বীথি: পর্ব-১৪

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বীথি

১২ ফুট বাই ৮ ফুটের একটা ঘর হবে হয়তো।

তিন কোনায় তিনটা ফোল্ডিং টেবিল বসানো এবং সেখানে কাজ চলছে। একেকটা টেবিলে তিনজন করে দাঁড়ানো। একজন ভাঁজ করছে, অন্যজন পলিপ্যাকে প্যাক করছে, আরেকজন প্রেস মেশিন দিয়ে প্যাকের মুখ মেরে দিচ্ছে। সকাল নয়টা থেকে কাজ শুরু করে শেষ করলাম সন্ধ্যা সাতটায়।

না বীথি, এটা আমার ছোট বোনের আয়োজনে সাদাকালোর মা দিবসের অনুষ্ঠান না। এখানে কেউ ভাঁজভাঙা দেশি শাড়ি পরে কবিতা শুনতে আসেনি। এটা টরন্টো শহরের রোববার সকালের এক ফ্যাক্টরির চিত্র। স্বাভাবিকভাবেই আজ মা দিবস, সবাই জানে সে কথা।

এ শহরের অনেক পরিবারে আজ মায়েদের নাশতা খাওয়াবে সন্তানেরা। ঘুম থেকে উঠেই বলবে, হ্যাপি মাদারস ডে। আমার একমাত্র সন্তানও গত রাতেই আমাকে বলেছে, আম্মু, আমি তোমাকে সকালে নাশতা দেব। তাই বিছানায় শুয়ে থেকেই যখন দিবার ফোন পেলাম, তখন দিবাকে ‘না’ করেছিলাম। বলেছিলাম, নারে, আজকে না। দেখি, ভেবে দেখি।

আরও পড়ুন

কিন্তু বীথি, ভাবনা আমাকে মাত্র ২০ মিনিট স্থির রাখেনি, নাইয়াকে বিছানায় রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, হোক না মা দিবস, তবু বাড়তি একটা কাজের সুযোগ, কিছু বাড়তি আয়, এই টানাটনানির সংসারে, দেখি না কী কাজ।

আমার দুর্বার মন আর সামারের লম্বা দিন আমাকে শান্ত এই শহরে আজ এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করিয়ে দিল। আমি বিশ্বাস করলাম, বাংলাদেশে রানা প্লাজায় যেসব শ্রমিক নিহত হয়েছেন বা যারা ওই সব শ্রমিকের অমানবিক কষ্টের টাকার ওপরে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভাগ্য করেছে, তারা শুধু খুনি নয়, তারা হচ্ছে মানুষরূপী জানোয়ার। জানিস বীথি, আজকে এই শহরে, বিদেশে অড জব বলতে যা বোঝায়, তা করলাম। ঘণ্টায় সাড়ে দশ ডলার করে ক্যাশ দেবে শুনে আজ সারা দিন বিভিন্ন শিফটে মোট পাঁচজন বাঙালিকে কাজ দিলাম আমি আর দিবা।

আমরা সবাই, নিজেদের বাচ্চা, মা দিবস, ছুটির দিন উপেক্ষা করে কাজে এসেছি মাত্র দুটি বাড়তি ডলারের আশায়।

এই আমাদের বিদেশজীবন, বীথি।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তোকে কোনো কষ্ট থেকে লিখতে বসিনি, কিন্তু যতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করছিলাম, ততক্ষণ ভাবছিলাম, এই তো আমার দেশের কাপড়, আমার দেশের গরিব মানুষের রক্ত–ঘামে বানানো কাপড়, প্যাক হচ্ছে আমার হাতে আর পরবে এই দেশের মানুষ। আরও ভাবছিলাম আমার নিজের অফিস ঘরের কথা। দুই বছর ধরে ভেবেছি, আমার অফিস জবের পাশাপাশি আমি একটা পার্টটাইম কাজ করব, আজই সেটা হবে ভাবিনি, যদিও কাজটা মাত্র কয়েক সপ্তাহের, তবু তো কাজ। একটা নতুন জগৎ, কিছু নতুন কানেকশন, একটা নতুন ভুবনে নিজেকে দাঁড় করানো।

খুব অদ্ভুত লাগে, বীথি। সারা জীবন কি মানুষ নিজেকেই অবিষ্কার করে বিভিন্নভাবে? আজকে যদি এই কাজে না যেতাম, আমি জানতেই পারতাম না বিদেশে কষ্ট করে ডলার উপার্জন বলতে মানুষ কী বলে, কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, টানা দশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর মাত্র ১০০ ডলার যে উপার্জন করে, সে মানুষ কী করে মানবিক হবে? কেন হবে?

সেই মানুষ কতটা কষ্টের টাকা মা–বাবা, ভাইবোনকে পাঠায়, আর তার বদলে পায় কেবলই অতৃপ্তির ঢেকুর। কেন আরও পাঠাও না বিদেশ থেকে? এই আমিই বিদেশে আসার আগে ভাবতাম, বড়পা আরও জিনিস পাঠায় না কেন? তাই বুঝি আল্লাহ আমাকে এক জীবনেই হাতেনাতে সব দেখিয়ে দিলেন। বলে দিলেন, নিজে কামাই করে জীবন চালিয়ে দেখো, মোহহীন হতে হয় কী করে, শিখে নাও জীবনের কাছে থেকে।

আরও পড়ুন

একই সাইজের কিছু টি–শার্ট ভাঁজ করছিলাম আমরা, ঘরভর্তি সব ইয়াং ছেলেমেয়ে, বেশির ভাগ-ই শিক্ষার্থী। পূর্ণোদ্যমে কাজ চলছে। ফ্লোর ম্যানেজার স্টানলি এসে বারবার বলছে, কুইক গাইস, কুইক, ইউ নিড টু ডু আ লট। তখন মনে পড়ছিল দেশের কথা।

একদম একই কায়দায় সকালে আমার নাম একটা কাগজে লিখে নিয়েছিল ম্যানেজার, আর যখন ফিরে এলাম তখন আবার আমার নামের পাশে টাইম লিখে ইনিসিয়াল নিয়ে নিল। আবার যখন যাব, আবার সাইন করব, হাতে হাতে পে করবে ১৫ দিন পরে।

আহ জীবন, বীথি।

২০১৪ সালের‌ মা দিবসটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকল।

একমাত্র ছেলে ছিল একা একা বাসায়, সারাটা দিন। এখন, এই এখনই বিছানায় ওকে পাশে নিয়ে একটু শুয়ে থাকব। ওর কপালে চুমু দিয়ে মনে মনে পরম করুণাময়কে বলব, জীবনের কাছে অসীম প্রাপ্তি, কষ্ট না করলে কী করে জানতাম, বুকভরে অর্জনের নিশ্বাস নিতে হয় কী করে?

কাল অফিস, বীথি। তোকে মা দিবসের আদর। চলবে...

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন