বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-৩
চীন সরকারের বৃত্তিতে বেইজিং সফর। ভাষা শেখার পর বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন লেখক। সাত পর্বের তৃতীয় পর্ব আজ
পড়ন্ত বিকেলবেলায় থাই এয়ারওয়েজের বিমানটি আমাদের নিয়ে বেইজিং বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। যাত্রীদের যখন বাসে করে বিমানবন্দরের ভেতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তাকিয়ে দেখলাম—চারিদিকে কেমন এক সুনসান নীরবতা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আকাশটাও যেন এক বিষণ্নতার চাদরে মোড়া। শীতের বিকেলের যে একটা ধূসর পর্দা থাকে, সেটা সেই প্রথম টের পেলাম। ব্যাংকক থেকে যখন আমরা থাই এয়ারওয়েজের বিমানে উঠি, তখন সেখানে ছিল গায়ের চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো গরম। আর বেইজিং বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে যখন বের হই, তখন হিমেল বাতাসের এক স্পর্শ যেন হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত নাড়া দিয়ে গেল। আমি ঢাকার ছেলে হলেও লেখাপড়া করেছি উত্তরবঙ্গের রংপুর ক্যাডেট কলেজে। তাই হিমালয় থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা কনকনে হাওয়ার সঙ্গে বেশ পরিচিত, কিন্তু তারপরও বেইজিংয়ের সেই প্রথম ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ এখনো আমার মনে দাগ কেটে আছে। বিমানবন্দরে পরিবেশ ছিল একই রকমের ঠান্ডা, মানুষজনের কোনো কোলাহল ছিল না। আমরা যেহেতু চীন সরকারের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছি, তাই আমাদের জন্য ইমিগ্রেশনে আগেই ব্যবস্থা করা ছিল। তাই কোনো বাক্যবিনিময় না করেই ইমিগ্রেশন পার হতেই দেখি, আমাদের রিসিভ করার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এসেছেন হান্নান ভাই। সেখানেই তার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন একটা মাইক্রোবাস। সেই বাসে চড়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটের উদ্দেশে।
আজ এত দিন পর চিন্তা করে দেখি, আমরা কতখানি ভাগ্যবান ছিলাম যে বেইজিং বিমানবন্দরে আমাদের মুহূর্তকালও অপেক্ষা করতে হয়নি। অনেকটা ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি’র মতন আমাদের রিসিভ করার সব আয়োজনই আগেভাগেই করা ছিল। কিন্তু ‘ধূসর মস্কো’র লেখিকা সেরিনা জাহানের অভিজ্ঞতা ছিল খুব করুণ। একই বছর, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে অনেকটা একই সময়ে তিনি যখন শ খানেক ভারতীয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে এয়ারফ্লোতের ফ্লাইটে করে মস্কো এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছান, তখন অন্যান্যের সঙ্গে তাঁকেও পড়তে হয়েছিল বিপাকে। কীভাবে তাঁরা তাঁদের ইউনিভার্সিটিতে যাবেন, সে ব্যাপারে এয়ারপোর্টের কোনো কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী কেউই এগিয়ে আসেননি। এমনকি তাঁদের সঙ্গে তাঁরা ভালো করে কোনো কথাও বলেননি। প্রায় আট ঘণ্টা সীমাহীন অনিশ্চয়তার সঙ্গে পার করার পর তাঁদের উদ্ধারের জন্য দুজন ভারতীয় সিনিয়র শিক্ষার্থীর আগমন ঘটে। তাঁরা তাঁদের এয়ারপোর্ট থেকে মার্কিন ডলারে ট্যাক্সি ঠিক করে ইউনিভার্সিটিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেই দুজন শিক্ষার্থী আবার নতুন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ডলার হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করেছিল। কারণ, সেই সময়ে সোভিয়েট ইউনিয়নে ডলারের দাম ছিল আকাশচুম্বী।
বিমানবন্দরে থেকে বের হয়ে আমাদের মাইক্রোবাস এক সময় বেইজিং শহরে যাওয়ার রাস্তায় উঠল। অনেকটা আমাদের দেশের সেই সময়কার আন্তজেলা রাস্তার আদলে সেই রাস্তা। জাঁকজমকের কোনো বালাই নেই। রাস্তার দুই পাশে খালি মাঠ কিংবা ফসলের খেত, মাঝেমধ্যে কিছু বাড়িঘর আর সেই সব বাড়িঘরের আঙিনায় কিছু মানুষের অলস আনাগোনা। আহামরি তেমন কোনো বিল্ডিং চোখে পড়ল না। সাঁঝের আলো-আঁধারিতে চারিদিকে মন হু হু করা এক বিষণ্নতার ছায়া। হয়তো সেটা ছিল আমার একান্ত অনুভূতি। সেই দিনকার সেই মুহূর্তের অনুভূতিটি ভোলার নয়, আমার মনের পাতায় আজীবনের জন্য গেঁথে রয়েছে। তবে সেটা ভাষায় প্রকাশ করাটা সহজ নয়। অনেক বছর পর যখন মাইকেল জ্যাকসনের ‘স্ট্রেঞ্জার ইন মস্কো’ গানটি প্রথমবারের মতো শুনি—
‘How does it feel?
When you're alone
And you're cold inside
Like a stranger in Moscow’
লাইনগুলো আমাকে বেইজিংয়ের বিমানবন্দর থেকে বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটে যাওয়ার সময়টার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এই লাইনগুলোতে যেমন সব হারানোর একটা বেদনার্ত হাহাকার আছে, সেদিন আমার মনেও সেই একই ধরনের এক মেলানকলি সুর বেজে উঠেছিল। বেইজিংয়ের আবহাওয়া আমাদের শীতলভাবে অভ্যর্থনা জানালেও তার কৌতুকপ্রিয় অধিবাসীরা কিন্তু তাদের স্বভাবসূলভ কৌতূহলোদ্দীপক ও আতিথেয়তাপূর্ণ আচরণ দ্বারা আমাদের চীনজীবনকে করে তুলেছিল বৈচিত্র্যময় এবং নানা ঘটনায় সমৃদ্ধ।
গোসলের সময় প্রথমে শাওয়ারের ঠান্ডা ও গরম পানির ট্যাপ ঠিকমতো অ্যাডজাস্ট করে তবেই কিনা শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি হোস্টেলে একটা গরম পানির গিজার্ড আছে, যেখান থেকে ফ্লাস্কে পানি সংগ্রহ করা যাবে। খাওয়ার ঠান্ডা পানি আনতে হবে ডাইনিং হল থেকে। হোস্টেলের বাথরুমের বেসিনের ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা হান্নান ভাইকে দেখেছি হোস্টেলের সেই ঠান্ডা পানি খেতে, তার পর থেকেই আমাদের কাছে ঠান্ডা পানির কোড নেম ‘হান্নান’স ওয়াটার’।
চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমরা মোট ১০ জন বিভিন্ন বিষয়ে আন্ডারগ্রেড লেভেলে পড়তে এসেছি। দুজন ফাইন আর্টসের, একজন মেডিসিনের আর বাকি সাতজন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন শাখার ছাত্র। যেহেতু চীনের ইউনিভার্সিটিগুলোর মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন হচ্ছে ম্যান্ডারিন (বিশুদ্ধ ফর্মের চায়নিজ), তাই আমাদের প্রথম বছর চায়নিজ ভাষার ওপর কোর্স নিতে হবে। আর সে জন্যই আমাদের বেইজিং এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নিয়ে আসা হলো বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটে। আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছলাম, তখন মাত্র সন্ধ্যা গড়িয়েছে। আসার পথে হান্নান ভাই আমাদের এখানকার হোস্টেল ও হোস্টেলের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বেশ কিছু সবক দিয়েছেন। শুরুতেই তিনি আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে আমরা যদি মনে করি, এখানকার হোস্টেল মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ব্যাংকক থেকে ছেড়ে আসা এশিয়া হোটেলের মতো লাক্সারিয়াস হবে, তবে কিন্তু আমরা বিরাট ভুল করব। হোস্টেলের ফ্যাসিলিটি নিয়ে তিনি শুধু একটি মন্তব্যই করলেন, ‘প্রথম প্রথম মনে হবে এখানে থাকা যাবে না, কিন্তু আসলে থাকা যাবে, শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’ তাই কিছুটা চিন্তিত মনে যখন মাইক্রোবাস থেকে নামলাম, তখন আমাদের ঘিরে ধরল একদল বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, যাঁরা আমাদের ঠিক এক বছর আগে পড়তে এসেছেন। মাত্র ভাষা শিক্ষার কোর্স শেষ করে নিজ নিজ সাবজেক্টে পড়ার জন্য যে যাঁর ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে থিতু হয়েছেন। তাঁরা আমাদের জন্য প্যাকেট ডিনার নিয়ে এসেছেন। কারণ, ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটের ডাইনিং হল ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। একবার ডাইনিং হল বন্ধ হয়ে গেলে ক্যাম্পাসের ত্রিসীমানার মধ্যে আর কোথাও খাবার পাওয়া যাবে না, সেই কথাও তাঁরা আমাদের বলে দিলেন। অতএব সাধু সাবধান।
আমাদের সবারই এই প্রথম বিদেশে আসা। তাই একদিকে যেমন নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করার উত্তেজনা কাজ করছে, আবার ঠিক তার বিপরীতে সম্পূর্ণ অচেনা–অজানা একটি দেশে কীভাবে নিজেদের খাপ খাওয়াব, সেই দুশ্চিন্তাও আমাদের পেয়ে বসেছে। বিশেষ করে যে দেশের ভাষা আমরা এক বর্ণও বুঝতে পারি না। তার ওপর আমরা সেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, চীনারা নাকি সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি সবই খায়। তাই খাওয়াদাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা কম নয়। আমাদের মানসিকভাবে কিছুটা হতোদ্যম হতে দেখে সিনিয়র ভাইয়েরা আমাদের বিভিন্নভাবে চিয়ারআপ করার চেষ্টা করলেন। তাঁরা তাঁদের নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে আমরা নাকি তিন মাসের ভেতরই কাজ চালানোর মতন চায়নিজ রপ্ত করে ফেলব। তাঁরা নিজেদের মধ্যে যখন টুকাটাক চায়নিজে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন, তখন খুব অবাক হলাম এই ভেবে যে আমিও একদিন তাঁদের মতন ‘চ্যাং চুং’ করে কথা বলতে পারব। চায়নিজদের কথা যেমন আমাদের কাছে ‘চ্যাং চুং’ আওয়াজের মতন লাগে, তেমনি আমাদের কথাও নাকি তাদের কাছে ‘চিলি কুলু, চিলি কুলু’ আওয়াজের মতন মনে হয়। বেশ কয়েক বছর পর আমাদের এক চায়নিজ বন্ধু আমাদের কাছে তাঁদের সেই গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছিল।
ডাইনিং হল যে সময় ধরে দিনে তিনবার খোলে, সেটাও আমাদের সিনিয়ররা আমাদের বলে দিলেন। ডিনার যে সন্ধ্যা ছয়টার ভেতর সেরে ফেলতে হবে, সেটা জেনে খুব অবাক হলাম। শুনেছিলাম, আমাদের দেশের জেলখানাগুলোতে এই ব্যবস্থা চালু আছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম এই ভেবে যে এ কোন জেলখানায় এসে ঢুকলাম।
সিনিয়র ভাইদের পরামর্শ, ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটে লেখাপড়ার চাপ নেই বললেই চলে, কিন্তু যখন নিজ সাবজেক্টের পড়া শুরু হবে, তখন নাকি চোখেমুখে শর্ষে ফুল দেখতে হবে। তাই এ সময় হচ্ছে ‘নো চিন্তা, ডু ফুর্তি’র সময়। কিন্তু ফুর্তি করার মতন তাৎক্ষণিক কিছুই চোখে পড়ল না। ক্যাম্পাসের ভেতর বেশ কয়েকটি হোস্টেল ছড়িয়ে–ছিটিয়ে অবস্থিত। কিন্তু বিল্ডিংগুলো বেশ পুরোনো। বিদেশি ছাত্রদের জন্য মূলত দুটি হোস্টেল বিল্ডিং, ছেলেদের জন্য বিল্ডিং নম্বর ফাইভ আর মেয়েদেরটা বিল্ডিং নম্বর এইট। চায়নিজে পাঁচকে বলে ‘ঊ’, আটকে বলে ‘পা’ আর বিল্ডিংকে বলে ‘লৌ’। সে হিসেবে আমাদের ছেলেদের হোস্টেল হচ্ছে ‘ঊ-লৌ’, যেখানে আমাদের জন্য চারটি রুম বুক করা আছে। দলের একমাত্র মেয়ের জন্য ‘পা-লৌ’তে এক পাকিস্তানি সিনিয়র স্টুডেন্টের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা আছে। ছেলেদের নিজেদের মধ্যে দুজন করে রুমমেট ঠিক করে সেই রুমগুলোতে উঠে যেতে হবে। আমাদের বাকি একজনকে থাকতে হবে হান্নান ভাইয়ের সঙ্গে। কারণ, তিনিও এই ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটের। চায়নিজ ভাষার ওপর চার বছরের ডিগ্রি করছেন। আগামী বছর ডিগ্রি শেষ হবে। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ এম্বাসিতে দোভাষী হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ করছেন। বেইজিংয়ে আসার পথে থাই এয়ারলাইনসের সৌজন্যে আমরা ব্যাংককে ‘এশিয়া হোটেল’-এ দুই রাত কাটিয়ে এসেছি। সেখানে আমাদের আটজন ছেলেকে ডাবল বেডের চারটি রুমে থাকতে হয়েছিল। বাকি একজনকে সিঙ্গেল রুম দেওয়া হয়েছিল। দেখা গেল, সেই আটজন এখানেও ব্যাংককের মতন নিজ নিজ রুমমেট বেছে নিল। অগত্যা সেই একজন, অর্থাৎ হামিদকেই যেতে হলো হান্নান ভাইয়ের রুমে। সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে রুম শেয়ার করতে হবে বলে প্রথমে হামিদকে কিছুটা বিমর্ষ দেখালেও যখন জানা গেল, হান্নান ভাই আর হামিদ দুজনেরই দেশের বাড়ি পাবনা, তখন অবশ্য হামিদকে বেশ উৎফুল্লই মনে হলো। আমি ও আমার ক্যাডেট কলেজের সহপাঠী আজমী ৩১৭ নম্বর রুমে। রুমে গিয়ে দেখি, একেকজনের জন্য একটি করে লোহার ফ্রেমের বেড, তাতে বেশ মোটা একটা ম্যাট্রেস, দুখানা বেডশিট, একটা কম্বল, একটা লেপ ও একটা বালিশ। এ ছাড়া রয়েছে কাপড় রাখার আলমারি আর পড়ার চেয়ার-টেবিল। আরও রয়েছে প্রত্যেকের জন্য একটা পানির ফ্লাস্ক ও একটা টিনের বড় বৌল। এত কিছু পেয়ে আমার মনে হলো, হান্নান ভাই কেন বললেন, ‘প্রথম প্রথম মনে হবে এখানে থাকা যাবে না।’
আমরা যে যার রুমে লাগেজ রেখে এসে আবারও হোস্টেলের সামনের চত্বরে এসে জড়ো হলাম। হোস্টেল–সংলগ্ন বেশ কয়েকটি বাস্কেটবল কোর্ট এবং তার পেছনে সকার কিংবা ভলিবল খেলার মাঠ রয়েছে। সেটা দেখে একটু চাঙা বোধ করলাম, অন্তত খেলাধুলা করে সময়টা পার করতে পারব। সিনিয়র ভাইদের আনা ডিনার খেতে খেতে তাঁদের সঙ্গে টুকাটাক কথাবার্তা হচ্ছিল আমাদের। এই টুকটাক কথাবার্তার মধ্যেই তাঁরা আমাদের এখানকার ক্যাম্পাস জীবন সম্পর্কে অল্পবিস্তর টিপস দিলেন, যেগুলো ছিল ভীষণ রকমের প্র্যাক্টিক্যাল। যেমন কীভাবে কমন বাথরুম, টয়লেট ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে হোস্টেল থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত ডাইনিং হল থেকে কুপনের মাধ্যমে খাবার কিনতে হবে। কারণ, এ দেশের অনেক কিছুই আমাদের দেশের মতন নয়। যেমন গোসল করার সময় প্রথমে শাওয়ারের ঠান্ডা ও গরম পানির ট্যাপ ঠিকমতো অ্যাডজাস্ট করে তবেই কিনা শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি হোস্টেলে একটা গরম পানির গিজার্ড আছে, যেখান থেকে ফ্লাস্কে পানি সংগ্রহ করা যাবে। খাওয়ার জন্য ঠান্ডা পানি আনতে হবে ডাইনিং হলের একটি নির্দিস্ট জায়গা থেকে। হোস্টেলের বাথরুমের বেসিনের ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা হান্নান ভাইকে দেখেছি হোস্টেলের সেই ঠান্ডা পানি খেতে, আর তার পর থেকেই আমাদের কাছে সেই ঠান্ডা পানির কোড নেম হয়ে যায় ‘হান্নান’স ওয়াটার’। হান্নান ভাই তাঁর স্বভাবজাত হাসিখুশি ব্যবহার দিয়ে আমাদের সবারই মন জয় করে নেন অল্প সময়ের ভেতর। তিনি আমাদের যেকোনো সমস্যার সমাধানের জন্য সব সময়ই তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের চীনের জীবনের শুরুটা তাঁর আন্তরিক বদান্যতায় হয়ে উঠেছিল নির্বিঘ্ন। ২০২১ সালের মার্চে তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সাভারের এক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। দোয়া করি, মহান আল্লাহ তাআলা যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করেন।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ডাইনিং হল যে সময় ধরে দিনে তিনবার খোলে, সেটাও আমাদের সিনিয়ররা আমাদের বলে দিলেন। ডিনার যে সন্ধ্যা ছয়টার ভেতর সেরে ফেলতে হবে, সেটা জেনে খুব অবাক হলাম। শুনেছিলাম, আমাদের দেশের জেলখানাগুলোতে এই ব্যবস্থা চালু আছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম এই ভেবে যে এ কোন জেলখানায় এসে ঢুকলাম। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার এই যে চীন ছেড়েছি সেই কত যুগ আগে, কিন্তু সেই সন্ধ্যা ছয়টায় ডিনার করার অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারিনি। আমাদের আরও সতর্ক করে দেওয়া হলো যে ডাইনিং হল বন্ধ হওয়ার পর রাতে আর কোথাও সহজে খাবার পাওয়া যাবে না। কারণ, এই ক্যাম্পাসের আশপাশে কোনো রেস্তোরাঁ নেই। আসলে সেই সময়ের বেইজিং আর আজকের বেইজিংয়ের ভেতর অনেক পার্থক্য। ‘হাইতিয়েন’ নামের ডিস্ট্রিকে অবস্থিত ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটটি মূল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বেইজিংয়ের অনেকগুলো প্রসিদ্ধ ইউনিভার্সিটি এই ‘হাইতিয়েন’ ডিস্ট্রিকের ‘সুয়ে ইউয়ান ল্যু’ (ইনস্টিটিউট অ্যাভিনিউ) নামের একটি লম্বা রাস্তার দুই পার্শ্বে অবস্থিত। এই ‘সুয়ে ইউয়ান ল্যু’র দুটি ইন্টারসেকশনের মধ্যে অবস্থিত আমাদের এই ইনস্টিটিউট। প্রথম ইন্টারসেকশনটির নাম ‘সি তাও খৌ’ কিংবা ‘চার রাস্তার মোড়’ আর পরেরটার নাম ‘ঊ তাও খৌ’। ‘ঊ’ মানে যে পাঁচ, সেটা তো আগেই উল্লেখ করেছি। এই দুই ইন্টারসেকশনে কিছু গ্রোসারি শপ রয়েছে, যেখানে মূলত ফলমূল, তরিতরকারি ও ব্রেড বা বিস্কুট–জাতীয় শুকনা খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু বিকেল পাঁচটায় সেই গ্রোসারিগুলো আবার বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ‘সুয়ে ইউয়ান ল্যু’র এই দুই ইন্টারসেকশনের মধ্যে নেমে আসে সুনসান নিস্তবতা। তখন এই রাস্তা দিয়ে কেবল দু–একটি সাইকেল কিংবা ঘড়ির কাঁটা ধরে দুটি পাবলিক বাসকে চলাচল করতে দেখা যায়। রাস্তার দুই পাশ তখন অন্ধকারে ডুবে থাকে। তবে ইনস্টিটিউটটির যে প্রান্তটি ‘ঊ তাও খৌ’র সঙ্গে মিশেছে, সেখানে অবশ্য একটি ‘শিয়াও মাই পু’ (কনভিনিয়েন্স স্টোর) আছে, যেটা রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সেটাই একমাত্র ভরসা যদি আমাদের খাবারের অন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকে। অর্থাৎ আমাদের সব সময়ই কিছু খাবার হাতের নাগালে রাখতে হবে আপৎকালীন সময়ের জন্য।
একসময় সিনিয়র ভাইয়েরা বিদায় নিলে আমরা যে যার রুমে ফিরে যাই। বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটের হোস্টেল ‘ঊ লৌ’, অর্থাৎ বিল্ডিং নাম্বার ফাইভে আমাদের চীনের জীবনের প্রথম রাতটি কেটেছিল একধরনের আচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে। আমি ক্যাডেট কলেজে দীর্ঘ ছয় বছর হোস্টেলে কাটিয়ে এসেছি, আমার জন্য হোস্টেলে থাকাটা মোটেই কঠিন কিছু নয়। সারা দিনের ক্লান্তিতে আমরা সবাই কাহিল ছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি বিছানা পেতে গা এলিয়ে দিতেই টের পেলাম যে বালিশের ভেতর তুলার বদলে রয়েছে একধরনের বিচি। সেই সঙ্গে বুঝতে পারলাম, চায়নিজদের জীবনযাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চেয়ে ভিন্ন। সেই ভিন্ন জীবনযাত্রা ও জীবনবোধকে ধীরে ধীরে আরও জানার সুযোগ হয়েছিল আমার দীর্ঘ সাত বছর বেইজিংয়ে বাস করার মাধ্যমে। হান্নান ভাইয়ের সাবধানবাণী যেমন মিথ্যা ছিল না, তেমনি অন্যান্য সিনিয়র ভাইদের দেওয়া ভরসাগুলোও অমূলক ছিল না। ধীরে ধীরে আমাদের চীনের জীবনটা হয়ে উঠেছিল নানা ঘটনার জন্য স্মরণীয় এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ। অচেনা চীন একসময় হয়ে উঠল চেনা–পরিচিত। চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন: বেইজিংয়ের সেই দিনগুলো: পর্ব-৪