্জেন পুট হিজ সিগনেচার অন ইয়োর চেস্ট? আমি কিছুটা অবাক হলাম এই প্রশ্নে। কিন্তু তাঁকে বললাম, নট ইয়েট। তারপর তিনি আমাকে বললেন, আমি যদি বাথরুমে যেতে চাই, তবে এটাই হবে শেষ সুযোগ। বাথরুমে আমি হেঁটে হেঁটেই গেলাম। বাথরুম সেরে এসে সেই ট্রলিতে উঠে বসতেই এক তরুণ টেকনিশিয়ান এল হাতে ক্যানুলা সেট করতে। আমার ভেইন পেতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। সেই ফাঁকে আমি তাঁর সঙ্গে টুকটাক আলাপ জুড়ে দিলাম। নাম তেনজিন, ভারতের সিকিম প্রদেশ থেকে এ দেশে এসেছেন বহু বছর আগে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা অবশ্য এসেছেন তিব্বত থেকে। উল্লেখ্য, তিব্বতের ১৪তম দালাই লামা তেনজিন গিয়াতসো ১৯৫৯ সালে চীন সরকার কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। হয়তো তাঁর পূর্বপুরুষেরা তখন বিতাড়িত, সেই দালাই লামার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসেন। বাঙালি ভূপর্যটক বিমল দে-এর তিব্বত ভ্রমণের ওপর লেখা ‘মহাতীর্থের শেষ যাত্রী’ এবং ‘মহাতীর্থে কৈলাসবাবার সন্ধানে’ বই দুটি আমার পড়া ছিল বলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে। আমি অবশ্য এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। তেনজিন তাঁর কাজ শেষ করে চলে যেতেই দেখি আমার সার্জেন রাফ-এডওয়ার্ডস হাজির। উনার হাতে একটা ফাইল। সেই ফাইল থেকে তিনি কয়েকটা কাগজ বের করে সেগুলো থেকে কিছু অংশ আমাকে পড়ে শোনালেন। মূলত সেগুলো ছিল অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীর সম্মতিপত্র। আমাকে সেগুলোতে সাইন করতে হলো। আমি সাইন করার সঙ্গে সঙ্গে ড. রাফ একটি মার্কার দিয়ে আমার চেস্টে তার সিগনেচার দিলেন। এখন আমি বুঝতে পারলাম, কেন আমাকে নার্স প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিল এই সিগনেচারের ব্যাপারে। অর্থাৎ আমি এখন সার্জারির জন্য প্রস্তুত। সত্যি সত্যিই তবে সময় হলো প্রতীক্ষিত সেই বাইপাস সার্জারির, যার জন্য আমি ৯ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি।
নার্স এসে জানাল আমাকে এখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি তাকিয়ে দেখলাম স্ত্রী এবং ছেলে আশেপাশেই রয়েছে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর্ব শেষ না হতেই দেখি দুজন লোক এসেছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারা যখন ট্রলি ঠেলে আমাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে যাওয়া শুরু করল, তখন নিজেকে কেন যেন খুব অসহায় মনে হতে লাগল। তার কারণ হয়তো এখন থেকে যা কিছু ঘটবে, তার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই। মনে মনে কালেমা পড়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ তাআলার হাওলায় সমর্পণ করলাম। তাতে মানসিক দুশ্চিন্তাটা অনেকটাই কেটে গেল। প্রথমে একটি করিডোর ধরে মিনিটখানেক চলার পর তারা একটি বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বাইরে থেকে একটা বোতাম টিপতেই সেই দরজা খুলে গেলে, তারা আমাকে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করল। বিশাল সেই রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম একটি বিশাল টেবিলে স্টেইনলেস স্টিলের সারি সারি টুলস টাওয়াল দিয়ে ঢাকা। রুমের ভেতর অনেক লোকের ভিড়, যাঁদের সবার পরনে রয়েছে এপ্রোন এবং আর মুখে মাস্ক। তাঁরা যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। আমি ঢুকতেই তাঁরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অস্ত্রপচার থিয়েটারের যে ছবি মনে গাঁথা ছিল, তার সঙ্গে এ রুমের তেমন মিল না পেয়ে কেন যেন মনে হলো আমাকে কি ভুল কোথাও নিয়ে এসেছে এরা। কিন্তু সেই ভুল ভাঙতে দেরি হলো না, যখন একদল নার্স আমাকে বিশেষ কায়দায় ট্রলি থেকে বেডে শুইয়ে দিল। পরনের গাউন খুলে একটা চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে দিল। আমি কিছুটা সংকোচ বোধ করছিলাম দেখে একজন নার্স আমার কানের কাছে এসে জানাল, ‘ডোন্ট ওরি, ইউ আর নট এক্সপোজড।’ এরপর আমার কাছে আসলেন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট যিনি আমাকে অ্যানেসথেসিয়া দেবেন। তার হাতে অক্সিজেন মাস্ক। আমি তাকে শুধু বললাম, ‘আই নিড ফিও কোয়ায়েট মোমেন্টস বিফোর ইউ অ্যাডমিনিস্টার।’ উনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমি তখন শেষবারের মতো কালেমা পড়লাম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আর মনে মনে বললাম, আল্লাহ্ কোনো দিন সজ্ঞানে তোমার সঙ্গে অন্য কাউকেই শরিক করিনি। সেই ভরসাতেই অক্সিজেন মাস্কটি নাকের কাছে এনে একবার কিংবা বড়জোর দুইবার শ্বাস নিতেই আমি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম। চলবে...
**আগামীকাল পড়ুন: দ্বিতীয় জীবন: পর্ব-৪
*লেখক: কাজী সাব্বির আহমেদ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কানাডা