দ্বিতীয় জীবন: শেষ পর্ব
কানাডায় বাইপাস হয়েছে লেখকের। চিকিৎসক এবং নার্সদের যে সেবা পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। পাঁচ পর্বের শেষ পর্বটি পড়ুন আজ...
পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার থেকে আমাকে যখন কেবিনে দেওয়া হয়, তখন সেই সেমি প্রাইভেট দুই বেডের রুমে আমি ছাড়া অন্য কোনো পেশেন্ট ছিল না। অবশ্য বিকেলের দিকে একজন চলে আসেন। যিনি আসেন, তিনি এই হাসপাতালের একজন পুরোনো রোগী। প্রায় ১৫ বছর আগে এই হাসপাতালেই তার প্যানক্রিয়াটিস ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে। আজ তিনি তাঁর হোমটাউন বার্লিংটন থেকে এসেছেন কিছু রুটিন টেস্ট করাতে, যার ভিত্তিতে তাঁর ওষুধের মাত্রা অ্যাডজাস্ট করা হবে। দুই রাত কাটিয়ে তিনি চলে গেলে তাঁর জায়গায় আসেন মিস্টার ওয়াঙ নামের এক বয়স্ক চায়নিজ। মিস্টার ওয়াঙের বয়স ৮০–এর বেশি হলেও তিনি বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী বছরখানেক আগে কানাডার পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হয়ে তাঁদের ছোট মেয়ের কাছে এসেছেন। বড় মেয়ে চীনের সাংহাই শহরে থাকে। শুকনা-পাতলা এবং ছোটখাটো গড়নের তাঁর স্ত্রীর বয়স ৮০–এর কাছাকাছি হলেও তিনি বেশ চটপটে, কর্মক্ষম এবং সেই সঙ্গে বেশ মুখরা। সর্বক্ষণই তিনি তাঁর স্বামীকে কথা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের কেউই এক বর্ণ ইংরেজি বলতে কিংবা বুঝতে পারেন না। তাঁদের মেয়ে তাঁদের নিয়ে এসেছেন কেবিনে। এসেই খোঁজ করছেন ম্যান্ডারিন জানা নার্সের। একজন নার্সকে পাওয়া গেল, যাঁর কাজ চালানোর মতো ম্যান্ডারিন জ্ঞান রয়েছে। তবে তাঁদের আশ্বস্ত করা হলো যে পরদিন সকালে যে নার্স আসবেন, তিনি ফ্লুয়েন্ট ম্যান্ডারিন পারেন। শুধু রাতের বেলার নার্সের ক্ষেত্রে একটু অসুবিধা হতে পারে, তবে কাজ চালানোর মতো কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই ম্যান্ডারিনে কথা বলতে পারি। কারণ, আমাদের দুজনেরই আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বেইজিং থেকে। তা ছাড়া স্ত্রীর বেইজিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি রয়েছে। ফলে স্ত্রী যখন ওয়াঙ ফ্যামিলির কাছে গিয়ে আমাদের পরিচয় দিলেন, তখন তাঁরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। একই রুমে ম্যান্ডারিন জানা দুজনকে পেয়ে মিস্টার ওয়াঙের মেয়ে বেশ নিশ্চিন্তমনে বাড়ি ফিরে গেলেন সেই রাতে।
পরদিন সকাল সাতটার দিকে মিস্টার ওয়াঙের দায়িত্বে থাকা নার্স ইয়োকো এসে হাজির। ঘটনাক্রমে আমার দায়িত্বও তাঁর কাঁধে পড়েছে। তিনি যখন জানতে পারলেন আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই দীর্ঘ সময় বেইজিংয়ে কাটিয়ে এসেছি এবং ম্যান্ডারিনে কথা বলতে পারি, তখন তিনিও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। চীনের হারবিন প্রদেশে জন্ম নেওয়া ইয়োকো বেড়ে উঠেছেন বেইজিংয়ে। ১০ বছর আগে তিনি কানাডাতে মাইগ্রেট করেছেন। তাঁর নার্সিংয়ের ট্রেইনিং টরন্টোতে। মিস্টার ওয়াঙ হচ্ছেন কমিউনিস্ট চায়নার সবচেয়ে কঠিন সময় কালচারাল রেভল্যুশনের সময়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম। এই প্রজন্মের লোকজনেরা চীনের সত্যিকারের পরিবর্তনকে চোখে দেখেছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে অনেক দুঃখ-বেদনার স্মৃতি। জীবনকে তাঁরা যেভাবে দেখেছেন, সেটা চীনের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনেকটা অকল্পনীয় ব্যাপার। মিস্টার ওয়াঙ তাঁর যৌবনে চীনের সিনচিয়াং প্রদেশে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। জীবনের একপর্যায়ে এসে থিতু হয়েছেন বেইজিংয়ে। তাই তিনি কথায় কথায় বলেন, ‘ট্রে গা শ্রি চিয়ে হেন তা’—এই পৃথিবী অনেক বড়। ‘নি মেন ইন কাই ছুই খান ই খান’—তোমাদের উচিত এই পৃথিবীকে ঘুরেফিরে দেখা। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই আমাদের আন্ডারগ্রেড করেছি বেইজিংয়ে; অর্থাৎ নার্স ইয়োকো, মিস্টার ওয়াঙ এবং আমাদের সবারই রয়েছে বেইজিংয়ে বসবাসের অভিজ্ঞতা। ফলে আমরা ম্যান্ডারিনে কথা বলার সময় বেইজিংয়ের কিছু কলোকিয়াল এক্সপ্রেশনও ব্যবহার করার সুযোগ পেলাম। চায়নিজ না হয়েও চায়নিজ ভাষা জানার সুবাদে ওয়ার্ডের অন্যান্য নার্স এবং স্টাফরা আমাদের বেশ সমীহের চোখে দেখা শুরু করেন। কারণ, তাঁরা নার্স ইয়োকো কিংবা অন্য কোনো ম্যান্ডারিন জানা নার্সের অনুপস্থিতিতে মিস্টার ওয়াঙের দোভাষী হিসেবে আমার স্ত্রীকে হাতের কাছে পেয়েছেন দিনে কিংবা রাতে—যখনই দরকার হয়েছে।
প্রতিদিন শাওয়ার নিয়ে নির্দিষ্ট মাত্রার ভেতর হাঁটাহাঁটি করা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তিনি বেশ কয়েকবার উল্লেখ করলেন। হাসপাতাল থেকে আমাকে একটা বুকলেট দেওয়া হয়েছে, সেখানে অবশ্য উল্লেখ করা আছে আমাকে প্রতিদিন কী পরিমাণ হাঁটতে হবে।
বাইপাস সার্জারির ঠিক ছয় দিন পর আমাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করা হয়। তবে ডিসচার্জের আগে ডাক্তার এবং নার্সেরা পুরোপুরি নিশ্চিত হন যে আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আর আমাকে প্রস্তুত করতে নার্সদের যে অক্লান্ত এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল, সেটা আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। বিশেষ করে শেষের তিন দিন এবং তিন রাতের তাঁদের যে কেয়ার আমি পেয়েছি, সেটা সত্যিই ভোলার নয়। এই সময় দিনের বেলায় আমার দায়িত্বে ছিলেন নার্স ইয়োকো আর রাতের বেলায় নার্স নার্গিল। নার্গিল যখন ডিউটিতে এসে দেখা করতে আসতেন, তখন তিনি জানালার সঙ্গে লাগোয়া তাকের ওপর রাখা আমার বিভিন্ন জিনিসপত্র খুব দ্রুত হাতে গুছিয়ে রাখতেন। অন্য নার্সদের অবশ্য আমি এই গোছানোর কাজ করতে দেখিনি। প্রথম দিন তিনি যখন ডিউটিতে আসেন, তখন আমি বেডে বসে মাগরিবের নামাজ পড়ছিলাম। অন্য সব নার্সের মতো তিনি আমার নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কিন্তু তিনি আমাকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘মে আল্লাহ্ একসেপ্ট ইয়োর প্রেয়ার।’ আর আমার টেবিলের ওপর তাইমুম করার জন্য আনা একটা পাথর দেখে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি শিয়া গোষ্ঠীর মুসলিম কি না। আমি তাঁকে অবশ্য কখনোই জিজ্ঞেস করিনি তিনি শিয়া কি না, কিংবা পার্সিয়ান বংশোদ্ভূত কি না। তবে আমার ধারণা, তিনি দুটোই। আমি তাঁকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই নার্সিং প্রফেশনে আসার পেছনে তাঁর কোনো অনুপ্রেরণা আছে কি না। আমার এই কয়েক দিনের হাসপাতালবাসের অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনুভব করেছি যে এখানকার নার্সরা তাঁদের ডিউটি শুধু ডিউটি হিসেবে পালন করেন না, তাদের কর্তব্য পালনের মধ্যে মিশে আছে একধরনের কমপ্যাশন। নার্গিলের উত্তর ছিল, ‘আমার প্রত্যাশা হচ্ছে, আজকে আমি আমার রোগীকে যে সেবা প্রদান করব, কালকে আমি যদি রোগী হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি হই, আমি যেন সেই একই রকম সেবা পাই।’ আমি নার্গিলকে বলেছিলাম, হাসপাতাল থেকে তুমিসহ অন্য নার্সদের যে সেবা আমি পেয়েছি, সেটি আমি আমার বাকি জীবনে কখনোই ভুলব না।
মোবিলিটি টিম আমাকে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করিয়ে যখন দেখল আমার ব্লাড প্রেশার এবং হার্ট রেটের রিডিং ভালো, তখন তারা আমাকে বাড়ি যাওয়ার জন্য উপযুক্ত বলে ঘোষণা দিল। তাদের এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে নার্স-প্র্যাকটিশনার এলেন আমার সঙ্গে আলাপ করতে, যদি আমার অন্য কোনো শারীরিক অসুবিধা থেকে থাকে, সেটা জানতে। আমার দুর্বলতার কারণে উনি আমাকে আরও একটি দিন সময় দিলেন পুরোপুরি রিকভারির জন্য। ডিসচার্জের ঠিক আগের দিন বেলা ১১টার দিকে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেন একজন নারী ভলান্টিয়ার। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি আমাকে বলেন যে তাঁর জন্ম হয়েছিল হার্টের কিছু সমস্যা নিয়ে, যার জন্য তাঁকে বেশ কয়েকবার হার্ট সার্জারির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে এখন তিনি ভালো আছেন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করে যাচ্ছেন। তাঁর মতো যাঁরা হার্ট সার্জারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি তাঁদেরকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করে বেড়ান, যাতে তাঁরা তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। আমাকে তিনি রিকাভারির সময় কী কী করণীয় এবং কী কী বর্জনীয়, সেগুলো সংক্ষেপে বলে গেলেন। প্রতিদিন শাওয়ার নিয়ে নির্দিষ্ট মাত্রার ভেতর হাঁটাহাঁটি করা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তিনি বেশ কয়েকবার উল্লেখ করলেন। হাসপাতাল থেকে আমাকে একটা বুকলেট দেওয়া হয়েছে, সেখানে অবশ্য উল্লেখ করা আছে আমাকে প্রতিদিন কী পরিমাণ হাঁটতে হবে। সত্তরোর্ধ্ব সেই ভলান্টিয়ারের নাম আমি ভুলে গেলেও তাঁর কিছু উপদেশ কিন্তু ভুলিনি। সেগুলো আমি বাসায় ফিরে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছি সব সময়।
ডিসচার্জের দিন বেলা ১১টায় আমাকে শাওয়ার করাতে এল ‘শাওয়ার ম্যান’। ১০–১২টি বিভিন্ন সাইজের টাওয়েল, সেন্টলেস সাবান আর শ্যাম্পু দিয়ে তিনি আমাকে গোসল করিয়ে দিলেন। এই গোসলের সময় তিনি আমাকে শিখিয়ে দিলেন কীভাবে আমি বাসায় নিজে নিজে গোসল করব, যা খুবই কাজে এসেছিল। শাওয়ার সেরে দেখি, আমার লাঞ্চ দিয়ে গেছে—ম্যাশ পটেটো আর এগ অমলেট। লাঞ্চের পরপরই আমি হাসপাতালের গাউন বদলিয়ে আমার নিজের পোশাক পরে নিলাম। আমি আমার নিজের পোশাকে নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না। আমার পাশের বেডের মিস্টার ওয়াঙ এবং তাঁর স্ত্রীরও একই দশা। তাঁরা আমাকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, আমার বয়স নাকি অনেকখানি কমে গেছে। ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী টিম হর্টনস থেকে ডোনাটের প্যাকেট, কফি আর অ্যাপ্রিসিয়েশন কার্ড নিয়ে এসেছে। সেগুলো নিয়ে আমরা বিদায় জানাতে গেলাম নার্সিং স্টেশনে। অ্যাপ্রিসিয়েশন কার্ডে সুন্দর ভাষায় আমার স্ত্রী লিখেছে, ‘ডাক্তার এবং নার্সদের কাছ থেকে যে অতুলনীয় সার্ভিস আমরা এখানে পেয়েছি, সেটার জন্য আমরা সত্যিই গ্রেটফুল।’ আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে আবু হুরাইরা মসজিদ কমিউনিটির ছোট ভাই তানভীর তার নতুন গাড়ি নিয়ে হাজির। গাড়িতে তার সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে আমি তাকে বলেছিলাম যে হাসপাতাল থেকে আমি যে সার্ভিস পেয়েছি, তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে, এত দিন ধরে আমি যে ট্যাক্স দিয়েছি, সেটা পুরোপুরি উশুল হয়ে গেছে। বাসায় এসে দেখি, আমার সহকর্মীরা আমার জন্য একটি ‘গেট ওয়েল’ কার্ড পাঠিয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই আমি গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছি। কার্ডে তাঁরা লিখেছেন, আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে তাঁদের সঙ্গে কাজে যোগ দিতে পারি। তাঁদের এই ‘গেট ওয়েল’ কার্ড আমার জন্য অনেকটা টনিকের মতো কাজ করেছে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
হাসপাতাল থেকে বাসায় আসি ২৫ ফেব্রুয়ারি। তার দিন কয়েক বাদে শুরু হয় পবিত্র রমজান। প্রথম রোজার দিন হঠাৎ করে আমার পায়ের ইনসিশনের জায়গা থেকে ব্লিডিং হওয়ায় আমি রোজা ভেঙে ফেলি। কয়েক দিন ধরে এ রকম ব্লিডিং হওয়ার পর মার্চের চার তারিখে আমি এবং আমার স্ত্রী টরন্টো জেনারেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে গিয়ে হাজির হই আবার। সেই পরিচিত পুরোনো জায়গা, যেখানে মাসখানেক আগে এসে হাজির হয়েছিলাম বুকব্যথা নিয়ে। যেহেতু আমার মেডিকেল রেকর্ড রয়েছে এই হাসপাতালের সিস্টেমে, তাই ট্রিয়ার্জ নার্স আমাকে সার্জিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ইমার্জেন্সি শাখায় পাঠিয়ে দেন। সেখানকার ডিউটি ডাক্তার প্রথমে একটু দ্বিধান্বিত ছিলেন ইনসিশনের জায়গায় সেলাই দিয়ে ব্লিডিং বন্ধ করবেন কি না। কিন্তু তিনি তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে কনসাল্ট করে আমার ইনসিশনের ছবি পাঠিয়ে দিলেন আমার সার্জেন রাফ-এডওয়ার্ডসের কাছে। আমার সার্জেনের কাছ থেকে উত্তর এল, কোনো কিছু করার দরকার নেই, শুধু ব্যান্ডেজ করে রাখতে হবে। তিন চার দিন পর দেখলাম, ব্লিডিং বন্ধ হয়ে গেছে। এপ্রিলের তিন তারিখ সকাল সাড়ে নয়টায় ছিল ড. রাফ-এডওয়ার্ডসের সঙ্গে আমার ফলোআপ অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তিনি আমার বুকের ইনসিশন চেক করে দেখলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন চলতে–ফিরতে কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে আমি কোনো প্রকার ডিজকমফোর্ট বোধ করেছি কি না। আমি তাঁকে বললাম যে আমি কোনো প্রকার ডিজকমফোর্ট বোধ করিনি। এই সুযোগে তাঁকে আমার গ্র্যাটিচুডও জানালাম। আমি তাঁকে বললাম, যখন আমাকে প্রথম জানানো হলো যে আমার বাইপাস লাগবে, তখন আমি নিজেকে স্রষ্টার কাছে পুরোপুরি সারেন্ডার করেছিলাম। আই বিলিভ, ইউ আর দ্য গড-সেন্ট পারসন হু পারফর্মড দ্য প্রসিডিউর টু সেভ মাই লাইভ। আই হোপ ইউ উড একসেপ্ট দিজ অ্যাজ আ কমপ্লিমেন্ট। তিনি যে আমার এই স্টেটমেন্ট কমপ্লিমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, সেটি মুখের অভিব্যক্তিকে ফুটে উঠেছিল। তাই তিনি সানন্দে আমার সঙ্গে ছবি তুলতে রাজি হয়ে গেলেন।
টরন্টো জেনারেল হসপিটাল থেকে আমাকে রেফার করা হয় টরন্টো রিহ্যাব সেন্টারে। যেকোনো বাইপাস সার্জারির রিকাভারি প্ল্যানের ভেতর রয়েছে এই রিহ্যাব সেন্টারের প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের ভেতর রয়েছে তিন ধরনের সার্ভিস। প্রথম এবং প্রধান সার্ভিসটি হচ্ছে রোগীর ফিজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট করা এবং ফিজিক্যাল ফিটনেসের ওপর ভিত্তি করে রোগীকে নির্দিষ্ট মাত্রার ব্যায়ামের অনুশীলন করানো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, একজন ডায়েটিশিয়ান প্রত্যেক রোগীর চাহিদা অনুসারে তাঁর জন্য একটি হার্ট ফ্রেন্ডলি খাবারের চার্ট তৈরি করে দেওয়া। আর সবশেষের সার্ভিসটি হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট। হার্টের কন্ডিশনের কারণে যেসব রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে, তাঁদের সব ধরনের মানসিক সাপোর্ট দেওয়া। সব মিলিয়ে প্রায় ছয় মাসের কোর্স এখানে। তবে সব রোগীর ক্ষেত্রেই যে এই ছয় মাসের কোর্স প্রযোজ্য, তা কিন্তু নয়। আমার সার্জেন আমাকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন, আমি যেন অন্তত ফিজিক্যাল ফিটনেস অ্যাসেসমেন্ট এবং সেই অনুযায়ী ব্যায়ামের অনুশীলনের কোর্সটি শেষ করি। রিহ্যাব সেন্টার থেকে আমাকে ফোন করে আমার প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেট করে ১৬ এপ্রিল। প্রথমে আমার ফিজিক্যাল আসেসমেন্ট এবং ইসিজি করা হয়। তারপর একজন কার্ডিওলজিস্ট আমার ফিজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট এবং ইসিজির রিপোর্ট দেখে আমাকে স্ট্রেস টেস্টের জন্য রেফার করেন। নির্দিষ্ট দিনে আবার টরন্টো রিহ্যাবে এসে হাজির হলাম স্ট্রেস টেস্টের জন্য। ট্রেড মিলের ওপর আস্তে আস্তে হাঁটা দিয়ে শুরু হলো এই টেস্ট। ধীরে ধীরে হাঁটার গতি এবং সেই সঙ্গে ইনক্লাইনেশন অ্যাঙ্গেল বেড়ে চলল। একসময় আমাকে বেশ দ্রুতগতিতে দৌড়াতে হলো। প্রায় ১১ মিনিট পর তারা আমাকে জানাল যে আমি ইচ্ছা করলে তারা এখন এই টেস্ট শেষ করতে পারে। কারণ, আমি ইতিমধ্যেই শেষ লেভেলে পৌঁছে গেছি। আমি রাজি হতেই তারা তখন সব কিছু থামিয়ে দিল। এই একই স্ট্রেস টেস্ট আমার হয়েছিল জানুয়ারি মাসে বাইপাস অপারেশনের আগে। সেই টেস্টে রিডিং ভালো আসেনি। প্রায় পাঁচ মিনিটের মাথায় তারা টেস্ট থামিয়ে দিয়েছিল। এবারকার টেস্টে হার্টের আর্টারির ফাংশনের আশানুরূপ রেজাল্ট পাওয়া গেল। কার্ডিওলজিস্ট আমাকে নিয়মিত ব্রিস্ক ওয়াকিং এবং সেই সঙ্গে অল্প বিস্তর জগিং করার পরামর্শ দিলেন। কারণ, আমার শরীর এখন এই লেভেলের ব্যায়াম করতে সক্ষম। সেই সঙ্গে আমার এখন কাজে ফেরত যেতে কোনো অসুবিধা নেই, সেটাও তিনি উল্লেখ করলেন। ফলে আমিও আমার কেস অফিসার ডিমিত্রাকে জানিয়ে দিলাম যে আমি মে মাসের সেকেন্ড উইক থেকে কাজে ফেরত যেতে আগ্রহী। আর মনে মনে ভাবলাম, এই স্ট্রেস টেস্ট দিয়েই কাহিনি শুরু হয়েছিল আবার এই স্ট্রেস টেস্ট দিয়েই কাহিনি শেষ হলো। সমাপ্ত...
*লেখক: কাজী সাব্বির আহমেদ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কানাডা