বীথি: পর্ব–১২
বীথি,
গত তিন থেকে চার বছরে ব্যক্তিগত একটা বিষয়ের কারণে নিজের জীবনেই এক বিশাল পটপরিবর্তন হয়েছে। খুব ভালোভাবে জেনেছি, এই জীবন মিথ্যার ওপরে দাঁড়াবে না, কখনই নয়। সত্য চিরকাল সত্য, মিথ্যা চিরকাল মিথ্যা।
এই পৃথিবীতেই মানুষের পাপ বা পুণ্যের সব হিসাব হবে, যদি তেমন কিছু থেকেই থাকে। মানুষ তার কর্মের ফল ভোগ করবে। কিন্তু ব্যক্তিগত কথা বলার জন্য অফিস ফাঁকি দিয়ে শান্ত বিকেলে বাড়ি আসিনি। বিশ্বাস কর, এইমাত্র বাড়ি ফিরলাম, বিকেল চারটা হবে। গ্রীষ্মের (সামার) উজ্জ্বল আলো। সারা পথ ভাবি, চারদিকে গাড়ি চলছে, একমুহূর্তের অসতর্কতা আমাকে মুহূর্তেই পৃথিবী থেকে তুলে নেবে।
তোকে বলেছি মনে হয়, টরন্টো শহরের এই ৪০১ রোড পৃথিবীর তৃতীয় ব্যস্ততম রাস্তা, এই পথে গাড়ি চালাতে গেলে অখণ্ড মনোযোগ দরকার, স্থির হাতে হুইল ধরে থাকি আর মাথার ভেতরে ছবির মতো চলতে থাকে বাংলাদেশ নামক একটা দেশ এবং সেই দেশের মানুষ। মানুষের সঙ্গে মানুষের জটিল সম্পর্কের জাল। কোথায় সেসব মানুষ, যাদের কথা ভাবলে আমার চোখে পানি আসে। ইচ্ছা করে এক্ষুনি এই মুহূর্তে ছুটে যাই প্রিয় দেশে? হ্যাঁ বীথি, আমার জীবনেই সেই সময় ছিল, তেমন মানুষ আমি দেখেছিলাম, খুব কাছে থেকে, খুব নিবিড়ভাবে, অন্তত ১০ বছর সেই তিনজন মানুষের সঙ্গে টানা যোগাযোগ ছিল, পারিবারিক যোগাযোগ, সরদার ফজলুল করিম, অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমান ও খান সারওয়ার মুরশিদ।
খান সারওয়ার মুরশিদ নানা চলে গেছেন অনেক আগে। আমি এখনো ভাবি, নানাকে কাছে থেকে দেখে যা শিখেছি, তা কি আর কোনো দিন কারও কাছ থেকে দেখব বা শিখব? নানা ছিলেন একজন প্রকৃত মানবিক ও শিক্ষিত মানুষ, কোনো দিন মন থেকে খারাপ চাননি কোনো মানুষের।
আনিস স্যার আর সরদার স্যার হচ্ছেন সৎ মানুষ। কোনো জায়গায় আনিস স্যারকে আপস করতে দেখিনি। দীর্ঘদিন প্রবাসজীবনে থেকে স্যার দেশে ফিরেছিলেন দেশে কিছু করার তাগিদে, একাগ্রভাবেই সৎ কিছু করার তাগিদে, কিন্তু কী পেয়েছেন স্যার দেশ থেকে? যাঁরা স্যারকে কাছে থেকে জানেন ও চেনেন, তাঁরা জানেন হয়তো আমি কি বলতে চাই।
সরদার স্যার আজকের বাংলাদেশে একজন কিংবদন্তি শিক্ষক। স্যার জানতেন, সত্যিকার লড়াই একমুহূর্তের জন্য থামে না। তাই স্যার আজন্ম যোদ্ধা।
কিন্তু বীথি, এই তিনজন মানুষ তো আমার বা তোর প্রজন্ম নয়। এমনকি আমার বাবারও আগের প্রজন্ম। কিন্তু আমরা কাদের পেলাম চোখের সামনে?
বাংলাদেশে ভালো মানুষ নেই সে কথা বলার প্রশ্ন আসে না, কিন্তু ভেবে দেখ তো কারা আছে আমাদের আশপাশে? কোন বেদনা আর পীড়ন থেকে আজ দেশের বাইরে চলে আসে হাজারো মেধাবী ছেলে বা মেয়ে এবং অন্য মানুষেরা?
গতকাল থেকে একটা কথা মেলাতে পারছি না। প্রায় শুনি, আমাকে অনেকেই বলে, ‘লুনা, আপনার কোনো ধারণাই নেই বাংলাদেশের একটা শ্রেণির হাতে এখন কত টাকা আছে। আপনার কোনো আন্দাজ নেই বলেই আপনি মূর্খের মতো কথা বলেন, সামান্য সামান্য বিষয় নিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদেন আবার লেখালেখিও করেন।’ বলেই আমার সামনে দাঁড়িয়েই হাসতে থাকে আমার পরের জেনারেশন।
তারা অনেকেই আমার চেয়ে ১০ থেকে ১২ বছরের ছোট। আবার অনেকে হয়তো আমার সমসাময়িক। গতকাল একটি মেয়ে বলছে, ‘জানেন আপনি, আমার এক বন্ধু আজকেই টরন্টোতে ওর কাস্টম–মেইড বাড়িতে বেজমেন্ট সাজানোর জন্য একটা টিভি আর কিছু শোপিস কিনল মাত্র ২১ হাজার ডলার দিয়ে।’
জানতে চাইলাম, কী করে তোর বন্ধু? ‘কিছুই না, এই শহরে কিছুই করে না লুনা, আপা। ও দেশে পাঁচ থেকে ছয়টা বায়িং হাউজের মালিক। দেশে টাকা কামাই করা তো সোজা, কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না, লেবার কস্ট নামে মাত্র, খুবই সোজা’, বলে মেয়েটা হাসতে থাকে। আমি নির্বাক বীথি, সারা পৃথিবীর ৮০ শতাংশ সম্পদ মাত্র ২ শতাংশ মানুষের নিয়ন্ত্রণে, তাহলে বাংলাদেশেও তো তা–ই হওয়ার কথা, কিন্তু এই কি আমরা মানুষ?
সেদিন কথা বলছিলাম এক তরুণ ছেলের সঙ্গে। আমাকে বলে, ‘আপা, আমার দরকার টাকা আর মেয়ে মানুষ, টাকা দিলে কোনো মেয়ে হাতে আসবে না এটা কি হয় নাকি এখন আর? আপনি অনেক দিন বাংলাদেশে যান না, তাই জানেন না। ঢাকা শহর কোথায় চলে গেছে, এখন মেয়েরা পারে না এমন কাজ নেই, এমন কোনো বিষয় নেই যা মেয়েদের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না, যদি আমি টাকা দিতে পারি। আর সংসার বা রিলেশনের যে কনসেপ্ট আপনি আমাকে বোঝালেন, এগুলো আর নেই, হয়তো আপনার মতো উদাহরণ আছে দুয়েকটা, কিন্তু সব এখন হিসেব, পাক্কা হিসেব এবং সেখানে টাকাটাই বড় প্রশ্ন।’
আমি বললাম, তোমার মনের ভেতরের ভালো বা মন্দের বোধ কি তুমি টাকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবে? ছেলেটি হেসে দিয়ে বলে, ‘ট্রিক তো সেটাই, আমি যদি জেনে যাই কি দিলে আপনাকে আমি কিনতে পারব, তাহলে তো সব সমস্যার সমাধান, তাই না?’ আমি আবার বলি, যদি আমি সততা চাই, আমি যদি কিছুই না চাই, যদি বলি তোমার অখণ্ড ভালোবাসা ছাড়া আমার আর কিছুই চাই না। ছেলেটি আমাকে কফি অফার করে বলে, ‘আপা, আপনার মাথায় সমস্যা আছে, এমন কথা এখন আর কেউ বলে না।’
জানিস বীথি, এই মাত্র ২০০২ সালে আমাকে বাংলাদেশে আমার এক সহকর্মী বলেছিল, ‘লুনা, খুব যে গর্ব করে বললেন, আপনার বাবা ঘুষ খায় না, হয়তো আপনার বাবা তিন লাখ টাকা খায়নি, কিন্তু তিন কোটি টাকা অফার করে দেখেছিলেন, ঘুষ খায় কি না? মনে রাখবেন, আজ বাংলাদেশে যারা সৎ, তারা সুযোগ পায়নি বলেই সৎ, সুযোগ আছে, কিন্তু সৎ থেকেছে, আপনি বাটি চালান দিয়েও সেই মানুষ এখন আর পাবেন না লুনা।’
বীথি, প্রিয় শিক্ষক সরদার স্যার বলেছিলেন, ১৯৯৭ সালে, ‘লুনা, বাংলাদেশে আর কয়েক দিন পরে সৎ মানুষ জাদুঘরে রাখন লাগব।’
তোকে অনেক অনেক কথা বলার জন্য প্রতিবার লিখতে বসি, কিন্তু যা লিখতে চাই, তার কিছুই লিখতে পারি না। অসহায় হয়ে, এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে লেখা শেষ করি। কবে সব কথা বলতে পারব বীথি?