কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়: ষষ্ঠ পর্ব
পঞ্চম পর্বের শেষে উল্লিখিত হয়েছিল, ওসমান রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের সবচেয়ে বড় দুর্গ ইনেগল তিন-চার মাস অবরোধ করে চূড়ান্ত হামলার সিদ্ধান্ত নেন। এ চূড়ান্ত হামলায় ওসমান ইনেগল দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়লে ইনেগলের এক হাজারের অধিক রোমান সৈন্যের বিপক্ষে ওসমানের ৭০০-৮০০ সৈন্যের তুমুল লড়াই হয়। এ লড়াই বেশ রক্তক্ষয়ী ছিল। শেষ পর্যন্ত ওসমান ও তাঁর সৈন্যরা ইনেগল দুর্গ জয় করে ফেলেন। ওসমানের সৈন্যদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলেও ওসমান রোমান সীমান্তের সবচেয়ে বড় এ দুর্গ জয় করে নিজের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি ইনেগলে কায়ি গোত্রের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে তিনি জমিদার নিকোলার শিরশ্ছেদ করেন। ইনেগল দুর্গ জয়ের পর এ দুর্গের দায়িত্ব ওসমান তার প্রিয় শতবর্ষী যোদ্ধা তুরগুত আল্পকে দেন। তুরগুত আল্প ওসমানের বাবা আরতুগ্রুলের সময় থেকেই কায়ি গোত্রের সেবা করে আসছিলেন অনেক অনেক যুদ্ধ করে। তার কুঠার নিয়ে যুদ্ধ করা সেই ১০০ বছর বয়সেও অব্যাহত ছিল। বেশ শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন তুরগুত ১০০ বছর বয়সে এসেও। এ ইনেগল অভিযানে ওসমানের বড় ভাই গুন্দুজের মৃত্যু হয়েছিল বলে কিছু ঐতিহাসিক দাবি করেন। আবার, কয়েকজন ঐতিহাসিকের মতে, গুন্দুজ ১৩০৩ সনে ইনেগল দুর্গের পাশেই এক যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। মূলত, গুন্দুজ বের কবর ইনেগলে পাওয়া গিয়েছিল বলেই ঐতিহাসিকদের এমন দ্বিমত রয়েছে।
ওসমানকে ইনেগলের অভিযানে সাহায্য করেছিল তাঁর অধীনে থাকা সাত-আটটি গোত্রের সৈন্যরা। ইনেগল, বিলেচিক ও ইয়ারহিসার দূর্গগুলোতে ওসমান কায়ী পতাকা উত্তোলন করে দুর্গগুলো জনগণের ওপর থেকে অতিরিক্ত করের বোঝা কমিয়ে দেন। ওসমান তাঁর বাবার মতোই এ দুর্গগুলোতে খ্রিষ্টান জনগণের জন্য পূর্বে রোমানদের আরোপিত করের অর্ধেক কর ধার্য করেন। ফলে দুর্গগুলো খ্রিষ্টান জনগণ শান্তিতে বসবাস শুরু করেন। ওসমান দুর্গ জয় করে যে গনিমত পেয়েছিল, তার সবই তার অধীনে থাকা গোত্রগুলোর সাধারণ জনগণের মধ্যে দান করে দেন।
ওসমানের এ বিজয়ে রোমান সম্রাট বেশ ক্ষুব্ধ হন। এ সময় রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বড় শহর বুরসার গভর্নর কোনিয়াতে সেলজুক রুমের সুলতান আলাউদ্দিনের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। সেই চিঠিতে ওসমানের ইনেগল জয় বুরসার জন্য হুমকি ও চলমান রোমান-সেলজুক শান্তিচুক্তির জন্য হুমকি বলে সেই গভর্নর দাবি করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওসমানকে সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর দরবারে ডেকে পাঠান এবং সেলজুক রুমের কিছু সৈন্য সোগুতে প্রেরণ করেন। কয়েকটি সূত্র দাবি করে, ওসমানকে কোনিয়াতে সুলতানের কাছে নিয়ে আসার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় তার বড় ভাই গুন্দুজ বেকে। যদিও ওসমান এ সময় কোনো রকম বিদ্রোহ আর না করে তাঁর ভাই গুন্দুজ ও সুলতানের পাঠানো সৈন্যদের সঙ্গে সুলতানের দরবারে উপস্থিত হন। ওসমান নিজেকে সুলতানের কাছে নির্দোষ দাবি করেন এবং সুলতানও ওসমানের এমন বিজয়ে তাঁর প্রশংসা করে তাঁকে কোনো শাস্তি দেননি। ওসমানকে সুলতান এ সময় দরবেশদের এক বিখ্যাত স্থানে প্রেরণ করেন। সেখানে ওসমান কিছুদিন সময় কাটিয়ে সুলতানের অনুমতিক্রমে আবারও নিজের অঞ্চল সোগুতে ফিরে আসেন।
কিছুদিন পর ওসমানের সোগুত শহর ও কারাচাহিসার দুর্গ সুলতান আলাউদ্দিন সফর করেন। এ সময় ওসমান বেশ বড় এক উৎসবের আয়োজন করেন তার অধীনে থাকা অঞ্চলজুড়ে। সুলতান আলাউদ্দিন সোগুতে প্রবেশ করলে ওসমান বে নিজে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করেন। ওসমান তখন সুলতানকে নিজের পক্ষ থেকে অনেক কিছু উপহার প্রদান করেন। এ উৎসবের পরপরই ওসমানকে তাঁর এত অর্জনের পুরস্কার স্বরূপ সুলতান আলাউদ্দিন সোগুতের পার্শ্ববর্তী সেলজুক শহর এসকিসেহির ও ইনোনু অঞ্চল প্রদান করেন। পাশাপাশি তিনি ওসমানকে সেলজুক রুম সাম্রাজ্যের প্রতি বার্ষিক কর দেওয়া থেকে মুক্তি দেন। এ সুযোগে ওসমানও সুলতান আলাউদ্দিনের মাধ্যমে নিজের অঞ্চলে বেইলিক (ক্ষুদ্র রাষ্ট্র) ঘোষণা করিয়ে নেন।
ফলে, ১২৯৯ সনে আত্মপ্রকাশ ঘটে ওসমানীয় রাষ্ট্রের। এভাবেই জান্দার রাষ্ট্রের মতো ওসমানের রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ হয় সেলজুক রুমের মাধ্যমে। ওসমান সেলজুক রুমের প্রতি আনুগত্য করলেও কোনো প্রকার করের ঝামেলা না থাকায় তিনি নিজের অধীনে থাকা গোত্রগুলোর জন্য নিজের রাষ্ট্রের কর ধার্য করেন। এখানেও ওসমান বেশ উদারতা দেখান। তার অঞ্চলের গোত্রগুলোর জনগণ অনেক দিন ধরে যে পরিমাণ কর সেলজুক রুমকে প্রদান করত, সে পরিমাণেরও অর্ধেক কর ওসমান নিজের অঞ্চলে থাকা গোত্রগুলোর প্রতি আরোপ করেন। ফলে ওসমানের এমন উদারতা বেশ সাড়া ফেলে দেয় আশপাশের তুর্কী রাষ্ট্রগুলোতে। তা ছাড়া পারস্যের ইলখানাতের মঙ্গোল সম্রাট গাজান খান মুসলিম হওয়াতে এবং এ সাম্রাজ্যের অধিকাংশ মঙ্গোল সৈন্য ও কমান্ডার মুসলিম হওয়াতে আনাতোলিয়াতে মঙ্গোল আগ্রাসন কয়েক বছরের জন্য কমে গিয়েছিল। তাই আনাতোলিয়াতে বেশ কিছুদিন শান্তি ফিরে বিরাজ করছিল।
এভাবেই ওসমান তাঁর বাবার রেখে যাওয়া বসতি, দুর্গ ও শহরের পরিধি আরও বিস্তৃতি করে ১২৯৯ সনে নিজের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে তাঁর বাবার জয় করা সোগুত শহরকে ঘোষণা করেন। ওসমান তাঁর অধীনে থাকা গোত্রগুলোর সৈন্যদের নিয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে রক্ষায় জোর দেন। ফলে, ১২৮০ সনে কায়ি গোত্রের প্রধান হওয়ার পর থেকে ১৯ বছরের মধ্যে ওসমান তাঁর বাবা আরতুগ্রুলের রেখে যাওয়া ৪০০ সৈন্যকে ৪০০০ সৈন্যে পরিণত করেন।
তবে বিপত্তি নিয়ে আসে তৎকালীন আনাতোলিয়ার মঙ্গল গভর্নর সুলেমিশ। সুলেমিশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বয়ং ইলখানাত সাম্রাজ্য ও সম্রাট গাজান খানের প্রতি। এ বিদ্রোহের কারণ ছিল গাজান খান ও তাঁর সাম্রাজ্যের অধিকাংশ কমান্ডার ও সৈন্যদের মুসলিম হওয়া। সুলেমিশ ছিলেন ১২৪৩ সনে কসদাগের ময়দানে সেলজুক রুম সাম্রাজ্যকে পদানত করা বিখ্যাত মঙ্গোল সেনাপ্রধান নয়ান বাইজুর নাতি। চলবে.....
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়