ঐতিহাসিক মুভি-সিরিজ দেখছি, প্রকৃত ইতিহাস কি জানতে পারছি: দ্বিতীয় পর্ব
প্রথম পর্বে উল্লিখিত মঙ্গল-সেলজুকদের যুদ্ধে আরতুগ্রুলের বীরত্বগাথা রচিত হওয়ার মাধ্যমে সেলজুকদের জয় হয়েছিল। পাশাপাশি সেলজুকদেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এ যুদ্ধে কায়িদের কল্যাণে বিজয় অর্জিত হওয়ায় সুলতান আলাউদ্দিন তখন সুলেমান শাহ ও আরতুগ্রুল উভয়ের ওপরই বেশ সন্তুষ্ট হন। এমন বীরত্বের জন্য তাদের উভয়ের পাশাপাশি পুরো কায়ি সৈন্যবাহিনীকে তিনি পুরস্কৃত করেন। কথিত রীতি অনুযায়ী, এভাবেই যুবক আরতুগ্রুলের নামডাক বেশ ছড়িয়ে পড়ে। আরতুগ্রুলের এমন বীরত্ব ও তার পিতা সুলেইমান শাহের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে সুলতান আলাউদ্দিন কায়ি গোত্রকে আনাতোলিয়ার এরজুরুম মতান্তরে এরজিনচান নামক সেলজুক সীমান্তের কিছুদিনের জন্য বসবাসের অনুমতি দেন। তাছাড়া সুলেমান শাহকে সেলজুক রোম সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ভূষিত করা হয়। সুলতান আলাউদ্দিন কায়ি গোত্রকে নতুন জায়গায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে ছোট ছোট মোঙ্গল সৈন্যদল সীমান্ত ভূমিতে আক্রমণ করলে অন্যান্য গোত্রগুলোর পাশাপাশি কায়ি গোত্রও তাদের শক্তিশালী সৈন্যদের নিয়ে মঙ্গলদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারে। কায়ি গোত্র এরজুরুমে স্থানান্তরিত হলে মঙ্গলদের সাথে বেশ কয়েকবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কথা কয়েকটি ঐতিহাসিক সূত্র দাবি করে। পাশাপাশি মঙ্গলদের আক্রমণে কায়ি গোত্রের কিছু ক্ষতিসাধন হওয়ার কথাও জানা গেছে।
আরতুগ্রুল তার গোত্রের সাথে নতুন স্থানে যাওয়ার পূর্বেই বা পরে একসময়ে বিয়ে করেন। তার সাথে বিয়ে হয় হালিমা সুলতান তথা হালিমা হাতুনের। হালিমা সুলতান সেলজুক রাজকন্যা। পিতা সুলতান আলাউদ্দিনের ভাই তথা একজন সেলজুক শাহজাদা ছিলেন। (কয়েকটি সূত্র আবার বলে, হালিমা সুলতান আলাউদ্দিনের কন্যা)। অধিকাংশ ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, হালিমা সুলতানের সঙ্গে আরতুগ্রুলের বিয়ে রাজনৈতিকভাবে হয়েছিল। মূলত মঙ্গলদের যুদ্ধে বিতাড়িত করার পর থেকেই সেলজুক রোমের সঙ্গে কায়ি গোত্রের সুসম্পর্ক বাড়তে থাকে। এর ফলে এ বিয়ে হয় বলে ধারণা করা যায়। একজন প্রাসাদে বড় হওয়া রাজকন্যা একটি যাযাবর গোত্রের বে–এর স্ত্রী হবেন, এ ব্যাপারটি তৎকালীন সময়ে পুরো আনাতোলিয়ায় বেশ আলোচিত হচ্ছিল। তবে বাস্তবতাও ছিল বেশ চমকপ্রদ, এর কারণ হালিমা সুলতান নিজের রাজকীয় জীবন ত্যাগ করে স্বামী আরতুগ্রুলের গোত্রের বাসস্থানেই গিয়েছিলেন এবং সাবলীলভাবে সকলের সাথেই মিলেমিশে জীবনযাপন শুরু করেছিলেন।
এখন আসি কায়ি গোত্রের বর্ণনায়, কায়ি গোত্র অঘুজ তুর্কীর অন্যতম বড় গোত্র হওয়ায় তাদের সাধারণ জনগণের সংখ্যা ছিল চার-পাঁচ হাজার এবং সৈন্যসংখ্যা ছিল দেড় থেকে দুই হাজার। এ সৈন্যদের ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য ছিল যে তারা গোত্রকে পাহারা দেওয়া বা যুদ্ধে যাওয়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে কৃষিকাজ করতে বাধ্য থাকত। কায়ি গোত্রের মানুষের জীবিকার মূল উৎস ছিল কৃষিকাজ, মেষ চড়ানো ও পশু শিকার করা। যাযাবরের মতো জীবনযাপনই ছিল তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অঘুজ তুর্কীর অন্যান্য গোত্রের মতো কায়ি গোত্রেরও প্রধান থেকে শুরু করে সবাই তাঁবুতে বসবাস করতেন। (একটু আগে উল্লিখিত বে শব্দটি তুর্কীরা অহরহ বলে থাকে। তৎকালীন সময়ে গোত্রগুলোতে সাহেবদের বে বলে সম্বোধন করা হতো, সৈন্যদের আল্প বলে ডাকা হতো ও নারীদের হাতুন ডাকা হতো)।
কিছুদিন পরে, ১২২৭ সনে ইউফ্রেটিস নদী অতিক্রমের সময় কায়ি গোত্রের প্রধান সুলেমান শাহ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তাকে আলেপ্পোর কাছেই এক স্থানে দাফন করা হয়। সুলেমান শাহের মৃত্যুর পর কায়ি গোত্রে শোকের ছায়া নেমে আসার পাশাপাশি নতুন গোত্র প্রধান কে হবেন সেটা নিয়ে নতুন নতুন চিন্তা উদয় হতে থাকে। এর কারণ ছিল সুলেমান শাহের চারজন পুত্রসন্তান ছিল। আরতুগ্রুলেরও বড় দুই ভাই ছিলেন। একজন ছিলেন সুংগুরতেকিন বে যিনি কয়েক বছর মোঙ্গল সাম্রাজ্যে সেলজুক সুলতানের গুপ্তচর ছিলেন বলে কিছু কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, আরেকজন ছিলেন গুন্দোগদু বে। তাছাড়া আরতুগ্রুলের একজন ছোট ভাই ছিলেন দুন্দার বে।
অবশ্য তৎকালীন সময়ে আরতুগ্রুল বে তার বীরত্বের অবদানের জন্য সেলজুক সুলতানের কাছ থেকে কিছু জমি পেয়েছিলেন পুরস্কার হিসেবে। উক্ত জমির অবস্থান ছিল আনাতোলিয়ার পশ্চিমে রোমান-সেলজুক সীমান্তে বিলেচিক ও থোবাসিয়ান শহরের কাছাকাছি কিছু পাহাড়ের পাশাপাশি অঞ্চলে। আরতুগ্রুল সেখানে যেতেই মনোনিবেশ করেছিলেন যাতে মোঙ্গলদের উৎপাত থেকে তার গোত্রের মানুষ ও গোত্রের আগত ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা রক্ষা পেয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করতে পারে। তবে আরতুগ্রুলের সঙ্গে তার বড় দুই ভাই একমত ছিলেন না। তারা রোমানদের কাছাকাছি সীমান্তে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন। তাছাড়া সুংগুরতেকিন ও গুন্দোগদু বে উভয়ই তাদের বাবার ইউফ্রেটিস নদীতে মৃত্যুকে কুলক্ষণ মনে করে এরজুরুম থেকে তাদের জন্মভূমি খোরেজমে স্থানান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন। এর ফলে কায়ি গোত্রে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। একদিকে আরতুগ্রুল এরজুরুম থেকে রোমান-সেলজুক সীমান্তে যেতে মনস্থির করেন, অন্যদিকে তার বড় দুই ভাই এরজুরুম থেকে উজবেক ভূমি খোরেজমে যেতে মনস্থির করেন। তবে আরতুগ্রুলের পক্ষে ছিলেন তার মাতা হায়মে হাতুন ও তার ছোট ভাই দুন্দার বে। তারা আরতুগ্রুলকে সমর্থন করেন ও রোমান সীমান্তে যেতে মনস্থির করেন। ভাইদের সিদ্ধান্তে এমন বিভক্তি কায়ি গোত্রের সাধারণ জনগণকেও বিভক্ত করে দেয়।
শেষ পর্যন্ত, আরতুগ্রুলের সাথে কায়ি গোত্রের দেড় হাজার সাধারণ মানুষ ও চার শ সৈন্য রোমান-সেলজুক সীমান্ত ভূমির উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং সুংগুরতেকিন-গুন্দোগদুর সঙ্গে অত্র গোত্রের আড়াই হাজার মানুষ ও এক হাজারের মতো সৈন্য খোরেজমের দিকে রওনা হয়। এভাবেই কায়ি গোত্রের বিভক্তি ঘটে। রোমান সীমান্তের কাছাকাছি জমিতে এসে আরতুগ্রুল নিজের সঙ্গে আসা গোত্রের মানুষকে নিয়ে নতুনভাবে জীবনযাপন শুরু করেন। এভাবেই নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। চলবে....
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
**মেটা ও এক্সসার্প্ট: নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]