বীথি: পর্ব-১৩
বীথি,
প্রিয় এক লেখকের লেখার শেষ একটা প্যারা পড়ে শোনাই তোকে, তারপর আসি লেখার কথায়।
তোকে অগ্রিম ভালোবাসা বীথি। মানুষের মূল কষ্ট কিন্তু শেয়ারিংয়ের। শরীরের কষ্ট জয় করা যায়, কিন্তু কথা বলতে না পারার কষ্ট বা শেয়ার করতে না পারার কষ্ট কত ভয়াবহ, তা কি সবাই জানে? তুই আমাকে সেই কষ্ট থেকে কিছুটা মুক্তি দিয়েছিস। এবার আসি ওই প্যারা প্রসঙ্গে
‘শফিক জিজ্ঞেস করে, উন্নয়ন হচ্ছে?’
‘আতিক বলে, কে জানে? মাস শেষে বেতন পাই। আর মাঝেমধ্যে গ্রামের মানুষগুলোকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই, এইটুকুই।’
‘আর লেখালেখি? জানতে চায় শফিক।’
‘আতিক ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে, তুই কি জানিস, দেশে প্রতিদিন কয়টা খুন হয়? জানিস, গ্রামের কত মানুষ শুধু একটা দিনের হিসাব করে? একেকটা দিনের পুরো ২৪ ঘণ্টা, প্রতিটা ঘণ্টার পুরো ৬০ মিনিট, প্রতি মিনিটের পুরো ৬০ সেকেন্ড ওরা ব্যয় করে কিসের চিন্তায়? ভাতের।
এর মধ্যে লেখালেখিকে তামাশা মনে হয়। এ বাস্তবতা তুই দেখিসনি।’
‘শফিক ঠাট্টা করে, কিন্তু মার্কেজ? ওর দেশেও তো বাজেভাবে দারিদ্র্য, দুর্নীতিপরায়ণ, সন্ত্রাসী। ও কী বলেছিল মনে আছে? বলেছিল, বাস্তবতা শুধু টমেটোর দামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।’ (গল্প, অগল্প, না-গল্প সংগ্রহ, শাহাদুজ্জামান, পৃষ্ঠা -২৪০ , প্রকাশক সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা)।
এই ওপরের লেখা প্রসঙ্গে আমার কথা তোকে বলতে চাই বীথি।
দুনিয়া এক আজব জায়গা। আর জীবন তার চেয়ে আজীব আদমি। দেখাই শেষ হয় না। যত দেখি, তত তৃষ্ণা বাড়ে। ২০০৬ সালে যখন আমার দুই বছরের ডিপ্লোমার মাঝামাঝি সময়, তখন প্রথম এই শহরে আমার আর নাইয়ার একাকী জীবন শুরু হলো। ছোট বোন কণা রয়ে গেল টরন্টোর আরেক শহর উইন্ডসরে। আমরা আশ্রয় পেলাম টরন্টোর বাঙালি এলাকার স্কারবোরোর এক সিলেটি পরিবারের বেজমেন্টে।
২০০৬ সালের জুলাই মাসের ২৮ তারিখ, কী অবাক করে তারিখটা বুকের ভেতরে রক্ত দিয়ে লেখা হয়ে আছে। ইয়াসমীন ভাবির বাসায় আমার আর নাইয়ার নতুন জীবন।
ভাবির ৩ মেয়ে, এক ছেলে। ২ মেয়েকে ১৮ বছর হওয়ার আগেই সিলেটে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ভাবির একটাই পথ, তা হলো দ্বীনের পথ। আমাকে প্রথম কয়েক দিন ইসলামি দাওয়াত দিতে এসেছিলেন। হয়তো দেখতেন, নামাজ পড়ি, খুব নিয়মমতো চলাফেরা করি, হয়তো দ্বীনের দাওয়াত পাইনি বলেই যাই না। একদিন ঠান্ডা মাথায় বললাম, ভাবি আমার এসব ভালো লাগে না, ধর্মের বিশ্বাস আমার কাছে ভীষণ পারসোনাল, সেটা নিয়ে আমি এক মুহূর্ত বাড়াবাড়ি করব না।
এরপর ভাবি আর ডাকেননি। কিন্তু ওই যে বাস্তবতা, যা তোকে প্রথম প্যারাতে বললাম। ইয়াসমীন ভাবির স্বামী কায়সার ভাই চালাতেন ট্যাক্সি। কানাডিয়ান সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কি করে টু-পাইস কামাতে হবে, কী করে কোথা থেকে কী সুবিধা নিতে হবে, এগুলো ছিল তাঁর হাতের তালুতে। ভাই–ভাবির সাফ কথা, এই খ্রিষ্টানদের দেশে থেকে যা পাও হাতিয়ে নাও, আর সেটা দিয়ে দেশে মসজিদ দাও—এমন হাজারো বাঙালি আছে এই শহরে। এরা না করেছে নিজের ভালো, না করেছে দেশের ভালো; না ভালোবেসেছে কানাডাকে, না নিজের দেশকে। সারা মাস শেষে ডলার পাঠাতে গিয়ে চিৎকার–চেঁচামেচি করেছে, আবার এই দেশের সিস্টেমলস না করলে সেই ডলারও অর্জন হবে না। সুতরাং চোখের সামনে ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে বাবা–মায়ের নানান দিগদারি দেখে দেখে, এখানে যুদ্ধ ওই ভাতের মতোই।
সারাক্ষণ, মানে ২৪ ঘণ্টা থেকে আজ ২৪ বছর অব্দি ভাই–ভাবির স্বপ্ন ছিল একদিন এই দেশ থেকে ভাতের নিরাপত্তা অর্জন হলেই দেশে গিয়ে সেটেল হবেন। ২৪ বছরের ভেতরে সিলেট থেকে ভাই–ভাবির পরিবারে যোগ হয়েছে মোট ২০ জন, ভাইয়ের পক্ষের ৩ ভাই, ভাবির ২ ভাই, দুই মেয়েজামাই, ভাইয়ের বৃদ্ধ মা, বড় জামাই মিঠুর মা। তাহলে এই আয়োজন কিসের? দেশে ফিরে যাওয়ার? ভাই ট্যাক্সি চালিয়ে গত ২০ বছরে যে কাঁচা পয়সা কামিয়েছেন, এই শহর আমি ৩টা জব করলেও সেটা পারব না। এই বাস্তবতা কি আমি চিনি? আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, বিদেশে থাকো, যদি ডলার পাঠাতে না পারোন তাহলে বিদেশে থাকো কেন?
অনেকে বলে, বিদেশে কষ্টই যদি করবে তাহলে থাকো কেন? কী চাকরি করো যে সারা দিন টানাটানির কথা বলো?
বীথি, লেখার শুরুতে তোকে আতিক আর শফিকের কথা বললাম। কিন্তু এই জীবন নিজের কাছে বাবার জীবনের মতো মনে হয়।
তুই তো জানিস, দরিদ্র কলেজশিক্ষক বাবা চাকরির শেষ ৩০ বছর ঢাকা শহরে ছিলেন। কিছুটা সম্মানজনক জায়গায় কাজ করেছেন, আমাদের পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু টাকা তো তেমন ছিল না বাবার কোনো কালেও। আবার বাবার অনেক সহকর্মীকে দেখতাম, গাড়ি চড়ছেন, ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কিনে দিচ্ছেন, বার্থডে পার্টি করছেন; কিন্তু আমরা পারতাম না। দেশের বাড়ি থেকে মানুষ তদবিরের জন্য এসে ফিরে যাওয়ার সময় মাকে বলে যেতেন, জলিল বড় চাকরি করে; কিন্তু কোনো ক্ষমতা নেই, কারও জন্য কিছু করতে পারে না। বাংলাদেশে কিছু করতে গেলে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’–এর ঘোরটপে পড়তে হয়, আর কানাডাতে অনেক অনেক ডলারের ঝনঝনানি করতে হলে অনেক বেশি মেধাবী হতে হয়। না হয় কায়সার ভাইয়ের মতো নানান পথ চিনতে হয়।
আমি হচ্ছি শাহাদুজ্জামানের গল্পের আতিকের মতো, খুব অল্পে বাঁচি, বাস্তবতায় বাঁচি।
আদর তোকে।