কানাডা আগমনের নেপথ্য–কথা: শেষ পর্ব–৫
সদাপরিবর্তনশীল বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার লক্ষ্যে সিঙ্গাপুর সরকার হাতে নেয় ‘নলেজ ইকোনমি’ প্রকল্প, যার চালিকা শক্তি হিসেবে নির্ধারিত হয় ‘লাইফ লং লার্নিং’। নলেজ ইকোনমির অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে ‘ইনোভেশন’, তাই সরকার একটি ‘ইনোভেটিভ নেশন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বরাদ্দ করে বিশাল অঙ্কের বাজেট। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে আয়োজন করা শুরু হয় ‘ইনোভেটিভ আইডিয়া’-র ওপর সেমিনার ও ওয়ার্কশপ, যার বেশির ভাগই পরিচালনা করতেন বিশ্বের নামকরা সব এক্সপার্ট। এ সময় ‘ব্রেইনডান্সিং’ নামের বেস্ট সেলার বইয়ের লেখক দিলীপ মুখার্জিসহ অন্য খ্যাতনামা লোকদের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশ গ্রহণের সুযোগ হয় আমার। তবে আমার দৃষ্টিতে ‘ইনোভেশন’ একটি ন্যাচরাল ‘ইনস্টিংক্ট’, যা কাউকে শেখানো যায় না, যেমন কবিতা লেখা। আর একটি জাতি তখনই ইনোভেটিভ হয়ে ওঠে, যখন তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয় এবং সেগুলোর সমাধান মাথা খাটিয়ে তাদেরই বের করতে হয়। যেহেতু সিঙ্গাপুর একটি ‘সমস্যাবিহীন’ দেশ, তাই জাতি হিসেবে সিঙ্গাপুরিদের ইনোভেটিভ হওয়ার সুযোগ অনেক কম। সরকার হয়তো এ সত্য অনুধাবন করে সচেষ্ট হয় শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ উপাদানটি যোগ করার জন্য। ঠিক এই সময়ে মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনের অর্থায়নে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনের অধীন গঠিত হলো একটি নতুন রিসার্চ উইং—সেন্টার ফর রিসার্চ ইন পেডাগজি অ্যান্ড প্র্যাকটিস (সিআরপিপি)। এই রিসার্চ উইংয়ের অন্যতম লক্ষ্য হলো সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান মান বিশ্লেষণ করে তাতে কীভাবে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ উপাদানটি যোগ করা যায়, তা খতিয়ে দেখা।
আমি তখন সিঙ্গাপুর পলিটেকনিকের ওয়েববেজড এডুকেশন প্রকল্পের সিস্টেম অ্যানালিস্টের পদ ছেড়ে দুই বছরের চুক্তিতে যোগ দিলাম সিআরপিপিতে সিনিয়ার সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে। আমার কাজ হলো কমপিউটিশনাল লিঙ্গুইস্টিক টেকনোলজির মাধ্যমে ক্লাসরুম টিচিংয়ের মান বিশ্লেষণ করা। এ সময় আমি সিআরপিপির ডিন কাম প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর প্রফেসর অ্যালেন লুকের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসি। সেকেন্ড জেনারেশন চায়নিজ-আমেরিকান প্রফেসর লুকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা লস অ্যাঞ্জেলেসের চায়না টাউনের পাশে ইকোপার্ক এলাকায়। পিএইচডি করেছেন কানাডার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটি থেকে, কিন্তু স্থায়ী হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এডুকেশনাল পলিসির একজন বিশ্বখ্যাত অথরিটি হিসেবে বিবেচিত প্রফেসর লুক সিঙ্গাপুর সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে এই রিসার্চ সেন্টারের সর্বোচ্চ পদটি গ্রহণ করেন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
প্রফেসর লুকের বিশেষ আগ্রহে সিআরপিপিতে তখন প্রায়ই বিশ্বের নামকরা এডুকেশনালিস্টরা এসে সেমিনার করতেন। সেসব সেমিনারে নিয়মিত যোগ দিয়ে ‘এডুকেশনাল পলিসি’ সম্পর্কে আমার তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিধি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। ‘এডুকেশন’ হচ্ছে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা কিনা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণিকে তাদের দারিদ্র্যের বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে আসার সুযোগ করে দেয়। বৃত্ত ভাঙার এই শক্তিশালী হাতিয়ারকে তাই বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই করতে চায় নিয়ন্ত্রণ, সে জন্য প্রবর্তন করে তার নিজস্ব এডুকেশনাল পলিসি। সিঙ্গাপুর সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। সিঙ্গাপুর সরকারের শিক্ষানীতিতে মূলত প্রাধান্য পায় কীভাবে মেরিটোক্র্যাসির ভিত্তিতে দেশের ‘লিডারশিপ’ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সরকার এটাও নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর, কোনোক্রমেই যেন এই ‘লিডারশিপ’ চায়নিজ জাতিসত্তার হাতছাড়া না হয়ে যায়। আর সে জন্যই সিঙ্গাপুরের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে চালু রয়েছে ‘স্ট্রিমিং’, যা প্রাইমারি লেভেলেই নির্ধারণ করে দেয় একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে, না তাকে ‘টেকনিক্যাল’ লাইনে পড়তে হবে। যেহেতু সিঙ্গাপুরের ‘সোশিও-ইকোনমিক’ মানদণ্ডে চায়নিজদের একটি অংশ এগিয়ে রয়েছে এবং তাদের ‘প্রিভিলেজড’ ছেলেমেয়েরা প্রাইমারি লেভেলে সেই স্ট্রিমিংয়ে ভালো করে। কালক্রমেই তারাই মেরিটোক্র্যাসির ভিত্তিতে লিডারশিপ গ্রুপে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারে। এই ‘আর্লি স্ট্রিমিং’-এর কারণে ‘আনপ্রিভিলেজড লেট ব্লুমার্স’-দের আর কোনো ‘সেকেন্ড চান্স’ থাকে না লাইফে। ‘আর্লি স্ট্রিমিং’ পদ্ধতির সমালোচনা করায় সরকারের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন প্রফেসর লুক। সরকার তাঁর চুক্তির মেয়াদ নবায়ন না করে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়ায়।
যেহেতু সিঙ্গাপুর একটি ‘সমস্যাবিহীন’ দেশ, তাই জাতি হিসেবে সিঙ্গাপুরিদের ইনোভেটিভ হওয়ার সুযোগ অনেক কম। সরকার হয়তো এ সত্য অনুধাবন করে সচেষ্ট হয় শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ উপাদানটি যোগ করার জন্য।
প্রফেসর লুকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাঝে তাঁকে জানিয়েছিলাম আমার কানাডা অভিবাসনের কথা। তিনি আমাকে সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার জন্য উৎসাহিত করে পরোক্ষভাবে আসলে উৎসাহিত করেছিলেন কানাডায় পাড়ি জমাতে। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সিঙ্গাপুরের ‘প্রোচায়নিজ’ শিক্ষাপদ্ধতি একজন ‘নন-চায়নিজ’ নাগরিকের পূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার জন্য একটি বড় অন্তরায়। প্রফেসর লুকের এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় সিআরপিপির কার্যক্রমে আসে নানা পরিবর্তন। আমারও উৎসাহে ভাটা পড়ে। তাই চুক্তির মেয়াদ পূরণ হওয়ার আগেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দিই হিউম্যান রিসোর্স বরাবর। তারপর একদিন পরিবারসহ রওনা হই টরন্টো অভিমুখে।
পিএইচডি করেছেন কানাডার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটি থেকে, কিন্তু স্থায়ী হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এডুকেশনাল পলিসির একজন বিশ্বখ্যাত অথরিটি হিসেবে বিবেচিত প্রফেসর লুক সিঙ্গাপুর সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে এই রিসার্চ সেন্টারের সর্বোচ্চ পদটি গ্রহণ করেন।
ঠিকানা ধরে একসময় মাইক্রোবাসটা এসে থামে আমার সহপাঠী বন্ধুটির বাসার সামনে। আমার বন্ধুর গাড়ি তখনো এসে পৌঁছায়নি। ভাড়া মিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি তাদের অপেক্ষায়। এভাবেই সূচনা হয় টরন্টোয় আমার নতুন জীবন। সমাপ্ত