কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত: নবম পর্ব

ব্যস্ত সময়ে একটু স্বস্তি
ছবি: সংগৃহীত

অষ্টম পর্বের ধারাবাহিকতায়...
কেটি আমার সদ্য বদলি হওয়া ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) মার্ককে বলল আমার সঙ্গে যেন কথা বলে। এর আগের ব্যবস্থাপক গাসি যতটা সাহায্য করত, মার্ক ঠিক এর উল্টো! বেশ রুক্ষভাবেই এসে আমাকে বলল, ‘টানা কত দিন হলো তুমি কাজ করছ? শেষ ছুটি কবে ছিল?’

বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে উত্তর দিলাম, ‘আমাদের তো প্রতিদিন কাজে আসতে বলা হয়েছে। তাই আসছি, শেষ ছুটি পেয়েছি গত বুধবারে!’

আমার অতিমারীকালীন সময়ে কাজের বিনিময়ে পাওয়া টাকাতেও এভাবে ভাগ বসাল ও! ক্ষমতাসীন মানুষ যখন কারও উপকারের চাইতে অপকার করাতেই  বেশি আগ্রহী (আগ্রাসী), মনোযোগী হয়, তখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়! এসব ছাড়াও ছোটখাটো আরও অনেক বিস্তর ঘটনা রয়েছে যেগুলো নিয়ে আরেকটা বৃত্তান্ত লেখা যায় নিমিষেই।

এবার সিডনি–পরবর্তী পর্বে চলে আসি। সিডনির ওয়ালমার্ট থেকে হ্যালিফ্যাক্সে বদলি হয়ে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দম আটকে ওখানেই কাজ করে যেতে লাগলাম।

তখন আশ্চর্যজনক হলেও কোনো চাকরি থেকেই কল পাচ্ছিলাম না। আমি চাকরি সহায়তায় সরকারি সংস্থা ‘নোভা স্কসিয়া ওয়ার্কসে’ যোগাযোগ করলাম। কয়েক সপ্তাহ ওদের সঙ্গে দেখা করে, কয়েকজন কর্মকর্তাদের সরাসরি কথা বলে যা বুঝলাম, এরা কথায় সাহায্যকারী, কাজের কাজ কিছুই করবে না! ধারণা সত্যি হলো। কয়েক সপ্তাহ পর পর আমার কাছে জানতে চাইত কতদূর এগুলো, আমি কোনো চাকরি পেয়েছি কি না, আর মাঝেমধ্যে কয়েকটা জব পোস্টিং পাঠিয়ে দিয়েই কাজ সারত ওই নারী কর্মকর্তা। তারপরও কাজের আশায় চেষ্টা করে যাওয়া আমি যোগাযোগ বন্ধ করিনি!
তখন আমার প্রতিবেশী ছেলেপেলেদের মারফতে রেস্তোরাঁয় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেলাম। এখানকার বাঙালি ছেলেদের অনেকেই কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার হয়ে কাজ করছে। আশা করি প্রথমদিককার পর্বগুলোর সুবাদে জেনে গেছেন রেস্তোরাঁর প্রতি অনিহা আর চাকরির ধরন। কিন্তু রাঁধুনি বা সেফ যা-ই বলুন, বি ক্যাটাগরি আর সোজা কথায় ইমিগ্রেশনের প্রসেসিংয়ের সময়  মাত্র পাঁচ-ছয় মাস। ব্যাস! কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা আপনি। তৃতীয় পর্বে আপনাদের বলেছিলাম রেফারেন্স ছাড়া ফাস্টফুড বা রেস্তোরাঁয় চাকরি হয় না। আশা করি আমার কথার প্রতিফলন দেখছেন। আসল কথায় আসি, সবাই এসব বলেই বুঝিয়ে–সুজিয়ে আমাকে পাঠাল কাজ করতে আর আমার এক দিনের কাজের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছিল ওখানে মোটামুটি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব! জানি না ওরা কীভাবে এ বদ্ধ জায়গায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নিজের সবটা উজাড় করে দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ওদের সবাইকে আমার করজোড়ে নমস্কার! ওয়ালমার্টেও চাকরির শেষের দিনগুলোতে ঠিক এমনটাই মনে হতো। নিজেকে এ কাজের জন্য আগেও কখনো উপযুক্ত মনে হয়নি আর সশরীরে কোমর বেঁধে খেলার মাঠে নেমেও একই ফল হয়েছিল। রেস্টুরেন্টের অভিজ্ঞতায় এই উপসংহারে এলাম, কিছু কাজ সবার জন্য না, চেষ্টা করা যেতে পারে।

টি ডি পরীক্ষার প্রস্তুতি
ছবি: লেখক

তবে  যে যুদ্ধের ফলাফল আগেই জানা আছে, প্রয়োজনে সে যুদ্ধে যেতে হয়, যাওয়া উচিত। নিজের সত্তাকে আরও গভীরভাবে জানতে যদি গভীর সাগরেও ডুব দিতে হয়, তা-ও দাও!

প্রায় মাস চারেক পর কিছু জায়গা থেকে জবাব পেতে শুরু করলাম। কিন্তু অধিকাংশই রিজেক্ট হয়ে যেতে লাগল! কাজেই বলতে গেলে ২০২০ সালে অর্ধেক অতিমারীর বিষবাষ্পে আর বাকি সময়টা চাকরির দরখাস্ত বাতিলের ঠেলায় কেটে গেল। একুশের জানুয়ারিতে সিআইবিসি ব্যাংকের চাকরি বাতিল হওয়ার পর ইমেইল পাই টি ডি ইনস্যুরেন্সের কাছ থেকে। এ ক্ষেত্রে বলা দরকার কেন সিআইবিসির চাকরি থেকে বাদ পড়লাম? কানাডার ব্যাংকগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানে থাকা ব্যাংকের জব ইন্টারভিউ কল পেয়ে মোটামুটি বেশ ভালো মনেই তার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো যিনি ইন্টারভিউ নেবেন, তিনি আমাকে জানালেন যে স্রেফ আমার পরিচিতি পর্বটা সারতে চান! আমি ঠিকই ফোন ইন্টারভিউ দিলাম আর যিনি প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করলেন তার কথাবার্তায়ও কোনো অসংলগ্নতা লক্ষ করিনি! তবে ফলাফল ছিল উল্টো। আর কোনো সাড়াই পেলাম না। টি ডির ইন্টারভিউ ছিল ভিডিও ইন্টারভিউ। ওদের ওয়েবসাইট ঘেঁটে যতটা পারলাম জেনে নিলাম, নোট করলাম, যে পজিশনে এপ্লাই করেছিলাম ওটার সম্পর্কেও বিস্তারিত পড়ে নিলাম। এর সঙ্গে আগের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নাবলিতেও চোখ বুলিয়ে নিলাম।

ম্যাকডোনাল্ড ব্রিজ - হ্যালিফ্যাক্স
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন

নির্দিষ্ট সময়ে বসে পড়লাম ইন্টারভিউ দিতে—সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম ম্যাক্সিম টার্ডি। খুবই সহজ সরল প্রাঞ্জল স্বভাবের মানুষ। মিনিটখানেকের কথাবার্তায় মনেই হলো না কোনো বিশাল বড় প্রতিষ্ঠানের ডাকসাইটে কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছি!
কথোপকথনের চুম্বক অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি—

ম্যাক্সিম-তোমার পরিচয় দাও। কেন টি ডি–তে কাজ করতে ইচ্ছুক? তোমার পজিশনের কাজকর্মের একটা ধারণা দিতে পারো?
আমি নিজের পরিচয় দিয়ে টিডি সম্পর্কে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করলাম, যা ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত ছিল। নিজের ভাষায় ওকে বুঝিয়ে বলার পর চাকরির বিবরণী থেকে প্রতিদিনের কাজ সম্পর্কে বললাম।

ম্যাক্সিম ইনস্যুরেন্স এজেন্ট হিসেবে কেন কাজ করতে চাও?
তোমার আগের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কীভাবে বর্তমান কাজে সহায়তা করবে?
এরপর জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি অধ্যাপকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছ, কীভাবে তোমার চাকরি হলো আর কি কি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলে?

ওখানকার নানাবিধ সমস্যার সমাধান কীভাবে করেছ?

এমন কতগুলো দিকের কথা বলো যেগুলো তোমাকে বর্তমান পদে কাজের জন্য সহায়তা করবে?

এরপর ও নিজেই ওই পদ সম্পর্কে আমাকে পুরোপুরি একটা ধারণা দিল। বেতন, সুবিধা, নিয়মকানুন সবকিছুই জানাল।

আরও পড়ুন

এ জবের একটাই পূর্বশর্ত ছিল, সেটা হলো লাইসেন্স পরীক্ষায় পাস করতে হবে। কাজ শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। দুই সপ্তাহ ক্লাসের পর পরীক্ষা, ফেল করলে চাকরি থেকে বরখাস্ত।

সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না! কাজেই ঝুঁকি নেওয়াই শ্রেয়। উতরে না গেলে কি হবে, সেটা না ভেবে পার পেতেই হবে এ মনোভাব রেখেই পাড়ি জমালাম হ্যালিফ্যাক্সের পথে। এখানে এক শহর থেকে অন্য শহরে স্থানান্তর হতেও বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। কেন নেই? সেটা নিয়ে ‘ড্রাইভিংয়ের যত কেচ্ছা’ লিখেছি। পরবর্তী সময়ে সেটাও বলার ইচ্ছে আছে।

গাড়ি চালিয়ে এক শহর থেকে বাক্সপেটরা পেছনে গুছিয়ে অন্য শহরে চলে যাবেন। নিজেকেই সব করতে হবে। তখন সুমন এগিয়ে এল। আমরা সিডনিতে এক বাসায় থেকেছি বছরখানেক। মূলত ওর কারণেই আমি ছোট্ট  সুন্দর সাজানো সিডনি থেকে পাড়ি দিয়ে নোভা স্কসিয়ার প্রাণকেন্দ্রে নতুন প্রাণের স্পন্দনের খোঁজে বেরিয়ে পড়ার সাহস পেলাম।

করোনাকালীন সময়ের ওয়ালমার্ট
ছবি: লেখক

আরও অসংখ্য অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি তখন। ওয়ালমার্টের বোনাসের একটা ব্যাপার ছিল। ওটা সামাল দিয়ে জবে সঠিক সময়ে ইস্তফা দিয়ে নতুন ভাড়া বাসার টাকা মেটানোর পথে বাধা এসেছে অগণিত। সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে সমাধানের পথে এগিয়েছে। এসবেরও গল্প নিয়ে ফেরত আসতে হবে কোনো না কোনো সময়। তার আগপর্যন্ত হ্যালিফ্যাক্সেই ফেরত যাওয়া যাক।

নতুন শহরে এসে সবকিছু খাপ খাইয়ে নিতে না নিতেই অস্বাভাবিক পড়াশোনার চাপে পিষ্ট হতে লাগলাম। আর আমার পড়ার ধরনও সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ায় দিকবেদিকও ভুলে যাওয়ার জো হলো।

প্রায় দুই সপ্তাহ চোখের ঘুম বিদায় দিয়ে পড়াশোনা করা পরও পরীক্ষায় উতরে যেতে ব্যর্থ হলাম। কানাডায় আসার পর ইউনিভার্সিটিতে অসংখ্য পরীক্ষা দিয়েছি। কিছু ছোটখাটো ক্লাস টেস্টের পরীক্ষার কথা বাদ দিলে কোনো পরীক্ষায় খারাপ করিনি। মোটামুটি মানসিকভাবে বিধস্ত হয়ে পড়লাম! চাকরিও গেল, আপাত দেখতে থাকা পি আর এর স্বপ্নও ছত্রখান হলো।

এর অর্থ হলো আবার চাকরি খোঁজো, তাও এখানে এসে...অর্থের জোগানও বন্ধ হলো। ক্রমশ...