বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-৬
চীন সরকারের বৃত্তিতে বেইজিং সফর। ভাষা শেখার পর বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন লেখক। সাত পর্বের ষষ্ঠ পর্ব আজ
আমরা যখন বেইজিংয়ে আসি তখন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। সে সময়ে ঢাকার আবহাওয়া গরম হলেও বেইজিংয়ে তখন শীত আসি আসি করছে। আমাদের বেইজিংয়ের শীতের তীব্রতা সম্পর্কে ঢাকাতেই চীনা দূতাবাস থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। তখন তাতে তেমন গা করিনি। কারণ, রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে আমি দীর্ঘ ছয়টি বছর বাংলাদেশের অন্যতম শীতের অঞ্চল রংপুরে কাটিয়ে এসেছি। রংপুরের সেই হাড় কাঁপানো শীতের ভোরে খোলা মাঠে পিটি–প্যারেড করেছি। শীতের রাতে আমাদের হোস্টেলের রুমে কোনো হিটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না। শীতকালে আমাদের দুটো করে কম্বল দেওয়া হতো। তাতেই মনে করেছিলাম যে শীতকে আমি জয় করে এসেছি। আসলে আমরা যারা গরমের দেশ থেকে এসেছি, তারা বেইজিংয়ের সেই শূন্যের নিচে ১৫ কিংবা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের শীতের তীব্রতা কখনোই কল্পনা করতে পারব না। হাড় কাঁপানো শীত যে কী জিনিস, সেটা বেইজিংয়ে আসার পর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। শীতকালে বেইজিংয়ে সাইবেরিয়া থেকে ঠান্ডা বাতাস আসে। হু হু করে সেই বাতাস যখন বয়ে যায় তখন চেনা জায়গাকেও অচেনা লাগে। মনে হয় পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহে এসে পড়েছি। এই পরিস্থিতিতে সিনিয়র স্টুডেন্টরা আমাদের আশ্বাস দিলেন, পর্যাপ্ত গরম কাপড় পরে বাইরে বেরোলে আর শীতকে মোকাবিলা করার কিছু কৌশল জানা থাকলে ভয়ের কিছু নেই। তাঁরা এই বলে অভয় দিলেন, দেখতে দেখতে শীত কেটে যাবে একসময়। আর উপদেশ দিলেন, শীতেরও যে একটা আলাদা সৌন্দর্য এবং প্রাণচাঞ্চল্য রয়েছে, সেটাকে উপভোগ করার। শীতের সৌন্দর্য হচ্ছে তুষারপাত। আর প্রাণচাঞ্চল্য হচ্ছে উইন্টার স্পোর্টস, যেমন আইস স্কেটিং। কালক্রমে এ দুটোরই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। তাই বেইজিংয়ের শীতকে আমার কাছে তেমন ভয়াবহ কিছু মনে হয়নি। বরং বেইজিংয়ের শীতকালকে উপভোগ করেছি আলাদাভাবে।
একজন বাংলাদেশির জন্য জীবনের প্রথম তুষারপাত দেখাটা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ হওয়ায় এ দেশের কোথাও তুষারপাত হয় না। তাই তুষারপাতের শ্বেতশুভ্র দৃশ্যপট নিয়ে প্রত্যেক বাংলাদেশির মানসপটে রয়েছে একধরনের ফ্যান্টাসি। তুষারপাতের দৃশ্যপট যে অদ্ভুত রকমের সুন্দর হতে পারে, সেটি আমাদের মননে প্রথম প্রবেশ করিয়ে দেন রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর রচিত ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণকাহিনির অংশবিশেষ ‘প্রবাস বন্ধু’ শিরোনামে ক্লাস নাইনে আমাদের পাঠ্য ছিল। সেখানে লেখকের ভৃত্য আবদুর রহমান তার নিজ শহর পানশিরের তুষারপাতের এত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন, যেন শুধু ভূস্বর্গেই এমন তুষারপাতের দেখা পাওয়া যেতে পারে। তাই বেইজিংয়ের শীতের শুরু থেকেই গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষাই আছি কবে সেই কাঙ্ক্ষিত তুষারপাতের দেখা পাব। অবশেষে সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তটি এল একদিন। ক্যালেন্ডারে সেদিনের তারিখটি ছিল ৩০ অক্টোবর ১৯৮৭। বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট থেকে আমরা কয়েকজন মিলে আমাদের বাংলাদেশ এম্বাসির এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেল। বাইরে এসে দেখি গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হোস্টেলে ফেরার জন্য আমাদের বেশ কিছুদূর হেঁটে সাবওয়ে নিতে হবে প্রথমে। সেই হাঁটার মাঝেই টের পেলাম, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ধীরে ধীরে তুষারকণায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আর সেগুলো ফুটপাতের ওপর জমা হয়ে হালকা এক শুভ্র আস্তরণের সৃষ্টি করছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সেই তুষারপাতের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল, এটা অন্য কোনো এক পৃথিবীর দৃশ্য। অদ্ভুত সুন্দর এই দৃশ্য আমরা কেউই মিস করতে চাচ্ছিলাম না। তাই পাতাল ট্রেনে না চড়ে আমরা ট্যাক্সি নিলাম। আমরা যখন আমাদের হোস্টেলে এসে পৌঁছলাম, তখন নরম ভেজা ভেজা তুষারে ডুবে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত। দেখি চারদিকে ভিড়। আমাদের মতো অনেক দেশের ছাত্রদের জন্যও হয়তো এটা প্রথম তুষারপাত। তাই ছবি তোলার ধুম পড়ে গেছে চারদিকে। শিশুদের মতো স্নো বল বানিয়ে বড়রাও মেতে উঠেছে সেই বল ছোড়াছুড়িতে। চারদিকে নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে এই তুষারপাত উপলক্ষে। অনেক রাত অবধি আমরা বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন।
চীনের উইন্টারের একটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে আইস স্কাল্পচার বা বরফের তৈরি ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনী অবশ্য শুরু হয়েছিল চীনের সবচেয়ে ঠান্ডা প্রদেশ হেইলোংচিয়াংয়ের রাজধানী হারবিন শহরে। ১৯৬৩ সালে স্থানীয় কয়েকজন শিল্পীর উদ্যোগে হারবিনের ট্রাওলিন পার্কে তাঁদের তৈরি আইস স্কাল্পচারের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রাতের বেলায় অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে বরফের তৈরি ভাস্কর্যগুলোকে বিভিন্ন রঙের আলোর মাধ্যমে সাজিয়ে এক অপার্থিব বর্ণিল পরিবেশ তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এই প্রদর্শনী খুব সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে পরবর্তী বছরগুলোতে অন্যান্য প্রদেশের ভাস্কররাও এ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু কালচারাল রেভল্যুশনের সময় এ প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে মাও সে–তুংয়ের মৃত্যুর পর আবারও এ প্রদর্শনী শুরু হলেও সেটি ছিল অনিয়মিত। কিন্তু ১৯৮৫ সাল থেকে এই প্রদর্শনীকে একটি বাৎসরিক ইভেন্টে পরিণত করা হয়। তখন থেকে শুধু দেশীয় ভাস্কর নন, বিদেশি ভাস্করেরাও এসে যোগ দিতে শুরু করেন হারবিনের ট্রাওলিন পার্কের এ প্রদর্শনীতে। কালক্রমে হারবিনের এই প্রদর্শনী পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ আইস স্কাল্পচার প্রদর্শনী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আরও একটা মজার তথ্য এই যে ২০০৭ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে কানাডিয়ান সার্জন নরম্যান বেথুনের অবদানকে স্মরণ করে এ প্রদর্শনীর মূল স্কাল্পচারটি ‘কানাডিয়ান’ থিমের ওপর নির্মিত হয়। আড়াই শ মিটার প্রশস্ত আর সাড়ে আট মিটার উঁচু সেই ‘কানাডিয়ান’ থিমের আইস স্কাল্পচারটি সে সময় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইস স্কাল্পচার হিসেবে বিবেচিত হয়। হারবিনের আইস স্কাল্পচার প্রদর্শনীর অনুকরণে ১৯৮৭ সাল থেকে বেইজিং শহরের অদূরে লোংছিংশিয়া নামের স্থানেও আইস স্কাল্পচার প্রদর্শনী শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল লোংছিংশিয়ার সেই আইস স্কাল্পচার প্রদর্শনী দেখার। আমি তখন বেইজিং পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। উইন্টারের এক সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটির সব ফরেন স্টুডেন্টকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই প্রদর্শনীতে। আমার স্মৃতিপটে সেই বর্ণিল সন্ধ্যাটি এখনো ভাস্বর হয়ে আছে।
চীনের উইন্টারের একটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে আইস স্কাল্পচার বা বরফের তৈরি ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনী অবশ্য শুরু হয়েছিল চীনের সবচেয়ে ঠান্ডা প্রদেশ হেইলোংচিয়াংয়ের রাজধানী হারবিন শহরে।
বেইজিংয়ের প্রথম উইন্টার আমাদের অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছিল। যেমন সাব–জিরো টেম্পারেচার। এই টেম্পারেচারে বাইরের জগৎটা আক্ষরিক অর্থেই একটা রেফ্রিজারেটরে রূপান্তরিত হয়। আর সেই ভয়াবহ উইন্টারের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সামারের জীবনের রয়েছে বিস্তর ফারাক। পোশাক-আশাক, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য চালচলনে এই পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। শীতকালে যে শুধু একটা মোটা জ্যাকেট পরলেই ঝামেলা চুকে যাবে, তা কিন্তু নয়। পোশাক পরতে হয়ে লেয়ার বাই লেয়ার। যেমন প্যান্টের নিচে ‘লং জনস’ বা থার্মাল আন্ডারওয়্যার, সেই সঙ্গে মুখে বালাকলাভা। বালাকলাভা হচ্ছে একধরনের টুপি, যা কিনা মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে রাখে শুধু চোখ দুটি ছাড়া। আমাদের দেশে আমরা এ ধরনের টুপিকে ‘মাঙ্কি ক্যাপ’ও বলে থাকি। উইন্টারের সময় হাতে দস্তানা, মাথায় ক্যাপ আর বালাকলাভা দিয়ে মুখ ঢেকে যখন বাইরে বের হতাম তখন মনে হতো আমি তো নই, বরং দস্যু বনহুর বেরিয়েছে কোনো এক অভিযানে। শীতে বেইজিংয়ের মানুষের খাওয়ার মেনুতে যোগ হয় ফারমেন্টেড নাপা ক্যাবেজ। উইন্টারের শুরুতেই দেখা যায় যে প্রায় প্রতিটি বাড়ির ব্যালকনিতে পালা দিয়ে রাখা হয়েছে এই নাপা ক্যাবেজ, যাকে চায়নিজে বলে ‘পাইছাই’। সাব–জিরো টেম্পারেচারে এগুলো বাইরে থাকে, প্রয়োজনমতো তারা সেগুলোকে ব্যালকনি থেকে নিয়ে রান্না করে খায়।
কালচারাল রেভল্যুশনের সময় চেয়ারম্যান মাও দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে শ্রেণিশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বানানো হয় রেড গার্ড, যারা ছিল মাওয়ের হাতের পুতুল।
চালচলনের পরিবর্তনের ভেতর রয়েছে আউটডোর খেলাধুলা। যেমন বাস্কেটবল, ভলিবল কিংবা ফুটবল—এগুলো বন্ধ। এর বদলে শুরু হয় উইন্টার স্পোর্টস। আমাদের ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের লাগোয়া এক পুকুরের পানি যখন সাব–জিরো টেম্পারেচারে জমে পুরোপুরি শক্ত বরফে পরিণত হলো তখন সেখানে শুরু হয়ে যায় আইস স্কেটিং। বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকত সেই চত্বর। টিকিট কেটে ঢোকার সময় ওদের কাছ থেকেই স্কেটিংয়ের জুতা নেওয়া যেত। আমরা কয়েকজন ফরেন স্টুডেন্ট নিয়মিত যাওয়া শুরু করলাম এই আইস স্কেটিংয়ের চত্বরে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখার মতো করে এক-পা দু-পা করে আস্তে আস্তে স্কেটিংও শিখে ফেললাম কিছুদিনের মধ্যে। নতুন একটা স্কিল রপ্ত করার প্রবল উত্তেজনায় প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যেতাম সেখানে। শীত শেষে যখন স্কেটিং বন্ধ হয়ে গেল তখন মনে মনে ঠিক করলাম, প্রতি শীতেই স্কেটিং করব। কিন্তু পরবর্তী উইন্টারগুলোতে কিছুটা লেখাপড়ার চাপে আর বাকিটা আলসেমির কারণে চীনের জীবনে এই স্কেটিং আর করা হয়ে ওঠেনি। প্রায় তিরিশ বছর পর কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সের ব্লু মাউন্টেন রিসোর্টে গিয়ে যখন দেখি সবাই স্কেটিং করছে, তখন আমারও ইচ্ছা হয়েছিল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল, আমি স্কেটিং করা পুরোপুরি ভুলে গেছি। একেই বলে অনভ্যাসে বিদ্যানাশ।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমাদের দেশে সারা বছরে ঘড়ির কাঁটার হিসাবে সময়ের কোনো পরিবর্তন হয় না। চীনে এসে দেখলাম এরা বছরে দুইবার ঘড়ির কাঁটা আগে-পিছে করে সময় পরিবর্তন করে। ইউরোপে ও পশ্চিমা দেশগুলোতেও একই নিয়ম চালু আছে। এই নিয়ম অনুযায়ী শীতের আগে আগে অর্থাৎ ‘ফল’ সিজনে ঘড়ির কাঁটাকে এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়, যাকে কিনা বলা হয় ‘ফল ব্যাক’। আর স্প্রিংয়ের আগমনে হয় ‘স্প্রিং ফরওয়ার্ড’ অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটাকে এক ঘণ্টা এগিয়ে দেওয়া হয়। পশ্চিমাদের অনুকরণে বাংলাদেশে অবশ্য একবার এই নিয়ম চালু করেছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সরকার। জনগণ কিন্তু এই সময় পরিবর্তনকে মেনে নেয়নি। তারা নতুন প্রবর্তিত সময়কে ‘ডিজিটাল টাইম’ আর আগের সময়কে ‘অ্যানালগ টাইম’ বলে তাদের প্রাত্যহিক জীবনকে চালিয়ে নিত। ফলে একসময়ে কোনো ঘোষণা ছাড়াই ডিজিটাল টাইমের বিলুপ্তি ঘটে বাংলাদেশে। সময়ের এই পরিবর্তনে বেইজিংয়ে শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য এতটাই কমে যায় যে বিকেল পাঁচটার সময় চারদিক আঁধার করে সন্ধ্যা নামে। আবার সূর্য উঠতে উঠতে বেলা বেজে যায় সাতটা। শীতের রাতগুলো হয় দীর্ঘ। দীর্ঘ রাতগুলো পার করার উপায় হিসেবে আমরা বেছে নিলাম আড্ডার আশ্রয়। উইকএন্ডগুলোতে সিনিয়র স্টুডেন্টরা আমাদের তাঁদের ইউনিভার্সিটিতে দাওয়াত দিতেন ডিনারের জন্য। তত দিনে আমাদের সবারই সাইকেল কেনা হয়েছে। ফলে স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত তাঁদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে যেতে আমাদের তেমন বেগ পেতে হতো না। সাধারণত ডিনার সারা হতো ডাইনিং হলে। কেউ কেউ আবার আমাদের জন্য রান্নার আয়োজন করতেন। ডিনারের পর শুরু হতো আড্ডা। অনেক সিনিয়র স্টুডেন্টের রুমে ছিল ভিসিআর। সেখানে আমরা দেখতাম হলিউডের সিনেমা। ছুটিতে হংকং থেকে অনেকেই হলিউডের লেটেস্ট মুভিগুলোর ক্যাসেট কিনে আনতেন আর সেই ক্যাসেটগুলো হোস্টেলের স্টুডেন্টদের হাতে হাতে ঘুরত।
দেশে থাকতে আমি কখনোই সিনেমার পোকা ছিলাম না। ক্যাডেট কলেজে আমাদের মাঝেমধ্যে প্রজেক্টরে ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ছুটিতে ক্যাডেট কলজের রুমমেট ফয়সলের সঙ্গে অভিসার সিনেমা হলে দেখেছিলাম হলিউডের ছবি ‘ম্যাকানাস গোল্ড’। এ ছাড়া ব্রুস লি অভিনীত বেশ কিছু মার্শাল আর্টসের ছবিও দেখা হয়েছিল। বেইজিং যাওয়ার পর প্রথম যে সিনেমাটি দেখি সেটি ছিল ‘দ্য শাওলিন টেম্পল’। বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের একটি অডিটরিয়ামে আমাদের ভাষা শিক্ষার ক্লাস থেকে দেখানো হয় এই সিনেমা। অনেকটা ক্যাডেট কলেজে যেমনটা আমাদের দেখানো হতো। এই মুভিতে দেখানো হয় কীভাবে নায়ক জেট লি তাঁর পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চীনের ঐতিহ্যবাহী শাওলিন টেম্পলে গিয়ে মার্শাল আর্টস রপ্ত করেন। জেট লি পরবর্তী সময়ে হলিউডের মার্শাল আর্টস ক্যাটাগরির মুভিতে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আমাদের দ্বিতীয় যে সিনেমাটি দেখানো হয় তার নাম ‘রেড সারগাম’, চায়নিজে ‘হৌং কাওলিয়াং’। সিনেমাটি সে বছরেই অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল চীনে। পরিচালক ট্রাং ইমৌ এবং ছবির নায়িকা কোং লি দুজনেই এই ছবির মাধ্যমে সিনেমার জগতে প্রবেশ করেন। এই ছবিতে অভিনয়ের সময় নায়িকা কোং লি বেইজিংয়ের ‘সেন্ট্রাল একাডেমি অব ড্রামা’র স্টুডেন্ট ছিলেন। আর পরিচালক ট্রাং ইমৌয়ের জন্য সিনেমাটি ছিল চীনের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার একটি সুযোগ। সুযোগটি তিনি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন। প্রাক-কমিউনিস্ট-চায়নার চিকিৎসক পিতামাতার সন্তান ট্রাং ইমৌয়ের বেড়ে ওঠার সময়টা ছিল বেশ কষ্টের। কারণ, তিনি যখন বালক তখন শুরু হয়ে যায় কালচারাল রেভল্যুশন। সে সময় তাঁকে পাঠানো হয় গ্রামের একটি কমিউনে, যেখানে তাঁকে অন্য কৃষকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষিকাজ করতে হয়েছিল। এ সময় তাঁর সুযোগ হয় গ্রামীণ জীবনযাপনকে খুব কাছ থেকে দেখার। এ সময় ফটোগ্রাফির প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়। নিজের রক্ত বিক্রি করে একটা ক্যামেরা কেনেন এবং গ্রামের দৃশ্যাবলির ছবি তুলে স্টিল ফটোগ্রাফিতে হাত পাকান।
কালচারাল রেভল্যুশনের পর তিনি ভর্তি হন ‘বেইজিং ফিল্ম একাডেমি’তে, যেখানে তিনি সিনেম্যাটোগ্রাফিতে গ্র্যাজুয়েশন করেন। জীবন থেকে অর্জিত অমূল্য সব অভিজ্ঞতা তিনি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন তাঁর প্রথম সিনেমা ‘রেড সারগাম’-এ। কাহিনিবিন্যাস, অনবদ্য অভিনয়, ক্যামেরার সূক্ষ্ম কারুকাজ আর গ্রাম্য চীনের বিশাল পটভূমিতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক রঙের শৈল্পিক উপস্থাপনের কারণে ‘রেড সারগাম’ মুভিটি চীনের দর্শকদের মাঝে বিপুল সাড়া ফেলে। চীনের সমাজের বিভিন্ন ট্যাবুকে আঘাত করেছে এই সিনেমার কাহিনি, যা চীনের সিনেমা জগতে একটি সাহসী পদক্ষেপ। বলা যেতে পারে, কালচারাল রেভল্যুশনের পর এ মুভিই প্রথম গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে চীনের ফিল্ম ওয়ার্ল্ডে নতুন একটি মাত্রা সংযোজন করে। এই সিনেমার মাধ্যমে পরিচালক ট্রাং ইমৌ ও নায়িকা কোং লি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুজন একত্রে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় মুভি তৈরি করেন, যা আমি আগ্রহ নিয়ে দেখেছি।
কালচারাল রেভল্যুশনের সময় চেয়ারম্যান মাও দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে শ্রেণিশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বানানো হয় রেড গার্ড, যারা ছিল মাওয়ের হাতের পুতুল। সেই রেড গার্ডরা তখন বুর্জোয়াদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্চ করত এবং সব নিষিদ্ধ বই অর্থাৎ মাওয়ের আদর্শের পরিপন্থী যেকোনো বই তারা জব্দ করে বহ্ন্যুৎসবে মেতে উঠত। ফলে সেই সময়ে একমাত্র মাওয়ের প্রিয় প্রাবন্ধিক ল্যু সুন ব্যতীত অন্য যেকোনো চীনা লেখকের বই ছিল নিষিদ্ধ। সাহিত্যের পাশাপাশি সিনেমা তৈরিতেও ছিল কঠোর বিধিনিষেধের বেড়া। সেই সময়ে চীনে শুধু প্রোপাগান্ডামূলক সিনেমা তৈরি হতো। বিদেশি ছায়াছবি বলতে গেলে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তারই মাঝে ১৯৫৫ সালে রাজ কাপুর অভিনীত ভারতীয় ছায়াছবি ‘আওয়ারা’ ইন্ডিয়ার কমিউনিস্ট ঘরানার সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সৌজন্যে চীনে মুক্তি পায়। স্বয়ং চেয়ারম্যান মাও এই ছবি দেখে বেশ প্রশংসা করেছিলেন এবং ছবিটির টাইটেল সং ‘আওয়ারা হু’ গানটিকেও খুব পছন্দ করেছিলেন। সেই সময়কার চীনের ছেলে-বুড়ো প্রায় প্রত্যেকেই ছবিটি উপভোগ করেছে। আমার বেইজিংয়ের জীবনে আমি অনেক চায়নিজকে পেয়েছি, যারা কথা প্রসঙ্গে আমাকে ‘আওয়ারা’ ছবির কথা বলেছে এবং সেই সঙ্গে ‘আওয়ারা হু’ গানের দুই লাইনও গেয়ে শুনিয়ে দিয়েছে। অথচ আমার নিজেরই কখনো দেখা হয়ে ওঠেনি ‘আওয়ারা’ সিনেমাটি। হয়তো সেটি আমার আগের জেনারেশনের সিনেমা বলে তেমন একটা আগ্রহ বোধ করিনি। কিন্তু বেইজিংয়ে এসে ‘রেড সারগাম’ দেখার পর আমি সমসাময়িক চায়নিজ সিনেমার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। তাই চায়নিজ ভাষা কিছুটা আয়ত্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে মুভি দেখা শুরু করি। এ সময় চীনের বিখ্যাত কমেডিয়ান ঠ্রেং ছিয়াং ও তাঁর ছেলে ঠ্রেং পেই-স অভিনীত কয়েকটি কমেডি সিনেমা বেশ জনপ্রিয় হয়। আমিও সেগুলো সিনেমা হলে গিয়ে দেখে বেশ উপভোগ করেছিলাম। চলবে...