কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়: সপ্তম পর্ব
ষষ্ঠ পর্বের শেষে উল্লিখিত হয়েছিল যে ১২৯৯ সালে নয়ান বাইজুর নাতি সুলেমিশ আনাতোলিয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন স্বয়ং মোঙ্গল ইলখানাত সাম্রাজ্যের প্রতি। সুলেমিশ নিজে চেঙ্গিস খানের মতো টেংরি ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তাই সুলেমিশ ইলখানাতের অবশিষ্ট অমুসলিম সৈন্যদের সংগঠিত করে এবং তাদের নিজের দলে ভেড়ানোর পাশাপাশি আরও সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকে। এ সময় সে ২০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে আনাতোলিয়ায় আত্মপ্রকাশ করেন।
সুলেমিশ আনাতোলিয়ায় নিজের মঙ্গোল রাষ্ট্র ঘোষণার ইঙ্গিত দেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই সুলেমিশ আনাতোলিয়ার ক্ষুদ্র তুর্কি রাষ্ট্রগুলোতে হামলা শুরু করে। তুর্কিদের ওপর আবারও হত্যা-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। ওসমানের অঞ্চলেও সুলেমিশের পাঠানো একটি বাহিনী হামলা করে।
সুলেমিশের বাহিনীর তুলনায় ওসমান নিজের অঞ্চলে থাকা অপেক্ষাকৃত কম সৈন্য নিয়েও বেশ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তার বসতি-শহর-দুর্গগুলোকে রক্ষা করেন। ওসমান এভাবেই সুলেমিশ ও তাঁর পাঠানো বাহিনীকে তাঁর অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেন। সুলেমিশের বিদ্রোহ ও আনাতোলিয়ায় আবারও আগ্রাসন ইলখানাতের মোঙ্গল সম্রাট গাজান খানকে ব্যথিত করে।
এমন সময় তিনি সিরিয়ায় মামলুকদের বিরুদ্ধে নিজের অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত কমান্ডার কুতলুগশাহকে তিনি একটি সেনাবাহিনীসহ আনাতোলিয়ায় পাঠান এই বিদ্রোহ দমন করতে। ক্ষুদ্র তুর্কি রাষ্ট্রগুলোতে হামলা করলেও সুলেমিশের বাহিনী একসময় দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ইলখানি কমান্ডার কুতলুগশাহের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুলেমিশ ও তার সেনাবাহিনী পরাজয় বরণ করে। সুলেমিশকে আটক করে কুতলুগশাহ পারস্যের ইলখানাতের রাজধানী তাবরিজে নিয়ে যান। তাবরিজে সুলেমিশের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে আনাতোলিয়ায় আবারও কিছু সময়ের জন্য শান্তি ফিরে আসে। ওসমানও বিথনিয়া অঞ্চলে নিজের ক্ষমতা বাড়াতে রোমান শহর ইয়েনিসেহিরকে পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন।
ফলে ১৩০০ সালের দিকে ওসমান রোমান শহর ইয়েনিসেহিরে আক্রমণ করেন। সেই শহরের এক হাজারের মতো রোমান সৈন্য প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ওসমানের খুব চৌকস যুদ্ধকৌশলের কারণে ওসমান নিজের ৫০০-৬০০ কায়ি সেনা নিয়ে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক রোমান সেনাদের ঘায়েল করে ফেলেন। ফলে কিছু সময়ের যুদ্ধের পরই রোমান সেনাদের পরাজয় ঘটে। ওসমান সোগুতের চেয়েও বড় একটি শহর ইয়েনিসেহির জয় করে ফেলেন। ইয়েনিসেহির জয়ের পর তিনি নিজের রাষ্ট্রের রাজধানী সোগুত থেকে এ ইয়েনিসেহির শহরে স্থানান্তর করেন। এখানে থাকা খ্রিষ্টান জনগণের পাশাপাশি তিনি নিজের গোত্র ও আশপাশের গোত্রগুলোর বেশ কিছুসংখ্যক জনগণের জন্য ইয়েনিসেহির শহরে বাসস্থান গড়তে আদেশ দেন। ওসমান নিজেও তাঁর পরিবারকে নিয়ে এ শহরের প্রাসাদে বসবাস শুরু করেন।
বলা বাহুল্য, ‘ওসমানীয়’ রাষ্ট্রের শুরুর দিকে ওসমানের অধীন অঞ্চলের গোত্র, দুর্গ ও শহরগুলোতে ৬০ হাজারের মতো সাধারণ জনগণ ছিল এবং চার-পাঁচ হাজার সৈন্য ছিল। যদিও ওসমানের অধীন অঞ্চলে খ্রিষ্টান জনগণের সংখ্যা মুসলমানের তুলনায় বেশি ছিল এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত। কথিত আছে যে ওসমানীয় রাষ্ট্রের প্রথম থেকেই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ ওসমানের ভূমিতে এসে স্বাধীনভাবে বসবাস করত। এর বড় কারণ ছিল বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যে সাধারণ খ্রিষ্টান জনগণকে জন্মগতভাবেই দাসের মতো মূল্যায়ন করা হতো। তাই তাদের কেউ কেউ ওসমানের দেওয়া স্বাধীনতার কথা ভেবে ওসমানীয় রাষ্ট্রে চলে আসত এবং রোমান সাম্রাজ্যের দাসত্বের শিকল থেকে মুক্ত হতে পারত।
১৩০০ সালে রোমান ইয়েনিসেহির শহর জয়ের পর ওসমান রোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ও অঞ্চলের দিকে মনোনিবেশ করেন। ওসমান বে ইয়েনিশেহিরের কাছের কয়েকটি দুর্গে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। ওই দুর্গগুলো রোমান জমিদারেরা তৎকালীন রোমান সম্রাট আন্দ্রেনিকোসের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। রোমান সম্রাটও তাঁদের একটি সেনাবাহিনী পাঠানোর আশ্বাস দেন। ওসমান এ খবর শুনেই রোমান দুর্গ কপ্রুহিসার ও মারমারিচিক অবরোধ করেন। বেশ কিছুদিন অবরোধে দুটি দুর্গেই দুর্ভিক্ষ আসন্নবর্তী হয়ে যায়। এ সুযোগে ওসমান প্রথমে মারমারিচিক দুর্গে হামলা করেন। এ দুর্গের রোমান সৈন্যরা ওসমানের বড় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধই গড়তে পারেনি। ফলে মারমারিচিক দুর্গ ওসমানের অধীন এসে পড়ে।
একইভাবে মারমারিচিকের পরই ওসমান নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে কপ্রুহিসার দুর্গ হামলা করে বিজয় অর্জন করেন। তিনি পরপর দুটি দুর্গ জয় করে দুর্গগুলো খ্রিষ্টান জনগণের জন্য করের বোঝা কমিয়ে দেন এবং তাদের মধ্যে গনিমতের কিছু অংশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য দান করে উদারতা দেখান। ওসমান এ দুটি দুর্গ জয় করেই থেমে থাকেননি, তিনি লেফকে দুর্গেও হামলা করেন এবং তাঁর সঙ্গে ৫০০ সেনার মতো একটি বাহিনী গিয়ে লেফকে দুর্গকে নিজের অধীন নিয়ে আসেন।
এভাবেই ওসমানের পরপর দুর্গ জয় করা ও খ্রিষ্টান জনগণের প্রতি উদারতা দেখানো নিয়ে আনাতোলিয়ায় হইচই পড়ে যায়। ওসমান এ তিনটি দুর্গ জয় করে রোমান শহরকে সুরক্ষা প্রদান করা আকহিসার ও কচহিসার দুটি রোমান দুর্গের দিকে নজর দেন। রোমান সম্রাটের সৈন্যবাহিনী আগমনের আগেই এ দুটি দুর্গ দখল করে ওসমান বিথিনিয়া অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিলেন। ওসমান একই সঙ্গে আকহিসার ও কচহিসার জয় করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। তাই তিনি নিজের সেনাবাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করে অতর্কিত হামলা করেন এ দুটি দুর্গে। এ দুর্গ দুটি ক্ষুদ্র হলেও বিথিনিয়া অঞ্চলে এ দুর্গগুলো বেশ প্রভাব ছিল। একে তো ওসমানের দক্ষ বাহিনী, পাশাপাশি সংখ্যায়ও বেশি থাকায় দুর্গ দুটির রোমান বাহিনী দাঁড়াতেই পারেনি ওসমানের সৈন্যদের সামনে। ওসমান এ দুর্গ দুটি জয় করে নিলে উল্লিখিত দুর্গ দুটির রোমান জমিদার পালিয়ে যান ও রোমান সম্রাটকে গিয়ে ওসমানের আগ্রাসনের ব্যাপারে নালিশ করেন। অতঃপর ওসমানের বিরুদ্ধে রোমান সম্রাট আন্দ্রেনিকোস ২ হাজার সৈন্যের একটি বিশেষ বাহিনী প্রেরণ করেন এবং ভয়ানক এক যুদ্ধের আভাস দেন। চলবে...
লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়