কানাডা আগমনের নেপথ্য-কথা: পর্ব -২

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুই বছর পর বেইজিংয়ে গিয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ল না শুধু দুয়েকটা ব্যাপার ছাড়া। বড় ধরনের পরিবর্তনগুলোর প্রথমটা হলো, আমাদের ইউনিভার্সিটির সব কটি ল্যাবে ইন্টারনেটের সংযোগ। দ্বিতীয় পরিবর্তনটা ছিল ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট–সংক্রান্ত। চীন থেকে পাস করে সাধারণত বাংলাদেশি ছাত্ররা হংকংয়ে ভিড় জমাত প্রফেশনাল চাকরির আশায়। কারণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে হংকং তখন সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এশিয়ার চারটি রাইজিং টাইগারের একটি বলে বিবেচিত হত। এবার লক্ষ্য করলাম কেউ কেউ এশিয়ার উঠতি টাইগার বা পঞ্চম টাইগার দেশ মালয়েশিয়াতেও পাড়ি জমাচ্ছেন চাকরি কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য। ঠিক একই সময়ে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিও চালু করেছে তাদের ‘রিসার্চ স্কলার’ প্রোগ্রাম, গবেষণা নির্ভর পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি, সঙ্গে ভালো অঙ্কের স্কলারশিপ মানি। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত এশিয়ান ইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কোর্স কমপ্লিট না করে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এসে পাড়ি জমাল আমার পরিচিত অনেকেই। চারদিকের এতসব কর্মকাণ্ডে আমিও প্রভাবিত হলাম। ইন্টারনেটের সুবাদে আমি তখন মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভালো ভালো ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ল্যাবের ওয়েবসাইটগুলোতে ঢুঁ মেরে বেড়াচ্ছি। উদ্দেশ্য আমার যোগ্যতানুযায়ী গবেষণাভিত্তিক কোনো একটা স্নাতক্তোর কোর্সে ভর্তি হওয়া। এদিকে আবার আমার বর্তমান মাস্টার্স প্রোগ্রামের কোর্সওয়ার্ক শেষ। সুপারভাইজারের সঙ্গে পরামর্শ চলছে গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে একসময় ‘ইমেজ প্রসেসিং’–সংক্রান্ত একটি বিষয়ও স্থির হয়।

আরও পড়ুন
ডিপার্টমেন্টসংলগ্ন ছাত্রাবাস ‘কলেজ যাবা’-তে রুম নিয়ে উঠে পড়লাম - ক্যান্টিনে তিন বেলার খাবারসহ রুম ভাড়া অতি সামান্য। শুক্রবার লাঞ্চে আবার স্পেশাল ডায়েট - ‘নাসি বিরিয়ানি’ (আমাদের পোলাউ মাংসের মালয়েশিয়ান সংস্করণ)।

ঠিক এই সময় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়া থেকে ভর্তির অফার পেলাম-ফিংগার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশনের ওপর গবেষণা সাপেক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি। বেইজিংস্থ মালয়েশিয়ান অ্যাম্বাসি থেকে ভিসা নেওয়ার সময় সেখানকার কাউন্সিলার অনেকটা গর্ব করেই বললেন—একটা সময় ছিল যখন মালয়েশিয়া থেকে ছাত্ররা বাংলাদেশে পড়তে যেত, আর এখন উল্টো তোমরা যাচ্ছো মালয়েশিয়ায়। ইতিমধ্যে ‘টাইম’ পত্রিকা কুয়ালালুমপুরের ‘টুইন টাওয়ার’ নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি বের করেছে—বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য বিশ্ব-মিডিয়াতে মালয়েশিয়া তখন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একটা মাস্টার্স কোর্স মাঝপথে অসমাপ্ত রেখে ভিন্ন একটা দেশে আরেকটা মাস্টার্স কোর্স গোড়া থেকে শুরু করা—মন থেকে এই দ্বন্দ্ব দূর করে একদিন বিমানে চেপে বসলাম কুয়ালালুমপুরের উদ্দেশ্যে। কাউকেই চিনি না, একজনের মোবাইল নম্বর শুধু সঙ্গে আছে।

বিমানের চাকা যখন কুয়ালালুমপুর ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে রানওয়ে স্পর্শ করল তখন স্থানীয় সময়ে রাত আটটা। ইমিগ্রেশন ও কাস্টম পার হয়ে সোজা চলে এলাম এয়ারপোর্টের ট্যাক্সি সার্ভিস সেন্টারে। সেখান থেকে সঙ্গে করে আনা মোবাইল নম্বরে ফোন দিতেই ওপাশে হাবিব ভাইয়ের আন্তরিক কণ্ঠস্বর—যে উৎকণ্ঠা নিয়ে সারাটা পথ কাঠ হয়ে ছিলাম, সেটা কেটে গেল নিমিষেই। উনি ট্যাক্সিচালককে ঠিকানা বলে দিলেন ফোনে। প্রায় মিনিট চল্লিশের পথ। পথে চালকের সঙ্গে খুচরা কথোপকথনে বুঝতে পারলাম যে কুয়ালালুমপুরের ব্যবহারিক ভাষা হচ্ছে মালয়ে—তবে ইংরেজি কম বেশি সবাই বুঝতে এবং বলতে পারে। আমার প্রথম মালয় শব্দ এই ট্যাক্সি ভ্রমণের মাঝেই শেখা হয়ে গেল—‘জালান’ যার অর্থ রাস্তা বা সড়ক, আবার ‘জালান-জালান’ অর্থ হাঁটাহাঁটি করা। পরে অবশ্য কাজ চালানোর মতো মালয় ভাষা আমার শেখা হয়েছিল সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বসবাসের কারণে।

আরও পড়ুন
আমি যে সময় মালয়েশিয়াতে এলাম, সম্ভবত সেই সময় ছিল তাদের উন্নয়নের ‘পিক-পয়েন্ট’। গড়ে উঠছে শহরের বাইরে নতুন দুটি অত্যাধুনিক শহর-পূত্রাজায়া ও সাইবারজায়া। বাংলাদেশ থেকে আসা শ্রমিকের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো।

মালয়েশিয়াতে নেমেই প্রথম যে জিনিষটা চোখে প্রকট হয়ে ধরা পড়ল, সেটা হলো ‘মাল্টি কালচারালিজম’। মালয়, চায়নিজ এবং ইন্ডিয়ান (মূলত তামিল) এই তিন জাতিসত্ত্বার সংমিশ্রনে গঠিত মালয়েশিয়ান জাতীয়তা। এখানে আসার পূর্বে আমার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা শুধু চীনের বেইজিং শহরে বসবাসের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য বিশাল এবং বিচিত্র চীনের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়েয়েছি অনেকটা সময় নিয়ে। চীনের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা নব্বুই ভাগ হচ্ছে ‘হান’ জাতিসত্ত্বার চায়নিজ, দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিসত্ত্বা হচ্ছে ‘মাঞ্চুরিয়ান’- এ ছাড়া আছে অসংখ্য উপজাতি। চীনের যাপিত জীবনের মূলধারায় ‘হান’ জাতির প্রাধান্য প্রকটভাবে প্রবল। সেই হিসেবে মালয়েশিয়ার চিত্র ভিন্ন। কুয়ালালুমপুরে মালয় এবং চায়নিজ জনসংখ্যার আনুপাতিক হার প্রায় সমান সমান হলেও ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা এদের তুলনায় অনেক কম। মালয়েশিয়ার মূল জীবনধারায় কোনো একক জাতির প্রাধান্য অনুপস্থিত, বরং ভিন্ন ভিন্ন জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সত্যিই চোখে পড়ার মতো।

দীর্ঘদিন বেইজিংয়ে বসবাস করার পর কুয়ালালুমপুরে এসে চীনের জীবনধারার সঙ্গে মালয়েশিয়ার জীবনধারার বেশ কিছু বৈপরীত্য ধরা পড়ল।

প্রথমত: সরকার নির্ধারিত ‘এক সন্তান’ রীতির দেশ চীন - অন্যদিকে মালয়েশিয়ান সরকার জনগণকে অধিক সন্তান নেওয়াতে উৎসাহিত করছে। তবে বর্তমানে চীনে এখন সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো বিধিনিষেধ নেই।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আরও পড়ুন

দ্বিতীয়ত: চীনে মূলধারার চায়নিজদের কখনো কোনো ধর্ম পালন করতে দেখিনি—ধর্মের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা যদিও অনেকটাই শিথিল ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর আমলের তুলনায়। অথচ মালয়েশিয়াতে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান পালন করাটাই স্বাভাবিক রীতি—অর্থাৎ ধর্মচর্চা এখানকার মূলধারা জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ সেটা যে ধর্মই হোক না কেন। চীনে যে চায়নিজ জাতিকে দেখে এসেছি এক ভাষাভাষী, যাদের পরিবার এক সন্তানভিত্তিক এবং যাদের জীবনে ধর্মের কোনো বালাই নেই, সেই চায়নিজদের মালয়েশিয়াতে দেখছি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে। অন্তত: পক্ষে তিনটি (মালয়, ইংরেজি এবং চাইনিজ) ভাষায় অনর্গল কথা বলছে—পরিবারে সন্তানের গড়ে সংখ্যা তিন থেকে চারটি—আর নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের ধর্মাচার পালন করছে। ইদানীংকালে অনেক শিক্ষিত চায়নিজ অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে অথবা মিশনারি কার্যক্রমের প্রভাবে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে—কিন্তু একই সঙ্গে তারা তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম ‘তাও’-এরও অনুসারী। মানে একই সঙ্গে তারা দুটি ধর্মের রিচুয়াল পালন করে থাকে। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়াকে আমার কাছে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হিসেবেই মনে হয়েছে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি যে সময়টায় মালয়েশিয়াতে আসলাম, সম্ভবত সেই সময়টা ছিল তাদের উন্নয়নের ‘পিক-পয়েন্ট’। তখনকার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়াকে একটি সমৃদ্ধ ও স্বাবলম্বী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চূড়ান্ত করেছেন। একই সঙ্গে সেসব কার্যক্রমকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করেছেন, যা কিনা ‘ওয়াওয়াসান ২০২০’ বা ‘ভিশন ২০২০’ নামে পরিচিত। ‘ভিশন ২০২০’-কে সামনে রেখে বিপুল কর্মকাণ্ডের আয়োজন পুরো দেশজুড়ে—তিন ধরনের মেট্রো রেলওয়ে, পেট্রোনাস টাওয়ার অর্থাৎ টুইন টাওয়ার, প্রচুর রাস্তাঘাট আর সারি সারি উঁচু দালান। গড়ে উঠছে শহরের বাইরে নতুন দুটি অত্যাধুনিক শহর - পূত্রাজায়া ও সাইবারজায়া। পূত্রাজায়াকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হবে সরকারের সব ধরনের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড। আর সাইবারজায়া হবে মালয়েশিয়ার ‘সিলিকন ভ্যালি’। ‘ভিশন ২০২০’-এর অন্যতম মূলভিত্তি ‘মাল্টিমিডিয়া সুপার করিডোর’ প্রকল্পের কারণে প্রচুর মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি তাদের এশিয়ান হেড-অফিস সাইবারজায়াতে স্থাপন করার জন্য ইতিমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সুবাদে বিভিন্ন দেশ থেকে এসে ভিড় করেছে অগনিত নির্মাণ শ্রমিক। বাংলাদেশ থেকে আসা শ্রমিকের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো।

আরও পড়ুন

হাবিব ভাইয়ের ফ্ল্যাটে সপ্তাহ দুয়েক থাকার পর চলে আসি আমার ইউনিভার্সিটি শহর বাংগি-তে। দুর্ভাগ্যবশত ‘ফিংগার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন’ গবেষণা প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন থেকে গ্র্যান্ট পেতে ব্যর্থ হয় - ফলে আমার স্কলারশিপ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। সেই সময়ে মালয়েশিয়ার সব চাইতে পুরোনো ইউনিভার্সিটি, ‘ইউনিভার্সিটি অব মালায়া’র কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের লেকচারার ইফতেখার ভাই এগিয়ে আসেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। তিনি আমাকে ‘ক্যাটালগিং অব বায়ো-ডাইভার্সিটি ইন মালয়েশিয়া’ নামক সেখানকার এক গবেষণা প্রকল্পের ‘গবেষণা সহকারী’-র পদ পাইয়ে দেন। এই পদে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর আমি সেই ডিপার্টমেন্টেই ‘মাস্টার্স বাই রিসার্চ’ কোর্সে ভর্তি হই - এবারে আমার গবেষণার বিষয় ‘কম্পিউটার সিকিউরিটি’। মাস্টার্স শেষে সাইবারজায়াতে ‘নফরমেন টেকনোলজি’ বিষয়ক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ইচ্ছা।

ডিপার্টমেন্টসংলগ্ন ছাত্রাবাস ‘কলেজ যাবা’-তে রুম নিয়ে উঠে পড়লাম - ক্যান্টিনে তিন বেলার খাবারসহ রুম ভাড়া অতি সামান্য। শুক্রবার লাঞ্চে আবার স্পেশাল ডায়েট - ‘নাসি বিরিয়ানি’ (আমাদের পোলাউ মাংসের মালয়েশিয়ান সংস্করণ)। সারাদিন ডিপার্টমেন্টে কাটিয়ে এসে বিকেলে ক্রিকেট খেলাও শুরু করলাম। রাতে ছাত্রাবাস চত্বরে খোলা আকাশের নিচে পাকিস্তানি, মরক্কো ও বাংলাদেশি সহপাঠী ছাত্রদের সঙ্গে বসে ‘তে-ও-আইস-লিমাও’ (আইস-লেমন-টি) সহযোগে আড্ডা অথবা হলের টিভি রুমে বসে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সিতি-নূরহালিজার গান শোনা। কোনো কোনো উইকএন্ডে আমাদের লালমাটিয়ার ওবায়েদ ভাই আসেন - তার গাড়িতে করে চলে যাই থিয়েটারে মূভি দেখার জন্য, কখনো বা ঘরোয়া কোনো গজলের আসরে। ঠিক এই সময়টায় পপতারকা মাইকেল জ্যাকসন এসে কনসার্ট করে গেল কুয়ালালুমপুরের অদূরে শাহ-আলম স্টেডিয়ামে। দুর্ভাগ্যবশত: আমার যাওয়া হয়নি সেই কনসার্টে। এর পরপরই আইসিসি ক্রিকেটের আসর বসলো কুয়ালালুমপুরে। ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ যে ইতিহাস গড়েছিল সেটা অবশ্য স্বচক্ষে উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে মালয়েশিয়ার জীবনটা মন্দ চলছিল না। চলবে...

*আগামীকাল পড়ুন: কানাডা আগমনের নেপথ্য-কথা: (পর্ব -৩)

আরও পড়ুন