কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়–২
প্রথম পর্বে আমরা জেনেছিলাম, বিশ বছর বয়সেই ওসমান সোগুত শহরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ও পরে সোগুতকে নিরাপদ বাণিজ্যিক শহর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ১২৭৭ বা ১২৭৮ সনের দিকে সেলজুকদের এক প্রাক্তন উজির উমর আবদুল আজিজ বে নিজের তিন হাজার মানুষের বসতি ও এক হাজারের মতো সৈন্য নিয়ে কোনিয়া থেকে আরতুগ্রুল গাজীর শাসনাধীন সোগুতের ভূমিতে বাসস্থান স্থানান্তর করেন। উমর বে একজন প্রাক্তন সেলজুক উজির হলেও সেলজুক রুম মঙ্গলদের করদরাজ্য হওয়াতে ও কোনিয়াতে মঙ্গলদের ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় তিনি সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে একসময় আনাতোলিয়ার পশ্চিমের এই সীমান্ত ভূমিতে আসার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও আরতুগ্রুল গাজীই তাঁকে সোগুতের ভূমিতে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। উমর বেও আরতুগ্রুলের আনুগত্য মেনে নেন ও নিজের সৈন্যদের নিয়ে আরতুগ্রুলের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীতে উমর বে তার মেয়ে মালহুন হাতুনকে ওসমানের সঙ্গে বিয়ে দিতে আরতুগ্রুল গাজীকে প্রস্তাব দেন। আরতুগ্রুল গাজী ও তার স্ত্রী হালিমা সুলতান উভয়েই এ প্রস্তাবে সাড়া দেন। ফলশ্রুতিতে, ১২৭৮ সনের দিকে ওসমান বে ও মালহুন হাতুনের বিয়ে সংঘটিত হয়। এই বিয়েকে অনেকটা রাজনৈতিক বিবেচনা করা হলেও এ দম্পতি বেশ সুখে শান্তিতে বসবাস করতেন। ১২৭৯ সনের দিকে তাদেরই ঘরে প্রথম সন্তান ওরহানের জন্ম হয়েছিল যিনি পরবর্তীতে ওসমানের সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি হয়েছিলেন।
১২৮০ সনে আরতুগ্রুলের মৃত্যু হয়। যদিও আরতুগ্রুল তার মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে রাখেন যে তার মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠ পুত্র ওসমান কায়ি বসতির বে হবে। পরবর্তীতে আরতুগ্রুলের মৃত্যুর পর কায়ি বসতির নতুন বে নির্বাচনে ওসমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হন তার চাচা দুন্দার বে। ওসমানের বড় ভাই গুন্দুজ বে আরতুগ্রুলের অসিয়ত সম্পর্কে জানত বলেই নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। অন্যদিকে, ওসমানের মেজো ভাই সাভচি বেও কোনিয়া থেকে সোগুতে বসতিতে ফিরে আসেন। তবে সাভচি বে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ফলে নির্বাচনে ওসমান ও দুন্দারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্যান্য বেগণের ভোটে ওসমান জয় লাভ করেন। গুন্দুজ ও সাভচি দুজনেই ওসমানকে ভোট প্রদান করেছিলেন। ফলে, কায়ি গোত্রের নতুন বে হন ওসমান বে।
ওসমান নতুন বে হওয়ার পর নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ওসমান কায়ি গোত্রের প্রধান হয়েই মঙ্গলদের ঝামেলা থেকে রক্ষা পেতে কাস্তামনুর চোবানিদ বেইলিকের প্রধান ইয়াভলাক আরসলানের সঙ্গে চুক্তি করেন। যেহেতু, আরতুগ্রুল কোনো প্রকার করই দিতো না মঙ্গলদের, তাই ওসমানও মঙ্গলদের কর না দিতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এর বড় কারণ ছিল পূর্ব থেকেই চোবানিদ বেরা সেলজুক রুমের ও মঙ্গলদের আনুগত্য করত। এ জন্য ইয়াভলাক আরসলান ও ওসমানের চুক্তির ফলে মঙ্গলদের আক্রমণ থেকে ওসমান কিছুদিনের জন্য মুক্তি পেয়ে যায়। বলে রাখা ভালো যে, চোবানিদ বেইলিকের বেগণও কায়ি গোত্রের সঙ্গেই রক্ত সম্পর্কিত ছিল।
ওসমান যখন কায়ি গোত্রের প্রধান নেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন পূর্ব দিকে সেলজুক রুম সাম্রাজ্য ইলখানিদ সাম্রাজ্যের মঙ্গোল সম্রাটের কাছে পদানত ছিল ও পশ্চিম দিকে ছিল বায়জেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্য। মঙ্গলদের কর না দিলেও, ওসমান তার বাবার মতো সেলজুক রুমকে বার্ষিক কর দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওসমান তার বাবা আরতুগ্রুলের রেখে যাওয়া বসতির ৪০০ সৈন্যকে নিয়ে আরও বড় সৈন্যবাহিনী তৈরি করার স্বপ্ন দেখেন। পাশাপাশি ওসমান তাঁর বাবার রেখে যাওয়া এ সোগুত অঞ্চলে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। এ জন্য ওসমান সোগুত অঞ্চলে আরও তুর্কি গোত্রের আগমন প্রত্যাশা করেন। তাই তিনি আনাতোলিয়ার পূর্ব দিকের সীমান্তে মঙ্গোলদের কাছে বেশ অত্যাচারিত হওয়া কয়েকটি তুর্কি গোত্রকে সোগুতে বাসস্থান গড়তে আমন্ত্রণ জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন পর তিন-চারটি তুর্কি গোত্র সোগুতে আগমন করে। ওসমানও তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেন সোগুতে। নতুন গোত্রগুলোর আগমনের ফলে ওসমান নিজের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধির দিকে জোর দেন।
ওসমান কায়ি গোত্রের প্রধান হওয়ার কিছুদিন পর এক আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখেন, যা ছিল বেশ মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ। এ স্বপ্নে ওসমান দেখেন যে একজন দরবেশের বুক থেকে একটি চাঁদ বের হয়ে ওসমানের বুকের মধ্যে ঢুকে যায় এবং ওসমানের বুক থেকে একটি গাছ বের হয়ে তা বড় হতে থাকে। গাছটির ডালপালা বেশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর গাছের চারপাশ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। ওসমান ঘুম থেকে উঠেই তার শিক্ষক বিখ্যাত সুফি শাইখ এদেবালির কাছে যান এবং তার দেখা এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা চান। শাইখ এদেবালি ওসমানের দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলেন যে এ স্বপ্ন ছিল ওসমানের মাধ্যমে নতুন ইসলামিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত। এ সাম্রাজ্য একসময় বেশ বড় ও দীর্ঘায়িত হবে এবং ওসমানেরই বংশধরেরা এ সাম্রাজ্যের দেখভাল করবে। অনেক ইতিহাসবিদ ওসমানের এ স্বপ্নকে অলৌকিক বলে থাকেন। কোনো কোনো সূত্রে, ওসমানের দেখা এ স্বপ্নকে পবিত্র স্বপ্নও বলা হয়ে থাকে।
এমন অলৌকিক স্বপ্নের পর ওসমানকে শাইখ এদেবালি নিজের মেয়ে বালা হাতুনের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব দেন। ওসমান সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং বালা হাতুনকে বিয়ে করেন। ১২৮১ সনে ওসমান ও বালার এক পুত্রসন্তান আলাউদ্দিন জন্মগ্রহণ করে। আলাউদ্দিনও পরবর্তীকালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রথম উজির হয়েছিলেন। তাই ওসমানের প্রথম স্ত্রী মালহুন হাতুনের পাশাপাশি দ্বিতীয় স্ত্রী বালা হাতুনেরও কায়ি গোত্রের প্রধান হাতুন হিসেবে মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে, ১২৮১ সনে ওসমানের মাতা হালিমা সুলতান মৃত্যুবরণ করেন।
ওসমান নিজের স্বপ্ন দেখা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় বেশ জোর দেয়া শুরু করেন। সোগুতে নতুন বাজার চালু করেন যেখানে তুর্কি, ভিনদেশি ও রোমান বণিকদের জন্য দরজা খুলে দেন। ধীরে ধীরে এভাবেই ওসমানের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। চলবে...
লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়