ঐতিহাসিক মুভি-সিরিজ দেখছি, প্রকৃত ইতিহাস কি জানতে পারছি: তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় পর্বের শেষে...
উল্লিখিত কায়ি গোত্রের বিভক্তির মাধ্যমে আরতুগ্রুলের নেতৃত্বে দেড় হাজারের মতো সাধারণ মানুষ ও চারশ সৈন্য রোমান-সেলজুক সীমান্তে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আনাতোলিয়ার পশ্চিমের এ সীমান্তে যে শুধু কায়ি গোত্রের মানুষই বসতি স্থাপন করেছিলেন এমন নয়, আরও কয়েকটি গোত্রের মানুষও বসতি স্থাপন করেছিলেন মঙ্গলদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে। নতুন ভূমিতে এসে সীমান্তে সুলতানের দেওয়া দায়িত্ব খুব দক্ষভাবে পালন করতে থাকেন আরতুগ্রুল বে। তবে আরতুগ্রুল নতুন ভূমিতে এসে প্রথমে তাঁর বসতি নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছিলেন বলে কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়।
১২৩০ সালে সেলজুক-আইয়ুবিদ ঐক্য জোট বনাম সর্বশেষ খাওয়ারাজমিয়ান সম্রাট জালালউদ্দিনের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আরতুগ্রুল বে ও তাঁর কায়ি সৈন্যরা সেলজুকদের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে সেলজুক-আইয়ুবিদের জয় হয়। এর কিছুদিন পরই ১২৩১ সালে আরতুগ্রুল বে তাঁর সৈন্যদের নিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক শহর থোবাসিয়ান আক্রমণ করে শহর দখল করে নেন। এ শহর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল সীমান্তবর্তী রোমান দুর্গগুলোর জমিদারদের ব্যবসার জন্য হলেও। এমনকি কিছু তুর্কি বণিকেরাও এখানে ব্যবসা করতে আসতেন। থোবাসিয়ান শহর জয় করে আরতুগ্রুল এ শহরের নতুন নামকরণ করেন ‘সোগুত’। এ শহরে বসবাস করা ভিনদেশি বণিকেরা আরতুগ্রুলকে প্রথমে ভয় পেলেও আরতুগ্রুল ওই শহরের পূর্ববর্তী রোমান গভর্নরের আরোপিত করের অর্ধেক কর ধার্য করলে বণিকেরা শান্তিতে ব্যবসা শুরু করেন। তা ছাড়া রোমান দুর্গগুলোর জমিদারদের প্রথমে আরতুগ্রুলের সঙ্গে ব্যবসা করতে না চাইলেও আরতুগ্রুলের প্রদানকৃত সুবিধাগুলো দেখে পুনরায় সোগুতে ব্যবসা চালু করেন। এ জন্য কয়েকজন রোমান জমিদারের সঙ্গে আরতুগ্রুলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তা ছাড়া এ শহর জয়ের পর প্রাপ্ত গনিমতের বেশির ভাগ অংশ তিনি তাঁর বসতির সাধারণ মানুষকে দান করে দেন এবং বাকি অংশ নিজের বসতির আর্থিক দুরবস্থা নিরসনে ব্যবহার করেন। আরতুগ্রুল বে কিছুদিনের মধ্যেই সোগুতে বেশ বড় এক বাজার উদ্বোধন করেন এবং সেখানে তুর্কি, রোমানসহ বিভিন্ন ভিনদেশি বণিকের আনাগোনা বেড়ে যায়। সোগুতে সে সময় দুই হাজারের মতো বণিকের বাস ছিল।
আরতুগ্রুলের তুলনামূলক কম সৈন্য নিয়ে অধিক সংখ্যক শত্রু রোমান সৈন্যদের পরাজিত করে সোগুত জয়ের কথা সীমান্ত ছাপিয়ে সেলজুক সাম্রাজ্যে বেশ ছড়িয়ে পড়ে। সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন খুব সন্তুষ্ট হয়ে আরতুগ্রুলকে পুরস্কার পাঠান। তা ছাড়া আরতুগ্রুলকে সুলতান সেলজুক রোম সাম্রাজ্যের রোমান সীমান্তবর্তী অঞ্চলের প্রধান নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন। অন্যান্য গোত্রগুলোর বে এবং সেলজুক গভর্নর-কমান্ডাররাও আরতুগ্রুলের এমন সাফল্যে ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকেন। এর কিছুদিন পরই ১২৩২ সালে আরতুগ্রুল বে ৩০০ কায়ি সৈন্য নিয়ে হাজারো শত্রু সৈন্যের রোমান দুর্গ কারাচাহিসার আক্রমণ করেন। দুর্গটি রোমানদের সীমান্ত অঞ্চলে অন্যতম বড় দুর্গ ছিল এবং তা সোগুতের বেশ কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। তিন গুণের বেশি শত্রুসৈন্যকে পরাজিত করে আরতুগ্রুল বে এ দুর্গ জয় করে নেন এবং তুর্কিদের জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। এ বিজয়ের ফলে দুর্গে বাস করা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ৪ হাজার সাধারণ মানুষ আরতুগ্রুলের অধীনে এসে পড়েন। আরতুগ্রুল উদারতা দেখান বরাবরের মতো। গনিমতের বেশির ভাগ অংশ তিনি সাধারণ মানুষকে দান করে দেন, কিছু অংশ নিজের বিজয়ী যোদ্ধাদের প্রদান করেন আর বাকিটা বসতির জন্য ব্যয় করেন।
তা ছাড়া কারাচাহিসার দুর্গের জনগণের জন্য আরতুগ্রুল আগের রোমানদের আরোপিত করের অর্ধেক কর ধার্য করেন। ফলে আগের মতো রোমানদের আরোপ করা অতিরিক্ত করের বোঝা না থাকায় দুর্গের সাধারণ খ্রিষ্টান জনগণ সন্তুষ্ট হয়ে শান্তিতে বসবাস শুরু করেন। এভাবে আরতুগ্রুলের উদারতার প্রশংসা সবখানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন এবার আরতুগ্রুলের সাফল্যে খুশি হয়ে তাঁকে আরও কিছু জমি প্রদান করেন। ফলে আরতুগ্রুলের নিজস্ব জমির সীমানা সোগুত থেকে ডোমানিকের পর্বতবেষ্টিত অঞ্চল পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এ সময় সীমান্তের প্রধান নেতা হিসেবে আরতুগ্রুল নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলতে থাকেন। তা ছাড়া কিছু রোমান জমিদারের সঙ্গে কায়ি গোত্রের দ্বন্দ্বও চলতে থাকে। কায়ি সৈন্যরা কমসংখ্যক হলেও নিজেদের দক্ষতার দরুন রোমানদের পরাস্ত করে দিতে পারতেন। তা ছাড়া সে সময় ক্রুসেডারদের ব্যাপক উৎপাতও পরিলক্ষিত ছিল। এ জন্য আরতুগ্রুলকে ক্রুসেডারদেরও মোকাবিলা করতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে আরতুগ্রুল বেশ কিছু ক্ষুদ্র যুদ্ধে জয় করেছিলেন বলেই তাঁর নামের পাশে যুক্ত হয়েছিল ‘গাজি’ উপাধি। মূলত ধর্মযুদ্ধে ইসলামের হয়ে লড়াই করে যাঁরা বিজয়ী হয়ে বেঁচে ফিরেন, তাঁরাই গাজি হয়ে থাকেন। আরতুগ্রুলের এমন সমসাময়িক অবস্থায় কনস্ট্যান্টিনোপোল ছিল ক্রুসেডারদের দখলে এবং রোমানরা নিকিয়াতে তাঁদের রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। তাই রোমান ও ক্রুসেডারদের থেকে তুর্কিদের রক্ষা করতে সেলজুক সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রধান নেতা হয়ে আরতুগ্রুলকে বেশ শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হতো এ অঞ্চল।
কিছুদিন এভাবে যেতেই ১২৩৮ সালের দিকে সেলজুক রোম সাম্রাজ্যে বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে। এর কারণ ছিল সুলতান আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে গিয়াসউদ্দিন কাইখসরু সিংহাসনে বসলে তৎকালীন সেলজুক উজির সাদেত্তিন কোপেক কলকাঠি নাড়তে থাকেন। তিনি দীর্ঘ সময় সাম্রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলের আমির ছিলেন বলে সাম্রাজ্যের উজির হওয়ার পর বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর অনুগত ব্যক্তি থাকায় তাঁর ক্ষমতাও বেশ বেড়ে যায়। সাদেত্তিন আগে থেকেই চেয়েছিলেন, সুলতান আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর সুযোগ বুঝে ষড়যন্ত্র করে মৃত সুলতানের ছেলে যুবক গিয়াসউদ্দিনকে সরিয়ে নিজে সিংহাসনে বসবেন। সাদেত্তিনের মঙ্গলদের সঙ্গে গোপন সম্পর্কের কথাও অনেক ঐতিহাসিক বলে থাকেন। উজির সাদেত্তিন সাম্রাজ্যের কয়েকজন আমির, কমান্ডার ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্বর্ণমুদ্রাসহ বিভিন্ন উপহার পাঠিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন। কয়েকটি গোত্রের প্রধানকে উপহার পাঠিয়ে তিনি নিজের অনুগত করতে পারলেও আরতুগ্রুল তাতে সায় দেননি। চলবে...
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]