বীথি: পর্ব-১১
রান্নাঘরে কাজ করছিলাম আর তোর সঙ্গে কথা বলছিলাম, মানে তোকে লেখা চিঠির সাথে। সেদিন একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছে, আচ্ছা, বীথিটা কে?
আসলেই কি কেউ আছে? নাকি আপনি বানিয়েছেন কাউকে?
আমি কি করে বলি যে-তুই জলজ্যান্ত একজন সত্যিকার মানুষ এবং তুই আমার সত্যিকার বন্ধু। যদিও বেশ কয়েকজন সেটা জানে। যা–ই হোক, কানাডায় শুরু হয়েছে তিন দিনের ছুটি, ঘরমুখী মানুষ তিন দিনের জন্য বাজারঘাট করে বাড়ি ফিরছে, এই নর্থ আমেরিকা এক অদ্ভুত দেশ জানিস, সবাই ঘরে থাকতে ভালোবাসে। কারণ এই দেশে কাজ মানে সলিড কাজ, আর ছুটি মানে একদম ছুটি, সবকিছু থেকে মুক্তি, কাজ আর ঘর সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। আর সেখানে যদি চাকরিতে আনন্দ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই।
কথাটা সবাই কীভাবে নেয় জানি না, কিন্তু বলি সবাইকে, এই দেশে যদি কর্মতুষ্টির (জব স্যাটিসফেকশান) ওপর জরিপ করা হয়, আমি প্রথম হব। বাংলাদেশে চাকরি করেছি সব মিলিয়ে ১০ বছর, কিন্তু কানাডায় চাকরি করে যে আরাম পেলাম বা পাচ্ছি, তা আর কোনো কিছুর সাথেই তুলনা হয় না। আজকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, তাই ৩ ঘণ্টা আগে বেরিয়েছি, তবুও পথে ভিড়, তোকে আগেই বলেছি বাড়ি ফেরার পথে আমাকে কম করে হলেও দেড়-ঘণ্টার ওপর ড্রাইভ করতে হয়, আর সেই সময়টা আমি মানুষের বিচিত্র জীবন নিয়ে ভাবি, ভাবতেই থাকি, আর সব ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু মানুষের সঙ্গে মানুষের জটিল সম্পর্ক জাল।
আর সেই সম্পর্কের নানা দিক ধরেই ভাবতে থাকি, কোথা থেকে শুরু করেছিলাম আর কোথায় শেষ হবে এই জীবন? আমার নিজের কাছেই নিজের বিস্ময় কাটে না বীথি, আমি নিজেই বুঝি না, কী শুনি এসব? আবার ভাবি, কই ঠিকই তো বলছে সবাই, আমি ও তো জানি এসবই সত্যি কথা, তবুও শুনতে বা মানতে এত অদ্ভুত লাগে কেন? এই আমরাই তো, এই আমরাই তো এসব করছি যুগ যুগ ধরে, এই মানুষেরাই তো, কিন্তু সেই সত্য যখনই চোখের সামনে চলে আসে, ধরা পড়ে যায় তাহলেই সব বিপত্তি, তাই না বীথি? আজকে ফোন করেছিল, লস অ্যাঞ্জেলেসে থেকে একটা মেয়ে, আমার লেখার রেগুলার পাঠক। প্রায়ই ফোন করে, কথা হয় দীর্ঘক্ষণ আর স্বাভাবিকভাবেই এমন কথোপকথনের ভেতর দিয়েই বেরিয়ে আসে ব্যক্তি জীবনের লুকিয়ে থাকা নানা টানাপোড়েন। আমি বিহ্বল হয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় লিখতে বসি, নিজেকে হালকা করি তোর সাথে কথা বলে।
মেয়েটি সংসার করছে আজ প্রায় ১৫ বছর, পরিচয় এর প্রথম প্রথম বেশ উত্তেজনা ছড়াত, বলত না না লুনা, শোন অনেক দেখেছি, আর না, আমি আর সংসারের সাথে নেই, আমি দেশ ছেড়েছি, এবার বাচ্চা নিয়ে নিজের মতো আরামে থাকব। আমার স্বামী যা পারে করুক, সে–ও ৯–১০ মাস আগের কথা।
আস্তে আস্তে মেয়েটা থিতু হতে থাকে, গলার সুর নরম হতে থাকে, আমিও বলি, কী লাভ একা হয়ে? যদি থাকতে পারিস থেকে যা, একা জীবন বহন করাও কিন্তু কম কষ্টের না। যাক, এভাবেই চলতে থাকে, মেয়েটা বেশ ম্যাচিউরড, অনেক সময় আমার মনে হয়, আহহহ–এভাবে তো আমি ভাবিনি, মেয়েটার একটা ভালো বন্ধুও আছে, যার সাথে, খুব যাচাই–বাছাই করে মেয়েটি চলে, আবেগে জড়িয়ে পড়ে না।
আমাকে বলে, লুনা তুমি তো বোকা, ভীষণ বোকা মেয়ে তুমি, সবকিছু নিজের করে চাও কেন? ওটা হলেই তো বিপদ বাড়ে, শান্তি চলে যায়। যেকোনো সম্পর্ক রাখতে হয় হিসাবের বাইরে, তুমি বোঝ না কেন? রিমি বলতে থাকে জানো, লুনা ছোটবেলা থেকে আমরা একজন মহিলাকে ফুফু ডাকতাম, অনেক পরে জেনেছি ওই মহিলা আমার বাবার বিশেষ প্রিয় মানুষ, আমার মায়ের-ও একজন বিশেষ মানুষ আছেন, জানো, আর আমার বোন বা বোন জামাই, কার কথা বললে তুমি বিশ্বাস করবে বলো? সবার, সবার একজন করে আলাদা মানুষ আছে, এভাবেই মানুষ বাঁচে জানো।
কেবল তুমি দেখি স্বপ্নের ঘোরে বাস করো, এটা কেমন কথা লুনা? তুমি বুঝতে চাও না কেন? কামনা–বাসনার মানুষ আর ঘর-সংসার করার মানুষ এক না।
দুইটা দুই হিসাব। তোমাকে আরও আরও রগরগে কথা বলতে পারি, তুমি আবার লিখতে বসো না যেন। আমার স্বামীর পক্ষের দুই সুন্দরী মামিশাশুড়ি আছেন, অসম্ভব সুন্দর ওই দুজন মামি, ওই দুই মামির সাথেই তাদের খালাতো ভাইদের রিলেশন, দীর্ঘদিনের রিলেশন।
জানিস বীথি, আমি আর আগাই না, আমার ভালো লাগে না, আমি জানি সব কথাগুলো সত্য, কিন্তু এই মুখোশধারী জীবন যাপন করতে চাই না বলেই একদিন সংসার ছেড়েছিলাম, আমিও জেনেছিলাম ও বিশ্বাস করেছিলাম সংসারের চক্রের ভেতরে অনেক অনেক চোরাবালি থাকে, আমরা সেই চোরা স্রোতেই জীবন পার করি।
কিন্তু সত্য কি জানিস, সেটা হয়তো বাংলাদেশ বা একান্তই আমাদের কালচার বা পৃথিবীর সব দেশের মানুষের ভেতরেই এই দ্বিমুখী রূপ আছে, আমার ভেতরেও আছে, কিন্তু আজকে এমন একটা বয়সে বা সময়ে এসে পৌঁছেছি, এখন মন থেকে বিশ্বাস করি, গোজামিল দিয়ে জীবন চালানো যায় কিন্তু সুখী হওয়া অসম্ভব, আমি সবাইকে ফাকি দিতে পারি, কিন্তু নিজেকে?
হিসাব করে অনেক কিছু নিশ্চয়ই পাব, টাকা, বাড়ি, গাড়ি, স্বামী সবকিছুই হিসাব করে পাব, কিন্তু সৎ সুখ? বা নিজের কাছে বড় হয়ে বাঁচা? সেটা কি হিসাব করে হয়েছে কোনো দিন? আমি এমন একটা দেশে আছি বীথি, এখানে জোর করে কাউকে কিছু করতে হয় না, এখানে তুই-ই গোটা সমাজ, তুই তোর মতো বাঁচবি, কেউ জোর করে তোকে কিছু করতে পারবে না, যদি তোর সায় না থাকে।
বাংলাদেশে এভাবে বাঁচা কঠিন, সেটা আমি নিজেই দেখে এসেছি। অনেক অনেক পথ হেঁটেছি বীথি, তুই জানিস সেটা, জীবনের নোংরামি আমারও কাছে থেকেই দেখা আছে, পোড়া দাগ দগদগে হয়ে লেগে আছে বুকের মাঝখানে, কিন্তু আর না বীথি। আর কোনো আপস না, নিখাদ/নিরেট তৃপ্তি চাই, যা চাই সবটুকু চাই, না পেলে না পাব, কিন্তু এই সবটুকু আবেগ চাওয়ার ও দেওয়ার জায়গায় আর কোনো আপস না। হয়তো হবে, নইলে না। কিন্তু হাল ছেড়ে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে বাচঁবো কেন বল?
আমি যা মানি আমি তাই চাইব, যা মানি না, যা দিনের আলোর মতো জ্বলজ্বলে না সেই অন্ধ গলিতে কেন হেঁটে যাব? আমার সিডিতে আজকে শুনছিলাম সেই প্রিয় গান ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’। খুব প্রিয় একটা গান। লম্বা ছুটি, এর ভেতরেই একদিন তোকে ফোন দেব, কথা বলব, কেমন? আদর। চলবে...