ঐতিহাসিক মুভি-সিরিজ দেখি ঠিকই, প্রকৃত ইতিহাস কি জানতে পারছি–১
বাংলাদেশের সিনেমা-সিরিজ পছন্দ করেন এমন মানুষদের মধ্যে বেশ কমই থাকবেন, যাঁরা আরতুগ্রুল গাজীর নাম শোনেননি। কারণ, সবচেয়ে বেশি ভিউ নিয়ে গিনেস ওয়ার্ড রেকর্ডসে ইতিহাস করা ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ সিরিজটি সুদূর তুর্কিয়ে (তুরস্ক) দেশটি ছাপিয়ে যেভাবে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই ঢেউ বাংলাদেশের অসংখ্য সিনেমা-সিরিজপ্রেমীকেও রাঙিয়ে দিয়েছে। আগেই বলে রাখা ভালো যে উক্ত সিরিজ নিয়ে আমার কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ নেই। উক্ত সিরিজের পরিচালকেরা যেভাবে বেশ সুস্থ বিনোদন দিয়ে একটি ইসলামিক সাম্রাজ্যের বীজ বপনকারী ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে তারা প্রকৃত ইতিহাস সব সময় দেখায়নি। বরং দর্শকদের আকর্ষণ করতে তারা বিভিন্ন কাল্পনিক দৃশ্য দিয়ে কাহিনিকে আরও রম্য করে তুলেছে। এটা যদিও স্বাভাবিক, সিনেমা-সিরিয়ালের পরিচালকেরা এসব করেই থাকে, নিজেদের কাজকে দর্শকদের নিকট আকর্ষণীয় করতে। তবে ইতিহাসই বিকৃত হওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব, বিখ্যাত এই ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরাটা বেশ প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি।
অবশ্য বলে রাখা ভালো, এই সিরিজের স্ক্রিপ্ট রাইটার নিজেই বলেছিলেন, আরতুগ্রুল গাজীর ইতিহাস তিনি খুঁজতে গিয়ে পেয়েছিলেন মাত্র দেড় পৃষ্ঠার তথ্য। এ কারণেই অনেক কাল্পনিক চরিত্রের সমারোহ তো ঘটেছেই, সঙ্গে রচিত হয়েছে কিছু বিকৃত ইতিহাসও। যাই হোক, প্রয়োজকের দেড় পৃষ্ঠার ইতিহাসের কথা যে অসত্য, এমনও নয়। তাইতো কিছু সূত্র ধরে বেশ গভীরে গিয়ে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজতে হয়েছে আমারও। মূল কথা, সিরিজের প্রযোজকেরাও বেশি গভীরের ইতিহাসে আপনাদের না নিয়ে গেলেও আপনাদের আমি সেই গভীরতায় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় কমতি রাখছি না। বলা বাহুল্য, আরতুগ্রুল গাজীর প্রকৃত ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু সূত্র ধরে আরতুগ্রুলের সমসাময়িক কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা ও কিছু ঘটনাও তুলে ধরেছি যাতে সবাই সেসময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সুনিপুণরূপে উপলব্ধি করতে পারেন। শুরু করছি ...
আরতুগ্রুল গাজী কায়ি গোত্রে জন্ম নিয়েছিলেন ১১৯৯ সনে। কায়ি গোত্র হচ্ছে অঘুজ তুর্কীর ২৪টি গোত্রের অন্যতম গোত্র। তবে কায়ি গোত্রের খ্যাতি যেমন ছিল বটে, তেমনি অন্যতম বৃহৎ গোত্রগুলোর একটি ছিল কায়ি গোত্র। আরতুগ্রুলের পিতা ছিলেন সুলেইমান শাহ ও মাতা ছিলেন হায়মে হাতুন। প্রসিদ্ধ তথ্যমতে, কায়ি ও অন্যান্য গোত্রগুলি মূলত ক্যাস্পিয়ান সাগরের তীরে যাযাবরের মতো জীবন যাপন করতো। সুলেইমান শাহ ১২১৪ সনে কায়ি গোত্রের প্রধান থাকার সময়ে তৎকালীন সেলজুক রোমের সুলতানের অনুমতিক্রমে নিজ গোত্রকে সেলজুক ভূমি আহলাতে স্থানান্তর করেন। তাছাড়া কায়ি ছাড়াও অন্যান্য গোত্রগুলো থেকেও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সুলতানের অনুমতি নিয়ে সেলজুক রোমের সীমান্ত ভূমিগুলোতে বসবাস শুরু করে।
তৎকালীন সময়ে আরতুগ্রুল গাজীর নামের হাঁকডাক শুরু হয় তার উঠতি বয়সে বীরত্বের স্মৃতি দিয়ে। কথিত রীতি অনুযায়ী, ১২২৪ সনে দুর্ধর্ষ মঙ্গোল সম্রাট চেঙ্গিস খান ১০ হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন তৎকালীন সেলজুক রোমের সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদকে আক্রমণ করতে। সে সময় সুলতান সীমান্ত ভূমিতে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে মহড়া দিচ্ছিলেন। আগেই বলে রাখি, চেঙ্গিস খান পৃথিবীর বিখ্যাত বিজেতাদের শীর্ষ নামগুলোর মধ্যে থাকলেও তিনি মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোকে ধূলিসাৎ করতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাইতো দেড় শ বছরের খ্যাতিমান ও অন্যতম বৃহৎ মুসলিম খাওয়ারাজমিয়ান সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে চেঙ্গিস খান নজর দেয় সেলজুক রোমের দিকে। এরই পদক্ষেপ হিসেবে ১০ হাজার মোঙ্গল সৈন্যের একটি বহর আনাতোলিয়ার সেলজুক ভূমির দিকে অগ্রসর হয়। ফলে সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন এ শত্রু সৈন্যবহরের মুখোমুখি হয়। শত্রুসৈন্যসংখ্যার সমসংখ্যক সৈন্য না থাকায় সুলতান যুদ্ধের আগেই ভয় পেয়ে যান। যুদ্ধ শুরু হলে তৎকালীন বিশ্বে বেশ দক্ষ ও শক্তিশালী মোঙ্গল সৈন্যরা সেলজুক সৈন্যদের প্রথম দিকেই খুব বিপর্যস্ত করে ফেলে। অবস্থা উপলব্ধি করে সুলতান পরাজয়ের ভয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর পথ খুঁজছিলেন।
অন্যদিকে, সুলতানের ওপর মোঙ্গলদের এরকম অতর্কিত আক্রমণের পূর্বাভাস কায়ি গোত্র প্রধান সুলেইমান শাহ আগে থেকেই জানতেন। কারণ, সেলজুক সীমান্ত ভূমিগুলোতে মোঙ্গলদের উৎপাত বেশ বেড়ে গিয়েছিল খাওয়ারাজমিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে। তাই তিনি নিজের গোত্রের সৈন্যদের প্রস্তুত করছিলেন মোঙ্গলদের প্রতিহত করতে। সুলতানের ওপর আক্রমণ হয়েছে শুনেই নিজের সন্তান আরতুগ্রুলকে তিনি যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দেন কিছু সৈন্যসহ। আরতুগ্রুল নিজের সঙ্গীদের ও গোত্রের প্রায় ৫০০ জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যান। ময়দানে গিয়ে আরতুগ্রুল একটু দ্বিধায় পড়ে যান, কারণ সেলজুক ও মোঙ্গল উভয় সৈন্যদের পোশাক কিছুটা একই রকমের ছিল। তবে আরতুগ্রুল একটু চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে যুদ্ধের যে দল দুর্বল হয়ে পড়েছে সেই দলের পক্ষেই লড়াই করতে মনস্থির করেন। মূলত, ঐতিহাসিকেরা এ ঘটনাকে দিয়ে আরতুগ্রুলের তরুণ বয়সেই বিচক্ষণতা ও অসহায়ের প্রতি দয়ার যে দৃষ্টান্ত, সেটাকে আরতুগ্রুলের বেশ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়া কাকতালীয়ভাবে আরতুগ্রুল সেলজুক বাহিনীর পক্ষেই চলে গিয়েছিল সেটাও খুব আশ্চর্যজনক ছিল। আরতুগ্রুল তার ৫০০ জনের বাহিনী নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঢুকেই বেশ বীরত্ব দেখাতে থাকেন ও মোঙ্গলদের পরাস্ত করতে থাকেন। প্রায় হেরেই বসা সেলজুকরা যেন মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে আরতুগ্রুলের বাহিনীর আগ্রাসন দেখে উৎসাহিত হয়ে বিজয়ের লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর সুলেইমান শাহ আরও ১ হাজারের মতো কায়ি সৈন্য নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে সেলজুকদের পক্ষে। সুলতান আলাউদ্দিন যেন নিজের চোখে স্বপ্ন দেখছিলেন, এর কারণ মোঙ্গলদের কাছে যেখানে পরাজয় অপেক্ষা করছিল, সেখানে মোঙ্গল বাহিনী নিজেরাই হঠাৎ এক তুর্কী গোত্রের সৈন্যদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধে হেরে যাওয়া অনিবার্য বুঝে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট মোঙ্গল সৈন্যরা পালিয়ে যেতে থাকেন। আরতুগ্রুলের বীরত্বগাথা এভাবেই শুরু হয়। চলবে...
লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়