দ্বিতীয় জীবন: পর্ব–২
কানাডায় বাইপাস হয়েছে লেখকের। চিকিৎসক ও নার্সদের যে সেবা পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। পাঁচ পর্বের দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আজ...
ভোররাতেই নার্স আমার ওজন নিল। রুটিন ভাইটালস আর ব্লাড সুগার চেক করার জন্য এল এরিকা। এরিকা আগেই জানিয়েছিল যে তার ডিউটি শেষ হবে সকাল সাতটায়। তাই সে আমাকে এনজিওগ্রামের জন্য শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিল। সকাল আটটার দিকে জেনিফার নামের নতুন একজন ডিউটি নার্স এসে জানাল যে আধা ঘণ্টার ভেতর আমাকে নিতে ক্যাথ-ল্যাব থেকে লোক আসবে। সময়মতো আমাকে নেওয়ার জন্য লোক চলে এল। স্ত্রীকে ফোনে জানালাম যে আমাকে এনজিওগ্রাম করার জন্য ক্যাথ-ল্যাবে নিয়ে যাচ্ছে। সে যেন সরাসরি সেখানে চলে যায়। প্রথমে আনা হলো প্রিপারেশন বুথে। সেখানে একজন বয়স্কা নার্স প্রথমে কম্পিউটারে সংরক্ষিত আমার তথ্যগুলো আমার সঙ্গে কথা বলে মিলিয়ে নিল। তারপর আমাকে জানাল, বেলা সাড়ে ১১টার সময় আমার এনজিওগ্রাম। শুরু হলো আবার অপেক্ষার পালা। ইতিমধ্যে স্ত্রী আর ছেলে চলে এসেছে। তারাও পাশে বসে প্রিপারেশন বুথে অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিক সাড়ে ১১টায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো এনজিওগ্রাম করার রুমে। চারদিকের যন্ত্রপাতি দেখে আমার কাছে মনে হলো আমি যেন একটা সায়েন্স ফিকশন মুভির ভেতর ঢুকে পড়েছি। প্রায় ছয়–সাতজনের একটা টিম আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রথমে একজন নামধাম এবং কী কী মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে এনজিওগ্রাম করা হচ্ছে, সেটা বেশ উঁচু স্বরে বলে গেল। ফ্যামিলি হিস্ট্রির কথাও উল্লেখ করা হলো। তারপর একজন সংক্ষেপে কীভাবে এনজিওগ্রাম করা হবে, সেটা ব্যাখ্যা করল। প্রথমে তারা ডান হাতের কবজির একটা অংশ অবশ করে ফেলল। সেই অবশ অংশ দিয়ে একটা প্রোব ঢোকানো হলো। আমাকে তারা বলেছিল আমি একটা চিমটি কাটার মতো ব্যথা অনুভব করব যখন তারা এই প্রোবটা ঢোকাবে। সত্যিই আমি সামান্য চিমটি কাটার মতো ব্যথা অনুভব করেছিলাম। আমার পাশে একটা বড় স্ক্রিনে তারা আমার হার্টের আশপাশের আর্টারিগুলোর ছবি দেখতে পাচ্ছিল, যা আমি দেখে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিছুটা দূরে আরেকটা কাচঘেরা রুম থেকে প্রফেসর ডগলাস ইং, যার নেতৃত্বে এনজিওগ্রাম করা হচ্ছে তিনি মাইকে বেশ কিছু ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিলেন। আর সেই ইনস্ট্রাকশন অনুসারে হার্টের বিভিন্ন আর্টারির ছবি তোলা হচ্ছিল। মিনিট বিশেকের ভেতর এ প্রসিডিউর শেষ হলো। তারপর প্রফেসর ইং এলেন আমার কাছে। তিনি আমাকে বললেন, আমরা তোমার তিনটা আর্টারিতে সেভেনটি পার্সেন্ট আর আরেকটাতে নাইনটি পার্সেন্ট ব্লক দেখতে পেয়েছি। এই ক্ষেত্রে বেস্ট অপশন হচ্ছে বাইপাস। তার কথা শুনে আমি তো হতভম্ব। আমার ধারণা ছিল হয়তো তারা একটা ব্লক পাবে এবং সেটাতে রিং পরিয়ে দেবে আর আমি বাড়ি চলে যাব। বাইপাস করতে হবে সেটা কল্পনাতেও ছিল না। আমার মানসিক অবস্থা প্রফেসর ইং টের পাচ্ছিলেন। তিনি আমার ওপিনিয়ন জানতে চাচ্ছিলেন। আমার মনে মনে বললাম, আল্লাহ ভরসা। আর তাঁকে বললাম, ‘ইফ বাইপাস ইজ দ্য বেস্ট অপশন, আই উইল গো ফর দ্যাট।’ প্রফেসর ইং তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ‘মিস্টার কাজী ইজ ডিসঅ্যাপয়েন্টেড টু হিয়ার দ্য রেজাল্টস বাট কমপ্রিহেন্ডস দ্য রেকমেন্ডাশনস।’
যখন হিজাব পরা এক মহিলা টেকনিশিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আর ইউ ফ্রম ব্লাড ডিপার্টমেন্ট?’ আমাকে কিছুটা হতভম্ব করে দিয়ে সে উত্তর দিয়েছিল, ‘নো, আই অ্যাম ফ্রম সিরিয়া।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বলেছিলাম, আই ফ্রম বাংলাদেশ, বাট আই ওয়াজ আস্কিং হোয়েদার ইউ কেইম ফ্রম দ্য ব্লাড ডিপার্টমেন্ট টু ড্র মাই ব্লাড।
ডান হাতের কবজিতে এয়ার-টাইট ব্যান্ডেজ করে আমাকে আবার পাঠানো হলো সেই প্রিপারেশন বুথে, যেখানে স্ত্রী আর ছেলে অপেক্ষা করছে। তাদের জানালাম, আমার বাইপাস লাগবে এবং আমি আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করে বাইপাস করাতে প্রাথমিকভাবে রাজি হয়েছি। স্ত্রী নিজে ডাক্তার, তাই তিনিও আমার সিদ্ধান্তকে উত্তম সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করলেন। প্রফেসর ইং রিপোর্টে লিখে দিয়েছেন, বাইপাস সার্জারি করা দরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সার্জারি না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালেই থাকতে হবে। আমাকে আরও তিন ঘণ্টা থাকতে হলো সেই প্রিপারেশন বুথে; কারণ আমার হাতের এয়ার-টাইট ব্যান্ডেজটা শুধু এই বুথের নার্সরাই তিন ঘণ্টা পর খুলতে পারবে। এই অপেক্ষার সময়টায় আমাকে আবারও স্যান্ডউইচ আর অরেঞ্জ জুস দেওয়া হলো। সময়মতো আমার সেই স্পেশাল এয়ার-টাইট ব্যান্ডেজ খুলে সেখানে আবার টাইট করে ক্রেপ ব্যান্ডেজ লাগানো হলো। এই ব্যান্ডেজের সময়কাল তারা আমাকে বলে দিল ২৪ ঘণ্টা। আমার শরীরে দুই ধরনের ব্লাড থিনার রয়েছে। ফলে আমার কবজি থেকে যেন কোনো ধরনের ব্লিডিং না হয়, সেই জন্য ব্যান্ডেজের এই সতর্কতা। এবার একজন মধ্য বয়স্কা নার্স নিয়ে চলল আমার সেই সেমি-প্রাইভেট কেবিনে। হাসিখুশি সেই নার্স আমাকে নানাভাবে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করল। সে আমাকে জানাল যে ‘ইউ আর ইন গুড হ্যান্ডস, উই উইল ফিক্স ইয়োর হার্ট।’ সে যেভাবে ‘উই’ বলল, তাতে আমি মনে মনে তার প্রশংসা করলাম। কারণ, সে নিজেকে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের একটি অংশ হিসেবে দেখছে। ম্যানেজমেন্টের ভাষায় এই অ্যাটিটিউটকে ‘ওনারশিপ’ বলা হয়।
হাসপাতালের বেডে এসে আমার প্রথম কাজ হলো পুরো ব্যাপারটা হজম করা। জীবনে আগে কখনো কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি। একমাত্র অপারেশন যেটা হয়েছিল, সেটা ছিল মুসলমানি বা খতনা। তাই একেবারে ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’-এর মতো একটা মেজর অপারেশন ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হবে, সেটা চিন্তা করতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু টের পেলাম আমি মানসিকভাবে এতটুকুও দুর্বল হইনি। কারণ হিসেবে আমি দেখলাম যে আমি আমার ভাগ্যকে পুরোপুরি আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছি। আর এই হসপিটাল এবং তার ডাক্তারদের সার্ভিসকে মহান আল্লাহ তাআলার উসিলা হিসেবে গ্রহণ করেছি। টের পেলাম এই স্পিরিচুয়াল দৃষ্টিভঙ্গিই আমাকে মানসিকভাবে স্ট্রং থাকতে সাহায্য করছে। তাই তো পরের দিন সকাল ১০টায় বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ ড. ওয়েবার ওয়ার্ড ভিজিটে এসে যখন জিজ্ঞেস করলেন আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে সার্জারির জন্য প্রস্তুত কি না, তখন হাসিমুখে বলেছিলাম, আই অ্যাম রেডি ফর দ্য সার্জারি। এই ওয়েবারই দুই দিন আগে আমাকে ইমার্জেন্সি থেকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। তিনি জানালেন, আমাকে কমপক্ষে পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হবে বাইপাস সার্জারির জন্য। কারণ, সার্জারির আগে আমার শরীর থেকে ব্লাড থিনার সম্পূর্ণভাবে ফ্ল্যাশ আউট করতে হবে। আর প্রথম দিনে ট্যাবলেটের মাধ্যমে আমাকে যে ব্লাড থিনারটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা ফ্ল্যাশ আউট হতে সময় লাগবে কমপক্ষে পাঁচ দিন। সেই হিসেবে সার্জারির আর্লিয়েস্ট ডেট হতে পারে আগামী সোমবার অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেদিন ‘ফ্যামিলি ডে’-এর ছুটি।
আমি সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতাম। সবাই খুব খুশি হতো, যখন তাঁদের কাজের প্রশংসা করতাম কিংবা ধন্যবাদ জানাতাম। সেই ধারাবাহিকতায় হিজাব পরা এক নারী টেকনিশিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আর ইউ ফ্রম ব্লাড ডিপার্টমেন্ট?’ আমাকে কিছুটা হতভম্ব করে দিয়ে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নো, আই অ্যাম ফ্রম সিরিয়া।’
হাসপাতালে ভর্তির তৃতীয় দিনে অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারিতে আমার ম্যানেজার গ্রেগকে জানালাম, এনজিওগ্রামের রেজাল্ট অনুযায়ী ডাক্তাররা আমার বাইপাস সার্জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সার্জারি হওয়ার আগপর্যন্ত আমাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। গ্রেগ আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে সার্জারির জন্য সাহস দিল এবং সেই সঙ্গে অফিসের কাজ নিয়ে কোনো রকম চিন্তা না করার উপদেশ দিল। তিনি আমাকে জানালেন, আমার জন্য হিউম্যান রিসোর্সের কাছে ‘শর্ট টার্ম ডিসেবিলিটি’-এর আবেদন করবে। অর্থাৎ যত দিন না পর্যন্ত আমি পুরোপুরি সুস্থ না হই, সেই পর্যন্ত আমাকে কাজে যোগ দিতে হবে না। সেদিনই গ্রেগ আমার ব্যক্তিগত ই–মেইলে ‘শর্ট টার্ম ডিসেবিলিটি’-এর অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম পাঠিয়ে দিলেন। ইনস্যুরেন্স এজেন্সি থেকে একজন এই ব্যাপারে আমার সঙ্গে খুব শিগগির যোগাযোগ করবে, সেটাও গ্রেগ তার ই–মেইলে উল্লেখ করলেন। পরদিন ইনস্যুরেন্স এজেন্সি থেকে ডিমিত্রা নামের একজন আমাকে কল করে জানাল সে আমার কেস অফিসার। তিনি জানতে চাইলেন আমার মেডিকেল কন্ডিশনের কথা। আমি যখন জানালাম যে আমি টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি এবং বাইপাস সার্জারির জন্য অপেক্ষা করছি, তখন তার কথাবার্তায় অনেকখানি এমপ্যাথি টের পেলাম। তিনি ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখের ভেতর গ্রেগের পাঠানো অ্যাপ্লিকেশন ফর্মটা ফিলআপ করে তার কাছে পাঠাতে বললেন।
হাসপাতালের এই ফ্লোরে নার্সদের দুটি স্টেশন। একটি আমার রুমের খুব কাছে। সেখানে গিয়ে নার্স ম্যানেজার ন্যাটালিকে অনুরোধ করাতে তিনি সেই ফর্মটা প্রিন্ট করে দিলেন। প্রথম দিন আমাকে হালাল খাবার দিতে ভুল করাতে আমি নার্স স্টেশনে গিয়ে রিপোর্ট করি। সেই সময় নার্স স্টেশনের ডিউটিরত নার্স আমাকে নার্স ম্যানেজার ন্যাটালির সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তখনই ন্যাটালির সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়। আমি যেন সব সময় হালাল মিল পাই সেটা তিনি সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিত করেন। তখন ন্যাটালি আমাকে বলেছিলেন, কোনো অসুবিধায় আমি যেন সরাসরি তাঁকে রিপোর্ট করি। এরপর করিডরে চলতে–ফিরতে যখনই তার সঙ্গে আমার দেখা হতো সে হাসিমুখে আমার কুশল জিজ্ঞেস করতেন। সেই সঙ্গে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিত।
শর্ট টার্ম ডিসেবিলিটির ফর্মটা ফিলআপ করতে গিয়ে দেখলাম, আমার হাসপাতালের ডাক্তারদের সাহায্য লাগবে। আমার মেডিকেল কন্ডিশনের বিবরণ এবং তার জন্য কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেটা আমাকে চিকিৎসকদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিতে হবে তাদের সিগনেচারসমেত। তাই প্রথমেই শরণাপন্ন হলাম ওয়েবারের। তিনি আমার মেডিকেল কন্ডিশনের বিশদ বিবরণ লিখে দিলেন। তারপর আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন কার্ডিওভাস্কুলার সার্জেনের জন্য যিনি আমার বাইপাস সার্জারি করবেন। কী ধরনের চিকিৎসা আমার মেডিকেল কন্ডিশনের জন্য দেওয়া হবে এবং কবে নাগাদ আমার জন্য কাজে যোগদান করাটা সেইফ হবে, সেটা শুধু সার্জনই লিখতে পারবে। তখনো যেহেতু আমার সার্জারির ডেট কিংবা কোন সার্জন আমার বাইপাস করবে, কোনোটাই ঠিক হয়নি, তাই সেই মুহূর্তে ফরমের সেই অংশটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশ্য উইকএন্ড শুরু হওয়ার ঠিক আগে অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ওয়েবার আমাকে জানালেন যে আমার সার্জারির ডেট ঠিক হয়েছে ১৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার। সার্জারির আগের দিন সার্জন এসে আমার সঙ্গে যে সার্জারির ব্যাপারে ডিটেইলস কথা বলবেন, সেটাও ওয়েবার আমাকে জানিয়ে দিলেন। এদিকে লং উইকএন্ড শুরু হয়ে যাচ্ছে। ফলে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ ছিল না।
জানালার পাশে বেড পাওয়াতে আমি হাসপাতালের ভেতরে থেকেও সব সময়ই বাইরের পৃথিবীর কিছুটা ছোঁয়া পেতাম। জানালা দিয়ে তাকালেই দেখতে পেতাম টরন্টো ডাউনটাউনের কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা। বিশেষ করে সকালবেলায় দেখতাম দলে দলে মানুষ আসছে টরন্টোর অফিস পাড়াতে আর বিকেলবেলায় তাদের আবার দল বেঁধে ফিরে যেতে দেখতাম। এদিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে স্নো-স্টর্ম শুরু হবে লং উইকএন্ডের সন্ধ্যা থেকেই। তিরিশ সেন্টিমিটার কিংবা তারও বেশি তুষারপাত হবে। তাই সেদিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে খেয়াল করলাম দুপুরের পর থেকেই গৃহমুখী মানুষের ঢল। নার্সদের ভেতরও দেখলাম দুশ্চিন্তা যাদের ডিউটি সন্ধ্যা সাতটায় শেষ হবে। আমি ভেবে দেখলাম সবাই সবার গন্তব্যে ফেরার জন্য ব্যাকুল, শুধু আমারই কোনো তাড়া নেই। অলসভাবে তাকিয়ে আছি জানালা দিয়ে বাইরে। অপেক্ষায় আছি কখন শুরু হবে সেই তুষারপাত। সেদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে পরদিন সকালে যখন তুষার পড়া বন্ধ হলো, তখন চারপাশের দৃশ্যপট বদলে গেছে পুরোপুরি। বরফের চাদরে ঢেকে গেছে পুরো শহর। অনেক বছর পর টরন্টোতে এবার এই ধরনের বড় আকারের একটি তুষারপাত হলো। আর আমি সেটা আমার হাসপাতালের বেডে শুয়ে পুরোটাই অবলোকন করার সুযোগ পেলাম। আমার সময় কাটতে লাগল অনেকটা যেন ছুটির আমেজে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
হাসপাতালের বেডে শুয়ে বসে সার্জারির জন্য আমার এই অপেক্ষার দিনগুলো ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং। সবকিছুই চলত রুটিনমাফিক এবং ঘড়ির কাঁটা ধরে। প্রতিদিন ভোরবেলায় আমার ঘুম ভাঙাত ওজন নেওয়ার জন্য আসা টেকনিশিয়ান। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আসত নার্স আমার ভাইটালস এবং সেই সঙ্গে ব্লাড সুগার রেকর্ড করতে। এই সমস্ত রেকর্ড আবার ‘মাই-ইউএইচএন’ পোর্টালে সঙ্গে সঙ্গেই আপডেট হতো। সেই পোর্টালে আমার যেহেতু অ্যাকসেস আছে একটা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তাই আমি ইচ্ছা করলে সেগুলো দেখতে পারতাম। এর পর সাড়ে সাতটায় আসত ব্রেকফাস্ট। তখন হাত–মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট খেতে বসে যেতাম। একেক দিনের মেনু একেক রকমের। কোনো দিন বয়েল ডিমের সঙ্গে বাটার-জেলিসহ ব্রেড। কোনো দিন ঠান্ডা দুধ আর কর্নফ্লেক্স। তবে ধোঁয়া ওঠা তিতকুটে এক কাপ কফি থাকত প্রতিদিনই। কফি শেষ করতে করতে আটটার মতো বেজে যেত। তখন ছিল ডিউটি ডাক্তারের ওয়ার্ড ভিজিটের সময়। ডাক্তারের ভিজিট শেষ হতেই চলে আসত আমার দায়িত্বে থাকা সেই দিনের নতুন নার্স। প্রতিদিনই নতুন নতুন নার্সের দেখা পেতাম। সেই নার্সদের প্রথম কাজ ছিল আমার রক্ত নেওয়া। দিনে আমাকে দুইবার রক্ত দিতে হতো পরীক্ষার জন্য। যেহেতু আমার ভেইন পাওয়া মুশকিল তাই আমি রক্ত নেওয়ার আগে তাদের সতর্ক করে দিতাম। কেউ কেউ নিজেরা ক্ষান্ত দিয়ে ব্লাড ডিপার্টমেন্টের এক্সপার্টকে তলব করত। আমি মনে মনে স্বস্তি পেতাম যখন দেখতাম ব্লাড ডিপার্টমেন্টের টেকনিশিয়ান এসেছে আমার রক্ত নিতে। আমি সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতাম। সবাই খুব খুশি হতো যখন তাদের কাজের প্রশংসা করতাম কিংবা ধন্যবাদ জানাতাম। সেই ধারাবাহিকতায় যখন হিজাব পরা এক মহিলা টেকনিশিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আর ইউ ফ্রম ব্লাড ডিপার্টমেন্ট?’ আমাকে কিছুটা হতভম্ব করে দিয়ে সে উত্তর দিয়েছিল, ‘নো, আই অ্যাম ফ্রম সিরিয়া।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বলেছিলাম, আই ফ্রম বাংলাদেশ, বাট আই ওয়াজ আস্কিং হোয়েদার ইউ কেইম ফ্রম দ্য ব্লাড ডিপার্টমেন্ট টু ড্র মাই ব্লাড। আমাদের ভুল–বোঝাবুঝি বুঝতে পেরে সে হেসে দিয়েছিল পরে। আরেকবার অল্প বয়স্ক এক কোরিয়ান পুরুষ নার্স অনেক কষ্টে আমার দুই শিশি ব্লাড নেওয়ার পর নিডল ডিসপোজ করার সময় এক শিশি ব্লাডও ডিসপোজ করে ফেলেছিল। সে তো আর শিশি খুঁজে পায় না। তারপর বেশ লজ্জা পেয়ে আমাকে বলল আবারও ব্লাড নিতে হবে। আমি বেচারার করুণ চেহারা দেখে মৃদু হেসে বললাম, নো প্রবলেম। চলবে...
**আগামীকাল পড়ুন: দ্বিতীয় জীবন: পর্ব-৩
*লেখক: কাজী সাব্বির আহমেদ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কানাডা