কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত—দ্বাদশ পর্ব

আর্ট গ্যালারি-কানাডায় প্রথম চাকরি
ছবি: লেখক

একাদশ পর্বের ধারাবাহিকতায়...

চাকরিবৃত্তান্তের পুরো গল্প সমাপ্তি করার সময় এখনো আসেনি। আপাতত অসমাপ্তই রয়েছে। তবে কবে নাগাদ এর ইতি টানতে পারব, তা বিধাতা বলে দেবেন। এর পরে আমি আরও কয়েকটা জায়গায় ব্যর্থ হওয়ার পর সবশেষে একটা পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে চাকরি পাই, যারা পিআর (পার্মান্যান্ট রেসিডেন্সি) পেতে আমাকে সহায়তা করেছে। এখন আমরা চাকরিবৃত্তান্তের কোন বিষয়গুলো একটু ভিন্নভাবে হলে হয়তো আজকে এ অবস্থায় পড়তে হতো না, সে ব্যাপারগুলো দেখব।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে শুরু করে চাকরির জন্য যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল, তা কখনো পিছু ছাড়েনি! আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও জটিল। কারণ, ইউনিভার্সিটির বাইরে কাজ করার অনুমতি ছিল না! কেন এমনটা হয়েছিল, তা আমার জানা নেই, পুরোটাই বর্ডার অফিসার বলতে পারবেন, যিনি প্রবেশের সময় আমাকে টরন্টোর জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে স্টাডি পারমিট ইস্যু করেছিলেন। তবে ওই সময় আমার প্রশ্ন করার পূর্ণ অধিকার ছিল। কিন্তু আমি এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না মোটেও। আর আমার সঙ্গে থাকা আরও দুই ছেলের কাগজপত্রে হয়তো কোনো সমস্যা ছিল, ওদের ওখানেই আটকে রেখেছিলেন বর্ডার অফিসাররা। ওরা আরও কাগজপত্র চাইছিলেন, ওদের এটাও বলতে শুনেছিলাম যে নিজেদের ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে। অন্যথায় ফিরে যেতে হবে এখান থেকেই! এসব দেখে অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আর এটাও জানতাম না আমার স্টাডি পারমিটের নিচে শর্তে কিছু লেখা রয়েছে। বিষয়টা আমার দৃষ্টিতে আসে যখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আসলেও জানা ছিল না কী করতে হবে বা আদৌ এমন কোনো শর্ত আরোপিত হতে পারে!

ওয়ালমার্টে জন্মদিনের দিন
ছবি: লেখক

সবার স্টাডি পারমিট থাকে একটা আর আমার হয়েছিল তিনটা। এ তো গেল প্রবেশপথের ঝঞ্ঝাটের কথা। মূলত এখানে ঢোকার পর থেকে চাকরির ভূত আমার ঘাড়ে চেপে বসে! স্টাডি পারমিটের ঝামেলা কাটিয়ে যখন কাজ করার অনুমতি পেলাম প্রথম চাকরিতেও খেলাম বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা। কেপ ব্রেটন ইউনিভার্সিটির আর্ট গ্যালারিতে চাকরির দ্বিতীয় দিনের মধ্যেই জানতে পারি চাকরিটা থাকছে না! এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, আমার ইন্টারভিউ যাঁরা নিয়েছিলেন প্রথমত তাঁদের গাফিলতির শিকার হয়েছিলাম আমি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় খানিকটা নিজের ভুলও। চাকরির পোস্টের সব খুঁটিনাটি ভালো করে আদ্যোপান্ত পড়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল আর যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, সেটা অবশ্যই সাক্ষাৎকারের দিন জিজ্ঞেস করে নিলে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়টা এড়ানো যেত সহজে! এ গেল প্রথম চাকরির কথা।

ওয়ালমার্টের চাকরিতে তেমন কিছু বলার না থাকলেও মূল সমস্যার সূত্রপাত যখন নতুন স্টোর ম্যানেজার কেটির সঙ্গে কাজের শিডিউল নিয়ে ঝামেলা হলো। দুর্ভাগ্যবশত প্রায় আড়াই বছর চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত সেটা বহাল ছিল। কীভাবে বুঝলাম? যখন দেখলাম আমি বিদায় নেওয়ার কয়েক দিন পর্যন্ত ওর কোনো হদিস নেই! এ ক্ষেত্রে অবশ্য নিজের খুব একটা দোষ আছে বলে মনে করি না। যেহেতু কেটি নতুন এসেছিল, তাই ওর সঙ্গে সামনাসামনি কথা না বললে কেন ও আমার শিডিউল বাতিল করেছিল, সেটা বোঝা মুশকিল ছিল! কিন্তু মুখোমুখি কথা বলাটাই হয়তো কাল হয়েছিল। খুব সম্ভবত ওর ব্যক্তিত্বে ঘা লেগেছিল, এটাই যে কেন আমি সরাসরি ওকে শিডিউল বাতিল নিয়ে প্রশ্ন করতে গেলাম? অন্য কোনো উপায় ছিল না বলেই এমনটা করতে হয়েছিল। তখন পর্যন্ত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ওই স্টোরে কাজ করলেও কখনো আমার শিডিউল কোনো ম্যানেজার বাতিল করেনি। আর স্টোর ম্যানেজারের তো আমার শিডিউল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার প্রশ্নই আসে না, মূলত এর দায়িত্ব থাকে ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজারের কাছে। এখনো জানি না কী প্রয়োজনে ও আমার শিডিউল বাতিল করেছিল বা এর প্রয়োজনই–বা কী ছিল? যদি কিছু করার প্রয়োজন হতো এর জন্য আমার ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজারের হস্তক্ষেপ করার কথা। একজন অপরিচিত কর্মীর শিডিউল বিনা কারণে বাতিল করে ওর কি আনন্দ বা কৃতিত্ব অর্জন করার ছিল, তা সত্যিই রহস্যজনক! তবে এসব কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না। যখন আমি সিডনি ছেড়ে হ্যালিফ্যাক্সে আসার পরিকল্পনা করি, তখন কেটির কারণে তা আটকে যায়। শুধু তা-ই নয়, আমি নিজ উদ্যোগে হ্যালিফ্যাক্সে গিয়ে ওখানকার ম্যানেজারদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলি বদলির ব্যাপারে, যত দূর প্রথম সাক্ষাতে মনে হয়েছিল ওদের কোনো সমস্যাও ছিল না। যে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম ও ইচ্ছুক ছিল। এতেও ক্ষান্ত হননি ওই মহিলা। পরে কানাডীয় সরকারের অল্প সময়ে অভিবাসনপ্রক্রিয়ার সুযোগের অংশ হিসেবে দেওয়া টি আর টু পি আর এ আবেদনের জন্য কাগজপত্র জোগাড় করতে গেলেও কেটি সাইন করে স্ক্যান না করে কাগজটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। এমনভাবে ছবিটা তুলেছিল যেটা বেশ ঝাপসা আর দেখেই বোঝা যায় কাজটা পরিকল্পিতভাবে করা!

টরন্টো এয়ারপোর্টে প্রবেশের সময়
ছবি: লেখক

যা-ই হোক ওই মহিলা এখনো বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন একই জায়গায়।
ওয়ালমার্টের দায়িত্বে থাকাকালে অবহেলাজনিত কোনো কাজ করেছি এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না। মোদ্দাকথা, ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হলে সেটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু না! তবে এ ক্ষেত্রে যদি আমি স্টোর পরিবর্তন করে অন্য কোনো স্টোরে আগেই বদলি হয়ে যেতাম তাহলে হয়তো পরে কেটির কারণে তৈরি হওয়া উটকো ঝামেলায় আর জড়াতে হতো না। আর নর্থ সিডনির দূরত্বও আমার বাসা থেকে ছিল অনেক দূরপথে। মূলত ওই স্টোরের সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা ভেবে আমি অমন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে সরে আসি। কর্মক্ষেত্রে আবেগের বশে কখনো কোনো চিন্তা করা চলে না। সব সময় নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বা অনাগত সময়ের দিকে তাকিয়ে অনেক জেনে-বুঝে কোনো প্রকারের আবেগের বশীভূত না হয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তের মীমাংসা করুন। কেটির পরবর্তী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে যদি আগেই ঠাহর করতে পারতাম, তাহলে হয়তো বদলি না হওয়ার ভুল করতাম না।

আরও পড়ুন

এরপরের স্বল্পকালীন চাকরির অভিজ্ঞতার কথায় আসি। প্রথমেই সিডনিতে রেস্টুরেন্টের চাকরির কথা বলি—অনেকটাই আশপাশের ছেলেপেলেদের প্রবল উৎসাহে এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে কনসেনট্রিকসের চাকরির পর যোগ দিই ওখানে। তবে এক দমবন্ধ হওয়া পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে এক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারি এখানে এক বছর কাজ করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারব না! বেশ ছোট্ট আকারের একটা জায়গায় গাদাগাদি করে সবাই কাজ করছে, এর ওপর টিফিন বা খাবার খাওয়ার ঠিকঠাক জায়গা নেই। নোংরা ওয়াশরুম। কিন্তু যারা ওখানে কাজ করছে তাদের মধ্যে উৎসাহের কমতি ছিল না মোটেও। সবাই আমাকে ভীষণভাবে সহায়তা করেছিল। প্রথমবার আমাকে দেখে আলিঙ্গন করে রীতিমতো উষ্ণ অভিবাদন জানানো থেকে শুরু করে বিদায়বেলাও একই রকম উষ্ণতা দেখিয়েছিল। ম্যানেজার থেকে শুরু করে কর্মী ভাইয়েরা। কিন্তু রান্নাঘরের ওই বদ্ধ জায়গা, দম আটকে আসা পরিবেশ (এটা একান্তই নিজের দৃষ্টিতে), রেস্টুরেন্টের কাজের অনভিজ্ঞতার চাপ—সবকিছুর বোঝা কাঁধে চাপিয়ে গিয়েছিলাম কাজ করতে। তাই হয়তো শেষমেশ নিজে মানসিকভাবে আর পেরে ওঠা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে একটা কথা বিশেষভাবে বলতে হয়—এখানে আসার পর থেকে সব চাকরির প্রতি আগ্রহ থাকলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে রেস্টুরেন্ট বা ফাস্ট ফুড চেইনের জবগুলোর প্রতি অনীহা ছিল চরম। কারণ, আমার রেজিউমের সবচেয়ে বেশি জমা দেওয়া হয়েছিল এসব জায়গায়, ইন্টারভিউও দিয়েছি বেশ কবার। কখনো বলেও দেওয়া হয়েছে চাকরি হয়ে যাবে। পরে হয়নি। কেন? উত্তর কারও জানা নেই। মাঝেসাঝে আমার এটা মনে হয় যিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনিও জানেন না কেন আমাকে বাদ দিয়েছেন! জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি! কয়েক দফা পেছনে লেগে থাকার পরও কোনো লাভ হয়নি। মাসের পর মাস এভাবে কোনো রকম সুরাহা হওয়া ছাড়াই কেটেছে। পরে এসব ব্যাপারের কারণে আমি আর ওমুখো হইনি। আবেদনও করিনি। তবে বি ক্যাটাগরির কথা ভেবে প্রথম থেকেই এদিকে ভাবা উচিত ছিল। ইমিগ্রেশনের বিষয় নিয়ে সব রকম ধারণা থাকলেও এটা জানতাম না যে বাকি চাকরি নিয়ে স্থায়ী অভিবাসন প্রক্রিয়ায় ঝামেলা এত বেশি! পরে যখন সুযোগ এল তখন সবকিছু মিলিয়ে আমি বেহাল!

হ্যালিফ্যাক্স পোর্ট
ছবি: লেখক

সিডনি থেকে হ্যালিফ্যাক্সে আসি টিডির চাকরির সুবাদে। এখানেও বিধি বাম! পূর্বশর্ত অনুযায়ী লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায় কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে চাকরি হারাই। এ ক্ষেত্রে যদি আগে থেকে এ সম্পর্কে আমার পূর্বধারণা বা পড়াশোনা জানা থাকত, তাহলে হয়তো পরীক্ষায়  উতরে যাওয়াটা সহজ হতো। যাদের পড়াশোনায় সময় বেশি লাগে বা বিষয় বোধগম্য হতে কিছুটা ধীরগতির, তাদের জন্য ওই লাইসেন্স পরীক্ষার সময়সীমাটা আসলে দুই সপ্তাহ যথেষ্ট নয়। অন্তত আমার জন্য ওই সময় কম মনে হয়েছে।

এরপরের স্কসিয়া ব্যাংকের চাকরিকে স্বল্পকালীন বলা যায় না। সবকিছুই ভালোই চলছিল, এ ক্ষেত্রে বাগড়া বাধাল ইমিগ্রেশন–সংক্রান্ত নিয়মাবলির কাগজপত্র! ক্রমশ...

আরও পড়ুন