কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়: চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় পর্বের শেষে বলা হয়েছিল, আনাতোলিয়ার তিনটি বেইলিকের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ অভিযান শুরু করে সেলজুক-মোঙ্গল জোটের সৈন্যরা। জার্মিয়ান, কারামানিদ ও এশরেফিদ বেইলিকগুলোর সেনারাও প্রতিরোধ করতে থাকে সুলতান মাসুদের অধীনে থাকা সেলজুক ও মোঙ্গল সেনাদের এ জোটকে। ফলে দীর্ঘদিন এ যুদ্ধ চললেও সেলজুক রুম ও মোঙ্গলরা আহামরি তেমন কোনো ফলও পায়নি। ওসমান ওই সময়ে সুলতান মাসুদের আনুগত্য করলেও মোঙ্গলদের কর না দেওয়াই ওসমানের জন্য একসময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ওসমানের বিরুদ্ধেও অভিযান করতে সুলতান মাসুদ প্রায় ৫-৬ হাজার সেলজুক-মোঙ্গল সৈন্য নিয়ে সোগুতের উদ্দেশে রওনা হন। ওসমানও নীরবতা ভেঙে তার নিজের গোত্রের ও তার অধীনে থাকা গোত্রগুলোর সমন্বয়ে প্রায় তিন হাজার সৈন্য নিয়ে সুলতান মাসুদের আক্রমণ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকেন। ফলে ১২৮৯ সন থেকে ওসমানকে সেলজুক ও মোঙ্গল সৈন্যদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধ করতে হয়। যার ফলে মোঙ্গলদের পাশাপাশি সুলতান মাসুদের সাথেও ওসমানের শত্রুতার সৃষ্টি হয়। তবে মঙ্গল ও সেলজুক জোটের আক্রমণ থেকে ওসমান নিজের অঞ্চলের বসতিগুলো, দুর্গগুলো ও সোগুত শহরকে বেশ সতর্কতার সাথে রক্ষা করেছিলেন। ওসমানের সাথে শত্রুতা চলতে থাকায় ওসমান সেলজুক রুমকেও কর দেয়া বন্ধ করে দেন এবং, কিছুটা স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালাতে থাকেন নিজের অঞ্চলে। এভাবে ১২৯১ সন পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে।
ফলে, মোঙ্গল গভর্নর গেয়হাতুর সাথে জার্মিয়ান, কারামানিদ, এশরেফিদের মতো ওসমানেরও বিরোধ সৃষ্টি হয়। তবে এখানে ওসমানের সাথে চুক্তিতে থাকা চোবানিদ বে ইয়াভলাক আরসলান নীরব ভূমিকা পালন করছিলেন। ১২৯১ সনের দিকে পারস্যের ইলখানাত সাম্রাজ্যের মোঙ্গল সম্রাট আরগুন খান মৃত্যুবরণ করলে তার ছোট ভাই গেয়হাতু ইলখানাতের সিংহাসনে বসেন। গেয়হাতু আনাতোলিয়াতে এক বছর পর ১২৯২ সনে প্রায় ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে আনাতোলিয়ায় অভিযান চালান। মোঙ্গলদের এ সৈন্যবহরে ৫-৬ হাজার সেলজুক রুম সৈন্যও ছিল।
মূলত, সেলজুক রুম মোঙ্গলদের করদরাজ্য হওয়াতেই তাদের ক্ষমতা বেশ কমে গিয়েছিল। তুর্কীদের বিরুদ্ধে অভিযানেও মোঙ্গলদেরকে সমর্থন করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। গেয়হাতু আনাতোলিয়ার গভর্নর থাকাকালীন সময়ে তুর্কী গোত্রগুলির সাথে তার বেশ বিরোধ হয়েছিল বলেই সিংহাসনে বসেই আনাতোলিয়ায় তার এমন আগ্রাসন। গেয়হাতুর এ অভিযানের প্রথম দিকে কারামানিদ ও এশরেফিদ বেইলিকের অঞ্চলসমূহ লন্ডভন্ড করে ফেলা হয়। এ সময় মেন্তেশে অঞ্চলে থাকা তুর্কীদের ওপরও আক্রমণ করা হয়। গেয়হাতু এসব অঞ্চলে বেশ লুটপাট চালায় তার সেনাবাহিনী নিয়ে। এ সময় কয়েক হাজার নারী-শিশুকে পাচার করে কোনিয়ায় পাঠানো হয়। তবে গেয়হাতু তার সেনাবাহিনীর এক অংশ নিয়ে কায়সারি অঞ্চলে অভিযান করতে গেলে কারামানিদ ও এশরেফিদ বেইলিকের সৈন্যরা পুনরায় তাদের অঞ্চলে মোতায়েন থাকা মোঙ্গল সৈন্যদের আক্রমণ করে ও নিজেদের বেইলিকের অঞ্চলগুলো মোঙ্গলদের থেকে দখলমুক্ত করে। কারামানিদ ও এশরেফিদ উভয় বেইলিকের আমিরেরা জোট হয়ে কোনিয়ায় আক্রমণ চালান। তবে তারা কয়েক দিনের মধ্যে কোনিয়া থেকে তাদের সৈন্যদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হন কারণ সাইপ্রাসের রাজা হেনরি মোঙ্গলদের সহায়তা করতে ১৫টি জাহাজ নিয়ে আগমন করেন এবং পাশের অঞ্চল আলাইয়ে আক্রমণ করেন। এ রকম যুদ্ধের সময়ে ওসমানও বেশ সতর্ক ছিলেন নিজের অঞ্চলে থাকা সৈন্যদের নিয়ে কারণ যেকোনো সময়ে গেয়হাতু আক্রমণ করতে পারত।
সুলতান মাসুদ হঠাৎ খবর পান, তাঁর ভাই কিলিজ আরসলান মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন এবং তিনি কাস্তামনুতে চোবান বেইলিকের ইয়াভলাক আরসলানের কাছে গেছেন। সেখানে কিলিজ আরসলান ইয়াভলাকের সহায়তায় বড় এক তুর্কি সৈন্যবাহিনী গঠন করছিলেন। এ খবর শুনে সুলতান মাসুদ রাগান্বিত হয়ে কাস্তামনুর উদ্দেশে রওনা হন প্রায় চার হাজার সৈন্য নিয়ে। অতঃপর কাস্তামনুতে ইয়াভলাক আরসলানের প্রায় দুই-আড়াই হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধ হয় সুলতান মাসুদের সৈন্যদের। বেশি সৈন্য থাকার পরও সুলতান মাসুদের বাহিনী পরাজয় বরণ করে এবং তাকে আটক করেন ইয়াভলাক আরসলান। এ খবর তখন দেনিজেলি শহরে লুট করতে থাকা মোঙ্গল সম্রাট গেয়হাতুর কাছে পৌঁছালে তিনি বেশ রাগান্বিত হন। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও অনুগত চোবানিদ বে ইয়াভলাক আরসলান এভাবে বিদ্রোহ করবে অন্য তুর্কিদের মতো, সেটা গেয়হাতু কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। পরে, গেয়হাতু ৩ হাজার মোঙ্গল সৈন্য পাঠান কাস্তামনুতে। তাদের সঙ্গে সেলজুক রুমের কমান্ডার শামসুদ্দিন জান্দারের অধীনে থাকা ২ হাজার সেলজুক সৈন্যও ছিল। এ সম্মিলিত বাহিনী কাস্তামনুতে গিয়ে অভিযান করে। ইয়াভলাক নিজের ২ হাজার সৈন্য নিয়ে বেশ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করলেও পরাজিত হন ও নিহত হন। সুলতান মাসুদকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয় এবং সুলতান মাসুদ পুরস্কারস্বরূপ শামসুদ্দিন জান্দারকে কাস্তামনুর বে হিসেবে নিয়োগ দেন। শামসুদ্দিন জান্দার সেলজুক রুম ও মোঙ্গলদের ছত্রচ্ছায়ায় নিজের বেইলিক প্রতিষ্ঠার অনুমতিও পেয়ে যায়। জান্দার বেকে কাস্তামনু অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়ে সুলতান মাসুদ কোনিয়ায় ফিরে যান।
কথিত আছে, এ অভিযানের পরই কাস্তামনুর পাশেই ওসমানের সোগুত অঞ্চলের উদ্দেশে মোঙ্গল সৈন্যরা গমন করে। মূলত ইয়াভলাকের মিত্র ছিল বলে ওসমানের অঞ্চল সোগুতে আক্রমণ চালাতে এসেছিল মোঙ্গলরা। তবে ওসমান প্রথম থেকে বেশ সতর্ক ছিল বলে মোঙ্গলদের তিন হাজার সৈন্যের বিপক্ষে তুলনামূলকভাবে কম সৈন্য নিয়েও ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ওসমান। ফলে মোঙ্গলরা পিছু হটে এবং কোনিয়ায় ফিরে যায়। কিছুদিন পর গেয়হাতু পারস্যে ফিরে গেলে আনাতোলিয়ার যুদ্ধাবস্থা কেটে যায় এবং কিছুদিনের জন্য শান্তি ফিরে আসে আনাতোলিয়ায়। চলবে...
*(স্বদেশকে ভালোবেসে জুলুমের প্রতিবাদ করা ও জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হলো বীর ওসমান গাজীর আদর্শ। তাই ওসমানের আদর্শের মতো জুলাই–আগস্টের বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার প্রতি অন্তর থেকে ভালোবাসা রইল।)
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
**নাগরিক সংবাদে, ভিডিও ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]