গাড়ি চালানোর যত কেচ্ছা : কানাডা পর্ব-১
সকাল সাতটা।
প্রতিদিনের মতো সকালে প্রাতরাশ না সেরে ব্যাগে নিয়ে রওনা হলাম। কাজের জায়গায় পৌঁছে খাওয়াদাওয়া সারা যাবে।
করোনা অতিমারিতে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে চোখের পলকে। বাসা থেকে আমার কর্মস্থল ওয়ালমার্টে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। করোনার থাবা বাগড়া বাধিয়েছে বাসের নিয়মাবলি আর শিডিউলেও!
কেপ ব্রেটনের সিডনিতে যে বাস সার্ভিস আছে, সেটাকে বলে ট্রানজিট কেপ ব্রেটন। ওদের সব বাস জমায়েত হয় ডরচেস্টার স্ট্রিটে। ওখান থেকে পর্যায়ক্রমে ছেড়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। বাসা থেকে প্রথমে ৯ বা ১০ নম্বর বাসে চড়ে ডরচেস্টারে এসে তারপর পরের বাস।
প্রতিটি বাসের যাত্রী সংখ্যা কমে দাঁড়াল ১২ জনে। লকডাউনের পরপরই প্রথম দিন বিষয়টা জানতাম না। গন্তব্যস্থল নর্থ সিডনি। মেইন বাসস্টপেজ থেকে ৫ নম্বর বাসে যেতে হবে ওই জায়গায়। প্রতিদিনের মতো আগেভাগেই উঠে বসে পড়েছি। দেখলাম চালক সটান নিষেধ করে দিলেন কয়েকজন যাত্রীকে! তাদের চেহারার আদল দেখে যা বুঝলাম ওরা আমার মতোই চাকরিতে যাচ্ছে। এরপরের বাস পাক্কা এক ঘণ্টা পরে। এখানে প্রতি ঘণ্টায় বাস ছেড়ে যায়। সকালের দিকের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো বাদে। তখন ওরা শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করে।
এখন ওদের উপায়? নিশ্চিত ওদের গলাকাটা ভাড়ায় ট্যাক্সিতে চেপে কাজে যেতে হবে। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও খারাপের দিকে চলে গেল।
পরের দিন দেখলাম আরও বেশি যাত্রী অপেক্ষা করছে বাসের জন্য। আর সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি যখন দেখছি ওখানে আগে থেকে লাইন দিয়ে ছেলেপেলেরা দাঁড়িয়ে গেছে! শুধু নিজে লাইনে থেকেছে তা–ই নয়, এর আগের দিন যারা বাসে উঠতে পারেনি, তাদের জন্যও জায়গা রেখে দিয়েছে, যাতে অন্য কেউ জায়গা নিতে না পারে। বিষয়টা বেশ কাঠখোট্টা ঠেকছে। যাদের বাসা বাসস্টপের কাছাকাছি, তারা যদি এভাবে প্রতিদিন এসে জায়গা দখল করে বসে থাকে, তাহলে যারা দূর থেকে আসছে, তারা কী করবে?
কারও কাছে কোনো উত্তর নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করব, সে অবস্থাও নেই। এখানে যে আগে আসবে, সে আগে জায়গা নেবে—এটাই নিয়ম। বাসা থেকে এখানে আসার প্রথম বাস ৭টা ২০–এ। ওই ছোকরাদের দল তারও অনেক আগে থেকেই জায়গা দখল নিয়ে রেখেছে। বুঝলাম, এভাবে চলতে পারে না। এর একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দরকার।
সবাই তখন একটা কম দামি গাড়ি কেনার পরামর্শ দিল। ভবিষ্যতে গাড়ি ছাড়া চলাচল এমনিতেই করা যাবে না। ‘কানাডা’ মানে ‘কার’। এখানে গাড়ি ছাড়া কেউ চলতে পারে না। জীবনের একটা না একটা সময় গাড়ির প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। কেননা, এখন থেকেই এর প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া যাক। সে ক্ষেত্রে এখানকার ধাপ মূলত দুটি—প্রথমে লাইসেন্সের লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়।
এরপর ওটা পাস করে গেলে রোড টেস্ট দিতে হয়। ব্যস! পাস করলে লাইসেন্স নিয়ে বাড়ি যাও। তবে যাদের নিজ দেশের লাইসেন্স কার্ড নেই, তারা এক বছর পর্যন্ত গাড়ি চালাতে পারেন না। এরপর ড্রাইভিংয়ের রোড টেস্ট। নিজের গাড়িতে দেওয়া যায় বা প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত গাড়ি দিয়েও। প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক না হলেও কমবেশি সবাই যারা নিজেরা গাড়ি কেনেনি, নিয়ে রাখে।
গাড়ি কেনার ব্যাপারে তখনো টাকাপয়সা আর বাকি সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি। এর মধ্যে ঘটে গেল এক আজব ঘটনা।
যথারীতি সকাল সকাল গিয়ে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কিন্তু এ কী! বাস তো দাঁড়াল না। সোজা চলে গেল। যেখানে বাসের নম্বর প্লেট থাকে, সেখানে লেখা আছে ‘আউট অব সার্ভিস’। কীভাবে সম্ভব? ভেতরে তো দিব্যি যাত্রীরা বসে রয়েছে। তাহলে আউট অব সার্ভিস হয় কী করে?
এত কিছু মাথায় যখন ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন চটজলদি ফোন করলাম ট্যাক্সি সার্ভিসকে। সকালের ৭টা ২০–এর ওই ৯ নম্বর বাস চলে গেলে মূল কাজের জায়গায় যাওয়ার পাঁচ নম্বর বাস মিস হয়ে যাবে। এই বাসে বাসার বাইরে থেকে উঠে মূল বাসস্টেশনে পৌঁছে পরবর্তী বাসে যেতে হয়। বেশি দেরি না করে চলে এল ট্যাক্সি। ওকে ডরচেস্টারের বাসস্টেশনে নামিয়ে দিতে বললে ও নামিয়ে দিল। নেমে ভাবলাম বাসে আর জায়গা পাব না।
দেখলাম আমাদের পাঁচ নম্বর বাস তখনো আসেনি। তখনো মাথায় ঘুরছে আগের বাসের কীর্তি! ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি জানালেন, এখন থেকে নিয়ম করা হয়েছে যদি কোনো কারণে গাড়ির মোট যাত্রী সংখ্যা ১২–এর অধিক হয়ে যায়, তখন আর বাড়তি যাত্রী নেওয়া হবে না। কারণ, প্রতি বাসে অতিমারি সময়কালীন মোট যাত্রী সংখ্যা ওটাই। কী করা যাবে? শিরে সংক্রান্তি।
এত দিন ভাবছিলাম বাসস্টেশনে গিয়ে কীভাবে কাজে যাওয়ার পরবর্তী ৫ নম্বর বাসে চড়ব? এখন তো বাসে চড়াও মুশকিল হয়ে যাবে দেখছি। প্রতিদিন যদি এভাবেই বাসে যাত্রী সংখ্যা ১২ হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে আমার ট্যাক্সি করে বাসস্টেশনে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো গতি থাকবে না। তবে এতেই কি সমস্যার কোনো হাল হবে? না, ওখানে পৌঁছে যদি আগে লাইনে দাঁড়ানো ছেলেছোকরাগুলোর ঠেলায় জায়গা না পাই, তখন কী হাল হবে?
মোদ্দাকথা, ৩০ ডলারের শ্রাদ্ধ করতে হবে, অন্য কোনো উপায় নেই। ওই দিন অবশ্য ৫ নম্বর বাসে জায়গা পেতে আর কোনো ঝক্কি পোহাতে হয়নি। আসার সময়ও বেশ ঠিকঠাকমতোই ফিরে এলাম। প্রতিদিন এভাবে চলবে না, এটা ওই দিন বোঝা হয়ে গেল।
সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে আমার বাসার বাকি ছেলেদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করতে লাগলাম। এটাই ঠিক করলাম কম দামে একটা গাড়ি কিনে আপাতত বেহাল পরিস্থিতি কিছুটা সামলে উঠে তারপর দেখা যাক কী হয়। আর আমি গাড়ি চালাতেও জানি না, এ ক্ষেত্রে কাজটা এখন থেকেই পরিচিত মানুষের সংস্পর্শে থেকেই শিখে নেওয়া উত্তম। পরে এই বিদেশবিভুঁইয়ে কোথায় না কোথায় গিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় কে জানে?
এ ক্ষেত্রে পুরো দায়িত্ব অপ্রত্যাশিতভাবে একাই কাঁধে তুলে নিল আমার রুমমেট জুয়েল। প্রথমে এটা ঠিক করা হলো আমার মোট কত টাকা হাতে রয়েছে। সর্বসাকল্যে বাজেট নির্ধারিত হলো ৩ হাজার থেকে ৩৫। এর বেশি সাধ্যে কুলাবে না। আমার ব্যাংকে সবকিছু মিলিয়ে এর চেয়ে কিছুটা বেশি আছে। আমরা ফেসবুকের মার্কেট প্লেসে গাড়ি দেখে ৩৫ ডলারের কাছাকাছি একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি দেখলাম। মূলত জুয়েলই যাচাই–বাছাই করে সব ঠিকঠাক করে নিল। এ ক্ষেত্রে আমি শুধু খরচাপাতির ব্যাপারটা সামাল দিলাম। ও আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে না গেলে সেটাতেও অনেক সমস্যা পোহাতে হতো।
এসব স্মৃতি আজীবন আগলে আমি বেঁচে থাকব হয়তো আর জুয়েল যেহেতু সবার জন্যই এমনটা করে, ওর এসব ছোটখাটো ঘটনা ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না! আমিও আজ পর্যন্ত কতজনকে পড়াশোনার সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে বা দেখিয়ে সাহায্য করেছি, এখন তার কানাকড়িও মনে নেই। এরপর ইউনিভার্সিটির চাকরিতেও যাদের সাহায্য করেছিলাম, পরবর্তী সময়ে তারা অনেকেই আমাকে আগের কথা বললেও আমি বেমালুম ভুলে গেছি। এরই নাম জীবন। জুয়েল গাড়ি খুঁজে বের করল বাসার বেশ কাছাকাছির মধ্যে। আমরা রওনা দিলাম।
আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওই বাসায়। জুয়েল কল দিল গাড়ির মালিককে। এর আগে আমাকে বলে দিল, দামাদামি বা গাড়ি পর্যবেক্ষণ সব ও করবে। আমার কাজ শুধু মনোযোগী ছাত্রের মতো সবকিছু অবলোকন করা, যাতে পরেরবার নিজেই এসব করতে পারি।
মাস্ক পরিহিত এক মধ্যবয়সী ভারতীয় যুবক বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের অভিবাদন জানিয়েই ওর আনা স্যানিটাইজারে হাত স্যানিটাইজ করে নিতে বলল। ও দক্ষিণ ভারতের। বুঝলাম ওর কথা বলার বাচনভঙ্গিতে, দক্ষিণ ভারতের অনেক সহপাঠীর সঙ্গে ক্লাস করছি। অনেকের সঙ্গে সখ্যতাও আছে। ওর নাম টিজু।
তখন অতিমারিতে ইতালিতে মড়ক লেগেছে। লাশের বহর নেওয়ার ছবি সকালে পেপারে দেখেছি। বেঘোরে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
গাড়ির কথায় ফেরত আসি, রুপালি রঙের হায়উন্ডাই এক্সেন্ট ২০১০ মডেল। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সামনের দিকের বাম্পারের নিচের অংশটা কিছুটা ভাঙা। ওখানে টেপ লাগানো রয়েছে। জুয়েল গাড়ির হুড তুলে ভেতরে কলকবজা বেশ ভালোভাবে দেখতে লাগল।
এরপর ওটা বন্ধ করে গাড়ির নিচে কিছু একটা দেখল। পুরোপুরি না দেখতে পাওয়ায় অনেকটা শুয়ে গিয়েও দেখে নিল। তখন বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস আট কি নয় হবে! ও এসবে ভ্রুক্ষেপহীন। জিজ্ঞেস করাতে জানাল শীতের সময় এখানকার রাস্তায় বরফ গলানোর জন্য লবণ ছিটানো হয় আর এতে গাড়ির নিচের তলদেশ ক্ষয়ে যায়। সেটাকে একটা কোডিং করিয়ে নিতে হয়, যাতে ক্ষয়রোধ করা যায়।
বাকি গাড়ির ভেতরে ঢুকে আমরা বসে দেখলাম। এরপর জুয়েল চালিয়ে দেখল। আমরা তিনজনে সিডনির মেইন হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চললাম অনেক দূরে। আমরা সিডনি রিভারের প্রধান সড়ক হয়ে ফেরত এলাম গাড়ির মালিকের বাসায়। যাওয়ার পথে জুয়েল গাড়ির পার্টস, কত দিন চালিয়েছে, সবকিছু মিলিয়ে কেমন সার্ভিস দেয়—খুঁটিনাটি জেনে নিল।
টিজুও আরও বেশ কিছু তথ্য দিল। কেন বিক্রি করতে চাইছে, এটাও জানা দরকার। টিজুর বাসার সামনে আমরা যখন পৌঁছাই তখন জুয়েল ওর নতুন হোন্ডা সিভিক ব্র্যান্ডের গাড়িটার বেশ প্রশংসা করেছিল। মূলত ওটা কেনা হয়েছে বলেই এটা বিক্রি করছে ও।
এখানকার সবাই এমনই করে, আলাদিনের ‘নতুন প্রদীপ নাও, পুরোনো প্রদীপ দাও’ লাইনের কথা মনে আছে? যখন দুষ্ট জাদুকর আলাদীনের অনুপস্থিতিতে ওর প্রদীপ হাতিয়ে নিয়েছিল, তখন এ কথা বলেই কাজ সেরেছিল। এখানকার চলনও ‘নতুন গাড়ি নাও, পুরোনো গাড়ি দাও’ এমন হয়ে গেছে! ক্রমশ...