কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত-একাদশ পর্ব

কোনো এক অবসরে লাইব্রেরিতে
ছবি: লেখক

দশম পর্বের ধারাবাহিকতায়

স্কসিয়ার চাকরির অফার পাওয়ার পর আমি নিয়োগকারী কর্মকর্তাকে একটা প্রশ্নই করেছিলাম, যেটা যেকোনো প্রবাসী ছাত্রের মাথায় থাকে—পিএনপির (প্রভিন্সিয়াল নমিনি প্রোগ্রাম-অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় আবেদনের একটা মাধ্যম) প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাব কি না?

কারণ ওই কাগজের জন্যই হন্যে হয়ে কাজ খোঁজা! ওই কাগজপত্র না পেলে স্থায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারব না।

বলা বাহুল্য, ইতিবাচক উত্তর পেয়ে মনে মনে বেশ নির্ভার বোধ করেছিলাম।

জয়েনের দিনে যথাসময়ে হাজির হলাম। দুই গ্রুপে ১০ জন করে খুব সম্ভবত মোট ২২ জন ছিলাম। আমাদের গ্রুপে পাঁচজন ভারতীয়, দুজন বাংলাদেশি, একজন করে কানাডিয়ান, ব্রাজিল, সোমালিয়া আর পেরুর। দুই গ্রুপ বিভক্ত হয়ে দুটি ভিন্ন রুমে চলে এলাম। অতিমারির কারণে তখন বিশেষ নিয়ম ছিল। ট্রেইনারের নাম এমি। সবার পরিচিতি পর্ব শেষ হওয়ার পর জানানো হলো, প্রথম তিন সপ্তাহ ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয়, নিয়মাবলি আর হরেক রকমের ব্যাংক কার্ড, চেকসহ আরও আনুষঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারপর গ্রাহকদের সঙ্গে ফোনে কীভাবে কথা বলতে হবে, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ পর্যায়কে বলা হবে পডিং—যদিও আমরা গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব, তবে আমাদের সহযোগিতায় ফিল্ড সাপোর্ট থাকবে। এমির সঙ্গে কাটানো তিন সপ্তাহের সময়টা খুব সুন্দর ছিল। ও আমাদের অনেক যত্ন নিয়ে, একই সঙ্গে অনেক মজা করেই সবকিছু শেখাতে লাগল।

বাসায় ফেরার পথে
ছবি: লেখক

এরপর আমরা নিচে চলে গেলাম যেখানে আমাদের ফোন রিসিভ করা ও কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলার মাসিক ট্রেনিং শুরু হলো। এত দিনের যে নিয়মাবলির প্রশিক্ষণ নিলাম, সেটাই ছিল এ চাকরির মধুচন্দ্রিমার সময়। এবার শুরু হবে আসল কাজ, যা সব সময়ই বিরক্তিকর! মানুষের অভিযোগের ফিরিস্তি শোনা আর সমাধানের চেষ্টা করা।

অনেকেই কাজ ছেড়ে দিল প্রথম মাসের পরই। এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও...কোনো কিছুই তাদের ধরে রাখতে পারল না! তবে কিছু ব্যাপার লক্ষ করলাম, আমাদের গ্রুপে মোট ২৪ জনের জন্য সাপোর্ট স্টাফ ছিল মাত্র ৪ জন! তাই প্রয়োজনের সময় ওদের কাছে পেতাম না। আর দুজনের ব্যবহার খুবই বাজে ঠেকেছিল। বলতেই হবে...ভাবতে আশ্চর্য হই, তারা এখানে বহাল আছে কীভাবে? কেউ কেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে না? যা-ই হোক, আমাদের ট্রেইনার পরিবর্তন হলো। কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু সাইট ম্যানেজারের শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে পারলাম না। তারপরও অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কাজ করে যেতে লাগলাম।

প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেল জয়েনের পর। কাজ ভালোই চলছিল। আমার গ্রুপ ম্যানেজার স্যান্ড্রা অনেক সহায়তা করত বিভিন্ন কাজে। তখন আমার মেডিকেল টেস্টের মেইল পেলাম, যেটা আমি আগেই অ্যাপ্লাই করে রেখেছিলাম। স্থায়ী অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় আবেদনের সময় মেডিকেল টেস্ট করাতে হয়। এর অগ্রিম প্রস্তুতি হিসেবে আমি টেস্ট করাতে চেয়েছিলাম। প্রায় পাঁচ মাসের অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত টেস্টের ডাক পাই। (করোনার সময়ের কারণে) ভাবলাম এ কাজ যেহেতু এখনই করিয়ে নিচ্ছি, তাই অফিশিয়াল কাগজপত্রগুলোরও একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখি কী অবস্থা। স্কসিয়া ব্যাংকের এইচআর (অফিশিয়াল কাগজপত্র প্রসেসিং যারা করে) ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করলাম। ওরা প্রথমে উত্তরই দিল না! এক সপ্তাহের পর পরের সপ্তাহের শেষের দিকে জবাব পেলাম, ওরা কাগজপত্র দেয় না! এ ক্ষেত্রে দুটি কাগজ লাগে—প্রথমত, অভিজ্ঞতার সনদ আর দ্বিতীয়ত, এনএসএনপি ২০০ (এটা এমপ্লয়ারের ফর্ম, পূরণ করার দায়িত্বও ওদের)। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল!

আরও পড়ুন

ঘুরেফিরে আবার একই জায়গায় এসে আটকে গিয়েছি—এমনটাই মনে হচ্ছিল। ইমিগ্রেশন–সংক্রান্ত কাগজপত্রের ব্যাপারে কোনো সাহায্য–সহযোগিতা করে না! কাজেই চাকরির শুরুতে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পেলাম না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও ইমিগ্রেশন অফিসে যোগাযোগ করলাম এ আশায়, যদি ওরা কোনো সাহায্য করতে পারে। ওখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে কথা বললাম। ওই মেয়ে কর্মকর্তা আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল, যা এখনো কানে বাজে, ‘তুমি কি তোমার এমপ্লয়ারকে বলেছ, ওরা যদি সাহায্য না করে, তাহলে তোমাকে কানাডা থেকে চলে যেতে হবে?’

বললাম, সবকিছুই গুছিয়ে বলেছি।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ইমিগ্রেশন বিভাগ এ ব্যাপারে প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের কোনো সহায়তা করে না! এমনকি ওরা এমপ্লয়ারদেরও কোনো কিছু বলতে পারে না! তাহলে এ ক্ষেত্রে কোথায় সহায়তা পাব? এর কোনো সদুত্তর পেলাম না। প্রায় মিনিট ত্রিশের কথোপকথনে বুঝলাম, অন্য কাজ খোঁজা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমার প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব পাইনি।

প্রশ্ন ছিল, চাকরির সময় যদি কোনো কর্মীকে অঙ্গীকার করা কথা পরবর্তী সময়ে বরখেলাপ করা হয় আর সে জন্য তাকে দেশছাড়া হতে হয়, এমন পরিস্থিতিতে সেই কর্মী কোথায় সহায়তা পেতে পারে? আমার অবস্থাটাই এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়।

লেসউড বাসটার্মিনাল
ছবি: লেখক

তখন শেষমেশ ওই কর্মকর্তা আমাকে আবার স্কসিয়া ব্যাংকে যোগাযোগ করতে বলল। ভালোভাবে বিষয়টা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে উপদেশ দিল। আমিও তা–ই করলাম। ব্যবস্থাপকদের আবার জানালাম। মানবসম্পদ বিভাগে (এইচআর) আবার যোগাযোগ করলাম। কিন্তু কোনো ফল হলো না। সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল যখন সিনিয়র ম্যানেজারদের জানালাম, ওরা একে তো আমলে নিলই না, বরং উল্টো আমাকে ব্যাংকিং সম্পর্কে নানা উপদেশ দিল, যা আমার কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো ছিল! সাহায্য না করতে পারার কারণ হিসেবে বলল, ওদের পলিসি আপডেট হয়েছে, যার আওতায় ওরা এনএসএনপি প্রদান করা বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ শুরুতে আমাকে বেমালুম মিথ্যা বলা হয়েছে। এত দিন শুনেছি, একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই, স্থায়ী অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় আবেদনের পথ প্রশস্ত। খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপার নিয়ে! চাকরিও কেউ আপনাকে অফার করবে না বা নিয়েও হাজির হবে না...সব দায়ভার একান্তই আপনার নিজের।

প্রতিদিন নিয়ম মেনে অফিসে কাজ করে যেতে লাগলাম! এটা জেনেও যে সব কাজই অর্থহীন। প্রতি সপ্তাহে কাজের মূল্যায়ন হতো। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপক আপনাকে কোথায় কোথায় কাজ করতে হবে বা কাজে পরিবর্তন আনতে হবে, এসব জানাবে। সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে একটা দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা মনে হয়েছিল। ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল ওয়ালমার্টের শেষ দিনগুলোয়। একদিকে আপনি জানেন এখানে কাজ করলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন না, আবার অন্যদিকে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন, সেটাও পারবেন না! কাজেই উভয়সংকট। এ অবস্থায় এমন কোনো কোম্পানিতে কাজ খুঁজে বের করতে হবে, যারা আমাকে পিআরের কাজে সাহায্য করবে। কিন্তু চাকরি খুঁজে পাওয়া এত সহজ নয়।

অবশেষে বহু চড়াই-উতরাইয়ের পর আরেকটা কোম্পানিতে চাকরি পেলাম। ভাবলাম, যাক এবার বোধ হয় ভাগ্য ফিরল। কোথায় কী! চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর প্রথম দিনই বুঝতে পারলাম, এ কোম্পানিতে প্রবাসী কর্মীদের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। এরা মূলত ফোন কোম্পানি হলেও টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও হোম সিকিউরিটি সেবাও প্রদান করে থাকে। তবে সবকিছুই এলোমেলো লাগছিল। কানাডায় আসার পর থেকে এমনটা অন্য কোনো জায়গায় দেখিনি! ভিন্নমাত্রার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। বিশেষ কোনো অসুবিধা হলে কেউ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আপনার আশপাশে থাকবে না। অবশ্য অতিমারির কারণে এটা অনেক পরিচিত একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে—বাসায় বসে কাজ। কিন্তু বরাবরই আমার আগের অভিজ্ঞতার সুবাদে এমন কাজ ভালো লাগেনি। কনসেনট্রিকসের কাজের কারণে আমি এ মাধ্যমের সঙ্গে থেকেই পরিচিত। কোনো বিশেষ সমস্যা, যেটা প্রায় সময়ই আপনার নাগালের বাইরে, এ ক্ষেত্রে টেক সাপোর্টের সাহায্য নিতে হবে। তবে অফিসে গিয়ে কাজ করাটা আমাকে অন্য রকমের আত্মবিশ্বাস জোগাত। আগে অনেক জায়গায় কাজ করেছি। সিডনিতে ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে ওয়ালমার্টে বা হ্যালিফ্যাক্সে টিডিতে এবং শেষে স্কসিয়াতে। কোথাও এমন ট্রেইনার দেখিনি, যার আচরণ সব সময় কেমন যেন একপেশে, বিশেষ করে আমার প্রতি! কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞা করলে বা জানতে চাইলে কীভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়, সে উপায় খুঁজে ফেরা। নিজেকে ট্রেইনার পরিচয় দেওয়া ওই ভদ্রমহিলা মূলত ব্রিটেন থেকে আগত হলেও তাঁর হাবভাবে এটা স্পষ্ট ছিল, তিনি প্রবাসীদের মোটেও পছন্দ করেন না! কর্মক্ষেত্রে বর্ণবাদের রোষে পড়ব ভাবিনি। সেটারও অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। ট্রেনিংয়ে কারও জন্য আলাদা করে সময় দেওয়া হতো না। সে ক্ষেত্রে যার প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা থাকবে, তাঁকে প্রশিক্ষককে জানাতে হবে। তিনি যদি সময় না দেন, তখন কী হবে, এটার উত্তর জানা যায় না। আমার ক্ষেত্রে সেটাই হলো। এর আগের সব চাকরিতে প্রশিক্ষকেরা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন, সময়ও দিয়েছেন। এ চাকরির সবকিছুই কেমন যেন সম্পূর্ণ অন্য রকম। বিভিন্ন ব্যাপার ছিল, যেগুলো প্রথম থেকেই বুঝতে সমস্যা হয়েছিল। আমার দায়িত্ব ছিল নিজে সর্বোচ্চটা দেওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষককে জানানো। যেটা নিয়মিত করলেও কোনো ফল পেলাম না! এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখতে হলো! আগের মতো স্কসিয়া ব্যাংকে যেমনটা জানিয়েছিল ওরা পিআরের কাগজপত্র জোগাড় করতে সাহায্য করে না, এরাও একই পথে হাঁটল। পার্থক্য এই যে ওরা তিন মাস পরে শর্ত সাপেক্ষে ওদের সিদ্ধান্ত জানাবে। আমার হাতে তখন এক দিনও সময় নষ্ট করার ছিল না ওয়ার্ক পারমিটের সময়স্বল্পতার কারণে। যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজন ছিল পিআর পেতে সাহায্য করবে—এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি।

তখনকার পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রশ্ন করে ফিরতাম, ‘আমি কি ভাগ্যপীড়িত, না পরিস্থিতির শিকার?’ তবে মেঘের পর রোদের ঝলমলে হাসির প্রত্যাশায় যেমন নাবিক অথই সাগরে জাহাজ ভাসিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলে, তেমনিভাবে শেষমেশ চেষ্টা করে যেতে হবে। কবে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে, সেদিকে না তাকিয়ে নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ! ক্রমশ...