বীথি: পর্ব-১৫
বীথি,
আবার বসলাম তোর সঙ্গে কথা বলতে।
আজ ভোরে ছোটবেলার এক পারিবারিক শিক্ষক, আমাদের পরিবারেরও খুব আপনজন নুরু স্যারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। স্যার কিছুক্ষণ কথা বলেই বললেন, ‘আরও লেখো লুনা, আমি তোমার লেখা পড়ি।’
স্যারকে বললাম, ‘নিজের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই লিখব স্যার, নিজের তাগিদেই লিখব। আপনি যে সময় করে পড়েন, সেটা জেনে ভীষণ ভালো লাগছে।’
কথাটা কিন্তু তা–ই, জানিস বীথি। অনেকেই হয়তো মনে করে, কেন লিখি?
যদি বলি, আপনি চাকরি করেন কেন? আপনি আড্ডা মারেন কেন? বিশেষ করে মেলামেশা করেন কেন? কারণ, আপনি বাঁচতে চান, তাই না? আমিও লিখি; কারণ, আমি বাঁচতে চাই, আমার একটা জানালা দরকার, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি আকাশ দেখি, নিজেকে দেখি, নিজেকে প্রকাশ করি, তাই আমি লিখি। না লিখলে হাত ব্যথা করে, তাই লিখি।
খুব অতীত মনে পড়ে রে বীথি, বিপদের সময় বেশি করে অতীত মনে পড়ে। ভাবি, কী হতে পারত? ভাবি, অন্য রকম কিছু কি হতে পারত জীবনে? এমন সময়গুলোতে বাবার কথা খুব মনে পড়ে বীথি। বাবার কথা মনে পড়ে; কারণ, বাবা সংসারের প্রধান ছিলেন, দায়িত্ব বাবার ঘাড়ে।
আমার জীবনের দায়িত্বও আমার ঘাড়ে, সঙ্গে আমার ছেলের দায়িত্ব। এই জীবন আমি নিজে বেছে নিয়েছি। এখানে কারও কোনো দায় নেই, এই দায়িত্ব সময়–সময় ভীষণ দায় মনে হয় বীথি।
চারপাশে যে মেয়েদের দেখি, যারা আমার মেয়েবন্ধু, তাদের দায় বা দায়িত্ব কি তাদের স্বামীরা নিয়েছে? জানি না বীথি, এ প্রসঙ্গে আর কথা নয়।
বরং কয়েক দিন হলো এই বিপদে বাবার কথা কেন মনে পড়ছে, সেটা বলে একটু হালকা লাগে কি না দেখি, কেমন? আমার বাবাকে তোর মনে পড়ে? শুধু অফিসে যেতেন আর বাসায় ফিরে খাতাপত্র নিয়ে বসে থাকতেন। আর মা তাকিয়ে থাকতেন সারা মাসের বেতনের দিকে, এইটুকু মনে পড়ে, আর ছুটির দিনে বাবা নিজের কাপড় নিজে ধুতেন।
আমরা চার বোন থাকার কারণেই মা আমাদের তেমন বিশেষ দিয়ে–থুয়ে বড় করেননি। যেমন ধর, বড় করে কোনো জন্মদিন আমাদের হতো না, আমরা বছরে এক-দুবারের বেশি কাপড় পেতাম না।
আবার হুট করে কোনো ভালো খাবার আমরা খেতাম না, অন্যদিকে বাবার সঙ্গে দূরত্ব থাকার কারণে এবং মাকে ভয় পাওয়ার কারনে বাবা–মায়ের সঙ্গে যে ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি আপন হয়, সেটা জেনেছি অনেক অনেক পরে। কিন্তু আমাদের মন কি আম্মা দমিয়ে রাখতে পারতেন?
আমাদের আশপাশে সব সময় আমাদের চেয়ে বেশি সচ্ছল পরিবার বাস করত। এই যেমন তুই বীথি, তোর বাবা সেই সময়, মানে ১৯৮২–৮৩ সালেই আইএলওতে কাজ করতেন, চাচা জেনেভা যেতেন প্রায় প্রতি মাসে, তোর জন্য কী না আনতেন বল? কিন্তু আমার বাবা ঠিক সেই সময় খুব জোর যেতেন নেপাল বা ভারত, আর বাবা বিদেশে যাওয়া মানেই আমাদের হায়েস্ট পাওয়া হচ্ছে সেই প্লেনে দেওয়া ছোট এক টুকরা সাবান বা একটা হালকা পটকা ব্রাশ। তবু ওই জিনিস হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হতো, আহ্, আকাশে উড়লে এ রকম আর কী কী দেয়?
এখন, আজকে এই ৪৫ বছর বয়সে বুঝতে পারি, আমাদের গোটা গ্রামে, গোটা জেনারেশনে বাবা একমাত্র শিক্ষিত সরকারি কর্মচারী, প্রথম মানুষ ঢাকায়, এর চেয়ে আর কত দূর যাবেন বাবা?
মানুষের যে সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা থাকে, মানুষের যে নিজেকে বিকাশ করারও একটা লিমিট থাকে এবং সেটাও যে মানুষ এক জীবনেই বুঝে যায়। কিন্তু সে কথা বলতে পারে না নিজের বউ–বাচ্চা–ভাই–বোন, নিজের বাবা–মাকে এবং অনেক সময় আমরা পরিবারের অংশ হয়েই বুঝতে পারি না সেই মানুষকে।
আর যখন বুঝতে পারি, তখন হায়, আর পেছন ফেরা যায় না, বীথি!
তুই কি জানিস, আমার বাবা এ লেখা পড়বেন না বা যদি বাবা পড়েনও, তাহলে এত কাঁদবেন যে মা আড়াল করে রাখবে আমার আজকের লেখা। বাবা বেঁচে আছেন বীথি, যেমন আমার ছেলে বেঁচে আছে।
একমাত্র ছেলেকে বোঝাতে পারছি না। আমার বেতনের একটা লিমিট আছে, আমার যোগ্যতারও লিমিট আছে, আমি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই যোগ্যতার মাপকাঠি তৈরি হয়েছে। নিজে খুব ভালো জানি, যা যা করছি এই জীবনে, তা–ই আমার জন্য এক জীবনে অনেক বেশি, এর চেয়ে বেশি দূরে যাওয়ার যোগ্যতা আমি তৈরি করতে পারিনি।
গত চিঠিতে লিখেছিলাম আমার বিপদের কথা, বীথি। গাড়ির ইনস্যুরেন্স অনেক হাই হয়ে গেছে, এ মুহূর্তেই একটা খণ্ডকালীন চাকরি বা বাসা বদলে বেজমেন্টে চলে গেলে আমার জন্য খুব ভালো হয়, কিন্তু ছেলেটার মনটা ছোট হবে। নাইয়া বলছে, ‘মা, আমার এই ঘর অনেক ভালোবাসি, আমি বেজমেন্টে যেতে চাই না।’ আমি এটাও বুঝি, জীবনের বাস্তবতা এখনই নাইয়ার বোঝার কথা নয়, জীবন আর কতটুকু বল? নাইয়া আছে আমার সঙ্গে আর মাত্র ৬–৭ বছর, তারপর বাকি জীবন হয়তো কষ্ট করার বা বোঝা বওয়ার সময় পাব, কিন্তু আজকে ছেলের আনন্দের সময় বয়ে গেলে আর সময়টা ফিরে পাব না, বীথি।
আমার বাবার কিন্তু এইটুকু চিন্তা করার অবকাশও ছিল না। বিদেশে না থাকলে আমিও এটা ভাবতে পারতাম না। মনে আছে তোর? বড়পার বিয়েতে বাবাকে লোন করতে হয়েছিল অনেক টাকা, তাই দেখে আমি আর কনা, খুব অল্পে আমাদের বিয়ে সেরেছিলাম, ভালো করেছিলাম কাজটা। কারণ, আমার বাবা–মা আমাদের অহেতুক আদর না করে আমাদের জীবনের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন অনেক অনেক আগেই।
সময়ের অনেক আগেই বাস্তব বুঝতে হয়েছিল আমাদের চার বোনকে। সেই সুবিধাও ভোগ করছি এই জীবনে, কিন্তু বেশি দায়িত্ব নেওয়ার কিছু অসুবিধাও আছে। সেই অসুবিধার নাম হলো ‘বিবেক’।
মানুষ যখন নিজের কাছে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চায়, তখন তার অপশন ক্রমেই কমে আসতে থাকে। তা–ই দেখেছি বাবাকে, বাবা আস্তে আস্তে চোখের সামনেই নির্মোহ হয়ে গিয়েছিলেন, কোনো কিছুতেই ভালো–মন্দ বলতেন না, কেমন একা হতে হতে শুধুই কাজকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। আমি কি আস্তে আস্তে সেদিকে যাব, বীথি?
দোয়া করিস বীথি, যেন সাহস আর বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলি। জীবনকে যেন বারবার চ্যালেঞ্জ করার সাহস থাকে। আদর।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]