ঐতিহাসিক মুভি-সিরিজ দেখছি, প্রকৃত ইতিহাস কি জানতে পারছি: পঞ্চম পর্ব
চতুর্থ পর্বের শেষে উল্লিখিত হয়েছিল যে সেলজুক রোমের সিংহাসন নিয়ে মঙ্গলদের আধিপত্যে আরতুগ্রুল একটুও খুশি ছিলেন না। তার শেষ আশা ছিল সুলতান কায়কাউস কিন্তু সেও পালিয়েছিল নিকিয়ার বাইজেন্টাইনদের কাছে। আরতুগ্রুল ক্রুসেডার ও রোমান প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে হঠাৎ যে যুদ্ধ করছিল তা যেমন সম্পূর্ণরূপে শেষও হচ্ছিল না, তেমনি সীমান্তবর্তী কয়েকটি রোমান দুর্গের জমিদারদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক হয়েছিল আরতুগ্রুলের।
এমন সময় সুলতান কিলিজ আরসলান এককভাবে ঘোষিত সুলতান হলে মঙ্গোলরা করের বোঝা আরও চাপিয়ে দেয়। সুলতান কিলিজ আরসলান নিজেই মঙ্গোলদের তোষামোদি বেশ করায় মঙ্গোলরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকে। তারা ছোট ছোট সৈন্যদল পাঠিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা গোত্রগুলোর তুর্কী বে, সেলজুক গভর্নরেরা এবং সেসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের অত্যাচার করতে থাকে। হত্যা-রাহাজানিও বাদ যাচ্ছিল না। সেলজুক কমান্ডার ও গভর্নরেরা অপারগ ছিলেন কারণ সেলজুক রোমের রাজধানী কোনিয়ার প্রাসাদই মঙ্গোলদের দখলে চলে গিয়েছিল।
আরতুগ্রুলের আনাতোলিয়ার পশ্চিমে রোমান সীমান্তে বসতি স্থাপনের তিন দশকেও সেই অঞ্চলে কখনো মঙ্গলরা না আসলেও ১২৫৮ সনের পর থেকে এসব অঞ্চলেও মঙ্গলদের উৎপাত বেড়ে উঠে। এর বড় কারণ ছিল একে তো সুলতান কিলিজ আরসলান মঙ্গলদের হাতের পুতুল ছিল আর অন্যদিকে ১২৫৮ সনে মঙ্গল বিজেতা চেংগিস খানের নাতি হালাকু খানের বাগদাদ জয়। হালাকু খানের বাগদাদ দখলকে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক মানবহত্যা বলেও মনে করা হয়।
কথিত আছে যে হালাকু খান বাগদাদে এসে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এ সময় নারীদের মঙ্গল সৈন্যরা ব্যাপকহারে ধর্ষণ করেছিল। তা ছাড়া নারী-শিশু পাচার তো আছেই। ৬-৭ বছর বয়সী শিশুদের পাচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন এসব শিশুদের তাদের অতীত শৈশবের স্মৃতি ভুলিয়ে মঙ্গল সৈন্য হিসেবে বড় করে তোলা এবং এক প্রকার ব্রেইনওয়াশ করে তাদের নিজেদের মা–বাবা, বংশের কথা ভুলিয়ে দেওয়া। ফলে এসব বাচ্চারা ইসলাম ধর্মের চেতনাও ভুলে যেত। মঙ্গলরা এমনটা তুর্কী বাচ্চাদের সঙ্গেও করে থাকত ঐ সময়ে।
এখন অনেকেই অজানা থেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে চেংগিস খান তো মুসলিম ছিলেন। ব্যাপারটা একেবারেই ভুল, খান নাম আছে বলেই তিনি যে মুসলিম ছিলেন এমন নয়। চেংগিস খান ছিলেন টেংরি ধর্মের অনুসারী। তৎকালীন পুরো মঙ্গোল জাতিই একই ধর্মের অনুসারী ছিল। তাই তার বংশের ছেলে-নাতিরাও একই ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। এ ছাড়া চেংগিস খানের মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানগুলোই প্রমাণ করে তার অন্ধ ইসলাম বিরোধীতার কথা। তাই বাগদাদ দখল করা তার নাতি হালাকু খান নিজেই ইসলামকে কটাক্ষ করেছিলেন এবং ইসলামের পুণ্যভূমি মক্কা-মদিনাও আক্রমণ করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন।
তবে হালাকু খানের এমন উদ্দেশ্যে বিপত্তি ঘটান তারই চাচাতো ভাই বেরকে খান। হালাকু খানের তৎকালীন সময়ে গোল্ডেন হর্ডের সম্রাট ছিলেন বেরকে খান। হালাকু খান বাগদাদ দখলের পর পুরো পারস্য তার দখলে চলে আসে। তাছাড়া আনাতোলিয়ার সেলজুকরা তো আগেই তাদের কাছে পদানত হওয়া। ফলে মঙ্গোলদের ইলখানাত নামক সাম্রাজ্য গঠিত হয়ে যায় পারস্য-আনাতোলিয়া-উজবেক ভূমিগুলো নিয়ে। অন্যদিকে রাশিয়ার ক্রিমিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল মঙ্গোলদের গোল্ডেন হর্ড সাম্রাজ্য। মূলত চেংগিস খানের পুত্র ওগেদেই খানের মৃত্যুর পরই বিরাট মঙ্গোল সাম্রাজ্য চারটি ভাগ হয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য গোল্ডেন হর্ড এবং ইলখানাত অন্যতম।
বেরকে খান একজন মঙ্গোল হলেও তিনি ১২৫২ সনে মুসলিম হন। পরে তিনি সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আসীন হওয়ার পর তার গোল্ডেন হর্ড সাম্রাজ্যে মুসলিমদের সংখ্যা অনেক বাড়তে থাকে এবং তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশ কমান্ডার ও সৈন্যরা মুসলিম হয়ে যান। হালাকু খানের ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের জন্য বেরকে খান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তৎকালীন মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যের সুলতানের সঙ্গে জোট করেন। মামলুকদের ভূমি সিরিয়ার কিছু অংশ মঙ্গোলরা দখলে নিলে ১২৬০ সনে আইন জালুতের প্রান্তরে ১৫০০০ মামলুক সৈন্যের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ হয় হালাকু খানের পাঠানো ২০ হাজার মঙ্গোল সৈন্যের। এ যুদ্ধে মামলুকদের কাছে মঙ্গোলরা পরাজিত হলে হালাকু খানের মিশর ও সিরিয়ায় আগ্রাসন বন্ধ হয়ে যায়। মামলুকেরাও তাদের হারানো অঞ্চল ফিরে পায়।
মূলত হালাকু খানের আগ্রাসনের প্রশ্রয় ও সেলজুক সুলতানের কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকাতেই মঙ্গলদের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল সেই সময়ে। আরতুগ্রুলও সেলজুকদের মঙ্গোলদের নিকট পদানতের পর থেকে সীমান্তের প্রধান নেতা হয়েও একে তো মঙ্গোলদের কর দেননি, তেমনি সেলজুকদের প্রতি তার আনুগত্যও কমতে থাকে। আরতুগ্রুল বুঝতে পারেন, সেলজুকদের অধীনে থাকলে মঙ্গোলদের খাদ্য হতে হবে এ অঞ্চলে থাকা তুর্কীদের। তাই তিনি সীমান্তের নেতা হিসেবে নিজের অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসন করতে থাকেন। তার সঙ্গে একমত হয়ে তার অধীনে থাকা অধিকাংশ তুর্কী গোত্রগুলোর বে'রাও মঙ্গলদের যেমন কর দেননি তেমনি আরতুগ্রুলের স্বাধীনভাবে শাসনকেও মেনে নেন।
মঙ্গোলরাও এসব অঞ্চলে উৎপাত শুরু করলে আরতুগ্রুল নিজের ৪০০-৫০০ সৈন্য নিয়ে হলেও তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৈন্যদলগুলোকে এসব অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেন। যদিও মঙ্গলদের এসব ক্ষুদ্র দলগুলো আরতুগ্রুলের কায়ি সৈন্যবাহিনীরও তিন-চারগুণ সৈন্য বহন করত। এখানেই আরতুগ্রুলের মাহাত্ম্য দেখা যায় যে অপেক্ষাকৃত ২-৩ গুণ কম সৈন্য নিয়েও শত্রুদের দক্ষ হাতে মোকাবিলা করে নিজের গোত্র ও সীমান্তে থাকা অন্যান্য গোত্রগুলোর তুর্কীদের তিনি রক্ষা করতেন।
১২৬০ সনের দিকে কায়কাউস ফিরে এলে তার সমর্থকেরাও তার সঙ্গে যোগ দিয়ে আবার বিদ্রোহ শুরু করে। সুলতানের সিংহাসনে থাকা তার ভাই কিলিজ আরসলানের বাহিনী ও তার বাহিনীর বেশ কয়েকবার গৃহযুদ্ধ হয়। আরতুগ্রুল এবার পরোক্ষভাবে কায়কাউসকে সমর্থন দেয়। তবে কায়কাউস গৃহযুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ১২৬২ সনে বেরকে খানের গোল্ডেন হর্ডে পালিয়ে যায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই নির্বাসনে ছিলেন। চলবে......
লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়