ঐতিহাসিক মুভি-সিরিজ দেখছি, প্রকৃত ইতিহাস কি জানতে পারছি: ষষ্ঠ পর্ব

পঞ্চম পর্বের শেষে বলা হয়েছিল, কায়কাউস গোল্ডেন হর্ডে পালিয়ে যায় আর সেখানে মৃত্যু পর্যন্ত নির্বাসনে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কায়কাউসের এভাবে নির্বাসনে পালিয়ে যাওয়া ও মঙ্গলদের পুতুল হওয়া সেলজুক সুলতানের বিরুদ্ধে আনাতোলিয়ার পশ্চিমের জনগণ খুব ক্রোধে ফেটে পড়ে। আনাতোলিয়ায় মঙ্গলদের উৎপাত পুনরায় বেড়ে যাওয়াও এর অন্যতম বড় কারণ ছিল। বিশেষ করে আরতুগ্রুল বে–এর অধীনে থাকা বে’রা ও আশপাশের গোত্রের নেতারা এবং কিছু সেলজুক বিদ্রোহী কমান্ডাররা মঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়েন। তা ছাড়া মঙ্গলদের আর আনাতোলিয়ার পশ্চিমের এসব ভূমিতে না প্রবেশ করতে দেওয়াও মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন গোল্ডেন হর্ডের মুসলিম মঙ্গল সম্রাট বেরকে খান। তিনি প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও স্বর্ণমুদ্রা পাঠিয়ে আরতুগ্রুল ও অন্যান্য গোত্রগুলোর বে’দেরকে বিদ্রোহ করতে উসকে দিতে থাকেন। আরতুগ্রুলও মঙ্গলদের থেকে রেহাই পেতে আর পথ না পেয়ে যুদ্ধের বিকল্প দেখেন না। ফলে ১২৬৫ সালের দিকে আনাতোলিয়ার পশ্চিমের সীমান্ত ভূমির ১০টির মতো গোত্রের সৈন্য ও কিছু সেলজুক বিদ্রোহীরা মিলে কোনিয়ার পথে রওনা হন প্রায় দুই-তিন হাজার সৈন্য নিয়ে। এসব সৈন্যদের নেতৃত্বে ছিলেন পশ্চিম সীমান্তের তুর্কিদের নেতা আরতুগ্রুল বে নিজেই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই কোনিয়ার প্রান্তরে ভয়ংকর যুদ্ধে মুখোমুখি হয় আরতুগ্রুলের অধীনে থাকা দুই-তিন হাজার সৈন্য ও ছয়-সাত হাজার মঙ্গল সৈন্য। এ যুদ্ধে বেশি সৈন্য নিয়েও মঙ্গলরা একপ্রকার কচুকাটা হয়েছিল আরতুগ্রুল ও তাঁর অধীনে থাকা বে’দের সৈন্যদের হাতে। যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যেতে থাকেন মঙ্গল সৈন্যরা। তবে এ যুদ্ধে কোনোরকমের নাক গলায়নি সেলজুক রোমের সুলতান ও তাঁর অধীন রাজ্যগুলো। ফলে মঙ্গলরা কিছুদিনের জন্য কোনিয়া থেকে পশ্চিম আনাতোলিয়ার ভেতরে আর ঢোকার সাহস করেননি। ষাটোর্ধ্ব আরতুগ্রুল এই বয়সেও মঙ্গলদের যেভাবে বিতাড়িত করেছিলেন, সে কথা পুরো আনাতোলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আরতুগ্রুল গাজী তাই ইতিহাসে বিরাট মঙ্গল বাহিনী পরাজিত করেছিলেন বলেই বেশ সুনাম করেছিলেন। তা ছাড়া ক্রুসেড ও রোমানদেরও বারবার প্রতিহত করায় তাঁর বিখ্যাত গাজী পরিচয় আছেই।

আরও পড়ুন

আনাতোলিয়ায় মঙ্গলদের এমন পরাজয়ের পরপরই গোল্ডেন হর্ডের বেরকে খানের বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধ হয় বাগদাদ জয় করা দুর্ধর্ষ ইলখানাত মঙ্গল সম্রাট হালাকু খানের। উল্লেখ্য, তাঁদের উভয়েরই ৩০ হাজারের মতো সৈন্য ছিল। সেই যুদ্ধে কে জিতেছিলেন, এমন তথ্য সঠিকভাবে ইতিহাসে না থাকলেও জানা যায় যে উভয়ের সেনাবাহিনীরই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে হালাকু খানের বাহিনী বেশ ধ্বংসযজ্ঞের মুখে পড়েছিল এমন তথ্য বেশ কিছু সূত্রে জানা যায়। ফলস্বরূপ বেরকে খান নিজের চাচাতো ভাইকে একপ্রকার পরাজিত করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনটি: একে তো মামলুকদের কাছে হেরে সিরিয়ার অঞ্চল হারিয়ে ফেলে হালাকু খান, পরে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয় আনাতোলিয়াতে আরতুগ্রুলের বিদ্রোহে এবং কয়েক দিন পরেই বেরকে খান সম্মুখ যুদ্ধে হালাকুর বাহিনীকে বেশ ক্ষতিসাধন করে। এভাবেই মুসলিমদের পবিত্র দুই স্থানে হামলা করতে চাওয়া হালাকু খান বেশ শক্তিহীন হয়ে পড়েন। বেরকে ও হালাকুর যুদ্ধ দেখে এমন কথাই ঐতিহাসিকেরা বলে থাকেন, মঙ্গলদের হাতেই মঙ্গলেরা রক্তপাত করলেন। এর কারণ ছিল দুজনই চেংগিস খানের নাতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে হালাকু তাঁর মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া-মিসরের দিকে আগ্রাসন বন্ধ করে দেন। কিছুদিন পর হালাকু অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুন

১২৬৫ সালে ভিন্ন কারণে সেলজুক রুমের সুলতান কিলিজ আরসলানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন মঙ্গলেরা। যদিও এর মূল কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, সুলতান কিলিজ আরসলান মঙ্গলদের বিরুদ্ধে আনাতোলিয়ায় তুর্কিদের বিদ্রোহ দমন করতে পারেননি এবং বিদ্রোহের সময় তিনি চুপ ছিলেন, তাই এ মৃত্যুদণ্ড। মঙ্গলদের ঝামেলা থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও মুক্তি পেয়ে আরতুগ্রুল গাজী নিজের সীমান্ত ভূমিতে ফিরে আসেন। তিনি স্বাধীনভাবে শাসন শুরু করেন সেখানে। তাঁর অধীনে আরও চারটি ক্ষুদ্র গোত্র ছিল বলে কিছু সূত্র বলে থাকে। তাঁর সীমান্ত নেতা সীল থাকাকালীন আরও কয়েকটি গোত্র তাঁর অধীনে থাকলেও কোনো কোনো গোত্র তাঁর অধীনতা থেকে বের হয়ে নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে বসবাস শুরু করে। সোগুত শহরে তুর্কি-রোমানদের পাশাপাশি ভিনদেশি বণিকদেরও আনাগোনা বাড়তে থাকে। আরতুগ্রুল সোগুতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং মুসল্লিদের জন্য অজুখানা নির্মাণ করেন। তিনি সোগুতের আধুনিকীকরণের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং তাঁর অধীনে থাকা দুর্গকেও ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করতে থাকেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে কয়েকজন রোমান দুর্গের জমিদারের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। আরতুগ্রুলের অঞ্চল সোগুত থেকে ডোমানিক পর্যন্ত সীমানা বিস্তৃত ছিল এবং কারাচা দাগ পর্বতকে কেন্দ্র করে সেখান থেকে নিজের অঞ্চলের সীমানা পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতার ছোঁয়া দেন। মঙ্গলদের কর না দিয়ে ও সেলজুকদের থেকে দূরে থেকে নিজের এ ক্ষুদ্র অঞ্চলে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে তাঁর অধীনে থাকা কায়ী বসতি ও অন্যান্য বসতিগুলোর বেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। তাঁর এ ক্ষুদ্র অঞ্চলে তাঁর নিজের কায়ী বসতি, অন্য চারটি বসতি, কারাচাহিসার দুর্গ ও বাণিজ্যিক শহর সোগুত সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের মতো সাধারণ মানুষ বসবাস করতেন। তাঁর এ ক্ষুদ্র অঞ্চলে মুসলমানদের চেয়ে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বেশি ছিল বলে কিছু ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। এর কারণ ছিল রোমানদের দুর্গ ও শহর তিনি জয় করেছিলেন, তাই খ্রিষ্টানদের সংখ্যাই বেশি হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তবে বাস্তব হলেও সত্য ছিল যে তাঁর অধীনে খ্রিষ্টান অধিবাসীরা বেশ শান্তিতে বসবাস করছিলেন। বড় কারণ হিসেবে ছিল যে আরতুগ্রুলের অধীনে খ্রিষ্টান অধিবাসীদের অতিরিক্ত কর দেওয়া লাগত না, যেমনটা আগে রোমানদের দেওয়া লাগত। ফলস্বরূপ এক নবদিগন্তের সূচনা হতে থাকে আরতুগ্রুলের এ ক্ষুদ্র অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। চলবে...

*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন