ঐতিহাসিক মুভি-সিরিজ দেখছি, প্রকৃত ইতিহাস কি জানতে পারছি: শেষ পর্ব
আজকের অন্তিম পর্বে আমরা আরতুগ্রুল গাজীর পরিবার, শেষ জীবন এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বীজ বপন সম্পর্কে জানব। মূলত, ১২৬৫ সনে আনাতোলিয়ায় মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জয়ী হওয়ার পর আরতুগ্রুল তার শেষ বয়সে যুদ্ধের চেয়ে শান্তি বজায়ই বেশি রেখেছিলেন ও স্বাধীনভাবে তার ক্ষুদ্র অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। আরতুগ্রুল গাজীর তিনজন পুত্রসন্তান ছিল (গুন্দুজ, সাভচি ও ওসমান)। গুন্দুজ ও সাভচি দুজনেই পর্যায়ক্রমে ১২৩০ থেকে ১২৪০ সনের মাঝামাঝি জন্মেছিল। আর তার ছোট ছেলে ওসমান ১২৫৪ সনে মতান্তরে ১২৫৬ বা ১২৫৮ সনে জন্ম নিয়েছিল। যদিও প্রথম দুই সন্তান জন্মের পর এক যুগেরও অধিক সময় ধরে আরতুগ্রুল-হালিমা দম্পতির কোনো সন্তান হয়নি, এ জন্য পরবর্তীতে তাদের মধ্যবয়সে এসে ওসমানের জন্মগ্রহণকে একটু হলেও বিস্ময়কর বলে থাকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক। ওসমান তার মা হালিমা সুলতানের গর্ভে আসার পূর্বে আরতুগ্রুল গাজী স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তার একজন পুত্রসন্তান হবে যিনি ভবিষ্যতে বিরাট এক ইসলামিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে—এমন কথিত রীতি আছে। আরতুগ্রুলের বয়স যখন ৫৪ এবং হালিমা সুলতানের বয়সও যখন পেরিয়ে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এবং স্বামী–স্ত্রী দুজনেই সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখনই ওসমান তার মাতা হালিমার গর্ভে আসে। এ খবর শুনে দীর্ঘদিনের প্রার্থনা কবুল হওয়াতে আরতুগ্রুল মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান এবং তিনি তার দেখা স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে শুরু করেন। এই ওসমান পরবর্তীতে তার বাবার তৈরি করা স্বাধীন অঞ্চলকে কেন্দ্র বানিয়ে একটি ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন যা বিখ্যাত ‘ওসমানীয় সাম্রাজ্য’ বা ‘অটোমান সাম্রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত। আর ঠিকই এ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করতে বীজ বপন করেছিলেন ওসমানের পিতা আরতুগ্রুল গাজী।
শেষ বয়সে এসে বার্ধক্যতায় বেশ অসুস্থ হয়ে পরেন আরতুগ্রুল গাজী। তিনি ১২৮০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। হালিমা সুলতানও তার স্বামী আরতুগ্রুলের মৃত্যুর এক বছর পরে মৃত্যুবরণ করেন। আরতুগ্রুলের মা হায়মে হাতুন সোগুতেই কায়ী বসতিতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন। বিখ্যাত কায়ী বসতির বিভক্তির পরে আরতুগ্রুলের বড় দুই ভাই সুংগুরতেকিন-গুন্দোগদুর ব্যাপারে ইতিহাসে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে উজবেক ভূমি খোরাসানে তারা বসতি স্থাপনের পর মঙ্গলদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল এবং বেশ ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছিল বলে কোনো কোনো সূত্র দাবি করে। তাছাড়া আরতুগ্রুলের ছোট ভাই দুন্দার বে সব সময় আরতুগ্রুলের সহচর হিসেবে থাকতেন।
আরতুগ্রুলের সহচর হিসেবে বিখ্যাত দুইজনের নাম বেশ কয়েকবার ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে, তারা হলেন তুরগুত আল্প ও আবদুর রহমান গাজী। তুরগুত আল্প ও আবদুর রহমান দুজনেই আরতুগ্রুলের একই বয়সী ছিল। তুরগুত আল্প ১৩৫ বছর বেঁচেছিলেন। তিনি একটি বড় কুঠার নিয়ে চমৎকারভাবে যুদ্ধ করতেন যা ঐতিহাসিকভাবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তার এই কুঠার এখনো ইস্তাম্বুল যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়। তিনি এমন শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন যিনি মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে দিতে পারতেন। তিনি আরতুগ্রুলের অধীনে থাকা কায়ী সৈন্যবাহিনীর প্রধান ছিলেন বলে কিছু কিছু সূত্র বলে থাকে। তুরগুত আল্প শুধু আরতুগ্রুলই নয়, বরং আরতুগ্রুলের পিতা সুলেইমান শাহ থেকে শুরু করে আরতুগ্রুলের পুত্র ওসমান ও নাতি ওরহান-এ বংশের চার পুরুষের সেবা করেছিলেন। আবদুর রহমান গাজীও ঠিক তেমনি কায়ী বংশের এ চার পুরুষের সেবা করেছিলেন। আবদুর রহমান গাজী ১২৯ বছর বেঁচেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। এরা জীবনের শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশায়।
সর্বোপরি, আরতুগ্রুল গাজী ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের প্রতি অটল। তিনি প্রজাদেরকে যেমন রক্ষা করেছিলেন তেমনি তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গীও ছিলেন। নিপীড়িত মানুষের জন্য আশার আলো হয়ে তিনি আবির্ভাব হয়েছিলেন। জালিমের প্রতি কখনোই তিনি দয়া প্রদর্শন করেন নি। তিনি তার বসতির মানুষের মতোই তাঁবুতে বসবাস করতেন। একটি বাণিজ্যিক শহর ও একটি বড় দুর্গ জয় করেও প্রাসাদে থাকেননি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। একজন সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করে গেছেন এতো যুদ্ধ জয় করে অঢেল গনিমত পেয়েও। বরং, দরিদ্র মানুষকে গনিমত দান করে প্রজাদের স্বাবলম্বী করতে পিছপা হননি। অধিক সংখ্যক শত্রু দেখেও ভয় না পেয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে জয় করেছেন অনেকবার। তিনি তার ক্ষুদ্র অঞ্চলকে কেন্দ্র করে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন যা তার উত্তরসূরিদের প্রতি অছিয়ত করেছিলেন। আল্লাহ ঠিকই তার স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন তার উত্তরসূরিদের মাধ্যমে। এ জন্যই ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বীজ বপন সোগুতে হয়েছিল বলে আরতুগ্রুল গাজীকে ‘ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পিতা’ বলা হয়। মূলত আরতুগ্রুল গাজী নিজেই ইসলামের শীতল ছায়ার ইনসাফের প্রতীক ছিলেন বলেই তার উত্তরসূরিরা ছিলেন একই ইনসাফের অনুসারী। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্যের বীজ বপন করে ইতিহাস সৃষ্টি করা এমন বীরকে জানাই হাজার সালাম।
এখানেই আরতুগ্রুলের ইতিহাস সমাপ্ত হলো। আপনাদের আশা করি এ বিখ্যাত বীরের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে পেরেছি। একদিকে আপনাদের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গিয়েছি, তেমনি ইতিহাস জানার প্রতি আপনাদের আগ্রহ ও ব্যাকুলতা দেখেও মুগ্ধ হয়েছি।
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]