কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়: পঞ্চম পর্ব
চতুর্থ পর্বের শেষে বলা হয়েছিল, আনাতোলিয়ায় তুর্কিদের বিরুদ্ধে কয়েক মাসের দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ইলখানাতের মোঙ্গল সম্রাট গেয়হাতু পারস্যে ফেরেন। গেয়হাতু প্রথম দিকে এ অভিযানে বেশ সফলতা পেলেও তুর্কিরা ঠিকই তাদের হারানো অঞ্চল যুদ্ধ করে ফিরিয়ে নেয়। গেয়হাতুরও এ অভিযানে বেশ কিছু অর্জন থাকলেও ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল বেশ। ফলে এ অভিযানের ফলাফল একপ্রকার অমীমাংসিত। শুধু ইয়াভলাক আরসলানের বেইলিকের পতন ঘটলেও আর কোনো বেইলিকেরই পতন ঘটেনি। এ অভিযানের পর থেকে ওসমান তাঁর অঞ্চলে মোটামুটি স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন এবং নিজের রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকেন। ইয়াভলাক আরসলানের মৃত্যুতে ওসমানের সঙ্গে থাকা শান্তিচুক্তি ভেঙে গেলেও ওসমান ইয়াভলাকের দুই সন্তান মাহমুদ ও আলি বেকে সাহায্য করতে থাকেন বিভিন্নভাবে।
১২৯৫ সনে ইলখানাত সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে, গেয়হাতু বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নিজেই নিহত হন এক যুদ্ধে। তাঁকে হত্যা করে ইলখানাতের সিংহাসনে বসেন বায়দু। যদিও বায়দুকে কয়েক মাস পর হত্যা করে সিংহাসনে বসেন গাজান খান। গাজান খান সিংহাসনে বসার কিছুদিন পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর ইলখানাত সাম্রাজ্যের অধিকাংশ মোঙ্গল সৈন্য, কমান্ডারসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের এমন ধর্মীয় পরিবর্তনে এ সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাস করা পারস্য-তুর্কির মুসলিম জনগণ ও সুফি-শাইখদের অবদান অনেক বেশি। ১২৯৬ সালের দিকে গাজান খানের আদেশে সুলতান মাসুদকে সেলজুক রুমের সিংহাসন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয় সুলতান তৃতীয় আলাউদ্দিন কায়কোবাদকে। সুলতান মাসুদকে সরানোর মূল কারণ ছিল, আনাতোলিয়ায় কয়েকটি তুর্কি রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটায় ওসমানের কায়ী গোত্রের মতো কয়েকটি গোত্রের মঙ্গোল বিরোধিতা এবং তাদের বিদ্রোহ কোনোভাবেই দমন করতে না পারা। সুলতান আলাউদ্দিন বেশ তরুণ ছিলেন। তিনি সিংহাসনে বসে আনাতোলিয়ায় নতুন আবির্ভাব হওয়া তুর্কি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন। ওসমানও সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে শুরু করেন।
১২৯৯ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে রোমান দুর্গ বিলেচিকের জমিদারের পুত্রের সঙ্গে আরেক রোমান দুর্গ ইয়ারহিসারের জমিদারের কন্যার বিবাহের আয়োজন করা হয়। বিয়ের আয়োজন বিলেচিক দুর্গে করা হয়েছিল। ওসমান বেকে বিলেচিক দুর্গের জমিদার এ বিবাহের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। ওসমানও তা সাদর গ্রহণ করেন। মূলত, বেশ কয়েক বছর ধরেই ওসমানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল বলে বিলেচিকের রোমান জমিদারের এ আমন্ত্রণ। তবে বিবাহ অনুষ্ঠানের আগের রাতে ওসমানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু ও হারমানকায়া দুর্গের রোমান জমিদার মিহাইল কোসেস এ বিবাহের অনুষ্ঠানে ওসমানকে যেতে বারণ করেন। মিহাইল কোসেস দাবি করেন, তিনি গোপনে বিলেচিক ও ইয়ারহিসারের জমিদারের ষড়যন্ত্র জেনেছেন। এ ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল, বিবাহের অনুষ্ঠানে ওসমানকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করা। ওসমান বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এ খবরে এবং বিলেচিকের জমিদারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা হওয়ায় বেশ মর্মাহতও হন। ওসমান পরদিন বিবাহের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এক সুন্দর পরিকল্পনা করেন, যার ফলে বিলেচিক দুর্গ তাঁর হাতে এসে পড়ে। বিবাহ অনুষ্ঠানের দিনে ওসমান তাঁর ৪০ জনের মতো কায়ী সৈন্য পাঠান বিলেচিক দুর্গে, যাঁরা বিয়ে উপলক্ষে ওসমানের দেওয়া উপহার নিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে সন্ধ্যাবেলায় ওসমান ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আল্প বিলেচিকে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওসমানের আগেই পাঠানো ৪০ জন সৈন্য দুর্গের রোমান নাইট সৈন্যদের ওপর হামলা করে বসেন। ওসমানের সঙ্গে থাকা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আল্প দেরি না করে দুর্গের ফটকে থাকা নাইটদের হত্যা করেন ও দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দেন। ফলে দুর্গের বাহিরে ছদ্মবেশ নিয়ে থাকা অপেক্ষারত প্রায় ১৫০ কায়ী সৈন্য দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং ৪০০ নাইটের বিরুদ্ধে ওসমানের ২০০ সৈন্যের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ বেশিক্ষণ দীর্ঘায়িত হয়নি, কারণ কায়ী সৈন্যরা একে তো বেশ দক্ষ যোদ্ধা ও সাহসী, ফলে তাঁদের অতর্কিত হামলায় দুর্গের রোমান নাইট সৈন্যরা দ্বিগুণ সংখ্যায় হলেও পরাজয় বরণ করেন। ওসমান বিলেচিকের জমিদারের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ তাঁর শিরোশ্ছেদ করেন। বিলেচিককে ওসমান কায়ী গোত্রের পতাকার অধীনে আনার কিছুক্ষণ পরই পাশেই ইয়ারহিসার দুর্গে তিনি ও তাঁর ২০০ কায়ী সৈন্য অতর্কিত হামলা করে দুর্গের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন। ইয়ারহিসার দুর্গের ৩০০ রোমান সৈন্য প্রতিরোধ গড়তে চাইলেও সাহসী কায়ী সৈন্যদের কাছে তাঁরা পরাজয় বরণ করেন। ফলে ইয়ারহিসার দুর্গও ওসমানের অধীনে এসে পড়ে। এ দুর্গের জমিদারকে ওসমান শাস্তি দেন এবং তাঁর মেয়ে হলোফিরাকে বন্দী করেন। যদিও হলোফিরার সঙ্গে পরে একসময় ওসমানের বড় পুত্র ওরহানের বিয়ে হয়েছিল। বিলেচিক ও ইয়ারহিসার দুর্গের বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে কায়ী সৈন্যরা বন্দী করেন। এভাবে এক রাতের মধ্যেই দুটি রোমান দুর্গের পতন হয় এবং ওসমানের বিজয়ের কথা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে ওসমান কয়েক দিনের মধ্যেই রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের সবচেয়ে বড় দুর্গ ইনেগল আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ইনেগলের জমিদার ছিলেন আয়া নিকোলা। ঐতিহাসিকেরা অধিকাংশই দাবি করেন যে এই নিকোলাই সেই নিকোলা, যাঁকে পরাজিত করে ওসমান কুলুচাহিসার দুর্গ জয় করেছিলেন। আবার কেউ কেউ দাবি করেন যে এই নিকোলা সেই নিকোলা থেকে ভিন্ন। যা–ই হোক, নিকোলার সঙ্গে ওসমানের বেশ শত্রুতা হয়েছিল বলেই ওসমান ইনেগলে অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তিনি ইনেগল দুর্গের চারপাশে নিজের সৈন্যদের নিয়ে অবরোধ গড়ে তোলেন। তিন-চার মাসের অবরোধের পর ওসমান চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এ দুর্গে প্রথমে হামলা করেন ওসমানের বাবা আরতুগ্রুলের সহচর শতবর্ষী তুরগুত বে। ওসমানের বড় ভাই গুন্দুজও এ দুর্গের অভিযানে বড় ভূমিকা রাখেন। চলবে.....
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়