কানাডার চাকরি বৃত্তান্ত-অন্তিম পর্ব
স্কসিয়া ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বেশ ভালো একটা বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র জোগাড় করতে না–পারা। আগের কনসেনট্রিকসে কাজ করার সুবাদে কল সেন্টারের চাকরির অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। কোনো কাজ শেখা হলে বা কোনো কাজের দক্ষতা কখনো বিফলে যায় না। কখনো না কখনো সেটার সুফল সামনে থেকে আপনাকে এগিয়ে নেবে অন্যদের চেয়ে।
ভালোভাবেই সেখানকার কাজ রপ্ত করে কাজ করে যাচ্ছিলাম। হয়তো ভাগ্যদেবীর অন্য ইচ্ছা ছিল। মোক্ষম সময়ে জানতে পারি, গত ছয় মাসের সব পরিশ্রম বৃথা হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সবকিছু ঠিক থাকলেও যে বিষয়টা হয়তো একটু ভিন্নভাবে হলে বা করলে পরবর্তী সময় আর হতাশার মুখ দেখতে হতো না, সেটা হচ্ছে চাকরি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর নিয়োগকারী কর্মকর্তাকে ইমিগ্রেশনের কাগজপত্রের বিষয়ে আরও খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করা। তাহলে হয়তো বিপদ হতো না। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে ইতিবাচক হওয়া যেমন জরুরি, ঠিক তেমনিভাবেই সঠিকভাবে কাজ করাটাও অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কখনো এটা ভেবে এগোনো উচিত না, যা আপনি ভাবছেন তা সঠিক; বরং এর বিপরীতমুখী ছবিটাও চোখের সামনে ভাসিয়ে নিতে হবে একবার।
এরপরের স্বল্পকালীন চাকরিতে কী হয়েছিল, তা আপনারা আগেই একাদশ পর্বে পড়েছেন। একইভাবে পরবর্তী কোম্পানিও কাগজপত্রের ব্যাপারে দ্বিচারিতা দেখিয়েছিল। পাশাপাশি ভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছিলাম। বর্ণবৈষম্যের শিকার কেন হয়েছিলাম, তার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হবে না। এটা অনেকের সঙ্গেই হয়ে থাকে! তবে এ ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের বিপক্ষে অভিযোগ করা উচিত ছিল। কিছু ক্ষেত্রে আমরা এতটাই খেই হারিয়ে ফেলি যে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা সম্ভব হয় না।
অভিবাসনসংক্রান্ত চাকরি জোগাড়ের ব্যাপারে আমি হন্যে হয়ে আবেদন করে যেতে লাগলাম।
সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হলাম বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতার। কোনো কোনো নিয়োগকারী কর্মকর্তা সরাসরি কাজ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করলেও ওয়ার্ক পারমিট বা পারমানেন্ট রেসিডেন্সি বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকল।
আবার কোথাও অনলাইনে ফুল টাইম চাকরির জন্য আবেদন করে সাক্ষাৎকারের দিন গিয়ে জানতে পারি, এটা খণ্ডকালীন চাকরি! অথচ ইন্টারভিউ শেষ করে ফিরে আসার সময়ও বাসে বসে যখন তাদের ওয়েবসাইটে দেখলাম, তখনো ওটা ফুল টাইম পজিশন দেখাচ্ছে!! এমনও হতে পারে, এটা জানা ছিল না।
আরেক কোম্পানিতে অনলাইনে ভিডিও ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি কারিগরি ত্রুটির কারণে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কর্মকর্তা আমার কথা শুনতেই পাচ্ছেন না! পরে আবার ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করল তাঁরা।
অন্য এক জায়গায় প্রথমে ফোনে ইন্টারভিউ হয়ে গেলে পরবর্তী ধাপের সাক্ষাৎকারের জন্য মেইল এল। ওখানে তাদের অফিসে সশরীর গিয়ে উপস্থিত হওয়ার কথা বলা ছিল। মূল সাক্ষাৎকারের দিন ঘটল বিপত্তি। সকাল থেকেই দেখি আমার কাছে ই-মেইলে ইন্টারভিউয়ের নির্দেশনাসংক্রান্ত কিছু মেইল এল। সেখানে বলা হয়েছে, ভিডিও ইন্টারভিউয়ের কথা! সবকিছু আবোলতাবোল ঠেকতে লাগল। পরে যিনি ফোনে ইন্টারভিউ নিয়েছেন, তাঁকে মেইল করলাম। ফিরতি মেইলে জানতে পারলাম, আমাকে অফিসেই যেতে হবে। যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে ইন্টারভিউ সম্পন্ন করে এলাম। তারা আগেই অন্য একটা মেইলে সাক্ষাৎকারের দিন কি বিষয়ে প্রশ্ন করবে, সেটার নমুনা আমাকে পাঠিয়েছিল। ওটা খুব ভালোভাবেই পড়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। বাসায় ফিরে অনেকটা নির্ভার হয়ে দুপুরের খাবার শেষ করব, এমন সময়ে একটা কল আসে। অপর প্রান্তের কর্মকর্তা নিজেকে ওই প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকারী কর্মকর্তাদের একজন পরিচয় দিয়ে জানালেন, আজকে সকালে আমি অফিসে গিয়ে যে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছি, সেটা ভুলবশত নেওয়া হয়েছিল। এমন ভুলের জন্য তাঁরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাকে আবার সাক্ষাৎকারের সম্ভাব্য দিনক্ষণ ঠিক করে নিতে বললেন। ফোনটা রেখে ভাবছিলাম, এটাও সম্ভব, তা–ও আবার এ দেশে!! অকূলপাথারে যখন কোনো নৌকা পথ হারিয়ে ফেলে, ঢেউয়ের স্রোতে এদিক-ওদিকে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ঢুলতে থাকে, নিজের অবস্থাও তেমন মনে হয়েছিল!
বিভিন্ন জায়গায় কাজের অন্বেষণ করে যেতে লাগলাম। পরিচিত ছেলেপেলেদেরও জানালাম। তারা কেউ কেউ নানান উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হলো। আর বাকিরা বিভিন্ন জব পোস্টের খুদে বার্তা পাঠাতে লাগল।
এমন দুরবস্থা হওয়ার কারণ নিজেও খুঁজে ফিরি। তবে নিজের অনুমান এই যে সিডনিতে শুরুতেই প্রথম পূর্ণাঙ্গকালীন যে চাকরিটা পেয়েছিলাম কনসেনট্রিকসে, ওটা ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। যদিও পরবর্তী সময় এর চেয়েও অনেক ভালো জায়গায় কাজ পেয়েছিলাম। কনসেনট্রিকসের একটা বিশেষ সুবিধে হচ্ছে—তারা কর্মী সচেতন আর একই সঙ্গে তাদের প্রতি সব সময় যত্নশীল। এটা অন্যান্য জায়গায় দেখলেও সিডনির কনসেনট্রিকসের কোনো তুলনাই হয় না! অন্য সব কোম্পানি বা চাকরির চেয়ে তারা সঠিক কর্মী বাছাইয়ে আর একই সঙ্গে তাদের সব রকম সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিতে সব সময় প্রস্তুত।
এমন যদি পরবর্তী সময় অন্তত কোনো একটা কাজের জায়গা পেতাম, তাহলে এমন দুর্দিন দেখতে হতো না।
কখনো যদি ঠাহর করতে পারেন, ম্যানেজার বা বস আপনার ছোটখাটো সব ব্যাপারেই খোঁজ বা যত্ন নিচ্ছেন, তাহলে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হয়ে ওই জায়গায় টিকে থাকার চেষ্টা করুন দীর্ঘদিন। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, কাজের প্রতি একাগ্রতা—এসব বিষয়েই ভর করে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। আর একই সঙ্গে ইমিগ্রেশনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। যদি যেকোনো কোম্পানি কর্মীদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে যত্নশীল হয়, তাহলে অবশ্যই আপনার যেকোনো জটিল বিষয়ে পাশে দাঁড়াবে। সেটা হতে পারে অভিবাসনপ্রক্রিয়া বা চিকিৎসাসংক্রান্ত বা দেশে পরিবারের কারও প্রয়োজনের ব্যাপারে! আপনি প্রত্যাশা করুন বা না করুন, তারা আপনার জন্য করবে। তবে প্রত্যাশার পারদে না চেপে যতটা সম্ভব বাস্তবতার নিরিখে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে এগিয়ে যেতে হবে! কথায় বলে, স্রষ্টা তাঁকেই সহায়তা করেন, যিনি নিজেকে সাহায্য করেন।
সিডনির ছেলেদের দলের প্রথম থেকেই পরিচিত থাকা সুমনের একটা জব পোস্টের খুদে বার্তা আবারও কাজে এল। সিডনি ছেড়ে যখন টিডি ইনস্যুরেন্সের চাকরি নিয়ে হ্যালিফ্যাক্সে আসি, তখন ও-ই দুই হাতে সবকিছু সামাল দিয়েছিল। শুধু এ কারণেই নয়, শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আরও অনেক কারণেই ওর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। সে অনেকগুলো কাজের পোস্টিং আমাকে পাঠিয়েছিল। বেশ কয়েকটা জায়গায় ইন্টারভিউ দেওয়ার পর একটা পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ হলো। অন্যান্য চাকরিতেও সুযোগ হয়েছিল, কিন্তু পারমানেন্ট রেসিডেন্সি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কর্মকর্তা ক্যাথির ছিল। তিনি নিজে থেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই স্থায়ী অভিবাসনের জন্য আবেদনপ্রার্থী। আমরা তোমাকে অস্থায়ী সময়কাল পার হওয়ার পর সে সুযোগ করে দিতে আগ্রহী। তবে এ ক্ষেত্রে তোমার প্রথম তিন মাসের অস্থায়ী সময়কালের কাজের মাপকাঠি বিচার্য হবে।’
আমার বাসা থেকে কাজে যাওয়ার দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। কাজ রাতের সময়ে—রাত ১০টা ৪৫ থেকে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট। মূলত রাতের সময়ে কাজ করবে—এমন কর্মীর প্রয়োজন ছিল। তারা সারা দিন এবং রাত কাজ করে এমন কোম্পানি। ফল রিভার মোটামুটি মূল হ্যালিফ্যাক্সের চাকচিক্যের বাইরের বেশ সাদামাটা একটা জায়গা, এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। ওখানে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মারফত জানতে পারি কিছুদিন আগেই একজনের পিআর চলে আসায় ও বেড়াতে যাচ্ছে ভারতে আর অন্যদেরও স্থায়ী অভিবাসনের প্রক্রিয়া চলমান। তাঁরা বললেন, কাজ করে যেতে। আর তিন মাসের মধ্যে একটা হল্লে হয়ে যাবে। তাঁদেরও এভাবেই হয়েছিল।
ধৈর্য রেখে সৃষ্টিকর্তার ‘ফল ত্যাগপূর্বক কাজ করে যাওয়ার ব্রত নিয়ে’ একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম নতুন দিনের আলোর খোঁজে। পেট্রোলিয়াম কোম্পানির মাধ্যমে পিআর অ্যাপ্লিকেশনপ্রক্রিয়া চলমান রয়েছে আমার। সমসাময়িক বন্ধু বা সহকর্মীরা অনেক আগেই স্থায়ী নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন।
আমার বিলম্বের কারণ ও সমাধান অনুসন্ধানেই এ দীর্ঘ লেখা রচিত। বর্তমান চাকরির বিগত ১৭ মাসের কথা বলার জন্য হয়তো অন্য কোনো সময় আবারও কলম ধরব। তত দিন পর্যন্ত সবাই নিজ কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করুন। আর প্রবাসে পাড়ি জমাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করবেন। পৃথিবীর যে তল্লাটেই যান না কেন পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই! ...সমাপ্ত