কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়-১
ওসমান বে এখনো এক বিখ্যাত নাম। বিখ্যাত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এই সাম্রাজ্যের নামকরণও তাঁর নাম দিয়েই হয়েছে। যাঁরা মুভি-সিরিজ দেখেন, তাঁরা ওসমান বেকে চিনতে বেশি সময় নেবেন না। কারণ, বিশ্বখ্যাত তুর্কি সিরিজ ‘কুরুলুস ওসমান’–এর জনপ্রিয়তা রয়েছে পুরো বিশ্বে। এই সিরিজে মূলত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান বের ইতিহাস দেখানো হচ্ছে। সিরিজে ‘ওসমান’ চরিত্রে অভিনয় করা বিশ্বখ্যাত অভিনেতা বুরাক অজসিভিত কয়েক দিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন তাঁকে নিয়ে যে ক্রেজ তৈরি হয়েছিল, সেটাই প্রমাণ করে তাঁর জনপ্রিয়তা।
সম্প্রতি ‘কুরুলুস ওসমান’ সিরিজের দেশি-বিদেশি অনেক ভক্ত দাবি করছেন, মাঝেমধ্যেই প্রকৃত ইতিহাস দেখানো থেকে দূরে সরে যায় এ সিরিজের কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে আমার কথা হচ্ছে, ফিল্ম-সিরিজের পরিচালক-প্রযোজকদের উদ্দেশ্যই থাকে কীভাবে দর্শকদের কাছে এর কাহিনিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবেন। এ কারণেই মূলত সিরিজে কিছু কাল্পনিক চরিত্র-দৃশ্য সংযোজিত হয়। তবে ‘কুরুলুস ওসমান’ সিরিজ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরং তাঁরা যেভাবে সুস্থ বিনোদন উপস্থাপন করে সারা বিশ্বের কাছে একজন বিখ্যাত মুসলিম যোদ্ধার চরিত্র প্রদর্শন করছেন, সেটাও প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু কিছু কাল্পনিক দৃশ্যের কারণে এমন একজন বিখ্যাত মুসলিম যোদ্ধার ইতিহাস বিকৃত হবে—সেটাও কাম্য নয়। তাই আপনাদের কাছে ওসমানের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরাটাও প্রয়োজন বলে মনে করি।
বলে রাখা ভালো, ওসমানের প্রকৃত ইতিহাস কোথাও ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়নি। মূলত বিভিন্ন ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তাঁর ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এ জন্য বেশ কিছু সূত্র ধরে আমাকে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজতে হয়েছে। আমি ধারাবাহিকভাবে ওসমান বের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে তাঁর সমসাময়িক বেশ কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনা উল্লেখ করছি, যাতে আপনারা তৎকালীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সুন্দরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
ওসমান বে তুর্কিদের বিখ্যাত কায়ি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন আরতুগ্রুল গাজি ও মা হালিমা সুলতানা। ১২৫৪ সালে, মতান্তরে ১২৫৮ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর জন্মস্থান ছিল তৎকালীন আনাতোলিয়ার পশ্চিম রোমান সীমান্তের কাছে সোগুত অঞ্চলে। আরতুগ্রুল গাজির তিন ছেলের মধ্যে ওসমান ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ওসমানের জীবনের প্রথমার্ধ নিয়ে ইতিহাসে তেমন বেশি তথ্য না থাকলেও কিছু সূত্রে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী। তির নিক্ষেপ, তলোয়ার চালানো ও শিকারে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। তাঁর শিক্ষক ছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত সুফি শায়েখ এদেবালি। ওসমান দ্বীনি শিক্ষাসহ যাবতীয় শিক্ষা তাঁর বাবার শাসনাধীন সোগুতের মাদ্রাসায় গ্রহণ করেছিলেন।
২০ বছর বয়সী ওসমানের সাহস ও যুদ্ধকৌশলের দক্ষতা দেখে বাবা আরতুগ্রুল গাজি তাঁকে সোগুত শহরের দায়িত্ব দেন। মূলত আরতুগ্রুল গাজি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে তখন ভাই দুন্দার বে ও ছেলেদের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগ করে দিচ্ছিলেন। ওসমানের বড় ভাই গুন্দুজ বেকে কারাচাহিসার দুর্গের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও কথিত আছে, আরতুগ্রুলের অবর্তমানে গুন্দুজই কায়ি বসতির ভারপ্রাপ্ত প্রধান বে হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। আর ওসমানের চাচা দুন্দারকে কায়ি বসতি, সোগুত শহর ও দুর্গের সব বাণিজ্যিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওসমানের মেজ ভাই সাভচি বে কিশোর বয়সে কোনিয়াতে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলেন। সেখানেই বহু বছর কাটান তিনি।
সোগুত শহরের দায়িত্ব নিয়ে ওসমান প্রথমেই সেখানে আসা দূরদূরান্তের বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোকে ডাকাতের আক্রমণ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নেন। সে সময় সোগুতের বাজারে প্রতিবেশী কয়েকটি রোমান দুর্গের জমিদারেরা ব্যবসা করলেও কোনো কোনো রোমান জমিদার আরতুগ্রুলকে শত্রু ভেবে ব্যবসা তো করতেনই না, বরং ডাকাত ভাড়া করে সোগুতে আসা বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোতে হামলা করে লুটপাট চালাতেন। ওসমান সাহসিকতার সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করে একসময় লুটপাট বন্ধ করে দেন। এ জন্য কয়েকজন রোমান জমিদারের সঙ্গে তাঁর শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এ কারণে নাইট বাহিনীর সঙ্গে ওসমানের ক্ষুদ্র বাহিনীর যুদ্ধ লেগেই থাকত। ওসমান কম সৈন্য নিয়েও সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুসেনাদের পরাজিত করতেন।
আরেকটি সমস্যা ছিল মঙ্গোলদের নিয়ে। আরতুগ্রুল যেহেতু মঙ্গোলদের কখনোই কর দিতেন না, সে জন্য তারা সোগুতের বাজারে হামলা করার জন্য ওত পেতে থাকত। ঈর্ষান্বিত রোমানদের মতো মঙ্গোলরাও সোগুতে আসা বিভিন্ন বাণিজ্যিক বহরে পথিমধ্যে হামলা চালিয়ে লুটপাট করত। ওসমানকে তাই মঙ্গোলদেরও প্রতিহত করতে হতো। তিনি সাহসিকতা ও আকর্ষণীয় যুদ্ধকৌশলের মাধ্যমে কম সৈন্য নিয়েও মঙ্গোল বাহিনীকে সোগুত থেকে বিতাড়িত করতেন। এভাবেই তিনি সোগুতকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে সেখানকার তুর্কি, রোমান ও ভিনদেশি ব্যবসায়ীদের নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
বিশোর্ধ্ব এক তরুণের জন্য এত কম বয়সে একটি বাণিজ্যিক শহর চালানো ও রোমান-মঙ্গোলদের মতো শত্রুদের আক্রমণ প্রতিরোধ করা সে সময় অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছিল। একসময় ওসমানের সুনাম সোগুত ছাপিয়ে আনাতোলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীদের জানমালের প্রতি ওসমানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা অনেক ব্যবসায়ীকে আকর্ষণ করে। তাঁদের অনেকেই সোগুতে আসা শুরু করেন। তরুণ ওসমান এভাবে দু-তিন বছরে সোগুতের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করে তাঁর বৃদ্ধ বাবা আরতুগ্রুলেরও নজর কাড়েন। চলবে...
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে, ভিডও ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]