দ্বিতীয় জীবন: পর্ব–৪

কানাডায় বাইপাস হয়েছে লেখকের। চিকিৎসক এবং নার্সদের যে সেবা পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। পাঁচ পর্বের চতুর্থ পর্ব পড়ুন আজ...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, তখন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমি কোথায় আছি কিংবা আমার আশপাশে কী হচ্ছে। এমনকি বাইপাস সার্জারির কথাও বেমালুম ভুলে বসে আছি। আমি তখন একটা তীব্র ঘোরের ভেতর আচ্ছন্ন। আমি শুধু শুনতে পারছিলাম স্ত্রীর কণ্ঠস্বর। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, অনেক দূর থেকে তার কথা ভেসে আসছে। একসময় ধীরে ধীরে আমার সেই ঘোর কাটতে শুরু করে। ঘোর কাটার শুরুতে মনে পড়ে যায় যে আমার অস্ত্রোপচারের কথা। তখন বুঝতে পারি, এখন পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে রয়েছি। আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবানি যে অস্ত্রোপচারের পর আমি জ্ঞান ফিরে পেয়েছি। অস্ত্রোপচারের পর জ্ঞান ফিরে পাওয়া যে আল্লাহ্‌র অপার অনুগ্রহে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আয়ু ফেরত পাওয়া, সেটা অনুধাবন করে তাঁর প্রতি জানাই অসীম কৃতজ্ঞতা। স্ত্রী বারবার জানতে চাচ্ছে, আমি কেমন বোধ করছি। আসলে আমিও ঠিক জানি না আমি কেমন বোধ করছি। কারণ, আমার যে একটি শরীর আছে, সেটা আমি ঠিক অনুভব করতে পারছি না। কেমন যেন এক ভোঁতা অনুভূতি শরীরজুড়ে। ফলে কোথাও কোনো ব্যথার অনুভূতি নেই। আমার স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে জানালাম, ভালো আছি। তার সঙ্গে এবং ছেলের সঙ্গে আমার আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। কিন্তু কী নিয়ে সেই আলাপচারিতা হয়েছিল, সেটার ডিটেইলস আমি পরে আর মনে করতে পারিনি। আমার মনে আছে, আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমি কতক্ষণ অস্ত্রোপচারের কক্ষে ছিলাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল যে প্রায় চার ঘণ্টা পর তারা এখন আমার সঙ্গে কথা বলছে। আমার স্ত্রীর কাছে পরে শুনেছি, আমি নাকি বাংলা, ইংরেজি, চায়নিজ—এই তিন ভাষাতেই তার সঙ্গে কথা বলেছি। উল্লেখ্য যে আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই কিন্তু চায়নিজ ভাষায় কথা বলতে পারি। তবে এটা আমার মনে আছে যে আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলে একসময় আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। সম্ভবত তাদের জন্য বরাদ্দ সময় তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমিও আবার কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাই।

এরপর আমি যখন আবার সজাগ হই তখন দেখি, একজন নার্স আমাকে জাগিয়ে তুলেছেন। নাম জানালেন আইদা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোনো ব্যথা অনুভব করছি কি না। যদি ব্যথা অনুভব করি, তবে তিনি আমাকে ব্যথা কমানোর ওষুধ দেবেন। আমি কোনো ব্যথা অনুভব করছিলাম না; বরং সারা শরীরজুড়ে ছিল সেই ভোঁতা অনুভূতি। হয়তো আগের দেওয়া কোনো পেইন কিলারের অ্যাফেক্ট তখনো আমার শরীরজুড়ে রয়ে গেছে। আমি তাঁকে জানালাম যে আমার কোনো ব্যথা নেই। তিনি তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি থার্স্টি কি না। আমি যে ভীষণ থার্স্টি ছিলাম, সেটা তখন টের পেলাম। সে কথা তাঁকে জানাতেই তিনি আমার মুখে ছোট্ট একটুকরা বরফ গুঁজে দিয়ে সেটা আমাকে চুষতে বললেন। সেই বরফ শেষ হতেই আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। এরপর আমি যখন আবার সজাগ হই, তখন আইদা আমার কাছে এসে আবার জানতে চান, আমি ব্যথা অনুভব করছি কি না। আমি আবারও না বলি। তবে তাঁর কাছ থেকে আরও এক টুকরা বরফ চেয়ে নিই। তারপর আবারও গভীর ঘুম। এই ঘুম আর জাগরণের বেশ কিছু পর্ব পার হলো। আমার সময়জ্ঞান তখন পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। কারণ, আমার কাছে মনে হচ্ছিল, কমপক্ষে তিন দিন অতিক্রান্ত হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। সেটা বুঝতে পেরেছিলাম, যখন আমার ঘোরের এপিসোডটা কেটে গিয়েছিল। আমি যখন ঘোরের ভেতর ছিলাম, তখন আমি শুধু মানুষের কথা শুনতে পেতাম; কিন্তু তাদের চেহারা দেখতাম না। তাই নার্স আইদার সঙ্গে আমার অনেকবার কথা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু তাঁর চেহারা আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না। সম্ভবত নার্স আইদার ডিউটি ছিল সারা রাত। সম্ভবত বলার কারণ হচ্ছে, আমার তখন কোনো সময়জ্ঞান ছিল না।

ইয়োগা কিছু শুকনো বিস্কুট খেতে দিলেন। কষ্ট করে দুটি বিস্কুট খেতে পেরেছিলাম। সেটাই ছিল অপারেশনের পর আমার প্রথম খাবার। অবস্থা দেখে স্ত্রী ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে রাতে থাকবে।

একসময় ঘুম ভেঙে দেখি, নতুন একজন নার্স আমার দায়িত্বে। বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন সেই নার্সের নাম জুলিয়া। খেয়াল করে দেখলাম যে এখন আমি আমার চারপাশের দৃশ্যাবলি দেখতে পাচ্ছি; অর্থাৎ আমার শরীর থেকে অ্যানেসথেসিয়ার প্রভাব অনেকখানি কেটে গেছে। আমি প্রথমেই তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হোয়াট ডেট ইজ টুডে? তিনি তখন আমার চোখের সামনে ঝোলানো একটি বোর্ডে আজকের তারিখটি লিখে দিলেন, ফেব্রুয়ারি ২০। তিনি চেস্টের ইনসিশন চেক করে জানতে চাইলেন কোনো ব্যথা অনুভব করছি কি না। আমি না বলাতে তিনি জানালেন যে আমার চেস্টে তিনটি টিউব লাগানো আছে, যার কাজ হচ্ছে ইন্টারনাল কোনো ডিসচার্জকে ড্রেন করা। যেহেতু সেই টিউবগুলো থেকে আর কোনো ডিসচার্জ হচ্ছে না, তাই সেগুলোকে এখন খুলে ফেলা হবে। আমি অবশ্য কিছুই টের পেলাম না, যখন সেই টিউবগুলো খুলে ফেলা হলো। তারপর আমার শরীর থেকে পেসমেকার–জাতীয় একটা ডিভাইস খোলা হলো। জুলিয়া আমাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এই ডিভাইস খোলার সময় আমি হার্টে একটু ডিসকমফোর্ট ফিল করব। শেষে খোলা হলো ক্যাথেটার। শরীরে যে এত কিছু লাগানো হয়েছিল, তার কোনো হদিসই আমার ছিল না। সব কিছু খোলার পরপরই একজন টেকনিশিয়ান একটি পোর্টেবল এক্স–রে মেশিন নিয়ে হাজির। আমার চেস্টের এক্স–রে নেওয়া হলো। তবে এক্স–রে রিপোর্টে দেখা গেল, আমার পেটে প্রচুর গ্যাস জমে আছে। ফলে একটা লাং একদম চুপসে আছে। নার্স জুলিয়া আমাকে বললেন, আমি যেন নিয়মিত ব্রিথিং এক্সারসাইজ করি, তা না হলে নিউমোনিয়া হতে পারে। সবশেষে এলো বেশ শক্ত–সমর্থ একজন ওজন নেওয়ার জন্য। আমাকে দুই হাতে একটি বালিশ বুকের মধ্যে চেপে বিছানা থেকে নামতে হলো এই ওজন মাপার জন্য। আমি এতক্ষণ বুকে কোনো ব্যথা অনুভব করিনি। কিন্তু বিছানা থেকে নামার সময় বেশ ব্যথা অনুভব করলাম। যাহোক, ওজন মেপে পাওয়া গেল সেভেনটি নাইন কিলো। অস্ত্রোপচারের দিন সকালে ওজন ছিল সেভেনটি সেভেন কিলো। প্রায় দুই কিলো ওজন বেড়েছে। পরে জেনেছি, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, অস্ত্রোপচারের সময় প্রচুর ফ্লুইড পাম্প করা হয় শরীরে। এখন টার্গেট হচ্ছে ধীরে ধীরে শরীর থেকে এই ফ্লুইড বের করতে হবে। খেয়াল করে দেখলাম, আমাকে এখন পর্যন্ত মুখে কোনো খাবার খেতে দেয়নি। এমনকি পানিও নয়। থার্স্টি বললে মুখে শুধু ছোট্ট একটা বরফের টুকরা দিয়ে চুষতে বলে। তবে আমার কোনো ক্ষুধার অনুভূতি ছিল না। শরীরে ফ্লুইড ইনটেকের ওপর কড়া নজরদারি ছিল। পরে বলা হয়েছিল, আমি যেন দিনে দেড় লিটারের বেশি লিকুইড কনজিউম না করি। ওয়াটার ইনক্লুডেড।

হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, শরীর আসলেই অনেক দুর্বল। হেঁটে আসার পর একটু ভালো বোধ করেছিলাম। তখন ইয়োগা কিছু শুকনো বিস্কুট খেতে দিলেন। কষ্ট করে দুটি বিস্কুট খেতে পেরেছিলাম। সেটাই ছিল অপারেশনের পর আমার প্রথম খাবার।

আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না যে আমাকে আসলে পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার থেকে কেবিনে পাঠানোর আয়োজন চলছে। সেই লক্ষ্যে তাঁরা তাঁদের চেকলিস্ট ধরে এগোচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রথমে আমার সার্জেন ড. রাফ-এডওয়ার্ডস এলেন আমাকে দেখতে। তিনি প্রথমেই সম্ভাষণ জানিয়ে জানতে চাইলেন কেমন ফিল করছি। তারপর আমাকে বললেন, আমার বাইপাস তাঁরা সুন্দরমতো সম্পন্ন করেছেন। মোট দুটি বাইপাস লেগেছে আমার। সেটাও তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর তিনি আমার স্ত্রীর খোঁজ করলেন। কারণ, তিনি আমার ‘শর্ট টার্ম ডিজঅ্যাবিলিটি’-এর অ্যাপ্লিকেশন ফরমের তাঁর অংশটা পূরণ করে এনেছেন, যেটা তিনি স্ত্রীর হাতে দিতে চান। আমার স্ত্রী তখনো এসে পৌঁছেনি। তাই তিনি সেই ফরমটা নার্সের জিম্মায় রেখে বিদায় নিলেন। এর কিছুক্ষণ পরই আমার স্ত্রী অবশ্য এসে পৌঁছেছিল। সার্জেন বিদায় নেওয়ার পর এলেন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট। অপারেশন থিয়েটারে তাঁকে মাস্ক পরা অবস্থায় দেখেছিলাম, তাই তাঁর চেহারা দেখে চিনতে পারিনি। তিনি আমার কুশল জিজ্ঞেস করলেন আর এক্স–রে রিপোর্ট দেখে বিদায় নিলেন। তারপর এলেন আরেকজন সার্জন, যিনি তাঁর নিজের পরিচয় দিলেন ড. রেজা হিসেবে। তাঁর সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখা হয়নি। তিনি হয়তো অপারেশনের সময় রাফ-এডওয়ার্ডসকে অ্যাসিস্ট করে থাকবেন। তাঁরা সবাই বিদায় নেওয়ার পর নার্স জুলিয়া জানালেন যে আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার লাঞ্চের জন্য তিনি ইতিমধ্যেই লিকুইড মিলের অর্ডার দিয়ে দিয়েছেন, যা কিনা আমি কেবিনে যাওয়ার পর দেওয়া হবে।

আমার নতুন ওয়ার্ডটি পিটার মাঙ্ক বিল্ডিংয়ের চারতলায়। অপারেশনের আগে ছিলাম একই বিল্ডিংয়ের পাঁচতলাতে অবস্থিত ১৮৮ নম্বর রুমের বেড নম্বর ২-তে। এবার আমার জন্য রুম বরাদ্দ হয়েছে ১৮৪ নম্বর। ভাগ্যক্রমে এবারও আমার বেড বরাদ্দ হয়েছে জানালার পাশে—বেড নম্বর ২। এই চারতলাতেই রয়েছে সেই উঁচু ছাদের এক বিশাল চত্বর, যেখানে বসার জন্য অনেকগুলো টেবিল-চেয়ার পাতা রয়েছে আর চোখ জুড়ানোর জন্য রয়েছে বেশ কিছু তাজা সতেজ গাছের সমারোহ। আমাকে এখানে রিসিভ করে দায়িত্বে থাকা নার্স তেনজিন। বয়সে বেশ নবীন নার্স তেনজিনকে জানালাম যে এর আগেও আমি আরেকজনকে পেয়েছি, তাঁর নামও তেনজিন। তিনি অপারেশনের আগে আমার হাতে ক্যানোলা সেট করে দিয়েছিলেন। তবে তিনি একজন পুরুষ। আপনিও কি তাঁর মতো সিকিম থেকে এসেছেন? হেসে বললেন, দেয়ার আর প্লেনটি অব তেনজিনস ইন দিজ ওয়ার্ড। তবে আমি এসেছি দার্জিলিং থেকে। দার্জিলিংয়ের নাম শুনে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি বাংলা পারেন কি না। তিনি আমাকে বললেন, দার্জিলিংয়ে প্রচুর বাঙালি থাকেন, কিন্তু তিনি বাংলা জানেন না। হিন্দি জানেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাঞ্চ দিয়ে গেলেন একজন। স্ত্রী আমার ব্যাগ থেকে টুকিটাকি জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখা শুরু করেছেন ঠিক তখনই হঠাৎ আমার বমি হলো। আমি নিজেও এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ভীষণ কষ্টদায়ক ছিল এই বমি। বমির কারণে অপারেশনের জায়গায় বেশ ব্যথা করছিল। বমি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপেটাইট চলে গেল। ফলে আমি কোনো খাবারই মুখে দিতে পারছিলাম না। এমনকি পানি পর্যন্ত নয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার আরও দুবার বমি হলো। সবুজ রঙের সেই বমি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে বাইল বা পিত্তরস বেরিয়ে এসেছে বমির সঙ্গে। আমার স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে ডিউটি ডাক্তারের খোঁজ করা শুরু করলেন। কিন্তু আমাদের জানানো হলো, ডিউটি ডাক্তার এক জরুরি অপারেশনে ব্যস্ত। তবে তাঁকে বমির কথা জানানো হয়েছে ছবিসহ।

ঠিক কী কারণে বমি হয়েছে, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে বের করা যাচ্ছিল না। তবে ধারণা করা হচ্ছিল, আমার পেটে যে একটা বড় আকারের গ্যাস–বাবল দেখা গেছে, এক্স–রেতে সেটাই এই বমির কারণ। ফলে পেট থেকে গ্যাস বের করার জন্য ওষুধ দেওয়া হলো। এ ছাড়া রক্তে পটাশিয়াম ও ফসফেটের ঘাটতির কারণে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্সের সৃষ্টি হয়েছে, যা কিনা আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। পটাশিয়ামের জন্য একটা ট্যাবলেট আর ফসফেটের জন্য একটা লিকুইড সাপ্লিমেন্টারি খেতে দিল। ফসফেটের সেই লিকুইড সাপ্লিমেন্টারি খেতে এতটাই বিস্বাদ যে সেটা খাওয়ার সময় ভয় হতো আবার বুঝি বমি হবে। সন্ধ্যায় আমার জন্য যে খাবার দেওয়া হলো, সেগুলো আমি মুখে দিতে পারিনি। আসলে কোনো ধরনের খাবারেই আমার রুচি ছিল না। তা ছাড়া আমি বেশ দুর্বল বোধ করছিলাম। এমন সময় আমার দায়িত্বে নতুন নার্স এলেন ইয়োগা। বয়সে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ সাউথ ইন্ডিয়ান অরিজিনের ইয়োগা আমার অবস্থা দেখে ব্রিথিং এক্সারসাইজ করার পরামর্শ দিলেন। এরপর নিজ উদ্যোগে একটি ওয়াকারের সাহায্যে আস্তে আস্তে করে সারা ওয়ার্ড ঘুরে হাঁটিয়ে আনলেন। রোগীকে হাঁটানোর জন্য আলাদা একটি ইউনিট রয়েছে; যার নাম ‘মোবিলিটি টিম’। আগে থেকে তাদের বুক না করলে সহজে পাওয়া যায় না। আমার জন্য যেহেতু কোনো অগ্রিম বুকিং ছিল না, তাই ইয়োগা নিজেই একটা ওয়াকার এনে আমাকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লেন। হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, শরীর আসলেই অনেক দুর্বল। হেঁটে আসার পর একটু ভালো বোধ করেছিলাম। তখন ইয়োগা কিছু শুকনো বিস্কুট খেতে দিলেন। কষ্ট করে দুটি বিস্কুট খেতে পেরেছিলাম। সেটাই ছিল অপারেশনের পর আমার প্রথম খাবার। অবস্থা দেখে স্ত্রী ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে রাতে থাকবে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে রোগীর নিকটজনের বা কেয়ার-গিভারের থাকার অনুমতি এবং ব্যবস্থা দুটিই আছে। রোগীর বেডের লাগোয়া একটা সোফা বেডে রোগীর কেয়ার-গিভারের জন্য শোয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে রাত-বিরাতে রোগীর যেকোনো প্রয়োজনে তাঁর কেয়ার-গিভার তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন। সার্জারির পর আমি যে কদিন হাসপাতালে ছিলাম, স্ত্রীও কেয়ার-গিভারের জন্য নির্ধারিত সেই সোফা বেডে হাসপাতালে ছিল।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ঘড়িতে রাত নটা বাজতে না বাজতেই আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু রাত ১১টার দিকে ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখি, ডিউটি ডাক্তারের সঙ্গে স্ত্রীর কথোপকথন চলছে। আলোচনার বিষয় আমার নাক দিয়ে রাইস-টিউব ঢুকিয়ে পাকস্থলী থেকে গ্যাস বের করা হবে কি না। আমি শুনেছি, রাইস-টিউব ঢুকানো একটি পেইনফুল প্রক্রিয়া। যখন সিদ্ধান্ত হলো যে এত রাতে আর তারা এই প্রক্রিয়ায় যাবে না, তখন আমি অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে আমার পেটের গ্যাস-বাবল আর ইলেকট্রোলাইট ইমব্যাল্যান্সের কারণে আমি পরের দুদিন বেশ কষ্ট পেয়েছি। কিছু খেতে পারিনি। শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কথা পর্যন্ত বলতে কষ্ট হতো। এই সময় নিকটাত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব হাসপাতালে আমাকে দেখতে এসে বেশ ভয় পেয়ে যায় শারীরিক অবস্থা দেখে। দুই দিন পর যখন আমার ফসফেট সাপ্লিমেন্টারি বন্ধ করে দেওয়া হলো, তখন থেকেই আমি ধীরে ধীরে ভালো বোধ করা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে খাবারে রুচি ফিরে পেলাম। শারীরিক দুর্বলতাও কেটে যেতে শুরু করল। ফলে আমিও নিয়ম করে সকাল-বিকেল দুবেলা মোবিলিটি টিমের সঙ্গে পুরো ওয়ার্ড ঘুরে হাঁটা শুরু করি। এই হাঁটা ছিল অস্ত্রোপচার থেকে রিকাভারির প্রথম স্টেপ।

মোবিলিটি টিমের মূল উদ্দেশ্য, আমার মতো ওপেন হার্ট সার্জারির রোগীকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরত পাঠানো। তাদের টার্গেট হচ্ছে, রোগী যেন বাড়িতে ফেরত গিয়ে একা একা চলতে–ফিরতে পারেন। বিশেষ করে সিঁড়ি ভেঙে অনায়াসে একতলা-দোতলা উঠতে পারেন। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে তারা প্রথমে রোগীকে নিয়ে ওয়ার্ডের করিডর ধরে হাঁটে। প্রথম প্রথম এই হাঁটা অল্প দূরত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ধীরে ধীরে তারা এই দূরত্ব বাড়ায়। তবে অবশ্য কিছুক্ষণ পরপর তারা খোঁজ নেয় রোগী হাঁটতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে কি না। ওয়ার্ডের করিডর পেরিয়ে প্রথমবার যখন আমাকে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন মোবিলিটি টিমের টেকনিশিয়ান আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি হাঁপিয়ে উঠেছি কি না। আমি হ্যাঁ বলাতে সেদিন তিনি সেখানেই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। তবে ধীরে ধীরে আমিও আমার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠি এবং ওয়ার্ড পেরিয়ে বাইরেও হাঁটা শুরু করি। একদিন সন্ধ্যায় হাঁটতে নিয়ে যাওয়া হলো উঁচু ছাদের সেই চত্বরে, যেখানে অস্ত্রোপচারের আগে আমি এবং স্ত্রী কফি নিয়ে বসে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। আমার সঙ্গে ছিলেন মোবিলিটি টিমের গ্রেস। বয়সে আমার থেকে কিছুটা বড় গ্রেস এসেছেন পোল্যান্ড থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে। কমিউনিস্ট আমলের পোল্যান্ডে তিনি ছিলেন একজন স্কুল টিচার। স্কুলের ছেলেমেয়েদের পোলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ পড়াতেন। কমিউনিস্ট আমলে পোল্যান্ডে শুধু রাশিয়ান এবং পোলিশ ভাষা প্রচলিত ছিল। ফলে কানাডা আসার আগে গ্রেসের পক্ষে ইংরেজি শেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে কানাডাতে এসে তিনি এবং তাঁর স্বামী দুজনেই কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিখেই কাজে ঢুকে যান। কানাডা কিংবা টরন্টোর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, একটি মিডল-ক্লাস জীবনোপকরণ অর্জনের জন্য অন্যান্য নিউ ইমিগ্র্যান্ট ফ্যামিলির মতো তাঁরাও দিন–রাত কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন। সেই সময় গ্রেসকে রাতের বেলায় কাজ করতে হতো। ফলে তাঁর সন্তানদের কিংবা স্বামীকে খুব কমই কাছে পেয়েছেন। আজ জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে তিনি তাঁর নিজের ভেতর এক গভীর শূন্যতা অনুভব করেন। তিনি মনে করেন, তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো ব্যয় করেছেন একাকী। যদিও তিনি তাঁর স্বামী এবং সন্তানদের নিয়ে একই শহরে একই বাড়িতে বাস করতেন, কিন্তু কাজের কারণে তাঁদের সান্নিধ্য পেতেন কদাচিৎ। বাবা-মা, ভাই-বোন এবং আত্মীয়স্বজনে ঘেরা পোল্যান্ডের যে সামাজিক বন্ধনকে তিনি ছেড়ে এসেছেন, সেটাকে আজ তিনি খুব মিস করেন। তাঁর মন চায়, আবার সেই সময়ে এবং সেই পরিবেশে ফিরে যেতে; যার কোনো বাস্তবিক অস্তিত্ব আজ পোল্যান্ডেও আর নেই। এটাই কঠিন বাস্তবতা। আমার সঙ্গে ধীরে ধীরে হাঁটার সময় কথা প্রসঙ্গে গ্রেস তাঁর এই ফিরে যাওয়ার আকুতির কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, শুধু গ্রেস একা নন, প্রত্যেক ইমিগ্র্যান্টের ভেতর রয়েছে এই ফিরে যাওয়ার আকুতি। চলবে...

**আগামীকাল পড়ুন: দ্বিতীয় জীবন: পর্ব-৫

*লেখক: কাজী সাব্বির আহমেদ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কানাডা