ঐতিহাসিক মুভি-সিরিজ দেখছি, প্রকৃত ইতিহাস কি জানতে পারছি: চতুর্থ পর্ব

তৃতীয় পর্বের শেষে উল্লেখিত হয়েছিল, আরতুগ্রুল বে উজির সাদেত্তিনের প্রস্তাবে সায় দেননি। সাদেত্তিনও বসে না থেকে সে সময় তিনি সাম্রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এ বলে বোঝান যে তিনি সেলজুকদের রক্ত থেকেই এসেছেন এবং তিনিই সুলতানের সিংহাসনের বড় দাবিদার। এ ভাবে তিনি বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। সেলজুক ভূমিতে আশ্রয় নেওয়া কয়েকটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ তুর্কী গোত্রও তাঁর সঙ্গে জোট বাঁধে। ফলে সাদেত্তিন বিদ্রোহ করে বসেন এবং সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সিংহাসনে বসা নতুন সুলতান গিয়াসউদ্দিনও নিজের বাহিনী পাঠিয়ে এ বিদ্রোহ দমনের আদেশ দেন। ঐতিহাসিকদের মতে, আরতুগ্রুল এ বিদ্রোহ দমনে সুলতানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতে নিজের অধীনে থাকা সীমান্তের বে ও সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে লড়াই করতে আসেন। যদিও সাদেত্তিনের বাহিনী বেশ শক্তিশালী ছিল, সে জন্য এ বিদ্রোহ দমনে সুলতানকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিছুদিন পর এ বিদ্রোহ শেষ হয়, সাদেত্তিন তাঁর বিরাট বাহিনী নিয়ে পরাজিত হন। সাদেত্তিনকে সুলতানের পাঠানো গোপন বাহিনী হত্যা করে এমন কথা প্রচলিত রয়েছে।  

(অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ক্লিপে হয়তো দেখে থাকবেন, আরতুগ্রুল বে শিরশ্ছেদ করেছিলেন সাদেত্তিন কোপেকের, যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই)।

এর আরও বেশ কিছুদিন পর ১২৪৩ সনে মঙ্গলদের ২০ হাজারের মতো একটি সৈন্যবাহিনী সেলজুক রুমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মঙ্গলদের বিখ্যাত কমান্ডার নয়ান বাইজু। সেলজুক রুমের সুলতান গিয়াসউদ্দিনও প্রায় ২৭ হাজারের মতো একটি বিরাট সেলজুক সৈন্যবাহিনী পাঠান। এ সৈন্যবাহিনীতে তুর্কীদের বিভিন্ন গোত্র, জর্জিয়ান কিছু সৈন্য,আরমেনিয়ার শাসকের পাঠানো কিছু সৈন্য ও বাইজেন্টাইন রোমানদের তৃতীয় সাম্রাজ্য ‘ট্রেবজন সাম্রাজ্যের’ কিছু সৈন্য অংশ নেয় সুলতানের পাঠানো কমান্ডারদের অধীনে। যদিও সেলজুকদের সৈন্যসংখ্যা বেশি ছিল, তাও এ যুদ্ধে হেরে যায় সেলজুক বাহিনী নয়ান বাইজুর কৌশলের কারণে।

আরও পড়ুন

তবে এ যুদ্ধে আরতুগ্রুল অংশ নেয়নি বলে নিশ্চিত তথ্য রয়েছে। বরং আরতুগ্রুল পশ্চিম আনাতোলিয়ার সীমান্তে নিজের দায়িত্বে বহাল ছিলেন। উক্ত যুদ্ধ কসদাগের ময়দানে হয়েছিল। এ যুদ্ধে সেলজুকদের হার পরে বেশ প্রভাব ফেলেছিল বলেই এ যুদ্ধ নিয়ে এতো বিশদ আলোচনা হলো। এ যুদ্ধে হারের ফলে সুলতান গিয়াসউদ্দিন নিজেই রাজধানী কোনিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান মঙ্গলদের ভয়ে। মঙ্গলরাও বেশ আগ্রাসন করে সিভাস ও কায়সারি শহরের পাশাপাশি পুরো এরজুরুম দখল করে নেয়। মঙ্গলদের আগ্রাসন বেশ ভয়াবহ ছিল এ সময়। কারণ, মঙ্গলরা লুটের পাশাপাশি নারী-শিশুদেরও টার্গেট করত। যে কারণে মঙ্গলদের আগ্রাসনে ধর্ষণের পাশাপাশি নারী-শিশুদের পাচার বেশ কয়েকবার ইতিহাসে আলোচিত হয়েছে। সুলতান কোনিয়া থেকে পালিয়ে গেলে মঙ্গোলরা কোনিয়া আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। তবে আনাতোলিয়ার পশ্চিম অঞ্চলের আমির জালালুদ্দিন কারাতাই কোনিয়াতে ঢোকার আগেই মঙ্গলদের প্রতিরোধ করেন। মোঙ্গলদের প্রতিরোধের এ লড়াইয়ে আমিরকে সহায়তা করেন স্বয়ং আরতুগ্রুল। আরতুগ্রুলও নিজের অধীনে থাকা সৈন্য ও সীমান্তের কিছু গোত্রের সৈন্য নিয়ে কোনিয়া রক্ষায় লড়াই করেন। ফলে কোনিয়া রক্ষা করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন

তবে বেশি দিন কোনিয়াকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সুলতান গিয়াসউদ্দিনের উজির কিছুদিন পর চুক্তি করে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সঙ্গে। ফলে সেলজুক রুম মোঙ্গলদের করদরাজ্য হয়ে যায়। প্রতিবছর সুলতানকে একটি বাৎসরিক কর দেওয়া লাগবে এমন শান্তি চুক্তি হয়। যদিও অনেক তুর্কী গোত্রের বে এবং সেলজুক কমান্ডার-আমির এটা মেনে নিতে পারেননি। স্বয়ং আরতুগ্রুল বেই মেনে নিতে পারেন নি, তাই তিনি মোঙ্গলদের কর না দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। এ সময় তার সঙ্গে পশ্চিমের সীমান্তের অন্যান্য গোত্রগুলোর কয়েকজন বেও একমত হন। শান্তিচুক্তি যে বেশি দিন কার্যকর থাকবে না সেটা আগেই বোঝা গিয়েছিল। কারণ, কোনিয়াতে প্রাসাদে এসে কর নেওয়ার কথা বলে সুলতানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়েও মোঙ্গলরা নাক গলাতে থাকে। বিপত্তি শুরু হয়, ১২৪৬ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পরই। তাঁর তিনজন পুত্র সন্তান (কায়কাউস, কিলিজ আরসলান, কায়কোবাদ) ছিল। কায়কাউস বড় সন্তান হয়ে সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসলেও মোঙ্গলরা তার বাকি দুই ভাইকেও সুলতান হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে সেলজুক রুমের অঞ্চলগুলো ৩ জন সুলতানের অধীনে বিভক্ত হয়ে যায়। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি বড় ভাই কায়কাউস এবং মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। অন্যদিকে মেজো ভাই কিলিজ আরসলান মঙ্গলদের তোষামোদি করে মঙ্গলদের ওপর আস্থা রাখে। কয়েক বছর পর ১২৫৪ সালে তাদের ছোট ভাই কায়কোবাদের রহস্যজনক মৃত্যু হলে কায়কাউস ও কিলিজ আরসলান উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। এর কারণ ছিল কায়কাউস মঙ্গলদের আধিপত্য মেনে নিতে চায়নি।

আরও পড়ুন

তৎকালীন সময়ে আরতুগ্রুল বে সুলতান কায়কাউসকে সেলজুক রুমের একক সুলতান হিসেবে মেনে নেন এবং তাকে সহায়তা করার ঘোষণা দেন। আরতুগ্রুলের কায়কাউসকে সমর্থনের মূল কারণ ছিল কায়কাউস মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেয়েছিল কোনোপ্রকার কর না দিয়ে এবং আনাতোলিয়াকে মোঙ্গলদের আধিপত্য মুক্ত করতে চেয়েছিল। আরতুগ্রুলও কোনোপ্রকার কর দিতো না মঙ্গলদের। তাই কায়কাউসকে সমর্থন করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। ফলে কায়কাউস তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিদ্রোহ করে বসে। তবে বেশি দিন এ বিদ্রোহ টেকেনি। নয়ান বাইজু নিজে মোঙ্গল সৈন্যদের নিয়ে এ বিদ্রোহ দমন করেন ১২৫৬ সনের দিকে। ফলেতে সুলতান কায়কাউস পালিয়ে যায় এবং বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে মঙ্গলদের তোষামোদি করতে থাকা সুলতান কিলিজ আরসলান সেলজুক রুমের একক সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন। এ ঘটনায় আরতুগ্রুল মোঙ্গলদের আধিপত্যে একটুও খুশি ছিলেন না। চলবে...

*লৈখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন